আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চুপকথা : উপন্যাসের খসড়া (পর্ব ২২)

ব্লগের আমি ব্লগের তুমি ব্লগ দিয়ে যায় চেনা

১৫ জীবনের অর্ধেকের বেশিকাল যে দেশে অতিবাহিত হলো, তা আমার দেশ নয়। হবে না কোনোদিন। নিশ্চিত জানি বলে হয়তো এই বিষয়ে আমি কিছু বেশি অনুভূতিপ্রবণ। প্রতিদিনই কোনো না কোনো একটি অনুষঙ্গ পেয়ে যাই যখন অনিবার্যভাবে মনে পড়ে যাবে, আমি এখানকার কেউ নই। অনেকদিন আগে একবার আমাদের অফিসে সিকিউরিটি অ্যালার্ম বসানোর জন্যে লোকজন এসেছে।

দলনেতা লোকটি আমার টেবিলে বসে, কথায় কথায় একসময় বলে, তুমি দেখছি বেশ ভালো ইংরেজি বলো! তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে, তাই তো, আমার কি ইংরেজি বলার কথা! কী অসম্ভব ব্যাপার! এখানকার কেউ তো নই আমি! লোকটি হয়তো কিছু ভেবে বলেনি, তার মন্তব্যটিকে প্রশংসাসূচকভাবে নেওয়ারও সুযোগ ছিলো, হয়তো তাই সে বোঝাতে চেয়েছে। অথচ আমার মনে হয়েছিলো, কথাটির গূঢ় অর্থ আসলে এইরকম : তোমার এখানে কী চাই বাবা, কী করে কোত্থেকে এসে জুটলে তুমি, বলো তো? হিন্দি অনুবাদে মেরে আঙ্গনে মে তুমহারা কেয়া কাম হ্যায়! এ দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্যে মানুষের আকুতির শেষ নেই। শুধু বাংলাদেশের নয়, পৃথিবীর সকল দেশের মানুষ যারা এখানে আসে, মার্কিন নাগরিকত্ব লাভ করাকে তারা পরম সৌভাগ্য ও মোক্ষ জ্ঞান করে থাকে। দোষের কিছু আছে বলে মনে করি না, যারা পারে তারা পারে। আমি পারিনি, নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে পেরে উঠবো এমন ভরসা নেই।

আসলে বোঝাপড়াটি করতেই অনিচ্ছুক আমি। আইনসম্মতভাবে এখানে থাকার জন্যে যতোটুকু না হলে নয়, তার বেশি কিছু আমার দরকারি মনে হয়নি। গাঢ় নীল রঙের মার্কিন পাসপোর্ট না হলে আমার কী আসে যায়? পরের দেশে আমার ভোটাধিকার দিয়ে আমি কী করবো? নাগরিকত্ব নিতে গেলে এ দেশের জন্যে নিঃশর্ত আনুগত্যের শপথ করতে হয়। তা কী করে সম্ভব বুঝতে পারি না। আমার সবুজ পাসপোর্টটি, যদিও আমার কোথাও যাওয়ার কথা নেই এবং এই পাসপোর্ট পৃথিবীর অনেক জায়গায়ই আজকাল দুর্ভোগের কারণ হচ্ছে শুনতে পাই, তবু সময়মতো আজও নবায়ন করিয়ে আনি।

চিলির কন্যা ইসাবেল আলেন্দে আমেরিকায় বসে উত্তর-দক্ষিণ আমেরিকা মিলিয়ে কল্পনায় একটি দেশ বানিয়ে তাকে ইনভেনটেড কান্ট্রি নাম দিয়েছেন। আমার হয়নি। হবে না। স্কুলে ছোটো ক্লাসে পড়ার সময় কোনো উর্দু ছবির একটি সংলাপ মানুষের মুখে খুব শুনতাম - আফসোস, ম্যায় আমরিকা মে পয়দা নেহি হুয়া! তখন ভালো করে বোঝার বয়স হয়নি, পরে ভাবলে মনে হতো, ঠাট্টার ছলেও কি এ কথা বলা চলে! একজন পাকিস্তানি আমেরিকায় জন্মায়নি বলে আক্ষেপ করলে তার দাস্য মনোবৃত্তিটিই প্রকাশ পায়। অথচ উল্টোদিকে প্রায় একই সময়ে ভারতীয় হিন্দি ছবির একটি জনপ্রিয় গান ছিলো, মেরা জুতা হ্যায় জাপানি, ইয়ে পাৎলুন ইংলিস্তানি, শ্যরপে লাল টোপি রুশি, ফিরভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি...।

জাপানের পাদুকা, বৃটিশ পরিধেয়, রুশ টুপি হলে কী হয়, আমার হৃদয়টি কিন্তু ভারতীয়। হৃদয়টিকে শুদ্ধ ও একাগ্র রাখাই জরুরি। এ দেশে আমি বাস করি দীর্ঘকাল ধরে অথচ তার জন্যে আমার কোনো টান নেই, তার ভালোমন্দে আমার কিছু এসে যায় না - এ-ও হয়তো এক ধরনের প্রবঞ্চনা। একটু কঠিনভাবে বললে, ভণ্ডামি। কিন্তু কোথায় যাবো আমি? সোভিয়েট ইউনিয়ন ষাটের দশকের শেষভাগে চেকোশ্লাভাকিয়া দখল করে নিলে কমিউনিস্টবিরোধী চেকরা দলে দলে দেশান্তরী হতে শুরু করে।

দেশত্যাগে ইচ্ছুক এইরকম একজন গেছেন সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে, যেখানে আবেদনকারীদের পছন্দের দেশে ভিসার ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে। আবেদনকারীকে সরকারি অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোন দেশে যেতে চান? উত্তরে আবেদনকারী বললেন, তা তো জানি না। তবে এমন কোথাও যেতে চাই যেখানে একটু শান্তি ও স্বস্তি নিয়ে বাস করতে পারি। সরকারি অফিসার একটি গ্লোব ধরিয়ে দিলেন আবেদনকারীর হাতে। বললেন, দেখেশুনে একটা দেশ ঠিক করে নিন।

আবেদনকারী অনেকক্ষণ ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে গ্লোবটি দেখলেন। তারপর সেটি ফিরিয়ে দিয়ে সরকারি কর্মচারিটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার কাছে আর কোনো গ্লোব আছে?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.