জলের মেয়ে জলে থাকো, স্থলে আমার বাস । তোমায় ভুলে মন দিয়েছি, তাই ভুলের সাথে বাস । ১.
রাস্তা পার হতে যাবে এমন সময় শিহাব এর নাম ধরে কেউ ডাকল । পেছনে ফিরে কে ডাকছে বুঝে উঠতে অনেকটা সময় লাগে শিহাবের । যে দাঁড়িয়ে আছে তার এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কথা না ।
তাঁর সাথে এভাবে দেখা হওয়ার কথা শিহাব স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি কোনদিন । তবে এরকম ঘটনা আগেও ঘটেছিল একবার । সেটা প্রায় দশ বছর আগের ঘটনা ।
শিহাব কে রোবটের মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পাতা নিজেই শিহাবের দিকে এগিয়ে যায় । পাতা শিহাবের কাছে এসে মুচকি হেসে বলল,
“কিরে ভুত দেখার মত চমকে উঠলি মনে হয় ? ভুলে যাসনি তো আবার ? চিনতে পারছিস তো আমাকে ?”
“কেমন আছিস পাতা ?”
“ভাল আছি ।
তুই কেমন আছিস ?”
“আমিও ভাল আছি” বলতে গিয়ে শিহাবের গলাটা কেমন যেন কেঁপে উঠল । পাতা যাতে বুঝতে না পারে তাই শিহাব সাথে সাথেই বলল, “তারপর এতদিন পর ?”
পাতা শিহাবের উত্তর না দিয়ে বলল, “সেই কখন থেকে তোকে ফলো করছি জানিস ? কোনভাবেই শিউর হতে পারছিলাম না তুই কিনা ? অনেক বদলে গেছিস তুই – খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে গাল ভাঙ্গা চেহারার সাথে আগের শিহাব কে কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না । ”
বহুদিন পরে আবার সেই মুগ্ধ করা হাসি দেখতে পেল শিহাব । শিহাব হেসে বলল, “দশ বছর অনেক সময়, তুইও তো বদলে গেছিস অনেক । ”
“উঁহু, আমি একটুও বদলায়নি ।
হাইট বেড়েছে হয়তো দু’ এক ইঞ্চি । কিন্তু তোর হাইট তো প্রায় আট দশ ইঞ্চি বেড়ে গেছে । আর চাপা ভেঙ্গে চেহারার কি অবস্থা করেছিস তুই ? বউ ঠিকমত সেবাযত্ন করে না বুঝি ?”
কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে আবারও হাসতে থাকে পাতা ।
পাতার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে শিহাব । অনেক প্রশ্ন ভিড় করে তাঁর মনে ।
কিন্তু পাতাকে সে কোন প্রশ্নই করতে পারে না । সব প্রশ্নকে সে একপাশে রেখে পাতার দিকে তাকিয়ে থাকে ।
পাতাকে খুব সুন্দর লাগছে । পাতার গায়ে নীল রঙের শাড়ি, তার সাথে দু' হাত ভর্তি নীল চুড়ি, আর কপালে নীল টিপ । পাতাকে দেখে মনে হচ্ছে আকাশের মেয়ে পথ ভুল করে আকাশ থেকে মাটিতে নেমে এসেছে ।
“কিরে কথা বলছিস না কেন ? আচ্ছা, তুই কি ফ্রি আছিস ?”
“পুরো সপ্তাহ ধরেই ফ্রি আছি, হেসে উত্তর দিল শিহাব । ”
“ছুটি নিয়েছিস নাকি ?”
“নাহ, চাকরিই ছেড়ে দিছি । ”
“ও মা ! চাকরি ছেড়েছিস কেন ?”
“এক চাকরি বেশী দিন ভাল লাগে না । তাই পাঁচ ছয় মাস পরপরেই চাঁকরি খুজতে হয় । ”
“এখনো আগের মতই আছিস ?”
“নাহ, আগের মত নাই ।
অনেক বড় হয়েছি, অনেক বদলে গেছি । তোর কি খবর বল ?”
“এইতো যেমন দেখছিস তেমনি আছি । আচ্ছা চল না কোথাও গিয়ে বসি । চল না রমনা পার্কে যাই । নৌকায় চড়ি না অনেক দিন ।
”
“অন্য কোথাও গেলে হয় না ?”
“কেন ? রমনায় গেলে সমস্যা কি ?”
“না কিছু না, চল । ”
রিকশায় উঠে শিহাবের কেমন জানি অস্বস্তি হতে থাকে খুব । জড়সড় হয়ে চুপ করে বসে থাকে ও । ও কে এভাবে চুপ করে বসে থাকতে দেখে পাতা জিজ্ঞেস করল, “কিরে তুই কি কিছু ভাবছিস ?”
“না, কিছু ভাবছি না । ”
“তাহলে এমন ভ্যাবলা মার্কা মুখ করে রেখেছিস কেন ?”
“শরীর তেমন একটা ভাল না, বেশ কদিন ধরেই জ্বর”, বলেই শিহাব বুঝতে পারল ভুল যা করার করে ফেলেছে ।
পাতা সাথে সাথে তার কপালে হাত দিয়ে বলল, “তোর তো বেশ ভাল জ্বর রে, এখনো তো মনে হয় একশ এক দুই হবে । ”
“ঠিক হয়ে যাবে ব্যপার না । ভাইরাস জ্বর ছয় সাতদিন পরেই সেরে যাবে । ”
শিহাবের সবকিছু কেমন যেন অন্যরকম লাগে । মনে হতে থাকে সে কোন স্বপ্নের মধ্যে আছে, ঠিক স্বপ্ন না তার কেমন জানি মনে হয় যে সে তার অতীতের কোন স্মৃতির মধ্যে আছে ।
তার মনের মধ্যে জড়ো হওয়া প্রশ্নগুলোর উত্তর সে নিজেই খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে ।
২.
আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগের কথা । শিহাব আর পাতা তখন সবে মাত্র দশম শ্রেণীতে উঠেছে । শিহাব রোজকার মত স্কুল পালিয়ে, রাস্তার পাশের দোকানটা থেকে দাদাগিরি দেখানোর জন্য চার টাকা দিয়ে একটা বেনসন কিনেছে । সিগারেটে আগুন ধরিয়ে সে যথাসম্ভব মুরুব্বীয়ানা দেখিয়ে সিগারেটটা বীরদর্পে ফুকে যাচ্ছে ।
স্কুলের ড্রেস পড়া অবস্থায় সিগারেট খাওয়ার যে একটা নিষিদ্ধ আনন্দ আছে, সেটা যারা খায় নি তারা কখনো বুঝতে পারবে না । দু’ তিন দিন ধরেই পাতা স্কুলে আসছে না । অসুখ বিসুখ হল কিনা কে জানে ? সিগারেটটা ফেলে দিয়ে রাস্তা পার হতে যাবে এমন সময় শিহাবের নাম ধরে কেউ ডাকল । পেছনে ফিরে শিহাব দেখল পাতা দাঁড়িয়ে আছে ।
“কিরে তুই ! আমি এই মাত্র তোর কথা ভাবছিলাম ।
ভাবছিলাম তোর আবার অসুখ বিসুখ হল কিনা ?”
“না আমার অসুখ বিসুখ হয় নি, এমনিতেই স্কুলে আসি নি কয়েকদিন । ”
পাতা যে কিছু লুকিয়ে যাচ্ছে তা বেশ বুঝতে পারে শিহাব । পাতাকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করতে যাবে ঠিক এমন সময় পাতার দিকে ভালমত তাকিয়ে শিহাব বোকা বনে যায় । পাতা একটা নীল শাড়ি পড়ে আছে, তার সাথে দু’ হাত ভর্তি নীল চুড়ি আর কপালে নীল টিপ । পাতাকে দেখে মনে হচ্ছে আকাশের মেয়ে ভুল করে আকাশ থেকে মাটিতে নেমে এসেছে ।
শিহাব কে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে পাতা জিজ্ঞেস করল,
“কিরে হা করে তাকিয়ে কি দেখছিস ?”
“তুই আজ শাড়ি পড়েছিস কেন ?”
“আমি আজ সারাদিন ঘুরে বেড়াব, তুই তো স্কুল পালিয়ে এসেছিস, তার মানে বিকাল পর্যন্ত তুই ফ্রি । চল রমনা পার্কে যাব । নৌকা চালাব অনেকক্ষণ । ”
“অন্য কোথাও গেলে হয় না ?”
“কেন ? রমনা পার্কে গেলে সমস্যা কি ?”
“না কিছু না, চল । ”
রিকশায় শিহাবকে চুপ করে থাকতে দেখে পাতা জিজ্ঞেস করল,
“কিরে তুই কি কিছু ভাবছিস ?”
“না, কিছু ভাবছি না ।
”
“তাহলে এমন ভ্যাবলা মার্কা মুখ করে রেখেছিস কেন ?”
“শরীর তেমন একটা ভাল না , বেশ কদিন ধরেই জ্বর”, বলেই শিহাব বুঝতে পারল ভুল যা করার করে ফেলেছে । এখনোই মেয়েটা রাস্তার সবার সামনে ওর গায়ে হাত দিবে । আর লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছা করবে শিহাবের । এই ব্যাপারটা শিহাবের খুবই অপছন্দ ।
পাতা যেন গায়ে হাত দেয়ার অপেক্ষাতেই ছিল ।
জ্বর শোনার সাথে সাথে সে শিহাবের কপালে হাত দিয়ে বলল, “তোর তো বেশ ভাল জ্বর রে, এখনো তো মনে হয় একশ এক দুই হবে । ”
“ঠিক হয়ে যাবে ব্যাপার না । ভাইরাস জ্বর ছয় সাতদিন পরেই সেরে যাবে । ”
“ঠিক হয়ে যাবে না কচু, তোকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে । ”
এবার চরম পর্যায়ের বিরক্ত হয়ে শিহাব বলল, “আমার জ্বর ভাল না হলে তোর কি ? তোর এত মাথা ব্যাথা কিসের ? আর তোকে একশ দিন মানা করছি না যে সবার সামনে গায়ে হাত দিবি না ।
তারপরও আমাকে ক্ষেপানোর জন্য কথায় কথায় থাপ্পর দিস, গায়ে হাত দিস । এগুলা কোন ধরণের ভদ্রতা ?”
পাতা হাসি চেপে বলে, “আচ্ছা, দোস্ত । আর কোনদিন তোর গায়ে হাত দিব না । ”
শিহাব পাতার হাসি চেপে রাখা দেখে আরও বিরক্ত হয় । রাগে তার গা জ্বলতে থাকে ।
সে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকে ।
শিহাব জানে তার এই রাগ বেশীক্ষণ থাকবে না । এই মেয়েটার উপর কেন জানি সে রাগ করে থাকতে পারে না । মেয়েটা তাকে অনেক বিরক্ত করে, ক্ষেপায় । তারপরেও এই মেয়েটাকে তার অনেক ভাল লাগে ।
যেদিন পাতা স্কুলে যায় না সেদিন সে ফার্স্ট ক্লাসেই পালিয়ে যায় । পাতা থাকলে পাতার সাথে টিফিন করে তারপর সে স্কুল পালায় । স্কুল পালানোর পরেও তার রেসাল্ট ভাল শুধু এই মেয়েটার জন্যেই । জমে থাকা সব পড়া পরীক্ষার আগে বুঝতে বসার আগেই এই মেয়ে এসে সব কিছু তাকে বুঝিয়ে দিয়ে যায় । রেসাল্ট ভাল বলে বাসায়ও সব বাঁদরামো সহ্য করে যান বাবা মা ।
পাতা না থাকলে আসলেই খবর ছিল তার ।
“জাহাপনা, আমরা আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌছে গেছি, কষ্ট করে আপনি যদি একটু নেমে দাঁড়াতেন তাহলে কৃতার্থ হতাম । ”
পাতার কথায় কল্পনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসে শিহাব । কপট রাগের ভাব ধরে রিকশা থেকে নামে । পকেট থেকে দশ টাকার একটা নোট রিকশাওয়ালা কে দিয়ে শিহাব পাতার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে ।
পাতা শাড়ি গুছিয়ে রিকশা থেকে নামতে বেশ সময় নেয় । আর এই সুময়টুকু শিহাব মুগ্ধ নয়নে পাতার দিকে চেয়ে থাকে । কি সুন্দর লাগছে আজ মেয়েটাকে !
পাতা ওদের প্যাডেল বোটটা ঠিক লেকের মাঝখান দিয়ে চালাচ্ছে । শিহাব চালাতে চেয়েছিল, কিন্তু পাতা ওকে ধমক দিয়ে বসিয়ে রেখেছে । প্রথমদিকে বেশ হাসিখুশি ভাবে নৌকা চালালেও এখন কেমন যেন আনমনে চালাচ্ছে ।
হঠাৎ নৌকা চালানো বন্ধ করে দিয়ে পাতা শিহাব কে বলল,
“জানিস, আমার আজ বিয়ে । আমার ফুপাতো ভাইয়ের সাথে । আজ ঘরোয়া ভাবে বিয়ে পড়িয়ে রাখবে, পড়ে অনুষ্ঠান করে তুলে নিয়ে যাবে । ”
শিহাব কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখল তার চোখ ভিজে গেছে । তার খুব লজ্জা করতে থাকল একটা মেয়ের সামনে এভাবে কেঁদে ফেলাটা ঠিক হচ্ছে না ।
পাতা তো বিয়ের কথা ফাজলামো করেও বলতে পারে । আচ্ছা সত্যি হোক বা মিথ্যে হোক তার চোখ দিয়ে এভাবে পানি পড়ছে কেন ? তার বুকের ভেতর এত কষ্ট হচ্ছে কেন ? আচ্ছা সে কি পাতাকে ভালবাসতে শুরু করেছে ? তাই বা কি করে হয় ? সে তো পাতা কে কখনো ওভাবে দেখে নি । সে আর পাতা তো পার্কের বেঞ্চে একসাথে হাত ধরে বসেও থাকেনি কোনদিন । আর পাতা তো তাকে ভালবাসার কথা বলা দূরে থাক, কখনো তুই তোকারি ছাড়া কথা বলে দেখে নি । সে যে একেবারে ছেড়ে কথা বলেছে তাও না ।
সবই তো ঠিক আছে, কিন্তু ভালবাসার কোন কিছু তো তাদের মধ্যে ঘটে নি তাহলে আজ পাতার বিয়ের কথা শুনে তার এত কষ্ট হচ্ছে কেন ? কেন এমন হচ্ছে ? তাও ভাল মেয়েটা অন্য দিকে তাকিয়ে আছে । নইলে শিহাবের চোখের পানি দেখে কি না কি মনে করত !
শিহাব নিজেকে সামলে নিয়ে বেশ কিছুক্ষন পর বলল, “ ভাল তো । ”
ওর কথা শুনে পাতা ওর দিকে ফিরে তাকাল । পাতার চোখের দিকে তাকিয়ে শিহাবের বুকের ভেতর আবার কষ্ট হতে শুরু করল । সে তাড়াতাড়ি মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল ।
তার চোখের জল আর যাকেই হোক অন্তত এই মানুষটাকে শিহাব দেখাতে চায় না ।
নৌকা থেকে নেমে একটা বেঞ্চে বসে দুজন দু’দিকে তাকিয়ে থাকে । ওদের চুপ করে বসে থাকা দেখে বাদাম-ঝালমুড়ি ওয়ালা কেউই ওদের বিরক্ত করতে সাহস পায় না ।
অনেক কষ্ট করে শিহাব গলা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল,
“তোর সাথে কি আর তাহলে দেখা হবে না ?”
পাতা ক্ষীণ স্বরে বলল, “জানি না । ”
শত চেষ্টা করেও দীর্ঘশ্বাসটা পাতার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না শিহাব ।
পাতা শিহাবকে জিজ্ঞেস করল, “তোর কি কিছু বলার আছে । ”
“ নাহ । ”
“তুই কিছু বলতে চাইলে বলতে পারিস, তোর বলাতে হয়তো কোনকিছু চেঞ্জ হবে না । কিন্তু তোর এই বলাতে কেউ হয়তো একটু শান্তি পাবে, একটু সান্ত্বনা পাবে । কি, কিছু বলবি ? ”
শিহাব কোন উত্তর দেয় না ।
সে চুপ করে বসে থাকে । শিহাব বুঝতে পারে তাদের এই অনুভূতিটির নামই ভালবাসা । এত কম বয়সে হয়তো ভালবাসা ব্যাপারটা উপলব্ধি করা স্বাভাবিক না । কিন্তু তারপরেও ভালবাসা বুঝতে সমস্যা হয় না একটুও । শিহাবের অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করে পাতাকে ।
কিন্তু বলে কি লাভ ? ভালবাসার মানুষটিকে আটকে রাখার ক্ষমতা তো তার নেই । বলতে গেলে বরং তার কথা শুনে পাতা হয়তো আরও বেশী কষ্ট পাবে । তার চেয়ে তার সম্পর্কে ভুল ধারণা নিয়েই পাতা তার নতুন জীবন শুরু করুক ।
অনেকক্ষণ পর পাতা উঠে দাঁড়াল । শিহাবের দিকে না তাকিয়েই বলল, “ভালো থাকিস ।
”
বলেই হাঁটতে শুরু করল পাতা ।
শিহাবের ইচ্ছে করল পাতার হাতটা ধরে ওকে থামিয়ে দিতে, সবার সামনে নির্লজ্জের মত পাতার হাতটা ধরে পাশাপাশি বসে থাকতে ।
কিন্তু সেসবের কিছুই তার করা হয় না । কারা যেন শিহাবের হাতে পায়ে অদৃশ্য শেকল পড়িয়ে দিয়েছে । শিহাব একফোটা নড়তে পারে না ।
সে শুধু পাতার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে । সে শুধু ভাবতে থাকে, তার সবকিছুর অর্ধেকটা নিয়ে পাতা কি সহজেই না দূরে সরে যাচ্ছে ! ভাবতে ভাবতেই তার চোখ আবার ভিজে যায় । ভিজুক, এখন চোখের জলে বন্যা হয়ে গেলেও কোন সমস্যা নেই । তার ভালবাসার মানুষটা তো আর দেখতে পাবে না । তাই গোধূলির আলো মিলিয়ে যাবার পরেও অনেকটা সময় ধরে নিশ্চিন্তে কাদতে থাকে শিহাব ।
আর আট দশটা ছেলের মতই হয়তো শিহাবের জীবনটা স্বাভাবিক হয়ে যেত । কিন্তু একটা মৃত্যু তার সবকিছুকে এলোমেলো করে দেয় ।
সে রাতেই পাতা আত্মহত্যা করে । মনকে সান্ত্বনা দেয়ার মত কোন কিছুই অবশিষ্ট থাকে না শিহাবের কাছে । আত্মহত্যা করে না শিহাব ঠিকই কিন্তু দিন-রাতের কোন হিসেব থাকে না তার কাছে ।
শিহাবের বাবা মা শেষ পর্যন্ত ছেলের এরকম অবস্থা দেখে সহ্য না করতে পেরে কোন এক দুপুরে মানসিক হাসপাতালে রেখে আসেন । শিহাব সুস্থ্য হয়ে ফেরে ঠিকই কিন্তু সেই পুরনো শিহাব আর ফিরে আসে না ।
৩.
“জাহাপনা, আমরা আমাদের গন্তব্যস্থলে পৌছে গেছি, কষ্ট করে আপনি যদি একটু নেমে দাঁড়াতেন তাহলে কৃতার্থ হতাম । ”
পাতার কথায় হঠাৎ বাস্তবে ফিরে আসে শিহাব । রিকশা থেকে নেমে শিহাব পাতার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে ।
পাতা শাড়ি গুছিয়ে রিকশা থেকে নামতে বেশ সময় নেয় । আর এই সময়টুকু শিহাব মুগ্ধ নয়নে পাতার দিকে চেয়ে থাকে । কি সুন্দর লাগছে আজ পাতাকে !
পাতা আর শিহাব সেই দশ বছর আগের বেঞ্চটিতে গিয়ে বসে । অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর পাতা শিহাবকে বলল,
“তোর মনে হয়তো অনেক প্রশ্ন জড়ো হয়েছে আমাকে ঘিরে । ”
পাতার কথার মাঝখানে শিহাব বাধা দিয়ে বলল, “আমি কোন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাই না ।
আমি কোথায় আছি ? কিভাবে আছি ? এসবের কিছুই আমি জানতে চাই না । আমি শুধু এই বেঞ্চটাতে তোর পাশে বসে সারাটা জীবন পার করে দিতে চাই । ”
পাতা শিহাবের দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে ।
বেশ কিছুক্ষন চুপচাপ পাশাপাশি বসে থাকে দুজন ।
পাতা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমাকে এখন যেতে হবে শিহাব, ভালো থাকিস ।
”
একটা মুহুর্ত দেরী না করে শিহাব পাতার হাতটা ধরে বলল, “এক ভুল আমি বারবার করতে পারব না, পাতা । এই ভুলের জন্য যত মূল্য দিতে হয় আমি দেব, তারপরও তোকে আর দূরে সরে যেতে দেব না । ”
পরিশিষ্টঃ
এতক্ষন লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা শিহাব এইমাত্র পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে আকাশের ঠিকানায় পাড়ি জমাল । হয়তো সেটা স্বাভাবিক নিয়মেই, হয়তোবা ভালবাসার মানুষের খোঁজে । :-)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।