ব্লগের আমি ব্লগের তুমি ব্লগ দিয়ে যায় চেনা
১০.১
প্রথমে স্বপ্ন বলে বোধ হয় না, তবু হয়তো স্বপ্নই। ঘুম ছিলো না, শুধু শুধু চোখ বুজে শুয়ে থাকা। রাত প্রায় দেড়টা, কাল অফিসে পৌঁছতে হবে একটু সকাল সকাল, সাপ্তাহিক টীম মিটিং। অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করি। দিনভর কাজের শেষে ঘরে ফিরেছি সাড়ে আটটার দিকে।
রান্নাবান্না কিছু করা নেই, বাইরে খেয়ে এসেছি। রান্না করতে ইচ্ছে করে না, করিও না। বেশিরভাগ বাইরে খাওয়া হয়। তা-ও একঘেয়ে হয়ে যায় একসময়। কিছু করার নেই, একা মানুষের জীবন এরকমই হওয়ার কথা।
নির্ঘুম বিছানায় ছটফট করা এক ধরনের শাস্তিই। বাল্যকালে শিখেছিলাম অন্ধকার ঘরে চোখ বুজে কল্পনায় মেষ গণনা করতে থাকলে একসময় স্নায়ু অবসন্ন হয়ে পড়বে, তখন ঘুমের আর না এসে উপায় থাকবে না। আমার মেষ গণনার কৌশল ব্যর্থ হয়। একশো, নিরানব্বই, আটানব্বই করে উল্টোদিকে গুনে শূন্য পর্যন্ত আসাও হয়ে যায় বার তিনেক। একসময় মনে হয় একটু তন্দ্রামতো হয়েছিলো, তখনই দেয়ালের লেখাটি দেখি।
চোখের সামনে নেই, তবু পরিষ্কার পড়া যায়। কালো বড়ো হরফের চিকা। একাত্তরের যুদ্ধাস্ত্রগুলোকে আরেকবারের জন্যে গর্জে উঠতে বলা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলাভবনের দেওয়ালে উৎকীর্ণ ছিলো। তিয়াত্তর-চুয়াত্তরে দেখা দেয়ালের লিখনটি তিরিশ বছর পরে ফিরে আসে।
তন্দ্রা ছুটে গেলে প্রথমে ভাবি বিছানায় উঠে বসি। স্বপ্নটি নিয়ে একটু ভাবা যেতে পারে। উঠি না। পাশ ফিরে চোখ বুজি, স্বপ্ন যদি ফিরে আসে! উঠে বসার চেয়ে শুয়ে থাকা অনেক আরামের। শরীর এখন কেবল আয়েশ খোঁজে।
একটা সময় ছিলো, তখন দিনে চার-পাঁচ ঘণ্টার বেশি ঘুমালে মনে হতো কতোটা সময়ের অপচয় হয়ে গেলো। শিশুরা যেমন জোর করে জেগে থাকতে চায় - ঘুমিয়ে পড়লেই দারুণ কিছু একটা ঘটে যাবে, দেখা হবে না! একসময় ভাবতাম, দিনে আট ঘণ্টা ঘুমালে ষাট বছরের আয়ুতে শুধু ঘুমিয়ে কাটবে বিশটি বছর। কী অপচয়! কোনো মানে হয়! আজকাল আর সেসব হিসেব মনে পড়ে না।
আমার দিন শুরু হয় কাকডাকা ভোরে। এ দেশে এসে অবধি এই ঊনত্রিশ বছরে কাক দেখিনি একটিও, শুধু দেশে ফোন করলে কখনো ব্যাকগ্রাউন্ডে কাকের ডাক শোনা হয়।
তবু আমার ভোর এখনো কাকডাকা ভোর। বিছানা ছেড়ে এক কাপ ব্ল্যাক কফি খেয়ে ঘুম তাড়ানো। হাতমুখ ধুয়ে বাইরে হাঁটতে যাওয়া, আধঘণ্টা হাঁটা। এইসময়ে প্রতিদিন নির্ভুলভাবে বাবাকে ভাবি, জীবনে আরো অনেককিছুর মতো প্রাতঃভ্রমণের এই অভ্যাসটি আমার মধ্যে তিনি কীভাবে যেন সঞ্চারিত করে দিয়ে গেছেন। অথচ তাঁর জীবনকালে আমি কখনো ভোরে হাঁটতে যাইনি।
ফিরে এসে গোসল সেরে অফিসের জন্যে তৈরি হওয়া। অফিসের সময় এমনিতে আটটা-পাঁচটা হলেও কাজের ধরণটি এমন যে কখনো তা ঘড়ি ধরে চলে না। প্রায় প্রতিদিনই গড়ে বাড়তি ঘণ্টা দুয়েক থাকতে হয়, তেমন হলে আরো বেশি, এমনকি রাতভর। ফলে, কিছু দেরি করে অফিসে যাওয়ার স্বাধীনতাটি নেওয়া চলে। আমি সচরাচর ন’টার দিকে পৌঁছাই।
কায়িক পরিশ্রম কিছু নেই, তবু একটানা বসে দীর্ঘ সময় কাজ করলে তারও ক্লান্তি আছে।
জানা ছিলো, বয়স হলে ঘুম কমে যায়। কিন্তু ঠিক কতো বছরে সেই বয়সে পৌঁছানো যায়? পঞ্চাশ? পঞ্চান্ন? ষাট? বেশিদিন আগের কথা নয়, কারো বয়স বেয়াল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বা পঞ্চাশ শুনলে মনে হতো, লোকটা তো বুড়ো! তখনো মনে আসেনি আমি ওই বয়সে গেলে অন্য কেউ আমাকে বুড়ো ভাববে। জিনিস একই, শুধু জায়গা বদলে গেছে। একসময়ের দর্শক পঞ্চাশে পড়ে এখন নিজেই দ্রষ্টব্য।
আজকাল ঘুমিয়ে মন ভরে না, জেগে উঠলে চোখের পাতা ভারী, সারা শরীরে আলস্য লেগে থাকে আঠার মতো। তবু ঘুম কি আর আসে! এখনও চোখ বুজে শুয়ে থাকাই সার হয়, ঘুম আর ফিরে আসে না, স্বপ্নও না।
পরশু আসিফের ছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান ছিলো। নিজের সংসারী হওয়া হয়নি, কিন্তু বন্ধুবান্ধবের বাচ্চারা কীভাবে যেন খুব দ্রুত আমাকে তাদের দলের একজন বলে গণ্য করে নেয়। ঠাট্টা করে বাচ্চাদের বাবা-মাকে বলি, ওরা ভালো মানুষ ঠিকই চেনে!
আসিফের ছেলেটি নিজে ফোন করেছিলো, কাকু আমার জন্মদিন।
চিনতে ভুল হয়নি, তবু ওর নামটি আমার ভারি পছন্দের। বিশেষ করে ওর নিজের মুখে খুব মিষ্টি শোনায়। পুট পুট করে সুন্দর উচ্চারণে বাংলা বলে। অথচ জানা কথা, স্কুলে যেতে শুরু করলে এই ছেলে বাংলা বলা একেবারে বন্ধ করে দেবে। বয়ঃসন্ধির আগেই না-বলায় এমন অভ্যস্ত হয়ে যাবে যে কেউ বাংলায় কথা বলতে গেলে হ্যাঁ হুঁ না এইসব বলে পালাতে চেষ্টা করবে।
বড়োজোর মার্কিনি সুরে কিছু বাংলা বুলি উগরে দেবে। এ দেশে সব বাঙালির ঘরেই অনেক বছর ধরে দেখছি এরকম।
জিজ্ঞেস করি, আমিটা কে?
আমি আসমান, তুমি চিনতে পারোনি কাকু?
আসিফ আর তার বউ রুম্মানের নাম মিলিয়ে ছেলের নাম আসমান। বলি, আমি বাবা জমিনের মানুষ, আসমানের খবর কী করে পাই? তা তোর জন্মদিনটা কবে রে বাপ?
কাল। তুমি না এলে কিন্তু আমি কেক কাটবো না।
মনে থাকে যেন।
তা থাকবে। তুই কতো বছরের বুড়ো হবি এবার?
চার। আমি কিন্তু বুড়ো না, বুড়ো তুমি।
আমি বুড়ো হলে তোর বন্ধু হলাম কী করে?
তোমার মাথায় কতো পাকা চুল।
চুল পাকলে কি বুড়ো হয় রে, বোকা বুড়ো...
ফোন রেখে মনে মনে ভাবি, বুড়োটা তাহলে হয় কীভাবে? এক দেশে এক লোক ছিলো। লোকটি কম বয়সে তার দেশের স্বাধীনতার জন্যে যুদ্ধ করেছিলো। অনেক দুঃখকষ্টের ভেতর দিয়ে দেশ স্বাধীন হলো। তার দেশের দখল নিয়ে বসা শত্রুরা পরাজিত হয়ে ফিরে গেলো। তার দেশের কিছু মানুষ সেই বিদেশীদের পক্ষ নিয়ে ধর্মের নামে অনেক অপকর্ম করেছিলো, দেশ স্বাধীন হলে তারা লুকিয়ে পড়লো।
লোকটা, সেই সময়ের তরুণ মুক্তিযোদ্ধা, আরো অনেকের মতো স্বপ্ন দেখেছিলো অতি উজ্জ্বল একটি ভবিষ্যতের। সত্যি হয়নি তার কিছুই। তার স্বপ্নের রং ক্রমে ফ্যাকাশে হতে থাকে, আসে অনিশ্চয়তা, নিষ্ফল ক্রোধ ও হতাশা। লুকিয়ে থাকা পরাজিত মানুষগুলি ধীরে ধীরে মুখ বাড়ায়, সুযোগমতো বেরিয়ে আসতে থাকে, সামাজিক প্রতিষ্ঠাও পেয়ে যায়। লোকটা বুড়ো হয়ে যায়, যখন সে আর প্রকাশ্যে বলার সামর্থ্য ধরে না যে সে স্বাধীনতাযুদ্ধের এক যোদ্ধা ছিলো, একসময়ে জয়ী হয়েও আজ পরাজিতের মতো নতমুখ হয়ে থাকতে হয় তাকে।
পরাজিতরা আস্ফালনের অধিকার ও ক্ষমতা অর্জন করে ফেলে আর যোদ্ধাকে পলাতক পরবাসী হয়ে যেতে হয়।
যুদ্ধের দিনে আমাদের দলনেতা ছিলেন কবির ভাই, তার বউ শাহানা এখন কবির ভাইকে ডাকে বুড়া মুক্তিযোদ্ধা বলে। একদিন শাহানা ফোনে আমাকে বলে, কীসের মুক্তিযোদ্ধা রে তোরা? জয় বাংলা কইয়া যুদ্ধ করলি, দেশ স্বাধীন হইলে পাছা উবুত কইরা ঘুমাইয়া থাকলি আর সব রাজাকারগুলান পাকিস্তান জিন্দাবাদ কইয়া তগো ... মাইরা দিয়া গেলো গা ...!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।