আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মানচিত্র কথা বলে



ম্যাপগুলো দাদিমার মতোই গল্প বলে। তবে দাদিমা গল্প বললে শব্দ হয়। কিন্তু ম্যাপ গল্প বললে শব্দ হয় না। তাই ম্যাপের কথাগুলো মন দিয়ে শুনতে হয়। পৃথিবীর একটি ম্যাপ খুলুন।

দেখবেন, ওটা আপনাকে বলবে, এই দেখুন আমার এখানে কত্তো বড় সাগর, কি ঢাউস একটা পাহাড়, এই তো আপনার দেশ, যেখানে আপনি পরিবার-পরিজন নিয়ে বাস করেছেন। চেয়ে দেখুন, আপনার দেশের চারপাশে আরো কত্তো দেশ। কোনটা বড়, কোনটা ছোট। শুধু তাই নয়, ম্যাপ খুললেই আমাদের জানা অনেক দেশের ইতিহাস, প্রকৃতি, ভাগ্য, অনেক কিছুই এসে ভিড় করে। সাইবেরিয়ার দিকে তাকান, মনের আয়নায় ভাসবে রাশি রাশি বরফ।

সাহারার দিকে নজর দিন, মনের কোণে ফুটে উঠবে দিগন্তজোড়া ধু-ধু মরুভূমি আর বালির সমুদ্র। বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্ব দিকে তাকান, দেখবেন প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশ। বিজ্ঞজনেরা বলেন, ম্যাপ উপন্যাসের চেয়ে জীবন্ত, নাটকের চেয়েও প্রাণবন্ত। আসলে ম্যাপ মেলে ধরলে পুরো পৃথিবীটা চোখের সামনে ভাসে, কথা বলে। এ ম্যাপকে সম্বল করেই অভিযাত্রীরা অভিযানে বের হন, সৈনিকরা যুদ্ধে যান, পথহারা পথিক আবার হারানো পথ খুঁজে পায়।

তবে ম্যাপ এ বিশ্বের কথা যতো না বলে, তার চেয়েও বেশি বলে পৃথিবীর মানুষগুলোর কথা। ইতিহাসের জনক হিরোদুতাস বলতেন, গ্রিস হচ্ছে পৃথিবীর কেন্দ্র। রোমানরা বলতো, গ্রিস নয়, রোমই পৃথিবীর কেন্দ্র। মধ্য যুগে ভাবা হতো জেরুসালেমই পৃথিবীর ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। কিন্তু যখন মানুষ কার্যকরভাবে পৃথিবীর চার্ট তৈরি করতে শিখলো, তখন জ্যোতির্বিদরা নির্ধারণ করলেন, বিশ্বের কাল্পনিক মধ্যবিন্দুটি লন্ডনের কাছেই।

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকেই গ্রিসের জ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন, পৃথিবী গোলাকার। কিন্তু পরে খৃস্টানদের গির্জাগুলো মানুষকে ভুল শিক্ষা দিল, আসলে পৃথিবী চ্যাপ্টা, ঠিক ম্যাপের মতো। এটার প্রান্তসীমা আছে যেখানে গেলে ধপাস করে পড়ে যাওয়া ছাড়া কোনো গতি নেই। প্রাচীন কিছু ম্যাপে দেখানো হয়েছে, পৃথিবীটা অনেক হাতি অথবা কচ্ছপের পিঠের ওপর দাড়িয়ে রয়েছে। আসলে ম্যাপ হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে প্রাচীন সাহিত্য, এটি বইয়ের চেয়েও অনেক পুরনো।

কেউ কেউ দাবি করেন বইয়ের আগে মানুষ ম্যাপ দিয়েই মনের ভাব আদান-প্রদান করেছে। সম্ভবত মানুষ প্রাচীনকালে কাদার ওপর লাঠি দিয়ে ম্যাপ একে তাতে হ্রদ, নদী, জঙ্গল, জঙ্গলের ভেতরে শিকারের সম্ভাব্য এলাকাসহ গন্তব্য স্থান নির্দেশ করতো এবং অনুমানের ওপর মানুষ হিসাব করতো নির্দিষ্ট স্থানে পৌছতে তার কতো সময় লাগতে পারে। ম্যাপের রয়েছে জাদুকরী ক্ষমতা। কারণ একটি ছোট্ট ম্যাপের মাধ্যমে পুরো পৃথিবীকে আমরা প্রতীকের সাহায্যে প্রকাশ করি। এর সাহায্যে আমরা বিনা পয়সায়, বিনা পাসপোর্ট, বিনা ভিসায় যে কোনো দেশে যেতে পারি।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, ম্যাপ নিজে সাদাকালো অথবা মাল্টিকালার কিছু ডট বা বিন্দু ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু আমাদের কল্পনার সাহায্যে আমরা এসব ডটকে শহর, নগর, রাজধানী, জঙ্গল, মরুভূমি, সাগর, মহাসাগর, নদী, দালানকোঠা ইত্যাদি বানিয়ে নিই। ভুল ম্যাপ অনেক সময় নতুন দেশ আবিষ্কারে সহায়তা করেছে। ইউরোপ ও এশিয়া প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর মোট আয়তনের ১০ ভাগের এক ভাগ হলেও প্রাচীন ভূগোলবিদ টলেমি (খ্রিস্টপূর্ব ৯০-১৬৮) বিশ্বাস করতেন, এ দুটি মহাদেশের আয়তন পৃথিবীর অর্ধেকের চেয়েও বেশি। ১৩শ শতক পর্যন্ত টলেমির এ ম্যাপ চালু ছিল।

আর এ ম্যাপ দেখিয়ে কলাম্বাস স্পেনের রাজা ফার্ডিনান্ড ও রানী ইসাবেলাকে বোঝাতে সমর্থ হন, তিনি পশ্চিম দিক থেকে ক্রমাগত জাহাজ চালিয়ে অবশ্যই পুব দিকে পৌছতে পারবেন। ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। কারণ কলাম্বাস পথে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিছু দ্বীপ পেয়ে যান। ১৫১৯ সালে বিখ্যাত অভিযাত্রী ম্যাগিলান পালতোলা জাহাজে চড়ে পৃথিবী একবার ঘুরে আসেন। তখন ইওরোপিয়ানরা ভাবলো যে, আমেরিকা মূলত একটি দ্বীপ আর এশিয়া মহাদেশটা আমেরিকার ঠিক পেছনে অবস্থিত।

ম্যাগিলানের দিনে আরো বিশ্বাস করা হতো, আমেরিকা ও দূরপ্রাচ্যের মধ্যে রয়েছে সামান্য একটু জলরাশি। আর বর্তমানে ম্যাপের মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই যে, সেই সামান্য জলরাশি মূলত প্রশান্ত মহাসাগর। আজ আমরা ম্যাপ দিয়ে যেভাবে মনের ক্ষুধা মেটাই, জায়গা বা দেশ খুজে বের করার খেলায় মাতি, তেমনি এক সময় বিশ্বের রাজারা ম্যাপ নিয়ে খেলতেন, দেশ জয়ের নেশায় মেতে উঠতেন। ম্যাপ যেমন দেশের সীমান্ত সমস্যাকে লাঘব করতো, তেমনি এ সীমান্তই অনেক যুদ্ধের কারণ হয়ে দাড়াতো। কারণ প্রকৃত সীমান্ত সব সময় রাজাদের খুশি রাখতে সমর্থ ছিল না।

১৭শ শতকে ফ্রান্সের অধিকতর যথার্থ ম্যাপ আকা যখন হলো, তখন রাজা ১৪তম লুই বিস্ময়ের সঙ্গে দাবি করে বসলেন, যুদ্ধের মাধ্যমে যে পরিমাণ ভূখ- তিনি জয় করেছেন, এ নতুন ম্যাপের মাধ্যমে তার চেয়েও বেশি ভূখ- হারিয়ে ফেলেছেন। এমনকি বর্তমানেও রাজনৈতিক ম্যাপগুলো সংশ্লিষ্ট দেশের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী আকা হয়। চীনের তৈরি ভারতের ম্যাপটি ভারতের প্রকৃত ম্যাপ নয়। আবার চীনের ম্যাপে হিমালয় পর্বতমালার অধিকাংশ স্থান চীনের নিজস্ব সীমানার মধ্যে দেখানো হয়, যা ভারত মানতে নারাজ। ইকুয়েডরের ম্যাপে দেশটিকে তার প্রকৃত আয়তনের প্রায় দ্বিগুণ দেখানো হয়েছে।

কারণ ১৯৪১ সালের যুদ্ধে তারা যে ভূখ-টুকু পেরুর কাছে হারিয়েছিল, তা তারা এখন শাসন না করলেও ম্যাপে ঠিকই দেখিয়ে থাকে। আবার গুয়াতেমালা সরকার প্রকাশিত ম্যাপে বেলিজ নামের ছোট দেশটির কোনো অস্তিত্বই নেই। আসলে ম্যাপ সভ্যতার অনুপম সৃষ্টি। কারণ মানুষ ম্যাপের সাহায্য কোনো প্রকার খরচ ও কান্তি ছাড়াই, যানবাহন, রোদ, ঠা-া, ক্ষুধা ও তৃষ্ণার ঝামেলা ছাড়াই পুরো বিশ্বটাকে দিনের ভেতর শতবার ঘুরে আসতে পারে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।