ব্লগের আমি ব্লগের তুমি ব্লগ দিয়ে যায় চেনা
৬
মুনির ভাই একাত্তরের এক দুপুরে ঢাকা শহরে জোনাকি সিনেমার পাশের একটি ব্যাংক অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ করতেও টাকার প্রয়োজন হয়। ঢাকা শহরে ঢুকে পড়া গেরিলাদের বাসস্থানের জন্যে ভাবতে হয়নি - নিজেদের বাড়িঘর ছিলোই - আরো অনেক ঘরের দরজা তাদের জন্যে উন্মুক্ত, আহার্যও সমস্যা নয়। কিন্তু তারপরেও টাকার দরকার যাতায়াত, যোগাযোগ, সরঞ্জাম সংগ্রহের জন্যে। সুতরাং পাকিস্তানীদের ব্যাংক লুট করার সিদ্ধান্ত।
এই ঘটনা ঢাকা শহরের মানুষকে সেদিন অনেক সাহস দিয়েছিলো, অপদস্থ বোধ করেছিলো দখলদাররা।
প্রকাশ্য দিবালোকে এই দুঃসাহসী অভিযানটিতে মুনির ভাইয়ের সঙ্গী আসাদ, রাজী, ফিরোজ আর ফেরদৌস। নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয় অভিযান। স্বাধীনতার পর একশো মুক্তিযোদ্ধার বৃত্তান্ত নিয়ে একটি বই বেরিয়েছিলো, তাতে মুনির ভাই অন্তর্ভুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার অগ্রবর্তী।
পরিচয় ছিলো তখন, ঘনিষ্ঠতা হয়নি। বছর চারেক আগে তিনি এই শহরে কিছুদিন বসবাস করেছিলেন। একদিন আমার সঙ্গে যাচ্ছেন, তাঁর চুল কাটানো দরকার।
আজকের দিনটা আপনার মনে আছে, মুনির ভাই?
প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধাকে কিছু বিভ্রান্ত দেখায়। জিজ্ঞেস করেন, ক্যান কী দিন আজ?
আজ ডিসেম্বরের ষোলো তারিখ।
ক্যামনে ভুললেন?
চুপ করে থাকেন ভূতপূর্ব মুক্তিযোদ্ধা, বজ্রাহতের মতো স্থির। আমার, হয়তো তাঁরও, তখন স্মরণে আসে, প্রায় তিরিশ বছর আগে এইরকম একটি দিনে চুল কাটানোর কথা আমাদের মনেও আসেনি। আমাদের তখন কাঁধ পর্যন্ত নামানো চুল, দীর্ঘদিন না-কামানো গালে দাড়ি-গোঁফের ফাঁকে দুই চোখে ক্লান্তি, অথচ মুখে যুদ্ধজয়ের উল্লাসময় দীপ্তি। সেই উৎসবে শ্রান্তি তখন অবান্তর। হাতের অস্ত্রটি আকাশের দিকে তুলে ধরা, ভঙ্গিটি যেন এই কথা রাষ্ট্র করে দিতে চায়, আমরা অসাধ্য সাধন করেছি, আকাশও আর আজ আমাদের কাছে অজেয় ও সুদূর নয়।
সেদিন আমাদের পোশাক মলিন ও অবিন্যস্ত, কাদামাটিতে মাখামাখি জুতা, কারো কারো খালি পা, নখ কাটা হয় না কতোদিন, অস্নাত এবং নির্ঘুম, শেষ আহার কখন হয়েছে মনেও নেই। বিজয়ীর যৌবন এইসব তুচ্ছ বিষয়ে মনোযোগ দেওয়ার সময় পায় না, বরং তাকে অপ্রয়োজনীয় ও বাহুল্য জ্ঞান করে।
মুনির ভাই আমার দিকে তাকান না, সামনে সরাসরি রাস্তায় তাঁর চোখ নিবদ্ধ। কয়েক মুহূর্ত পরে তাঁর গালে অশ্রু গড়িয়ে নামতে দেখি। সারাপথ দু’জনে আর কোনো কথা বলি না।
পরে একদিন মুনির ভাই বলেছিলেন, আমার ক্যান জানি আর কিছুই মনে পড়ে না। ভুল হয়া যায়, আগরতলা যাওয়ার সময় এক রিকশাওয়ালা তার বাড়িতে একরাত আমারে লুকায়া রাখছিলো। তাদের একখান মোটে মুরগি, ডিম বেচলে ঘরে কিছু পয়সা আসে। আমি জানতে পারি নাই, তারা সেই মুরগি জবাই কইরা আমারে ভাত খাইতে দিছিলো। রিকশাওয়ালার বউ কয়, মুক্তিগো লাইগা কলিজাডা খুইলা দিতে পারি।
আপনে চিন্তা কইরেন না ভাইজান, দ্যাশ স্বাধীন হইলে ম্যালা মুরগি হইবো আমার!
দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে যান মুনির ভাই। আমি বলি না, বলার মুখ নেই, ওই রিকশাওয়ালার ঘরে ম্যালা মুরগি হয়নি, আমরা জানি। স্বপ্ন দেখেছিলাম, আমরা পারবো। সাম্যবাদী একটি রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থা আমরা চেয়েছিলাম। সেখানে মানুষের ধর্মপরিচয় অপ্রাসঙ্গিক - ধর্ম হবে মানুষের ব্যক্তিগত চর্চার বিষয়, রাষ্ট্র ও ধর্ম পৃথক থাকবে, যেমন থাকে সকল আধুনিক ও সভ্য রাষ্ট্রে।
রাষ্ট্রের পরিচালকরা সকল মানুষের কল্যাণ করবেন, মানুষকে নির্ভয়ে কথা বলার অধিকার দেবেন, আহার-পরিধেয়-আশ্রয়-বিদ্যাচর্চা-স্বাস্থ্যের সংস্থান নিশ্চিত করবেন।
আমরা পারিনি, করা হয়নি কিছুই, আমরা দেশ ছেড়ে এসেছি। এমনও মনে হতে পারে, দেশই আমাদের ছেড়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রের পালকরা আজ আর আমাদের ভাষায় কথা বলেন না, সে ভাষা তাঁরা বিস্মৃত হতে প্রবলভাবে ইচ্ছুক বলে মনে হয়।
দেশান্তরী, তবু দেশটি আমার বড়ো ভালোবাসার ধন।
আমার দেশের সামান্যতম কোনো সাফল্যে আমার গর্ব হয়, চোখ আর্দ্র হয়। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে নবাগত ও অখ্যাত বাংলাদেশ দুর্দান্ত পাকিস্তানীদের হারিয়ে দিয়েছে জেনে একলা ঘরে আমি প্রাণভরে কাঁদি। একুশে ফ্রেব্রুয়ারিকে জাতিসঙ্ঘ সারা পৃথিবীর মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দিলে অহংকারে মাটিতে আমার পা পড়ে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।