ব্লগের আমি ব্লগের তুমি ব্লগ দিয়ে যায় চেনা
১৭
"আমার তো ঘর নেই, আছে ঘরের দিকে যাওয়া..."
প্লেনের একটানা গোঁ গোঁ আওয়াজ কী একঘেয়ে ও ক্লান্তিকর! এই যাত্রার যেন আর শেষ নেই। তা হোক, আমার øস্নায়ু সজাগ ও সতেজ, অনুভূতি তীক্ষ্ণè ও একমুখী। একসময় অদৃশ্য পাইলটের কণ্ঠস্বর শোনা যায় - আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের ঘোষণা। এতোকাল পরে দেশে ফেরার উত্তেজনা ও উদ্বেগ আমার স্নায়ুসমূহ আর সহ্য করতে পারে না। কম্পমান আমার উদ্বেল হৃদয়, আমার সমস্ত শরীর।
এই রৌদ্রোজ্জ্বল দুপুরের আকাশে ভাসমান মেঘের ভেতর থেকে বিমান ক্রমশ নামতে থাকলে চোখ ভরে আমার দেশের ঘন সবুজ গাছপালা দেখি। এতো ওপর থেকে ঘনবদ্ধ সবুজকে বিশাল ও মনোহর এক অরণ্যের বিস্তার বলে ভ্রম হয়। এখনো বাড়িঘর দৃশ্যমান নয়। একটি নদী চোখে পড়ে, কোন নদী এটি? জানার প্রয়োজন নেই। এই আমার দেশ, এই প্রত্যাবর্তনের মুহূর্তটির জন্যে কতোকাল অপেক্ষা করে আছি! মনে মনে দেখি, বিমানবন্দরে মুনিয়া আমার অপেক্ষায়।
কিন্তু তা কী করে সম্ভব? তবু ভাবতে দোষ নেই। অকস্মাৎ অনুভব করি, মুনিয়ার মুখচ্ছবি আমার স্মরণে নেই। কিছুতেই মনে পড়ে না তার চোখগুলি কেমন, কীরকম তার ভুরুর ভঙ্গিমা। হাতের আঙুলগুলো তার কেমন ছিলো? চিবুক? কোঁকড়া চুল ছিলো কী তার? মাঝখানে সিঁথি, নাকি একপাশে? মনে পড়ে না, স্মরণে আসে না কিছুই। কী আশ্চর্য, যে নারীকে আমার এতো কাছের মানুষ ভেবে এসেছি, তার মুখ মনে নেই, তাই হয়? আবার ভাবি, মনে থাকলেই বা কী হতো? যে মুনিয়াকে আমি সেই কোন সুদূরকালে দেখেছি, এখন কী আর সে সেই মুনিয়া আছে? থাকে না, কেউ তেমন থাকতে পারে না।
আমিও কি আজ আর সেই আমি? ভেতরে ভেতরে মানুষ অপরিবর্তনীয় থাকতে পারে, বহিরঙ্গে থাকে না। আমার মাথাভরা ঝাঁকড়া চুল মুনিয়ার প্রিয় ছিলো, আপনা থেকে বাড়তে দেওয়া যে চুলগুলোকে আমার ব্যক্তিত্বের খুব দরকারি অংশ ভাবতাম এককালে এবং এক সৈনিকের আদেশে যে চুল হারিয়ে তীব্র অপমানের জ্বালায় দগ্ধ হয়েছিলাম একদা - সেই চুলের কতোটুকু আর অবশিষ্ট আছে আজ? আসমান ছেলেটির ঘোষণা মানলে আমি বুড়ো হয়ে গেছি, আমার কতো চুল পাকা! তবু জানি, অপেক্ষমান মুনিয়াকে দেখামাত্র চিনে নিতে পারবো। মুনিয়া কি চিনবে আমাকে? কে জানে! ভাবি, এতো বছর পরে আমার দেশেরই বা কতোটুকু আমার চেনা? ঢাকা শহরকে কি চিনতে পারবো? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? কলা ভবন? অথবা সূর্যসেন হল? সুরুজ মিয়া কি এখনো আছে? ইন্টারনেটে ঢাকার কাগজ পড়ে জানি, এই শহরে নতুন অনেক রাস্তা হয়েছে, মানুষ বেড়েছে কয়েকগুণ, রাস্তায় সারিবদ্ধ গাড়ির বাহার, ঝকঝকে আলো ঝলমল শপিং সেন্টার, নতুন নতুন উঁচু সব ইমারতের সারি। হয়তো মনে হবে, কোথায় এসেছি আমি! অবতরণের চূড়ান্ত মুহূর্তে আমার হৃৎস্পন্দন অদম্য হয়ে ওঠে, বুকের ভেতরের হাতুড়ির আওয়াজ প্লেনের শব্দকেও চাপা দিয়ে দিচ্ছে, সহযাত্রীরা সবাই তা শুনতে পাচ্ছে বলে মনে হয়। অবতরণ সম্পন্ন হলে প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি।
আমি দেশ ছাড়ার সময় বিমানবন্দর ছিলো তেজগাঁয়, এটি আগে দেখিনি। বাইরে এসে মুনিয়াকে না দেখে আশ্চর্য হই না। জানতামই তো, সে থাকবে না। আর কোনো চেনামুখও নেই। থাকার কথা নয়।
হঠাৎ দেখি চন্দ্রালোকিত হেমন্তরাতে পাঁচজন সশস্ত্র যুবক নদীর ঘাটে বাঁধা নৌকার দিকে হাঁটে। নৌকায় মুনিয়া আগেই উঠে বসে আছে। কোথা থেকে এলো সে? কিন্তু এতো চাঁদের আলোতেও তার মুখ স্পষ্ট দেখা যায় না। তেঁতুলতলার বিশাল গাছটি অবিকল আছে দেখি, মৃদু হাওয়ায় তার ঝিরঝিরে পাতাগুলি নড়ে। আমার পিতা কুয়াশাময় শীতসকালে প্রাতঃভ্রমণে যাচ্ছেন - অবিকল আগের ছবি, এতো বছরেও কিছুমাত্র মলিনতা নেই।
মনে হয়, আমার বালক বয়সটি যেন অকস্মাৎ ফিরে এলো। শীর্ণ নলামারার পানির ওপরে কুয়াশা এখনো ঘুরপাক খায়, নদীর ওপার কুয়াশায় কুয়াশা। পি. টি. স্কুলের ভাঙা বেঞ্চে বসা আমরা, ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে সুফী স্যার। প্রিয় সাইকেলটি নিয়ে সাতমাথার মোড় পেরিয়ে যাচ্ছি...
ঘুম ভেঙে যায়, তবু অসম্ভব স্বপ্নের ঘোরে বিছানায় পড়ে থাকি। একটিমাত্র মহার্ঘ্য জীবন কতো বিচিত্র আলোছায়ায় মিলেমিশে যাপিত হয়।
যা পেছনে ফেলে এসেছি, যা আর ফিরে পাওয়া কোনোদিন হবে না - তাই দিয়ে স্বপ্নের বুনন চলতে থাকে। পরবাসী নিঃসঙ্গ আমি, বাকি জীবনটিও এইভাবে অতিবাহিত হবে। একসময় চলে যাবো এই জীবন ছেড়ে। পরবাসে কারো মৃত্যু ঘটলে তার সম্প্রদায়ের মানুষেরা মৃতের নশ্বর দেহটি দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে থাকে। বেশিরভাগ পরবাসী মানুষ স্বদেশে সমাহিত হওয়ার বাসনা পোষণ ও প্রকাশ করে, মৃত্যুর পরে হয়তো পারিবারিক সমাধিস্থলে বিগত প্রিয়জনদের সাহচর্যে নিজেকে স্থাপিত করতে চায়।
আমিও কি তাই চাইবো? অর্থহীন মনে হয় - কী হবে, নিশ্চল অনুভবহীন একটি শরীরই শুধু আমার দেশের মাটিতে পৌঁছবে, আমি তখন আর আমি নই - নশ্বর ও পচনশীল প্রাণ-পরিত্যক্ত একটি মনুষ্যদেহমাত্র। আর কিছু নয়। কী কানাকড়ি মূল্য আছে তার? একেক সময় মনে হয়, জীবনটি হয়তো অন্যরকম হতে পারতো! হলে তা কী রকম হতো? কে বলবে!
There is no air for that mouth
He can’t live without a land,
And then he falls to his knees
Not onto native soil, but into death.
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।