সিরিয়াকে ঘিরে সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ আমাকে আমেরিকার জনগণ ও তাদের নেতাদের উদ্দেশ্যে সরাসরি কথা বলতে উদ্বুব্ধ করেছে। আমরা এমন একটি সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি যখন আমাদের সমাজের মধ্যে যথেষ্ট যোগাযোগ নেই। আর এ ধরনের পরিস্থিতিতে এটা করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে আমাদের সম্পর্ক চলে এসেছে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমরা একে অন্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলাম।
কিন্তু আমরা একজোটও হয়েছিলাম এবং একসঙ্গে নাৎসিদের পরাজিত করেছিলাম। ওই ধরনের ধ্বংসযজ্ঞ যাতে আর না ঘটে সেজন্য তখন সার্বজনীন আন্তর্জাতিক সংস্থা জাতিসংঘ গড়ে তোলা হয়েছিল।
জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাতারা বুঝেছিলেন যে, যুদ্ধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠা কেন্দ্রিক সিদ্ধান্তগুলো শুধু মতৈক্যের ভিত্তিতে হওয়া উচিত এবং আমেরিকার সম্মতি নিয়েই নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদের ভেটো ক্ষমতা জাতিসংঘ সনদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। এই সুগভীর প্রজ্ঞাই গত কয়েক দশক ধরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক স্থিতিশীল রেখেছে।
কেউই চায় না যে জাতিসংঘ জাতিপুঞ্জের নিয়তি বরণ করুক, প্রকৃতপক্ষে প্রভাব না থাকার কারণে যেটা ভেঙে পড়েছিল।
প্রভাবশালী দেশগুলো যদি জাতিসংঘকে পাশ কাটিয়ে যায় এবং নিরাপত্তা পরিষদের অনুমোদন ছাড়া অন্যের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেয় তাহলে তা হওয়া সম্ভব।
অনেক দেশ এবং পোপসহ প্রধান ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতাদের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় হামলা চালালে তাতে আরো অনেক নিষ্পাপ মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। সংঘর্ষও ছড়িয়ে পড়বে বিশেষত, তা সিরিয়া সীমান্ত ছাড়িয়ে অনেক দূরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে। হামলা হলে সহিংসতা বাড়বে এবং নতুন করে সন্ত্রাসবাদের উত্থান ঘটবে। এতে ইরানের পরমাণু সমস্যা এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট নিরসনে বহুপাক্ষিক যে প্রচেষ্টা রয়েছে তা ভেস্তে যেতে পারে এবং মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকায় আবারো অস্থিরতা তৈরি হতে পারে।
এটা আন্তর্জাতিক আইন-শৃঙ্খলার পুরো ব্যবস্থার ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারে।
সিরিয়ায় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই হচ্ছে না। বহু ধর্মীয় গোষ্ঠীর একটি দেশে সরকার ও বিরোধীদের মধ্যে সশস্ত্র লড়াই হচ্ছে। সিরিয়ায় গণতন্ত্রপন্থীরা তেমন নেই বললেই চলে। অথচ সেখানে প্রচুর সংখ্যায় আল-কায়েদার যোদ্ধা ও উগ্রবাদী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে।
বিদ্রোহীদের সঙ্গে মিশে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইরত আল নুসরা ফ্রন্ট এবং ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড লেভান্তকে এরইমধ্যে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর। বিদ্রোহীদের কাছে বিদেশি অস্ত্রের যোগান এই অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষকে নতুন মাত্রা দিয়েছে এবং তা বিশ্বের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের একটিতে পরিণত হয়েছে।
আরব দেশগুলো থেকে যাওয়া ভাড়াটে যোদ্ধারা সেখানে লড়াই করছে এবং পশ্চিমা দেশগুলো এমনকি রাশিয়া থেকেও যাওয়া কয়েকশ জঙ্গি আমাদের গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিরিয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে তারা কি আবার আমাদের দেশগুলোতে ফিরে আসতে পারবে না? যেখানে লিবিয়ায় যুদ্ধের পর উগ্রপন্থীরা মালিতে গিয়েছে। আর তা আমাদের সবার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনা তৈরি করতে সিরীয়রা যাতে শান্তিপূর্ণ সংলাপে বসতে পারে তার জন্য শুরু থেকে চেষ্টা চালিয়ে আসছে রাশিয়া। আমরা সিরীয় সরকারকে নয়, আন্তর্জাতিক আইনকে সুরক্ষা দিচ্ছি। আমাদের জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে কাজে লাগানো প্রয়োজন এবং মনে রাখা দরকার যে, বর্তমানের সংকটময় ও অস্থির বিশ্বে আইন-শৃঙ্খলার সুরক্ষাই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার সামান্য কয়েকটি উপায়ের মধ্যে অন্যতম। আইন এখনো সবার উপরে এবং তা পছন্দ হোক বা না হোক আমাদের অবশ্যই তা মেনে চলতে হবে। বর্তমানের আন্তর্জাতিক আইনে কেবল আত্মরক্ষার্থে বা নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক শক্তি প্রয়োগের সুযোগ আছে।
জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী অন্য কোনো কিছু গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা আগ্রাসনের শামিল।
সিরিয়ায় বিষাক্ত গ্যাসের ব্যবহার হওয়ার বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সিরীয় সেনাবাহিনী তা ব্যবহার করেনি-এটা বিশ্বাস করার মতো প্রতিটি কারণ রয়েছে। পক্ষান্তরে শক্তিশালী বিদেশি পৃষ্ঠপোষক যারা মৌলবাদীদের পক্ষ নিয়েছে, তাদের হস্তক্ষেপের জন্য উস্কানি দিতে বিদ্রোহীরা এটা ব্যবহার করেছে বলে মনে করার মতো অনেক কারণ রয়েছে। খবর রয়েছে, জঙ্গিরা আরেকটি হামলা চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে-এবার তা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে, যা উপেক্ষা করা যায় না।
এটা উদ্বেগের যে, বিদেশে অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের মধ্যে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা কি আমেরিকার দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের জন্য? এতে আমার সন্দেহ আছে। সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ ক্রমশ আমেরিকাকে গণতন্ত্রের আদর্শ হিসেবে নয়, দেখছে নিষ্ঠুর বাহিনীর ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতে, যারা ‘হয় তুমি আমাদের সঙ্গে অথবা আমাদের বিপক্ষে’ স্লোগান নিয়ে এগিয়ে চলেছে।
কিন্তু শক্তি অকার্যকর ও অর্থহীন বলে প্রমাণিত হয়েছে। আফগানিস্তানের অবস্থা টালমাটাল এবং বহুজাতিক সেনা প্রত্যাহারের পর সেখানে কি ঘটবে কেউ তা বলতে পারে না।
লিবিয়া বিভিন্ন উপজাতি ও গোত্রে বিভক্ত। ইরাকে গৃহযুদ্ধ চলছে, যেখানে প্রতিদিন কয়েক ডজন মানুষ নিহত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে অনেকে ইরাক ও সিরিয়ার মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে পেতে পারেন এবং তারা প্রশ্ন করতে পারেন, তাদের সরকার কেন সাম্প্রতিক ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে চায়।
কোন লক্ষ্যবস্তুতে এবং কতো আধুনিক অস্ত্র দিয়ে হামলা চালানো হচ্ছে তা কোনো ব্যাপার নয়। হামলা হলে বৃদ্ধ ও শিশুসহ বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি অনিবার্য।
কাদের সুরক্ষার জন্য এই হামলা।
তুমি যখন আন্তর্জাতিক আইনের ওপর নির্ভর করতে পারবে না তখন তুমি নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অন্য পথ খুঁজে বের করবে। এভাবে গণবিধ্বংসী অস্ত্র অর্জনে আগ্রহী হয়ে উঠেছে অনেক দেশ। এটা যুক্তিসংগত যে, তোমার বোমা থাকলে কেউ তোমাকে স্পর্শ করবে না। নিরস্ত্রীকরণে জোর দেয়ার প্রয়োজনীয়তা শুধু আমাদের কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে, যেখানে বাস্তবে ধীরে ধীরে তা আমাদের খেয়ে ফেলছে।
আমাদের অবশ্যই শক্তি প্রয়োগের ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং সভ্য কূটনীতি ও রাজনৈতিক সমাধানের পথে ফিরে আসতে হবে।
গত কয়েক দিনে সামরিক ব্যবস্থা এড়ানোর একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অন্যান্য সদস্যদের অবশ্যই সিরীয় সরকার রাসায়নিক অস্ত্র আন্তর্জাতিক সংস্থার নিয়ন্ত্রণে দিয়ে দেয়ার যে সদিচ্ছা দেখিয়েছে তার সুবিধা গ্রহণ করতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামার বিবৃতি পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, এটাকে তারা সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের বিকল্প হিসেবে দেখছে।
সিরিয়া নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখার বিষয়ে প্রেসিডেন্টের আগ্রহকে আমি স্বাগত জানাচ্ছি।
গত জুনে নর্দান আয়ারল্যান্ডের লাফ এর্নিতে গ্রুপ এইটের বৈঠকে আমরা যে বিষয়ে সম্মত হয়েছিলাম তার আশা বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের অবশ্যই একসঙ্গে কাজ করতে হবে এবং সমঝোতার লক্ষ্যে আলোচনাকে পরিচালিত করতে হবে।
আমরা সিরিয়ায় শক্তি প্রয়োগ এড়াতে পারলে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিবেশ উন্নয়নের পাশাপাশি পারস্পারিক আস্থা বাড়বে। এটা আমাদের সম্মিলিত সফলতা হবে এবং অন্যান্য জটিল বিষয়গুলোতে সহযোগিতার দ্বার খুলে যাবে।
প্রেসিডেন্ট ওবামার সঙ্গে আমার কাজের ও ব্যক্তিগত সম্পর্কে ক্রমশ আস্থা বাড়ছে। আমি এটাকে সাধুবাদ জানাই।
মঙ্গলবার জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া তার ভাষণ আমি গভীরভাবে খেয়াল করেছি। ‘আমেরিকা আলাদা কেন, আমেরিকার ব্যতিক্রময়তা তাকে সবার থেকে আলাদা করেছে’-একে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি বলে অভিহিত করে তিনি আমেরিকার ব্যতিক্রময়তা নিয়ে যে বক্তব্য রেখেছেন আমি তার সঙ্গে একমত হতে পারিনি। এর পিছনে যে অভিপ্রায়ই থাকুক না কেন জনগণকে নিজেদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা ভাবতে উদ্বুদ্ধ করাটা চরম বিপজ্জনক। অনেক বড় ও ছোট, ধনী ও দরিদ্র দেশ আছে যাদের দীর্ঘ দিনের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য রয়েছে এবং এখনো তারা গণতন্ত্রের পথে হাঁটে। তাদের নীতিতেও ভিন্নতা রয়েছে।
আমরা সবাই আলাদা। কিন্তু আমরা যখন ঈশ্বরের আশির্বাদ চাই তখন আমাদের ভুললে চলবে না যে, ঈশ্বর আমাদের সবাইকে সমান করে বানিয়েছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।