ব্লগে লেখার চেয়ে পড়তে ভালো লাগে... বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গনে মুসলিম মেয়েদের মধ্যে ফজিলতুন্নেসা হলেন প্রথম স্নাতক ডিগ্রীধারী। তাঁর আগে আর কোন মুসলমান মেয়ে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করতে পারেনি। ফজিলতুন্নেসার জন্ম ১৯০৫ সালে টাঙ্গাইল জেলার করোটিয়ার অদূরবর্তী কুমল্লী নামদার। পিতার নাম ওয়াজেদ আলী খাঁ, তিনি করোটিয়ার জমিদার বাড়িতে সামান্য একটি চাকরি করতেন। পারিবারিক অস্বচ্ছলতা থাকা সত্বেও তিনি তাঁর মেয়েকে শিক্ষার পথে এগিয়ে দেন।
শৈশব হতেই ফজিলাতুন্নেসা লেখাপড়ায় আগ্রহী এবং মেধাবী ছিলেন।
ফজিলতুন্নেসার শৈশব আর কৈশোর কেটেছে গ্রামে। গ্রামের স্কুলেই তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু। স্কলের বাৎসরিক পরীক্ষায় ভালো ফলাফল দেখে তাঁর পিতা তাঁকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন বলে মনস্থির করেন। সামাজিক ও পারিবারিক বাধা অতিক্রম করে তিনি ফজিলতুন্নেসাকে ঢাকা নিয়ে আসেন এবং সে সময়ের একমাএ সরকারী বালিকা বিদ্যালয় 'ইডেন স্কুলে' ভর্তি করে দেন।
সরকারী স্কুলে ভর্তি হয়ে ফজিলতুন্নেসা মহা খুশী। শুরু হয় তাঁর কঠোর পরিশ্রম ও সাধনা। কঠোর অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের পুরস্কার তিনি পান ১৯২১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন(বর্তমান এসএসসি) পরীক্ষায় ঢাকা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে এবং মাসিক ১৫ টাকা হারে বৃত্তি পান। তখন থেকে লোকের মুখে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। ১৯২৩ সালে ইডেন কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন এবং শিক্ষাবৃত্তি লাভ করেন।
অতঃপর কলকাতার বেথুন কলেজে বিএ পড়ার জন্য যান। এই কলেজে তখন তিনিই ছিলেন একমাএ মুসলিম ছাএী। ১৯২৫ সালে ডিসটিংশান সহ বিএ পাশ করেন। তাঁর আগে কোন মুসলিম মেয়ে এই বিরল সম্মানের অধিকারী হয়নি। বিএ পাশ করে তিনি ঢাকা ফিরে আসেন।
তাঁর পিতা তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিতে মাস্টার্স ক্লাশে ভর্তি করে দেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাএী। কিন্তু এখানে তিনি কঠিন পরীক্ষায় পড়লেন কারন তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষার পরিবেশ ছিলনা। এক্ষেএেও ফজিলতুন্নেসা ছিলেন সফল, তিনি সতীর্থদের সাথে গড়ে তুলেন বন্ধত্বময় সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। ১৯২৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গনিত বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেনিতে প্রথম স্থান লাভ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন।
বাংলার রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থাকে ভ্রুকুটি দেখিয়ে অসম সাহস ও উচ্চ শিক্ষা লাভের প্রবল আকাংখায় বোরকা ছাড়া বহুবিধ অত্যাচার সহ্য করে উওরসুরী মুসলিম মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করেন ফজিলতুন্নেসা।
এই সময় তিনি সাহসী পদক্ষেপ নেন উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিলেত যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে একজন মেয়েকে বিলেত পাঠাতে অস্বীকৃতি জানালে তিনি নিজ চেষ্টায় 'ষ্টেটস স্কলারশীপ' যোগাড় করেন। বিলেত যাবার পূর্বে তিনি কিছুদিন ঢাকার ইডেন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। ফজিলতুন্নসার বিলেত যাএাকে একটি উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করে সওগাত পএিকা ১৯২৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তাঁকে সংবর্ধনা দেয়।
একজন মুসলিম নারীর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য সম্মান দেখিয়ে সম্বর্ধনা দেওয়ার নজির ঐ প্রথম। প্রথম মুসলিম নারীর সাত সমুদ্র তের নদী পার হওয়া উপলক্ষ্যে 'কাজী নজরুল ইসলাম' একটি গান লিখে স্বকন্ঠে গেয়েছিলেন। গানটি ছিল "জাগিলে পারুল কিগো সাত ভাই চম্পা ডাকে"। পল্লী কবি জসিম উদ্দীন ফজিলতুন্নেসাকে উদ্দেশ্য করে 'বিদায় অভিনন্দন' নামে একটি কবিতা লিখে সম্বর্ধনা সভায় পাঠান।
বিলেতে থাকাকালে খান বাহাদুর আহসানউল্লাহ্র পুত্র প্রথম বাঙালি সলিসিটর জনাব শামসুজ্জোহার সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়।
পিতার গুরুতর অসুস্থার খবর শুনে বিলাতের পাঠ অসমাপ্ত রেখে তাঁকে দেশে ফিরতে হয়। পরবর্তীতে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁর মধ্যস্থতায় জনাব জোহার সাথে ফজিলতুন্নেসার বিয়ে হয়। দেশে আসার পর তিনি কলকাতার বেথুন কলেজে শিক্ষকতার চাকরী নেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত ইডেন কলেজের অধ্যক্ষার পদে আসীন ছিলেন।
প্রশাসনিক কোন্দলের জের ধরে তাঁকে নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বেই তাঁকে বাধ্যতামূলক আবসর নিতে হয়।
জীবনের শেষ দিনগুলো কাটিয়েছেন নিঃসঙ্গ নির্জনে। ১৯৭৬ সালে ফজিলতুন্নেসার জীবনের ইতি ঘটে। আমাদের ব্যার্থতা আমরা এই গুণী নারীকে যথাযোগ্য সম্মান দিতে পারিনি। বর্তমান বাংলাদেশেও ফজিলতুন্নেসাকে স্মরন করে না।
নজরুল ও ফজিলতুন্নেসা :
১৯২৮ সালে নজরুলের দ্বিতীয় দফা ঢাকা সফরের সময় ফজিলতুন্নেসার সাথে নজরুলের পরিচয় ঘটে।
ফজিলতুন্নেসা তখন ঢাকার দেওয়ান বাজারস্থ হাসিনা মঞ্জিলে থাকতেন। কাজী মোতাহার হোসেনের কাছ থেকে ফজিলতুন্নেসা জানতে পারেন নজরুল হাত দেখে ভাগ্য বলতে পারেন এবং ফজিলতুন্নেসারও তার হাত নজরুলকে দেখাবার ইচ্ছা হয়। এভাবে ফজিলতুন্নেসা ও তার বোন সফীকুননেসার সাথে নজরুলের পরিচয় ঘটে ফজিলতুন্নেসার বাসায়। কাজী মোতাহার হোসেনের লেখা থেকে জানা যায়, সেই দিন রাতেই নজরুল ফজিলতুন্নেসার ঘরে যান এবং প্রেম নিবেদন করেন। ফজিলতুন্নেসা নজরুলের আবেদন প্রত্যাক্ষান করেন।
নজরুল ফজিলতুন্নেসার বিলেত গমন উপলেক্ষে ‘’বর্ষা-বিদায়” নামক একটি কবিতা লেখেন। কলকাতা ফিরে গিয়ে নজরুল ফজিলতুন্নেসাকে একটি কাব্যিক চিঠি লেখেন। সেই কাব্যিক চিঠির নাম রহস্যময়ী (পরে তুমি মোরে ভুলিয়াছ নাম দেওয়া হয়)। কাজী মোতাহার হোসেন লেখেন, “ফজিলতের প্রতি নজরুলের অনুভূতির তীব্রতা দু’তিন বছরের সময়-সীমায় নিঃশেষিত হয়ে যায়”। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।