যদি নির্বাসন দাও.................................................................. আমি ওষ্ঠে অঙ্গুরী ছোঁয়াবো আমি বিষ পান করে মরে যাবো! বিষণ্ন আলোয় এই বাংলাদেশ নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ, প্রান্তরে দিগন্ত নির্নিমেষ- এ আমারই সাড়ে তিন হাত তুমি।
আমার মেয়ে রুমি। বয়স আট বছর। খুবই দুরন্ত আর ছটফটে। সকাল বেলা ওর চেঁচামেচিতে ঘর খুব সরগরম হয়ে ওঠে।
এই যেমন আজো মায়ের সাথে বায়না ধরেছে- এটা খাবোনা, ওটা বানাওনি কেন, মামার বাসায় কখন যাবে বলো...। এর মাঝে দু'বার এসে আমার বিরুদ্ধেঅভিযোগ পেশ করে গেছে- 'বাপি, তোমার জন্য আমার স্কুলের দেরী হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও। ' আমি হেসে সম্মতি জানাই। সকালবেলার চোটপাট শেষে ওকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি।
প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার পথে ওকে স্কুলে পৌঁছে দিই। স্কুটার থেকে নেমে ও বিশাল ওজনের ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে সহপাঠীদের সাথে হাসতে হাসতে ক্লাশে ঢুকে পড়ে। শেষমুহুর্তে পেছনে ফিরে আমার দিকে ছোট্ট হাতটি নেড়ে বাই জানাতে কখনো ভুল করে না। আমি ওর এই বিদায়ী সম্ভাষণটা খুব উপভোগ করি।
আজ হঠাৎ কেন জানি ফেলে আসা দিনগুলির কথা মনে পড়ছে।
আমার দুরন্ত শৈশবের পাঁচমিশালী দিনগুলো কেটেছে চিরসবুজ এক গ্রামে। যেখানে আকাশের অসীম নীল হাতছানি দিয়ে ডাকত সারাটা দুপুর, নদীর শীতল জল গভীর মমতায় ধুয়ে দিতো সারা শরীরের কান্তি, সবুজ ধান-খেতের আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে ঠিক পৌঁছে যাওয়া যেত দূর পাহাড়ের পাদদেশে, মন খারাপ করা কোন এক পড়ন্ত বিকেলে সাগর পাড়ে বসে কষ্টগুলোকে উড়িয়ে দেয়া যেত বিষন্ন সীগালের ডানার পালকে মেখে। স্কুল থেকে এসেই চলে যেতাম খেলার মাঠে। ফুটবল, ক্রিকেট হাডুডু, ডাংগুলি, বউচি কোনকিছুই বাদ রাখিনি। কখনো বা নদীর তীরে জমজমাট ফুটবল খেলার আসর বসাতাম।
মাঝে মাঝে স্কুলে যেতে ভালো লাগতো না। তখন খুব করে চাইতাম, একটু অসুখ করুক। জ্বর হওয়ার অজুহাতে কয়েকদিন স্কুল যাওয়ার যন্ত্রণা হতে রক্ষা পেতে কতবার ইচ্ছে করেই বৃষ্টিতে ভিজেছি! কিন্তু জ্বর আসেনি। সম্ভবত প্রকৃতি তার সন্তানদের এভাবেই আগলে রাখে। শীতের মৌসুমে পড়শীর গাছ থেকে রস চুরি করে খাওয়ার মজা ভুলতে পারিনি আজো।
বছরের শেষের দিকে মেলা বসত গ্রামে। আমরা সারাবছর ধরে সঞ্চয় করতাম সেই মেলার জন্য। উপরন্তু বাবা-মার কাছ থেকে কিছু বোনাস আদায়ের চেষ্টা। আহ! কি বর্ণিল ছিল সেই দিনগুলি। জ্যোৎস্নাভরা রাতে মায়ের কোলে শুয়ে রূপকথার গল্প শুনতাম।
শুনতে শুনেতে কখন যে গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতাম টেরই পেতাম না। স্বপ্নের রাজ্যে ডালিমকুমার হয়ে কতো রাজকন্যাকে যে উদ্ধার করেছি তার কোন ইয়ত্তা নেই। মাঝে মাঝে ভাবি- সেই সোনালি দিনগুলো যদি আবার ফিরে পেতাম!
গাড়ির হর্নে সম্বিত ফিরে পাই। ছুটে চলি অফিসে। বেশ কিছুক্ষণ ফাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করি।
না, আজ কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছি না। কেমন জানি নস্টালজিক হয়ে উঠেছে মনটা। দুপুর হলে ছুটি নিয়ে বাসায় ফিরে আসি। ঘরে ঢুকতেই দেখি- রুমি পা ছড়িয়ে দিয়ে কোলের উপর বই রেখে পড়া মুখস্থ করছে। আমাকে দেখে ও উল্লসিত হয়ে ওঠে আর শমর্ী একটু চিন্তাগ্রস্থ হয় অসময়ে আমার প্রত্যাবর্তনে।
'কি, শরীর খারাপ করেনি তো তোমার?' না, আমি ঠিক আছি বলে রুমির পাশে গিয়ে বসি। ওকে জিজ্ঞেস করি। মামণি, আজ স্কুলে কি পড়াল? রুমি এক বিশাল বর্ণনা দিতে থাকে আর আমি খুব আগ্রহভরে শুনতে থাকি। আমি বলি- মামণি স্কুল থেকে এসেই তো পড়ছো- চলো একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি। শমর্ী বাধা দিয়ে বলে- 'ও পড়ছে না।
এই রোদের মধ্যে বাইরে যাবে কি? বাইরে থেকেই তো এলো। ' আমি দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। একটু হাঁটব- ঘন সবুজ কোন রাস্তা দিয়ে এক চিলতে নীল আকাশ দেখতে দেখতে অনেকটা পথ একলা হেঁটে যাব। তেমন রাস্তা কি আছে কোথাও এই ব্যস্ত শহরে? হয়তো আছে, হয়তো নেই!!!
ঘন্টাখানেক পরে ফিরে আসি। রুমি তখন ওর মায়ের সাথে গানের ক্লাশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
এই সময় ওর প্রতিদিন নাচ, গান, আবৃত্তি, ড্রয়িং এসবরের কোন না কোন ক্লাশ থাকে। সেখান থেকে ফিরলেই ওকে বসতে হবে টিউটরের কাছে। তারপর গানের রেওয়াজ, নাচের প্র্যাকটিস, হোম টাস্ক, স্কুলের পড়া এসব শেষ করে ঘুমোতে যেতে যেতে প্রায় বারোটা বাজে। আমি আমার মেয়ের এই যান্ত্রিক জীবনটাকে শুধুই অবলোকন করতে পারি আর কিছুই না। আমি জানি- আকাশের নীল রং ওর মনে কোন ছায়া ফেলে না, সবুজের স্নিগ্ধতা কখনো আলোড়ন জাগায় না, পাখির গান বা ফুলের সমারোহ ওকে খুব একটা পুলকিত করে না ।
ওর জীবনের সবটাই যান্ত্রিকতা- এমনকি স্বপ্নগুলোও। ওর স্বপ্নে কখনো ডালিমকুমারের পঙ্খীরাজ পাখনা মেলে না, সেখানে যতসব সায়েনস ফিকশন আর জেমস বন্ডের রোমহর্ষক, দুধর্ষ কাহিনির ঘনঘটা।
আমি আর ভাবতে পারছি না। আমি আমার মেয়ের এই কষ্টকর জীবন আর সহ্য করতে পারছি না। আমি ওকে সবুজের কাছে নিয়ে যাবো- মাটির সোঁদা গন্ধের অনুভূতি শেখাব, নদীর কলকল রবে সত্যের স্বরূপ উপলব্ধি করতে শেখাব, আমি ওকে ফুল-পাখি-প্রকৃতির কাছে নিয়ে যাব।
খুব কাছে, খুব।
আমি বলি- মামণি, চলো আজ সবাই মিলে তোমার দাদা বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। শমর্ী বাধা দিয়ে বলে- 'কি যে বল তুমি? ওর গানের ক্লাশ আছে না?' আমি রুমিকে আবার বলি- মামণি যাবে? রুমি বলে- না বাপি, ওখানে কারেন্ট নেই, নোংরা মাটিতে হাঁটতে আমার বিচ্ছিরি লাগে!
একটা বিরাট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বেরিয়ে আসি। ব্যর্থতার হাহাকার। আমার মেয়ে তার আধুনিক মায়ের সব বৈশিষ্ট্যই আস্তে আস্তে রপ্ত করছে।
আমার শুধু সুমনের একটা গানই মনে পড়ছে -
ইস্কুলের পড়ার সঙ্গে আছে পাড়ার গানের স্কুল
নিয়ম করে শিখতে হবে রবীন্দ্র নজরুল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।