মানুষ মানুষের জন্যে ‘আপনি কি সুন্দরী? তাহলে পৃথিবী আপনার হাতের মুঠোয়’ এই ধরনের বিজ্ঞাপন চিত্র আমরা প্রতিমুহূর্তে টেলিভিশনে দেখছি, রেডিওতে শুনছি। বিজ্ঞাপনে দেখানো হয় কালো মেয়েটি তার গায়ের রঙের কারনে সমাজের সবার কাছে অপমানের শিকার হচ্ছে আর ফর্সা মেয়েটি কালো মেয়েটিকে টপকিয়ে চাকরি পেয়ে যাচ্ছে এরকম কিছু। বিজ্ঞাপনটি দেখার পর কি আমাদের কিছুটা চিন্তার উদ্রেক হয়? মনে হয় তা হয় না। কারন বিজ্ঞাপনটি আমাদের সমাজের চিন্তা চেতনার সাথে মিলে যায়। আমাদেরই অনেকের বোনের অসংখ্য যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিয়ে হচ্ছে না, কারন গায়ের রঙ একটু খারাপ।
একি ব্যাপার চাকরি ক্ষেত্রেও দেখা যায়। তাই স্বাভাবিক ভাবেই বিজ্ঞাপনটি আমাদের হজম হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু কালো মেয়েটি অসুন্দর, ফর্সা মেয়েটি সুন্দর এ ধারনা আমাদের কে দিল? আমরা কিভাবে সুন্দর অসুন্দরের স্ট্যান্ডার্ড ঠিক করলাম তা ভেবে দেখার বিষয়! ভাবতে গিয়ে যে কথাটি মনে আসে তা হল মানসিক যুদ্ধে হারিয়ে আরেক পক্ষকে ছোট করাটাই দুর্বল মানুষদের একমাত্র অবলম্বন। ব্যাপারটা ঠিক সে রকম যেমন এক বন্ধুর মুখে দাঁড়ি গোঁফ উঠে না বলে তাকে ladies বা half ladies বলে মানসিক বশ্যতার শিকার করানো। কিন্তু ছেলেটির বন্ধুরা খুব ভালো করে জানে পুরুষত্ব দাঁড়ি কিংবা গোঁফে না, পুরুষত্ব অন্য জায়গায়।
দাঁড়ি গোঁফ কেবল জেনেটিক ইস্যু। তা সত্ত্বেও তারা এই মোক্ষম অস্ত্র ছাড়বে না কারন তা দিয়ে অতি সহজে দাঁড়িহীন সুপুরুষকেও নুপুংসক প্রমানিত করা যায় এবং তাদের আধিপত্য বজায় থাকে। ঠিক একি আইডিয়া ব্যাবহার করে বিভিন্ন কোম্পানিগুলো তাদের প্রোডাক্ট বিক্রি করছে। আপনি সুন্দরী নন তা প্রমান করে আপনাকে সুন্দরী হওয়ার মন্ত্র বলে দেয়া তাদের প্রোডাক্ট বিক্রি হওয়ার একমাত্র অবলম্বন। এই শক্তিশালী মিডিয়া বারবার সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করছে তুমি যেমনটি আছো সেভাবে তুমি অসম্পূর্ণ।
আর একি কথা টিভি, রেডিও , বিলবোর্ড সব জায়গায় দেখতে দেখতে তা আমাদের অবচেতনে জায়গা করে নেবে এটাই স্বাভাবিক। তারপর আমরা হীনমন্যতায় ভুগব। তখন আমাদের মনে কেবল একটাই কামনা অমুক ‘কাপুরের’ মত skin tone চাই, তমুক ‘শর্মার’ মত bikini figure চাই, ‘টমটম বসুর’ মত পীনোন্নত বুক আর ‘কাতুকুতু কাইফের’ মত attractive lips চাই, চাই ‘চুন্নু খানের’ মত ‘six pack of Abs’ আর এ নিয়ে চিন্তায় রাতের ঘুম হারাম হয়। আয়নার সামনে দাঁড়ালে মনে হয় যেন কোন চার পায়া গাধাকে দেখছি। আমার আরেকটা বিষয় খুব দৃষ্টিকটু লাগে যখন দেখি বাংলাদেশে মেয়েদের বিভিন্ন জামা বিক্রি হচ্ছে যাদের নাম খুশি, রাশি, মুন্নি ইত্যাদি।
ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যখন দেখি আমার আত্মীয়ারা টিভি সিরিয়াল দেখার সময় সিরিয়ালের নায়িকাদের পূজায় নেমে পড়ে। ‘ইস খুশির ড্রেসটা কি সুন্দর’ ‘মানভির ঠোটের লিপিস্টিকটা দেখেছিস?’ এ ধরনের মন্তব্য প্রায় শুনি। তারা বুঝতে পারে না নিজেদের অজান্তেই নিজেদের এটা বুঝাচ্ছে সিরিয়ালের নায়িকারা superior এবং তারা inferior. ফলে তারা শিকার হচ্ছে হীনমন্যতার এবং এই হীনমন্যতার সুযোগ নিয়ে আরেক দল তাদের শোষণ করছে। আর আমরা মানুষের স্তর থেকে নেমে গরু ছাগলের দলে নিজেদের নাম লেখাচ্ছি। ‘six pack of Abs’ ‘32-28-34’ এ আমার কোন সমস্যা নেই যদি তা নিজের সিদ্ধান্ত,নিজের ইচ্ছা, নিজের ব্যাক্তিত্ত্বের প্রকাশ হয়।
কিন্তু কোন মহল বা কারো দ্বারা প্রভাবিত এবং হীনমন্যতার শিকার হয়ে কেউ যদি silicon breast এর জন্য লাফালাফি করে তাতে আমার আপত্তি আছে। প্রত্যেক মানুষের ব্যাক্তিগত পছন্দ রয়েছে। অনেক ছেলে ফর্সা মেয়ে পছন্দ করে না। এর মানে এই না যে ফর্সা মেয়েরা সুন্দরী না। আবার অনেক ছেলে ফর্সা মেয়ে দেখলে লাফালাফি শুরু করে।
আমি যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা হচ্ছে পছন্দ অপছন্দ আপেক্ষিক ও ব্যাক্তি নির্ভর। এখানে কোন পরম স্ট্যান্ডার্ড নেই। মমতাজ কালো ছিলেন কিন্তু তার জন্যই সম্রাট শাহজাহান নির্মাণ করলেন তাজমহল। ভিতরটাই মুখ্য, বাহির নয়। অতি দামি মোড়কে গোবর প্যাকিং করলে গোবরের দাম বেড়ে যায় না।
আমাদের মনে রাখতে হবে আমরা প্রত্যেকেই Genetically আলাদা, আমরা প্রত্যেকেই শারীরিক ও মানসিক ভাবে অনন্য। স্কুলজীবনে একটা ভাবসম্প্রসারন প্রায় পরীক্ষাতে আসত ‘আত্মশক্তি অর্জনই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য’। বাক্যটি বাস্তবে রুপ দেয়ার সময় এসে গেছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।