আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মনিকা আলির বৃক লেন নিয়ে সামপ্রতিক বিতর্ক

কবিতা, কলাম, গল্প, ব্যক্তিগত কথামালা

[লেখাটি যায়যায়দিনের আর্ট অ্যান্ড কালচার ম্যাগাজিনে 03 আগস্ট 2006 তারিখে প্রকাশিত] মনিকা আলির বৃক লেন নিয়ে সামপ্রতিক বিতর্ক অবনি অনার্য বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নভেলিস্ট মনিকা আলির প্রথম উপন্যাস ব্রিক লেন প্রকাশিত হয় 2003 সালে। সেবারই ম্যান বুকার প্রাইজের জন্য নির্বাচিত হয় এ বইটি। সমপ্রতি, বহুল আলোচিত এই বইটির চলচ্চিত্ররূপ দেয়ার জন্য যৌথভাবে ইনভেস্ট করে রুবি ফিল্মস প্রোডাকশন কোম্পানি এবং ফিল্ম ফোর। কাজও শুরু করেছে তারা। কিন্তু যাদেরকে নিয়ে এই বইটি লেখা হয়েছে, এবং এখন চলচ্চিত্ররূপ দেয়ার জন্য যাদেরকে এক্সট্রা হিসেবে কাস্ট করার ল্যে মোটা অংকের টাকা দেয়ার লোভ দেখানো হচ্ছে, সেই ব্রিক লেনবাসীরই একটা বড় অংশের প্রতিবাদের মুখে পড়েছে ব্রিক লেন।

ব্রিক লেনে তাদের সংস্কৃতির ভুল উপস্থাপন হয়েছে বলে তাদের দাবি_ 'ডার্টি লিটল মাঙ্কিস', 'অশিতি, নিরর, ছোট আত্মার মানুষ' ইত্যাদি বলে সিলেটিদের গালি দেয়া হয়েছে বইটিতে। তাদের প্রতিবাদের উৎপত্তি কিন্তু এখন নয়, বইটি প্রকাশের পর থেকেই। এবার তারা আলির বই পুড়িয়ে ফেলারও ঘোষণা দিয়েছে। ক্যাম্পেইন অ্যাগেইনস্ট মনিকা আলিস ফিল্ম ব্রিক লেন-এর নেতা আবদুস সালিক বলেছেন, 'বাকস্বাধীনতা যদি তার (আলির) অধিকার হয়, তবে আমাদেরও তার বই পুড়ে ফেলার অধিকার আছে। আমাদের ােভ আমরা এভাবেই প্রকাশ করবো।

মনিকা আলিকে আমরা পছন্দ করি না। আমাদের কমিউনিটির মান-সম্মান রার দায়িত্ব আমাদের। ' বাদ-প্রতিবাদের যুদ্ধ কেবল বৃটেনের ব্রিক লেনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, মিডিয়াও সরগরম হয়েছে। যোগ দিয়েছেন প্রথিতযশা সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরাও_ জার্মেইন গ্রিয়ার, সালমান রুশদিও আছেন এদের মধ্যে। গার্ডিয়ানে এ-বিষয়ে কমেন্ট আসছে প্রচূর।

উল্লেখযোগ্য কিছু কমেন্ট এখানে দেয়া হলো। 27 জুলাই 2006 তারিখে জোনাথন হিউড গার্ডিয়ানে লেখেন: স্থানীয় লোকজনের প্রতিবাদের কারণে মনিকা আলির উপন্যাস ব্রিক লেনের শুটিং আর ব্রিক লেনে করা সম্বব হবে না বলে গার্ডিয়ানে আজ খবর প্রকাশিত হয়েছে। রুবি ফিল্মস আর ফিল্ম ফোর তাদের শুটিং অন্যত্র স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইতিমধ্যে অবশ্য প্রতিবাদ আরো বহুদূর গড়িয়েছে। ব্রিক লেনে শুধু নয়, যেখানেই এছবির শুটিং হোক না কেন, বিােভকারীরা সেটা প্রতিহত করবে বলে জানিয়েছে।

ক্যাম্পেইন অ্যাগেইনস্ট মনিকা আলিস ফিল্ম ব্রিক লেন-এর নেতা আবদুস সালিক সিলেটি বাংলাদেশির সংস্কৃতির ভুল উপস্থাপনের প্রতিবাদ জানান। বিােভকারীরা উপন্যাসের কিছু অংশ পাঠ করে উপস্থিত জনতাকে শোনান যেখানে উপন্যাসের একটি ক্যারেক্টার সিলেটিদের বলে 'ডার্টি লিটল মাঙ্কিস', 'অশিতি, নিরর, ছোট আত্মার মানুষ' ইত্যাদি। তারা বইটির বাকি দেড় ল শব্দ আর পড়ে না, যেখানে সিলেটিদেরকে বেশ মমতা, মহত্ব আর আনন্দ সহকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। হতে পারে যে, বিােভকারীদের প্রতিবাদ বইটিতে উপস্থাপিত জাতিগত বিষয়াশয় নিয়ে নয় বরং এর জেন্ডারবিষয় নিয়ে, যেখানে একজন নারী তার স্বামীকে ছেড়ে নিজেই ব্যাবসা শুরু করে? এমন কি হতে পারে, আংশিক হলেও প্রকৃতঅর্থে ব্রিক লেনের সহানুভূতিশীল-প্রাণবন্ত উপস্থাপনের পরও তারা বইটি পড়েই নি? যা সাধারণত হয় এসব েেত্র, প্রকৃত ঘটনার চেয়ে কানকথা বেশি ছড়ায়। শোনা যায়, কোনো এক ক্যারক্টারের চুল থেকে তরকারির পাতিলে জোঁক পড়ার দৃশ্য নিয়ে রেস্তোঁরার মালিকরা প্রতিবাদ করেছে।

আসলে, এরকম কোনো ঘটনা বইয়েও নেই, প্রোডাকশন কোম্পানির মতে চিত্রনাট্যেও নেই। "ফিল্ম মেকারদের তাড়ানোর মোরাল রাইট তাদের আছে"_ এই বলে বিােভকারীদের প্রতিবাদের আগুন আরো বাড়িয়ে দিয়েছেন (অস্ট্রেলিয়ান নারীবাদী লেখিকা এবং কলামিস্ট) জার্মেইন গ্রিয়ার। তিনি বলেন, বৃটিশ মা আর ঢাকাইয়া বাবার সন্তান মনিকা আলি ব্রিক লেনের সমাজচিত্র তুলে ধরার কেউ নন, তাছাড়া তিনি সেটা করেছেন একজন শাদা লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। মিডিয়াতে কোনো এলাকার সংস্কৃতি তুলে ধরা নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মনোপীড়ন এক জিনিস, আর সেই সংস্কৃতি তুলে ধরবার েেত্র একজন লেখকের স্বাধীনতা বা ফিল্ম কোম্পানির ফিল্ম বানানোর স্বাধীনতায় বাধা দিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি করা ভিন্ন জিনিস। আইনগত বা আদর্শগত কোনো ভিত্তি এর নেই, এটা কোনো বহুমাত্রিক সোসাইটির বৈশিষ্ট্যও নয়।

আর তাছাড়া, সোসাইটির কেই নন বলে আলি সেই সোসাইটি নিয়ে লিখতে পারবেন না, এটা অ্যাবসার্ড। বহুমাত্রিক গল্পকারের লাইসেন্স দেয়ার দায়িত্ব কার? আর যাই হোক, গ্রিয়ারের নিশ্চয়ই নয়। রেসিয়াল অ্যান্ড রিলিজিয়াস হেট্রেড অ্যাক্ট-এর সংশোধনীতে আর্টিস্টিক বা রিলিজিয়াস যাই হোক-না-কেন, সব বিষয়েই মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা বলা হলেও, আর্টিস্টদের প েসরকার এখনো ততটা সরব নয়। কমু্যনিটি সেন্সরশিপ, বিশেষত মাইনরিটি কমু্যনিটির হিডেন স্টোরির েেত্র মত প্রকাশের স্বাধীনতার জায়গা ক্রমশই সংকুচিত হয়ে আসছে। এরপর শুরু হয় সিরিজ প্রতিক্রিয়া।

বিভিন্নরকম মতামত এসেছে গার্ডিয়ানে। যেমন একই তারিখে গ্রেট বৃটেন থেকে জুসির প্রতিক্রিয়া ছিলো এরকম: অবিশ্বাস্য সহজ-সাবলীল একটি বই যা কিনা নিঃসন্দেহে সেরকমই একটা চলচ্চিত্ররূপ পেতে যাচ্ছে,তার জন্য এটা একটা ভালো পাবলিসিটি বলা যায়। এটার প্রতিবাদ নিঃসন্দেহে হাস্যকর, আর তাছাড়া জোনাথনের কথাগুলো সত্য। তবুও, তার মতো একজন লোকের প েওই সোসাইটি তথা এশিয়ানদের জন্য কোনটা ভালো সে বিষয়ে শব্দের ফুলঝুরি ঝরানোও হাস্যকর। এ বিষয়ে আমরা আরো আরো এশিয়ানদের মতামত নেই না কেন... জানি, বাকস্বাধীনতা রা করা গুরুত্বপূর্ণ, তবুও আত্মম্ভরি লোকেদের পাছায় দাঁতের কামড় পড়েছে দেখলে আমার দুষ্টসত্তা হেসে ওঠে।

গ্রেট বৃটেন থেকে এন্ডারস্পো লেখেন: 'ফ্রি স্পিচ' তথা বাকস্বাধীনতার নামে এসব 'লিবারেলদের' উত্তেজনা দেখলে হাসি পায়...'ফ্রি স্পিচ' আসলে স্বাধীন মিথ্যা বলা। আমাদের সবরাই কিছু না কিছু স্বাধীনতা কাটছা ঁট করতে হয়। এখানে সিলেটি বাঙালিদের আন্দোলনকে অগ্রহণযোগ্য ভাবা হচ্ছে কেন? যে বই তাদের কালচারের দুর্নাম করে তার প্রতিবাদ তারা করতেই পারে। গ্রেট বৃটেন থেকে সানিকাউডি গার্ডিয়ানের সমালোচনা করে লেখেন: সত্য কথা বলতে, গার্ডিয়ানেরও দোষ আছে। এর আগে ব্রিক লেনের মতবিরোধ নিয়ে তারা দুটো আর্টিকেল ছাপিয়েছে, কোনোটাতেই ফিল্মের পরে কারো কোনো খবর নেই।

কিন্তু আমরা স্টোরি করতে গিয়ে দেখি, প্রচূর লোক ফিল্ম করা সাপোর্ট করছে, শুধু তাই নয়, তারা বলছে, প্রতিবাদ এসেছে ওই একটা মিষ্টি দোকান থেকে। জার্মেইন গ্রিয়ার প্রসঙ্গে টার্ক্সিয়েন লেখেন: প্রাক্তন নারীবাদী, চিন্তাবিদ জার্মেইন গ্রিয়ার অনেক বছর আগেই 'কালচারাল' ব্যাপার বলে নারীকে খোজা করার প েসাফাই গেয়ে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন। 'দ্য ফিমেল ইউনাক' বইয়ের এ লেখিকা পরে কালচারাল ব্যাপার বলে জোরপূর্বক বিয়ের পও নেবেন, এতে আর সন্দেহ কী? অপছন্দের কারণে (এমনকি সে বই না পড়েও) বই পুড়ে ফেলার পাবলম্বন করেছেন বলে বিস্মিত হবার কিছু নেই। কমনগ্রাউন্ড লেখেন: আপনি হয়তো কাউকে আঘাত করতে চাচ্ছেন না, কিন্তু যে উপায়ে আপনার প্রকাশের ধরন, প্রকাশের মিডিয়া বা মেসেজ তাদের পছন্দ না হয়, তবে সেটা আপনি করেেত পারেন না, সেটা অবদমনের পর্যায়ে পড়ে। নিজেকে প্রকাশের নিয়ন্ত্রণ।

আমার বাবা টেকনো পছন্দ করেন না, তাই বলে আমরা সব মিউজিক নিষিদ্ধ ঘোষণা করবো? ক্যামেরন1 লেখেন: ব্রিক লেন এশিয়ানদেরকে এখানে বিষয়টি নিয়ে কমেন্ট করতে দেখা যাচ্ছে না কারণ, তারা মনে করে তাদের কমু্যনিটি সমালোচনার ঊধের্্ব... তাছাড়া, তাদের অধিকাংশই তেমন শিতি নয়... কার্ল হাঙ্গাস লেখেন: আমি বাঙালি সিলেটি... কমু্যনিটি সমালোচনার উধের্্ব নিজেদের ভাবে_ এরকম মন্তব্য একান্তই শাদা-চামড়া প্রসূত... ওল্ডসাইনিক লেখেন: আমি বাঙালি নারী, পূর্বপুরুষ সিলেটের। ব্রিক লেন আমি পড়িনি কারণ, এশিয়ার পদদলিত নারীসমাজ আর তাদের মতায়ন নিয়ে লেখা কোনো বই আর ভাল লাগে না। এশিয়ার নারী লেখকগণ এটাকে বই বিক্রির একটা স্ট্র্যাটেজি হিসাবে ব্যবহার করেন। প্রাচ্যের এসব কালচার আর পশ্চাদপদতার কাহিনী পড়তে পশ্চিমারা ভালোবাসেন। এজন্য অরুন্ধতী রায়, ঝুম্পা লাহিড়ী, অ্যামি ট্যানদের বই আর সহ্য হয় না... থারা লেখেন: যারা লেখালেখি করেন, সত্য প্রকাশের একটা দায়ভার তাদের থাকে।

কেবলমাত্র 'ফ্রিডম অব স্পিচ'-এর আড়ালে লুকিয়ে আত্মরা করা বড় কথা নয়। আমি বিশ্বাস করি, ব্রিক লেনে কেবলমাত্র বড় দাগে ইউকে-তে সিলেটি বাংলাদেশিদের অনুভূতি বর্ণনা করা হয়েছে। ইস্ট এন্ডে সেকু্যলার বনাম মূল ইসলামের দ্বন্দ্বের মতো ভাসাভাসা বিষয়ে সামান্য আলোকপাত করা হয়েছে। বাস্তবিকই ঢাকাইয়া আর সিলেটিদের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। বৃটিশ বাংলাদেশি কমু্যনিটিতে সংখ্যালঘু ঢাকাইয়ারা (নন-সিলেটি) সংখ্যাগরিষ্ট সিলেটিদের সহ্য করতে পারে না।

অনেক সিলেটি প্রবাসী গণ্ডগ্রাম থেকে এসেছে, অথচ তাদের উত্তরসূরীরা ক্রমাগত ব্যবসা, চাকুরি ইত্যাদি েেত্র উন্নতি করছে, মিডিয়াতেও একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখেছে (উদাহরণস্বরূপ চ্যানেল-এস, এস দিয়ে সিলেট)। নন-সিলেটি ঢাকাইয়ারা, যারা নিজেদের এলিট মনে করে, নিজেদের এমন অবস্থা সহ্য করতে পারে না, তারা এমনকি ভুলে যায় যে, বৃটেনে এসেছে তারা এইতো কদিন আগে। অনেক ঢাকাইয়া প্রবাসীই ছাত্র, যারা দেদারসে খরচও করতে পারে না। ফলত তারা ঈর্ষাকাতর। মনিকা আলি স্রেফ একজন এথনিক রাইটার, বহুমাত্রিক সমাজে কেবল পা দিয়েছেন।

তাছাড়া, সমালোচনা হলে বিক্রি বাড়ে। মেডগার্ল লেখেন: প্রিয় থারা, যারা ফিকশন লেখে, সত্য প্রকাশের দায়বোধ তারা করে না। বাইটদ্যহ্যান্ড লেখেন: প্রথমে বই সম্পর্কে বলি, মায়েভ কেনেডি 28 জুলাই গার্ডিয়ানে লিখেছেন, 'প্রথম 5 চ্যাপ্টারের উপর ভিত্তি করে গ্র্যান্টা ম্যাগাজিনের বেস্ট ইয়াং বৃটিশ নভেলিস্ট খেতাব প্রাপ্তির দৌড়ে এগিয়ে যান আলি। পরে প্রকাশনা সংস্থা ডাবলডে-র সঙ্গে তিন লাখ কপি প্রকাশের জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। তাকে অনেক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পার পেতে হয়েছে।

বইটি সাহিত্য সমালোচনা এবং জনপ্রিয়তা দুই দিক থেকেই সফল। বুকারসহ প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ পুরষ্কারের জন্যই বইটি মনোনীত হয়, অনেক পুরষ্কার লাভও করে। ' অতএব জুসি এবয় অন্যরা, আপনাদের সাহিত্য সমালোচনার বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক কম। অনেক সমালোচক বইটি না পড়লেও, ক্যাম্পেইন অ্যাগেইনস্ট মনিকা আলিস ফিল্ম ব্রিক লেন-এর নেতা আবদুস সালিক বইটি বাংলা ইংরেজি দুই ভাষাতেই পড়েছেন। তিনি বলেন, 'তার সঙ্গে আমার সাাৎ হয়নি, আমি করতেও চাই না।

সেতো আমাদের কেউ না। এখন সে এখানে আসতে চাইলে আমার দিক থেকে কোনো সমস্যা নেই। আমি ভদ্রলোক, কিন্তু এখানকার জনগণ এখন উত্তপ্ত, তাই তার নিরাপত্তা আমি নিশ্চিত করতে পারছি না। ' মিস্টার সালিক এও বলেছেন, 'বাকস্বাধীনতা যদি তার (আলির) অধিকার হয়, তবে আমাদেরও তার বই পুড়ে ফেলার অধিকার আছে। ' 24 জুলাই গার্ডিয়ানে প্রকাশিত জার্মেইন গ্রিয়ারের (1939-) আর্টিকেল লেখকরা বিশ্বাসঘাতক; তারা আপনাকে লুকিয়ে আপনার সম্পর্কে এমন ভাষায় লেখবে যে আপনি বুঝতেই পারবেন না।

আপনার বাস্তবতা সে নেবে, রুজ্জুটা টেনে নেবে, শেষে বুনবে নিজের মতো করে, যা আপনার বাস্তবতার চেয়েও বাস্তব, কেননা, ওটা টেক্সট। টেক্সট অনেক ক্যারেক্টার মিলে তৈরি। একেকটা ক্যারেক্টার যেন পাথরে খোদাই করা। একবার আপনি চিত্রিত হলে সেটা চিরস্থায়ী; কিন্তু এই চিরস্থায়ীত্ব আপনার নয়। প্রত্যেক ব্যক্তি বা কমু্যনিটি, যাদের নিয়ে লেখা হয়, সবারই একইরকম অস্বীকৃতি, অনুপ্রবেশ আর প্রতারণার অনুভূতি হয়।

2003 সালের জুনে হ্যারিয়েট লেন-এর নেয়া মনিকার সাাৎকার থেকে জানা যায়, ব্রিক লেন রচনার সময়ই "তিনি সচেতন ছিলেন যে, তার অবস্থান আসলে দুটো কালচার থেকেই দূরে। " প্রকৃতপ,ে আলির অবস্থান বৃটিশ কালচারের কাছাকাছি। বাংলা একরকম ভুলেই গেছে আলি। বোল্টনের জন্ম নেয়া আলির মা এক ড্যান্স পার্টিতে দেখা পান আলির বাবার, তাকে ফলো করে বাংলাদেশ অব্দি যান। আলির বাবা ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে তার চাকুরিতে যোগদানের জন্য বাংলাদেশে ফেরেন, এখানেই তাদের বিয়ে হয়।

71 সালে তিন বছর বয়সী মনিকা বাবা-মার সঙ্গে পাড়ি জমায় বৃটেনে। প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, কষ্ট তার লেখায় সত্য হয়ে দেখা দেয়। 2003 সালে জন্মভূমিতে ফিরতে চাইলে বাংলাদেশি হাই কমিশন ভিসা রিফিউজ করে। নিদারুণ তিক্ত অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে, দেশে ফেরা হয়তো তার চেয়েও বেশিই। ব্রিক লেন 46 সপ্তাহেরও বেশি সময় বেস্টসেলার ছিলো, দেড় লাখেরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে।

এসবের কিছুই সম্ভব হতো না যদি আলি নিজে বাঙালিত্বের একটা নিজস্ব ধরণ তৈরি করতে না পারতেন। একজন বৃটিশ রাইটার হিসাবে, তিনি ভালো করেই জানেন, বৃটিশ শ্রোতার কাছে কোনটা একটু ব্যতিক্রমী কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে। একজন লেখক বলতেই পারেন, সৃষ্ট ক্যারেক্টারদের প্রতি তার আছে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা। আলি ভাবতেই পারেননি, তার সৃষ্ট প্লটের সঙ্গে বাস্তব ব্রিক লেন কালচারের অনেক অসঙ্গতি থাকবে। যেহেতু বাংলাদেশিদের নিয়ে বৃটিশরা খুব কমই জানে, জানার চেষ্টাও করে কম, তাই ইংরেজি নভেলে বাংলাদেশি ক্যারেক্টার সাড়া জাগাতে সম হবে।

তার বাবা বাংলাদেশি_ এ-তথ্যই নন-এশিয়ান বৃটিশদের কাছে বাংলাদেশিদের নিয়ে তার লেখার অথরিটি প্রমাণের জন্য যথেষ্ট, কিন্তু বৃটিশ বাংলাদেশিদের কাছে মোটেও নয়। ব্রিক লেনের অস্তিত্ব বাস্তব, মনিকাকে সেটা আবিষ্কার করতে হয়নি। পরিচিত একটা নির্দিষ্ট নাম ব্যবহার করে সেখানে বিরাজমান ছাছে ঢালা পরিস্থিতির কৃয়েটিভ রূপায়ন করতে পেরেছেন। বাঙালি ক্যারেক্টার পেয়ে ইংরেজরা খুশি হলেও সেখানকার অধিবাসী সিলেটিদের কাছে ওইসব ক্যারেক্টার অপরিচিত। ইসলামী সংস্কৃতির মধ্যে ধর্মচু্যত, বিশৃঙ্খল ক্যারেক্টার, পবিত্রের মধ্যে অপবিত্র ক্যারেক্টার দেখে বাঙালি মুসলমানের কষ্ট হওয়া স্বাভাবিক।

আর একজন মুসলিম নামধারী প্রো-বাঙাল লেখিকা এইসবই তুলে ধরছে। যাদের নিজের ভাণ্ডার খুব সমৃদ্ধ নয়, আত্মাভিমান তাদের জন্য ভয়ংকর। ব্রিক লেন নভেল লিখতে গিয়ে আলিকে প্রকৃত ব্রিক লেনে সময় দিতে হয়নি। ফিল্ম ভিন্ন ব্যাপার; বাস্তব ব্রিক লেনে নভেলটির চলচ্চিত্রায়ণ করার জন্য অনুমতি নেয়া হচ্ছে। ফিল্ম মেকারদের হটিয়ে দেয়া অধিকার কমু্যনিটির লোকজনের আছে, কিন্তু অন্য কোথাও শুটিং করে সেটা ব্রিক লেন হিসাবে চালিয়ে দিলে তাদের কিছুই করার থাকবে না।

এসব েেত্র, নিজেদের নভেল এবং নিজেদের সিনেমা নিজেরা বানানোই একমাত্র প্রতিষেধক। ভুল উপস্থাপন কষ্ট দেয় সত্য, কিন্তু ভুল উপস্থাপন ছাড়া প্রকৃত উপস্থাপনও হয় না। কৃষক কখনো তীরন্দাজের কথা শোনে না। আংলাদেশি ব্রাইটনদের উচিত হবে, ব্রিক লেন না পড়া, এবং এর সিনেমারূপ না দেখা। জার্মেইন গ্রিয়ারের আর্টিকেলের প্রতিক্রিয়ায় সালমান রুশদি, লন্ডন মনিকা আলির ব্রিক লেন নভেলের প্রস্তাবিত চলচ্চিত্ররূপায়ন প্রসঙ্গে 24 জুলাই গার্ডিয়ানে প্রকাশিত জার্মেইন গ্রিয়ারের আর্টিকেল অজ্ঞতা (তিনি আসলে বিশ্বাস করেন, এটাই লন্ডনের বাংলাদেশিদের নিয়ে প্রথম চলচ্চিত্র, আর এটাও জানেন না, ব্রিক লেনের এশিয়ান একটা বড় অংশ চায় এটা হোক); প্রো-সেন্সরশিপ বাতুলতা (না, কেবলমাত্র প্রস্তাবিত চলচ্চিত্রটি তাদের পছন্দ হবে না, এ-যুক্তিতে একটি সিনেমা বানানোর প্রক্রিয়া বন্ধ করার 'মোরাল রাইট' মানুষের নেই); আর মনিকার প্রতি নারীসুলভ ঈর্ষাকাতরতার মিশেল।

ফিল্মের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প েগ্রিয়ারের সাফাই অশিতি, বকধার্মিক লোকের মতো লজ্জাকর, যদিও এটা অপ্রত্যাশিত নয়। এরকম তিনি আগেও করেছেন, আমার স্পষ্ট মনে পড়ে। আমার 'স্যাটানিক ভার্সাস'-এর বিরুদ্ধে আক্রমণের চূড়ান্ত অবস্থায়ও তিনি বলেছেন, 'তার নিজস্ব সমস্যা নিয়ে লেখা বইয়ের প েপিটিশনে আমি সাইন করবো না। ' তিনি আমাকে, "আত্মম্ভরী, কালো চামড়ার ইংরেজ" বলেও কটা করেছেন। এবার মনিকার পালা।

গ্রিয়ার বলেছেন, "লেখকরা বিশ্বাসঘাতক"; তারই এটা জানা উচিত। জার্মেইন গ্রিয়ারের আর্টিকেলের প্রতিক্রিয়ায় ভিভিয়ান আরচার, লন্ডন ব্রিক লেনের কিছু আত্ম-প্রচারকারীদের প্রতিবাদের প েকেন বলতে এলেন জার্মেইন গ্রিয়ার? ইস্ট লন্ডনের একজন অধিবাসী হিসাবে আমার বিশ্বাই হচ্ছে না, মনিকা আলির বই এবং এর উপর ভিত্তি তরে নির্মানাধীন ফিল্ম-এর আপত্তিকর অংশ নিয়ে বিােভকারীরা ব্রিক লেনের মতো বহুজাতির মিশ্র একটি অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করে। প্রথম প্রকাশের সময় ব্রিক লেন নভেল দিয়ে পয়সা বানাতে চেয়েছে ছোট্ট একটা গ্রুপ। খুব অল্প সংখ্যক লোকই বইটা পড়েছে। এখনইবা কজন পড়ছে? গ্রিয়ারের উপদেশ মোতাবেক বইটি না পড়লে কিংবা নির্মিতব্য ছবিটি না দেখলে, বই বা ছবি বিষয়ে কমেন্ট করার অধিকার তারা হারাবে।

পুলক্সহিল, বের্ডফোর্ডশায়ার থেকে জন সিং-এর প্রতিক্রিয়া ব্রিক লেন নিয়ে বর্তমান বিতর্ক প্রসঙ্গে আপনার আর্টিকেল মূল সমস্যার গভীরে প্রবেশ করতে পারেনি বলে আমার মনে হয়। মূল সমস্যা আমার মতে, খুব বাজে গবেষণার ফল হওয়া সত্বেও সাহিত্যের সমালোচকরা একটি নভেলের বিষয়বস্তুর সাহিত্যগুণ এবং পাঠ্যগুণের কারণে খুব তাড়াতাড়ি প্রশংসা করে বসেন। সন্দেহ নেই, সমালোচকরা ভালো বিশ্বাস নিয়েই প্রশংসা করেন, তবুও এটা দুঃখজনক যে, তারাও ওই কালচার লাইফস্টাইল ইত্যাদি নিয়ে লেখকের মতোই কম জানেন। কিছু কিছূ েেত্র নভেলটির আখ্যানভাগকে ড্যান ব্রাউনের ডা ভিঞ্চি কোডের সঙ্গে তূলনা করা যেতে পারে, কাল্পনিক অথচ সারবস্তুর অসারতা। জনগণের ব্যাগ্র উত্তেজনায় অবশ্যই বইটি বাজেয়াপ্ত বা এর চলচ্চিত্রায়ণ বন্ধ হতে পারে না, তবে আশা করা যায়, এর ফলে সাহিত্য সমালোচকরা তাদের মন্তব্য করার আগে আরো একটু বেশি চিন্তাভাবনা করবেন, আরো বেশি ইনফরমেশন নেবেন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.