আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চুপকথা : উপন্যাসের খসড়া (পর্ব ৫)

ব্লগের আমি ব্লগের তুমি ব্লগ দিয়ে যায় চেনা

৩.২ জালাল ভাই হঠাৎ কী মনে করে শেলফ থেকে জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলি বইটি বের করে তাঁর বিশেষ পছন্দের অংশগুলি পড়তে শুরু করেন। জাহানারা ইমামের পুত্র রুমী যুদ্ধযাত্রার জন্যে প্রস্তুত : "...রুমী বলল, ‘তোমার জন্মদিনে একটি সুখবর দিই, আম্মা। ’ সে একটু থামল, আমি সাগ্রহে তাকিয়ে রইলাম, ‘আমার যাওয়া ঠিক হয়ে গেছে। ...’ "...লোহার সাঁড়াশী দিয়ে কেউ যেন আমার পাঁজরের সবগুলো হাড় চেপে ধরেছে। অন্ধকারে, চোখের বাইরে, নিঃশর্তভাবে ছেড়ে দিতে হবে।

জানতে চাওয়াও চলবে না - কোন পথে যাবে, কাদের সঙ্গে যাবে। রুমী এখন তার নিজের জীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে, তার একান্ত নিজস্ব ভুবন, সেখানে তার জন্মদাত্রীরও প্রবেশাধিকার নেই। "...রুমী আগামীকাল রওনা হবে। "...রাতে শোবার সময় রুমী বলল, ‘আম্মা আজকে একটু বেশী সময় মাথা বিলি করে দিতে হবে কিন্তু। ’ "জামী বলল, ‘মা, আজ আর আমার মাথা বিলি করার দরকার নেই।

ওই সময়টাও তুমি ভাইয়াকেই দিয়ে দাও। ’ "ছোট বয়স থেকেই ঘুমোবার সময় দু’ভায়ের মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে হয়। মাঝে মাঝে এ নিয়ে দু’ভায়ে ঝগড়াঝাটিও বাধে। রুমী বলে, ‘আম্মা তুমি জামীর কাছে বেশীক্ষণ থাকছ। ’ জামী বলে ‘মা তুমি ভাইয়ার মাথা বেশী সময় বিলি দিচ্ছ।

’ "আমি রুমীর মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলাম, রুমী ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’ গানটার সুর আস্তে আস্তে শিস দিতে লাগল। "...জামীকে পাশে বসিয়ে আমি স্টিয়ারিং হুইল ধরলাম। ড্রাইভারকে গতকালই বলে দেয়া হয়েছে, আজ তাকে লাগবে না। পেছনে শরীফ আর রুমী বসল। শরীফের হাতে খবরের কাগজ।

খুলে পড়ার ভান করছে। "রুমী বলল, ‘সেকেন্ড গেটের সামনে আমি নেমে যাওয়া মাত্র তোমরা চলে যাবে। পেছন ফিরে তাকাবে না। ’ "তাই করলাম। ইগলু আইসক্রীমের দোকানের সামনে গাড়ী থামালাম।

রুমী আধাভর্তি পাতলা এয়ারব্যাগটা কাঁধে ফেলে নেমে সামনের দিকে হেঁটে চলে গেল। যেন একটা কলেজের ছেলে বই খাতা নিয়ে পড়তে যাচ্ছে। আমি হুস করে এগিয়ে যেতে যেতে রিয়ারভিউ-এর আয়নায় চোখ রেখে রুমীকে এক-নজর দেখার চেষ্টা করলাম। দেখতে পেলাম না, সে ফুটপাতের চলমান জনস্রোতের মধ্যে মিশে গেছে। "...মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস আটকে আসে।

মাঝে মাঝে চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। মাঝে মাঝে সব কাজ ফেলে ডুকরে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মাছের মাকে নাকি শোক করতে নেই। চোরের মাকে নাকি ডাগর গলায় কথা বলতে হয়। রুমী যাবার পর উঁচু ভল্যুমে ক্যাসেট বাজানো হয় প্রায় সারাদিনই।

সন্ধ্যে হলেই সারা বাড়ীতে সব ঘরে বাতি জ্বেলে জোরে টিভি ছেড়ে রাখা হয়। অর্থাৎ বাড়ীতে বেশ একটা উৎসব উৎসব পরিবেশ। বেশ গান-বাজনা, হৈ-চৈ কলকোলাহল। আশপাশের কোন বাড়ীর কেউ যেন সন্দেহ না করে যে এ বাড়ীর লোকগুলোর বুক খাঁ খাঁ করছে, ব্যথায় কল্জেয় টান ধরছে। "আকাশের বুকেও অনেক ব্যথা।

তার কিন্তু আমার মত চেপে রাখার দায় নেই। তাই সেও ক’দিন থেকে মাঝে মাঝে অঝোরে ঝরাচ্ছে। না জানি রুমীদের কি কষ্ট হচ্ছে এই বৃষ্টিতে!" পড়তে পড়তে জালাল ভাইয়ের গলা ভারী হয়ে ওঠে, আর পড়া সম্ভব হয় না। চুপ করে সামনের শূন্য দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া দুই পাগলের তখন আর কিছু করার থাকে না। ফোন বাজছে।

জালাল ভাই উঠে গিয়ে ধরেন। ভাবী। দু’একটা কথার পর ফোন আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, সীমা আপনার সঙ্গে কথা বলতে চায়। হালকা গলায় বলি, আমাদের এতিম কইরা ফালায়া রাইখা গেলেন তো নাইয়োরে। কখন আসবেন? নাইয়োর গেলে কি আর এতো তাড়াতাড়ি আসা যায়? আসলে যে জন্যে ফোন করছি, আপনের ভাইরে তো চিনি।

রান্নাবান্না সব করা আছে, তারপরেও হয়তো আপনেরে না খাওয়ায়া বিদায় করবে। বিশ্বাস তো নাই। পরে বলবে, অ, তুমি রানছিলা নাকি? আমি না খাইয়া যাওয়ার বান্দা? ঘরে তো আমার জন্যে কেউ রানতে বসে নাই। ভাবী তাঁর পছন্দের প্রসঙ্গ পেয়ে বলেন, ব্যবস্থা করলেই হয়। এই খাইছে, এখন তাহলে রাখি।

এখনই ভাষণ দিবেন তো! না না, ভাষণ না। সত্যি চিন্তা করা দরকার আপনের। আপনেই বলেন, আমার আর বয়স আছে? এই বয়সে কার মেয়ের সর্বনাশ করি কন, তেমন শত্রু তো কেউ নাই। তারপর দুইদিন পর বিধবা হয়া বাপের ঘাড়ে গিয়া তাকে উঠতে হবে। তা কি ভালো কথা? বিয়া করার কথা বললেই আপনে বুড়া সাজতে চান।

আচ্ছা ভাবী, আমার বুড়া হইতে আর বাকি কি? আজকাল পোলাপানে চুলের মধ্যে খাবলা খাবলা কমলা গোলাপি সবুজ হলুদ সব রং লাগায়া রাখে, বলে হাইলাইট করছে। আরে আমিও তো আমার চুলে ম্যালা সাদা সাদা হাইলাইট কইরা রাখছি। আগে বলতাম আমার চুল কাঁচা-কাঁচা পাকা, এখন সেগুলি সব পাকা-পাকা কাঁচা। ভাবী প্রসঙ্গ পাল্টান, আপনাদের পাগলামি কেমন চলে? ভাবী, মানুষরে কিছু একটা নিয়া থাকতে হয়। আমাদের এই দুই ভাইয়ের আর কী আছে, বলেন? তা জানি।

ভাবী ফোন রেখে দিলে জালাল ভাই খাওয়ার টেবিলে যেতে বলেন। খেতে বসে জিজ্ঞেস করি, দেশে ফেরার কথা কখনো ভাবেন, জালাল ভাই? হ্যাঁ, প্রতিদিন ভাবি। যাইতে চান? চাই, খুবই চাই। এইখানে আরাম-আয়েশ সব আছে, কারো কাছে জমা-খরচের হিসাব না দিলেও চলে। তারপরেও দিনের শেষে মন হয়, এইসব উঞ্ছবৃত্তি ছাড়া আর কিছু না।

এই দেশে আমার দরকারটা কি? দেখেন, খালি আমি একলা না। আমি সামান্য মানুষ, কতো বিদ্বান, প্রতিভাবান বাঙালি পৃথিবীর কতো জায়গায় আছে। তারা দেশটারে কিছু দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, দেশের জন্যে কিছু একটা করার সুযোগ পাইলে এখানে কী আর থাকে? ঠিকই ফিরা যাইতো তারা। বলি, আপনি যাইবেন? জালাল ভাই খাওয়া থামিয়ে বলেন, না। চাইলেও আর কোনোদিন হবে না।

প্রথম প্রথম ভাবতাম এই দেশে আমি থাকতে আসি নাই, সময় হইলে ফিরা যাবো নিজের মাটিতে। কিন্তু ছেলেমেয়েগুলি বড়ো হইতে হইতে আমার গলার জোর কমতে থাকে, মনে হয় এদের বাংলাদেশে নিয়া আমি কী জীবন দিতে পারবো, কী নিরাপত্তা দিতে পারবো? আর নিজেরও বয়স হইতেছে, এই বয়সে দেশে গিয়া নতুনভাবে শুরু করার সাহস পাই না, বুঝতে পারি না আমি কী কাজ নিয়া জীবনধারণ করবো, ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে পারবো। আমরা দুই বুড়াবুড়ি না হয় জানি বাংলাদেশের জীবন কী, কিন্তু ছেলেমেয়েগুলি তো সেই জীবন জানে না, তাতে অভ্যস্ত হয় নাই, তাদের জন্যে খুব কষ্টেরই হবে। তাদের সেই অনিশ্চিত জীবনের মাঝখানে ফেলার কী অধিকার আমার আছে? আমার নিজের কথা ভাবি। আমার ছেলেমেয়ে বা সংসারের দায় নেই, তবু আমার দেশে ফেরা হবে না।

জালাল ভাই এসব নিয়ে কখনো প্রশ্ন করেন না, কৌতূহল প্রকাশ করেন না বলে রক্ষা। আমিও এই বিষয়ে আগে কখনো তাঁকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। জালাল ভাই বলে যান, আর আমার দেশটারে কি এখন আমি আর চিনতে পারবো? যা শুনতে পাই তাতে মনে হয় এই দেশ তো আমরা চাই নাই। আমি জানি দেশ নিয়া যা ভাবি, যেসবে বিশ্বাস করি - সেসব বিষয়ে মুখ বন্ধ না রাখতে পারলে অসুবিধা হইতে পারে, বিপদ ঘটতে পারে। সেইগুলি উপেক্ষা করার বয়স বা সাহস আমার নিজেরও আর নাই।

শেষ কথাটা এই যে, জীবনভর দেশে ফেরার ইচ্ছাটা থাকবে, তা নিয়া হয়তো কখনো ভাবনাচিন্তাও করবো, কিন্তু ফেরা আর হবে না। ওই ইচ্ছাটা নিয়াই মরতে হবে, আমি জানি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.