এম. মুবিনুল ইসলাম
নীতির রাজা হল রাজনীতি, যদিও বর্তমানে এটি রাজার নীতি রাজনীতি হিসেবে বাস্তবতা পেয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলের অবির্ভাব জনগনের সেবা ও কল্যাণের জন্য, দেশের সামগ্রীক উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য। এখানে রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ডের প্রধান বিচারক জনগন। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলো পরস্পর ভাল কিছু করার প্রতিযোগিতা করবে এটিই স্বাভাবিক। গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর যেমন স্বাধীনতা রয়েছে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের, তেমনি জনগনেরও অধিকার রয়েছে তাদের প্রাত্যহিক কাজকর্ম নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করার এবং নাগরিক হিসেবে সকল অধিকার ভোগ করার।
দায়িত্বতো থাকবেই। রাজিৈতক দল এমন কিছু করবেনা যা জনগনের অধিকার ও শান্তি হরন করবে। দূর্ভোগ ও হয়রানি বৃদ্ধি করবে। দাবী আদায়ের জন্য হরতাল, অবরোধ, বন্ধ বা অন্যান্য রাজনৈতিক কর্মসূচী পালন করার অধিকার যেমন দলগুলোর রয়েছে জনগনেরও তেমনি অধিকার আছে, ইচ্ছা হলে তা মানার আবার ইচ্ছে না হলে অমান্য করার। যদি গনতন্ত্র ও জনকল্যানের কথা বলি তাহলে আমাদের কারো দলগতভাবে হোক বা সমষ্টিগতভাবে হোক অধিকার নেই অপরের স্বাভাবিক চলাফেরা, কর্মকান্ড বাধাগ্রস্থ করে অবরোধ, হরতাল বা ঘেরাও পালনে বাধ্য করার।
এভাবে রাজনৈতিক দলের কর্মসূচী পালনে বাধ্য করা সংবিধান, মৌলিক মানবাধিকার ও নাগরিক অধিকারের পরিপন্থী। কিন্তু দনি এশিয়ার নবীন গনতান্ত্রিক দেশ বাংলাদেশের জনগন উপর্যুপরি তারই সম্মুখীন হচ্ছে। রাজনৈতিক হাঙ্গাঁমা, জোরজবরদস্তী আর অস্থিতিশীলতা জনগনের দূর্ভোগ বাড়াচ্ছে। ব্যবসা-বানিজ্য, অর্থনীতি ধ্বংস হচ্ছে। আমদানী-রফতানী-বৈদেশিক বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ইমার্জিং টাইগার হিসেবে প্রবৃদ্ধির হার বৃদ্ধি, রেমিটেন্সের রেকর্ড, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের রেকর্ড, বিদেশে বাংলাদেশী পণ্যের বাজার সমপ্রসারনের সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ হওয়ার পথে। সামপ্রতিক রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও কর্মসূচী জনগনের যে পরিমান দূর্ভোগ বৃদ্ধি করেছে তার বৈধতা নিয়ে এবার প্রশ্ন উঠেছে খোদ ভুক্তভোগী জনগনের মধ্যে।
চলমান সংঘাতময় রাজনৈতিক কর্মসূচী ও জনগনের ভোগান্তির শুরু 27 অক্টোবর'06 বিকাল হতে। 25, 26 ও 27 অক্টোবর'06 ছিল পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর এর মতো ধর্মপ্রান মানুষের বৃহত্বর ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব। এ উৎসবে বৃদ্ধ মা-বাবা, আত্নীয় স্বজনের সাথে ঈদ করতে নাড়ীর টানে গ্রামে ছুটে শহুরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও প্রবাসী অগনিত বাংলাদেশী।
কয়েকদিনের ঈদের আনন্দ সেরে সবাই ছুটবে যার যার কর্মস্থলে। একবিংশ শতাব্দীর কর্মব্যস্ত মানুষের ছুটে চলার কোন বিরতি নেই। কিন্তু মানুষের সে স্বাভাবিক ছুটে চলা থমকে দিল অশুভ এক রাজনৈতিক কর্মসূচী 27 অক্টোবরের ভাংচুর, অগি্নসংযোগ ও অরাজক পরিস্থিতি এবং 28 অক্টোবরের অবরোধ। অথচ কিছুদিন আগে থেকে 14 দল নেত্রী ঘোষনা করেছেন যেদিন কে এম হাসান প্রধান উপদেষ্টার শপথ নিবেন সেদিন থেকে লাগাতার অবরোধ হবে। তিনি দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিলেন লগি, বৈঠা, লাঠি ও যার যা আছে তা নিয়ে রাস্তায় নেমে আসার জন্য।
কিন্তু 27 বা 28 অক্টোবর কে এম হাসান তো শপথ নেননি, বিদায়ী সরকারও মতা হস্তান্তর করেনি তাহলে কেন জনগন প্রস্তুত না হতেই অপ্রত্যাশিত ভাবে ঈদের আনন্দকে ম্লান করে 27 অক্টোবরের অরাজকতা ও 28 অক্টোবর থেকে লাগাতার অবরোধ? লাখ লাখ লোক পরিবার-পরিজন, কর্মস্থল, নিজ নিজ ঠিকানা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যার যার জায়গায় আটকা পড়লেন। যাত্রীবাহী বাস, ট্রেন মাঝপথে আটকা পড়ে কি অবর্ননীয় দূর্ভোগ সহ্য করেছে তা প্রত্যদশর্ীদের কাছে শুনে রীতিমতো আঁতকে উঠার মতো অবস্থা। এমনিতে পণ্যদ্রব্যের অপ্রতুলতা ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, এর মধ্যে পণ্যবাহী শত শত যানবাহন রাস্তায় রাস্তায় আটকে পড়ে। শাকসবজী, মাছ তরকারী, কাঁচামালসহ ভোগ্যপণ্য রাস্তায় পঁচে পড়ে থাকে। সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় অতি প্রয়োজনীয় শিশু খাদ্য, দুধ, রুগীদের ব্যবহার্য-অঙ্েিজন, জরুরী ঔষধপত্র ইত্যাদি।
অভাবের জনপদ রংপুর অঞ্চলের মঙ্গাঁ পরিস্থিতি হতে থাকে আরো প্রকট। ঈদের মতো একটি জাতীয় উৎসবের মুহুর্তে এভাবে হঠাৎ লাগাতার কর্মসূচী বিশ্বের কোন সভ্য কেন অসভ্য দেশেও আছে কিনা আমাদের সন্দেহ। অথচ সে অসভ্য কাজটাই আমাদের দেশে সফলভাবে হয়ে গেল। সুশীলসমাজ, নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবি মহল মুখে কুলুপ এঁটে হুক্কা হুয়া বাহাবা বাহাবা দিয়ে চললেন। অসংখ্য মানুষের অবর্ননীয় দূর্ভোগ কেউ আমলে আনল না।
আমি নিজেই এর ভূক্তভোগী এবং প্রত্যদশর্ী। সেদিন মুখ থেকে অজান্তে বেরিয়ে এসেছে সে বাক্যটি 'সেলুকাস বড় বিচিত্র এ দেশ'। সত্যিই অবাক হওয়ার মতো সে পরিস্থিতি।
27 অক্টোবর ঢাকায় বিভিন্ন জায়গায় ভাংচুর, অগি্নসংযোগ, বাসাবাড়ীতে হামলা চরম আতংকজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। ভয়ে মানুষ সেদিন সন্ধ্যা বা রাতে ঘর হতে বেরোতে সাহস করেনি।
পরদিন 28 অক্টোবর পুরানা পল্টন মোড়, বায়তুল মোকাররম সংলগ্ন এলাকা, কস্তুরীর সামনে যে ভয়াবহ বর্বরতা, পৈশাচিক উল্লাস, লগি বৈঠা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মানুষ হত্যা, মৃতদেহের উপর নাচানাচি ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে দেশ বিদেশের কোটি কোটি মানুষ দেখেছে তারা শিহরিত না হয়ে পারেনি। সভ্য দুনিয়ায় এমন নৃশংসতা চলতে পারে এটি বিশাস করতে যেন গায়ের লোম খাঁড়া হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। এ যেন রাজপথে তাজা মানুষের রক্তের হোলিখেলা। এরপরবর্তী অবস্থা সকলের জানা। প্রথম দফা অবরোধ শেষে 6 নবেম্বর 2য় দফা, 19 নবেম্বর 3য় দফা এবং 3রা ডিসেম্বর 4র্থ দফা অবরোধ এবং ঘেরাও, অবস্থান কর্মসূচী, সমাবেশ বিােভ সবমিলে প্রায় 40 দিন এদেশের প্রতিটি মানুষ অনিশ্চয়তা আর অসহনীয় দূর্ভোগের মধ্যে দিনাতিপাত করেছে।
হাজারো বেদনা, অসহায় অসুস্থ মানুষের আর্তনাদ, খেটে খাওয়া মানুষের অন্ন জ্বালা, ঘরে ঘরে দরিদ্র-নিঃস্ব বণি আদমের দুঃখ কষ্ট বাংলার আকাশ বাতাস ভারী করে তুলেছিল। টেলিভিশনের পর্দায় আর পত্র-পত্রিকার পাতায় উদ্বিগ্ন মানুষের অসহায় দৃষ্টি যেন দৈত্য এসে স্বস্তি ছিনিয়ে নেয়ার মতো অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। সারাদেশ থেকে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করতে রাজপথ, রেলপথ, নৌপথ অবরোধের ঘোষনা দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড, যানবাহনে ভাংচুর, অগি্নসংযোগ, পথচারীকে নাজেহাল, যাত্রীদের সর্বস্ব ছিনতাই কোন ধরনের আন্দোলন ? এমনিতে হরতাল আর অবরোধ এক জিনিষ নয়। কিন্তু রাজপথ, রেলপথ, নৌপথ বাদে রাজধানী, মহানগরী, মফস্বল শহর থেকে আরম্ভ করে সারাদেশের সকল যান চলাচল জোর করে বন্ধ করা ছিল নিজেদের কর্মসূচি বহিভর্ূত ও অবৈধ। বন্দরের মাল খালাস বন্ধ, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রগুলো ধবংস, বার্ষিক পরীার মূহুর্তে কোমলমতি শিার্থীদের কাস পরীায় আঘাত, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজট সৃষ্টি, জনগনের বাহনে অগি্নসংযোগ, রাস্তায় রাস্তায় পিকেটারদের মারমুখী কর্মকান্ড গণতন্ত্র কখনো সমর্থন করতে পারে না।
ফাঁকা রাস্তায় পিকেটারদের ফাঁকি দিয়ে চলতে গিয়ে গাড়ীর চাকায় পিষ্ঠ হয়ে মারা পড়েছে বিরাট সংখ্যক নিরীহ পথচারী, সড়ক দূর্ঘটনায় সর্বস্বান্ত হয়েছে অনেকগুলো পরিবার। অবুঝ বাচ্চাদের ব্যবহার করা হয়েছে বোমা, ককটেল ফাটাতে এবং পিকেটিং এর কাজে। খুন হয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রাজনৈতিক নেতাকর্মী, হাত-পা হারিয়ে পঙ্গু হয়েছে অনেকে। আন্দোলনের সুযোগে ক্রাইম হয়েছে অসংখ্য। দেশ অচল করে দেয়া, সবকিছু বন্ধ করে দেয়ার হুমকি আর জবরদস্তি যেন 14 কোটি মানুষকে গৃহবন্দী করে রাখার শামীল, সারাদেশকে বৃহত্তর কারাগারে রূপান্তর করার অনুরূপ।
গণতন্ত্রের নামে জঙ্গীতন্ত্র, মগতন্ত্র, এ এক বড় ধরনের অন্যায়, এটি একটি রাজনৈতিক সন্ত্রাস। রাজনেতিক কর্মসূচী পালনে জনগনকে বাধ্য করা এখতিয়ার বহিভর্ূত, অসাংবিধানিক। আইন পেশায় নিয়োজিতদের বলবো পারলে এর বিরদ্ধে উচ্চ আদালতে একটি রীট করতে, এ অন্যায়ের বিরূদ্ধে জনগনকে সোচ্চার করতে। এ অন্যায় দমনে ব্যর্থতার জন্য তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাদেরও দায়দায়িত্ব কোন অংশে কম নয়। যার জন্য ওনাদেরকেও জবাবদিহি করতে হবে।
লেখক: এমফিল রিসার্চ ফেলো
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।