আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চুপকথা : উপন্যাসের খসড়া (পর্ব ১৪)

ব্লগের আমি ব্লগের তুমি ব্লগ দিয়ে যায় চেনা

৯.২ দিন যায়। উদাসীন সব দিন। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছে আলগাভাবে কিছু খোঁজখবর করি, দেশের বাইরে কোথায় যাবো, যেতে হলে কী করতে হবে। তারাই সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত দেয়, আমেরিকা চলে যা। আমেরিকা নিয়ে আর অনেকের মতো আমার কোনো বিশেষ অনুরাগ বা আকর্ষণ নেই।

যুদ্ধের সময় তারা আমাদের সরাসরি বিরোধিতা করেছে। ততোদিনে আবার কানাঘুষা শুরু হয়েছে যে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ডে আমেরিকার হাত ছিলো। বহু বছর ধরে তারা অনেক দেশে এই কাণ্ড করেছে। তাতে কিছু বিরাগ জন্মাতেই পারে, কিন্তু নিজের ইচ্ছেমতো জীবন যাপন করার জন্যে আমেরিকা সবচেয়ে উপযুক্ত দেশ বলে বন্ধুরা প্রবলভাবে একমত। আমার তখন কিছুতেই কিছু এসে যায় না।

আমেরিকা না হয়ে সাইবেরিয়া হলেও আমার আপত্তি ছিলো না। রাতের পর রাত কারফিউ-এ দমবন্ধ অবস্থা, সেই মধ্য-অগাস্টে শুরু হয়েছে, তা আর কোনোদিন উঠে যাবে বলে মনেও হচ্ছে না। একুশ বছর বয়সী এই আমার মধ্যরাতের পরও বাইরে থাকার ইচ্ছে ও প্রয়োজন থাকতেই পারে। তা যদি না-ও থাকে, তবু ইচ্ছে হলেও কারফিউ-এর বেড়া আমাকে ঘর থেকে বাইরে যেতে দেবে না - ভাবলে দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। রাজনীতি বলে প্রকাশ্যে কিছু নেই, থাকলেও তার সন্ধান আমার জানা নেই, শাসকদের বিরোধী রাজনীতিকরা আত্মগোপনে অথবা জেলখানায়।

কোথাও কোনো ভরসার আলো দৃশ্যমান নয়। মাঝে মধ্যেই পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানের গুজব শোনা যায়। নভেম্বরের শুরুতে সত্যি সত্যি তা ঘটেও - তিন-চার দিনের ব্যবধানে দুটি, যে সময় দেশটির চালক কারা তা-ও কারো জানার উপায় ছিলো না। গুজবের ডালপালা ছড়ায়। একসময় জয়ী এবং পরাজিত পক্ষের পরিচয় জানা যায় - প্রাথমিক জয় খালেদ মোশাররফের, তারপর কর্নেল তাহেরের সহযোগিতায় জিয়া জয়ী, ফলে খালেদ মোশাররফ পরাজিত ও নিহত।

পুরাণকাহিনীতে বর্ণিত ভ্রাতৃসংহারের নতুন রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি। এই গোলযোগের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় চার রাজনীতিককে জেলখানায় খুন করা হয়। শেখ মুজিবের হত্যাকারী বলে যারা নিজেদের বীর ঘোষণা করেছিলো, তাদের নিরাপদে দেশের বাইরে পাচার করে দেওয়া হয়। ষড়যন্ত্র, অভ্যুত্থান, গুজব, আতংক, উপর্যুপরি হত্যাকাণ্ড - এইসব উপাদান সহযোগে মানুষের জন্যে যা প্রস্তুত হয় তা এক ধরনের ক্লান্তি, নিরাসক্তি ও হতাশা। এর শেষ কোথায়, কেউ জানে না।

অনিশ্চয়তা ঘনীভূত হয়ে ওঠে। ক্রমশই প্রতীয়মান হতে থাকে, এ দেশটি চলবে গায়ের জোরে। বন্দুকধারীরা সহজে হটবে না। হত্যাকারীরা পুরস্কৃত হবে। কারাগারের নিরাপত্তার মধ্যেও কোনো নিরাপত্তা আসলে রাখা হবে না।

ধিক্কার জন্মায় - এই দেশ আমার নয়, এই ব্যবস্থার জন্যে আমি যুদ্ধ করিনি। আমার সিদ্ধান্ত তখন আরো সহজ হয়ে যায়। নভেম্বরে এইসব ঘটনার আগেই আমেরিকার ভিসা হয়ে গিয়েছিলো, ডিসেম্বরে আমার দেশ ছেড়ে আসা। পারিবারিক পিছুটান সবার মতো আমারও কিছু ছিলো, তবু কেউ কোনো আপত্তি জানায়নি। এক মুনিয়াকে নিয়ে কিছু সংশয় ছিলো, সে কীভাবে নেবে।

এই সময়ে আমার চলে যাওয়ার অর্থ তার সঙ্গে চিরস্থায়ী বিচ্ছেদ, তা আমার জানা ছিলো। মুনিয়াও জানতো, তবু সে খুব সহজভাবে বিদায় দিয়েছিলো। তাকে সব কথা খুলে বলা হয়নি, আমার আত্মসম্মানবোধ তা অনুমোদন করেনি। এ আমার এমনই ব্যক্তিগত অপমান, ব্যর্থতা ও পরাজয়, সে কথা প্রেমিকাকেও বলা সম্ভব হয় না। মুনিয়া কী বোঝে, সে-ই জানে।

বলেছিলো, তোমার ওপর আমার এইটুকু বিশ্বাস আছে যে, গভীর কোনো কারণ না থাকলে তুমি আমাদের সম্পর্ককে উপেক্ষা করে এরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারতে না। আমাকে কিছু ব্যাখ্যা করে বলার দরকার নেই। তোমাকে ভালোবাসি বলে স্বার্থপরের মতো তোমার পথ আগলে ধরবো কেন? বরং ওই ভালোবাসার অধিকারেই আমি তোমাকে একটি প্রশ্নও করবো না। বিদায়কালে এয়ারপোর্টে আমার হাতে একটি খাম গুঁজে দেয় মুনিয়া। বলে, এখন পড়ার দরকার নেই।

আসলে বিদায় জানাতে আসা সবার চোখের সামনে তা সম্ভবও ছিলো না। বিমান আকাশে উড্ডীন হলে খামটি খুলি। একটি ছোটো চিরকুট। মুনিয়া লিখেছে, কোনোদিন আমাদের দেখা আর হবে কিনা, জানি না। তবু যতোদূরেই যাও, আমি তোমার খুব কাছাকাছি আছি জেনো।

বিচ্ছেদেই তুমি আমার চিরদিনের হয়ে গেলে। বিমান ক্রমশ উঁচুতে ওঠে। মনে হয়, এই উচ্চতা ও ব্যবধান থেকে আমার দেশটিকে কোনোদিন দেখা হয়নি। আমার জন্মভূমির বৃক্ষলতা, মানুষের বসতি, জলাশয় আর ওপরে নীল আকাশ - সব ছেড়ে এখন আমার অনিশ্চিত যাত্রা। যুদ্ধের দিনে কখনো স্বপ্নেও কি ভেবেছি, এই দেশটি ত্যাগ করে আমাকে চলে যেতে হবে? একসময় চারপাশে শুধু সাদা মেঘের ওড়াউড়ি ছাড়া আর কিছু দেখা যায় না, মনে হয় মাটির পৃথিবীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগই আর নেই।

টের পাই, প্রতি মিনিটে এখন আমার আর মুনিয়ার মধ্যে যোজন যোজন শূন্যতার দূরত্ব রচিত হয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ দূর, আরো দূর। এখনো বিমান আমার দেশের সীমানায়, কিছুক্ষণ পরে চলে যাবো অন্য কোনো সীমানায়। হঠাৎ মনে হয়, আমি হয়তো ভুল করে এই বিমানে উঠে বসেছি। আমার কোথাও যাওয়ার কথা ছিলো না।

এখন ভাবলে আশ্চর্য বোধ হয়, মুনিয়ার সঙ্গে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তটি কী সহজে নিয়েছিলাম। জীবনে প্রথমবারের মতো একটি প্রেমের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছি, আভাসে-ইঙ্গিতে ভবিষ্যতের কথাও উল্লিখিত হতে শুরু করেছিলো, দু’জনেই হয়তো সম্পূর্ণ নিমজ্জনের জন্যে তৈরিও ছিলাম। সেই ভালোবাসার জনকে ছেড়ে দিতে কষ্ট হওয়ার কথা। হয়নি তা নয়, কিন্তু তা অনেক পরে, যখন আর ফিরে যাওয়া নেই। ততোদিনে মুনিয়াকে আমি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছি।

আবার ভাবি, সেই সময়ে হয়তো আমি স্বাভাবিক মানুষ ছিলাম না। কেউ কি ছিলো সেদিনের বাংলাদেশে? থাকা সম্ভব ছিলো না। কী অসহ্য উদ্ভ্রান্ত ও বিভ্রান্তিময় এক সময় - ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক। সজ্ঞানে অথবা অজ্ঞাতসারে সেদিন একই সঙ্গে দুটি ভালোবাসা থেকে আমি দূরে চলে গিয়েছি। আমার দেশটির জন্যেও আমার ভালোবাসা কিছু কম নয়।

এই আজও, প্রায় তিরিশ বছর পরে, দুটি ভালোবাসাই আমার জীবনে সমান জাগ্রত। এও জানি, দূরবর্তী থেকে ভালোবেসে যাওয়াই আমার নিয়তি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.