জুলাই সংখ্যা'06
দেলোয়ার হোসেন
ঋতু চক্রের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ।
ছয়টি ঋতুর বিচিত্র রূপের মধ্যে আমরা ডুবে থাকি সারাটি বছর। একটা ঋতুর মনোমুগ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতেই এসে যায় আর এক ঋতুর রূপের বাহার। সে রূপ শুধু আকাশ, বাতাস আর প্রকৃতি ঘিরেই নয়_ তার ছুঁয়া লাগে প্রতিটি প্রাণের গভীরে।
শীতের বুড়ি পালিয়ে যেতেই কালো কোকিলের কুহু স্বরে মন ভরে ওঠে আমাদের।
আবার সূর্যের প্রচণ্ড দাবদাহে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে প্রাণিকুল। প্রকৃতিও হয়ে পড়ে কেমন বিবর্ণ বিষণ্ন। তার পর বৈশাখ এসে ভাঙা-গড়ার খেলা খেলতে খেলতে হঠাৎ যখন ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করে, ঠিক তখনই ধূসর বরণ এলোকেশে বর্ষা এসে হাজির হয় বাংলার আকাশে। গুড়গুড় শব্দে জানান দেয় তার আগমন বার্তা। যেনো জাদুর ছোঁয়ায় মস্নান করে দেয় সূর্যের খরতাপ।
এক ঝলকা হিমেল বাতাসের পরশ আমাদের অনুভবে আসে। আমরা বুঝে নেই, এ আমাদের বর্ষার অকৃত্রিম ভালোবাসার পরশ।
আষাঢ় ও শ্রাবণ বর্ষা ঋতুর ভাগে পাওয়া দু'টি মাস। তাই বর্ষা এসেই বাংলার আকাশ বাতাস আর প্রকৃতি ঘিরে জারি করে তার শাসনতন্ত্র। কালো মেঘ ধীরে ধীরে জমাট বেঁধে ওঠে।
সেই কালো মেঘের কাছে বৃষ্টি চায় চাতক পাখি। তৃষ্ণার্ত মাঠঘাট আর বাংলার প্রতিটি প্রাণ ব্যাকুল মনে প্রতীৰায় থাকে বোবা দৃষ্টি মেলে।
বর্ষা আমাদের প্রাণের কথা জানে, আমাদের অভাব অভিযোগের কথা জানে। তাই বৃষ্টির নূপুর পায়ে ঝুমুর ঝুমুর তালে ঝরে পড়ে বাংলার মাটিতে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হাসতে হাসতে ঘর ছেড়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়।
সুরে সুরে বলে- 'আয় বৃষ্টি ঝেপে, ধান দেবো মেপে...'।
তখন পথের মানুষ আর দৌড়ে ঘরে ফিরতে চায় না। বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে তারা ভিজতে চায়। এ যেনো বর্ষার সাথে বাংলার মানুষের অনাদিকালের সম্পর্ক। বড় পাওয়ার জন্য ছোটখাটো ৰতি সেও যে আনন্দের।
চোখের পলকে ছড়িয়ে পড়ে মেঘ। কানে বাজে সেই চেনা গুরম্ন গুরম্ন মেঘের ডাক। আর থেকে থেকে কালো মেঘের বুক চিরে, চোখ ঝলসানো সেই অাঁকাবাঁকা বিজলি চমক। আমাদের মনে সূচিত হয় নতুন দিনের নতুন স্বপ্ন।
টিনের চালে ঝমঝম অবিরাম বৃষ্টির শব্দ।
পৃথিবীর আর কোনো শব্দই পেঁৗছায় না কানে। কেবল বৃষ্টির ঝম্ঝম্ শব্দ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা দু'হাতে কান ঢাকে_ আবার ছাড়ে। শা-শা একটা শব্দের ঢেউ, তাদের মনকে যেনো ডেকে নিয়ে যায় স্বপ্নের সুদূরে। এভাবে বৃষ্টির শব্দ নিয়ে খেলা চলে তাদের।
কবি বলেন-
টিনের চালে গাছের ডালে
বিষ্টি ঝরে হাওয়ার তালে,
হাওয়ার তালে গাছের ডালে
বিষ্টি ঝরে তালে তালে।
জুঁই চামেলি ফুলের বোঁটায়
বিষ্টি ঝরে ফোঁটায় ফোঁটায়।
বাদলা দিনে একটানা সুর,
বিষ্টি ঝরে মিষ্টি মধুর।
গাছের চালে, পাতার ফাঁকে চুপচাপ বসে থাকে পাখিরা। জনশূন্য মাঠ-ঘাট জনশূন্য পথ-প্রানত্দর।
গোয়াল ঘরে গরম্ন আর হাম্বা রবে ডাকে না। কি এক প্রশানত্দিতে বন্ধ চোখে জাবর কেটে চলে সারাৰণ। কখনো দেখা যায় জনশূন্য পথের ধারে দাঁড়িয়ে বেভুলো রাখালের সাদা গাভিটি ভিজে একাকার। গাঁয়ের পুকুর অথবা নদীতে বৃষ্টির ফোঁটায় সৃষ্টি হয় ধূসর বরণ কুয়াশা কণার। উঠোনে জমে ওঠে পানি।
সে পানির ঘোলা স্রোত নামে ঢাল বেয়ে। পুলকে আকুপাকু করে ওঠে কিশোর-কিশোরীদের মন। সহসা খাতার কাগজ ছিঁড়ে তারা তৈরি করে কাগজের নৌকা। সে নৌকা ভাসিয়ে দেয় উঠোনের পানিতে। নৌকা দুলে দুলে এগিয়ে যায় স্রোতের টানে।
কিন্তু বৃষ্টির আঘাতে পথ চলা বড় দায়। তাই উল্টে পড়ে পানির মধ্যে। এতেই যেনো আনন্দের সীমা থাকে না শিশু-কিশোরদের।
বর্ষা এলেই আমাদের মনের গভীরে জেগে ওঠে সুরের কাঁপন। কেননা সুর শুনি বৃষ্টির, সুর শুনি বাদল হাওয়ার, সুর শুনি পাতা পলস্নবের।
তখন মন যেনো হয়ে ওঠে উদাস। হারিয়ে যায় অজানা ঠিকানায়। তাই বুঝি বর্ষা কবিতার ঋতুর সুরের স্বরলিপি। আবার প্রকৃতিকে নতুন সাজে সাজতে দেখে মনের অজানত্দেই মন, মনের খাতায় এঁকে যায় বর্ষার মন ভুলানো সব ছবি। মেঘ, বৃষ্টি আর প্রকৃতির মায়াময় সব দৃশ্য।
কবি বলেন_
বাদল হাওয়ায় মনে পড়ে
ছেলে বেলার গান,
বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
নদে এলো বান।
এই টাপুর টুপুর বৃষ্টি ঝরতে ঝরতেই ভরে ওঠে খাল- বিল, নদী-নালা। নদীর বুকে আবার নৌকা ভাসে। রাসত্দার পাশে ডোবা নালার ঘোলা পানিতে হাপুস হুপুস ডুব সাঁতারে মেতে ওঠে গ্রামের ছেলেমেয়েরা। ছেলেরা বাড়ির পেছন থেকে কলা গাছ কেটে তৈরি করে কলার ভেলা।
মনের আনন্দে বেয়ে বেড়ায় ডোবা নালায়। এই ভেলা শুধু খেলা পর্যনত্দ সীমাবদ্ধ থাকে না। মানুষের দৈনন্দিন অনেক উপকারে আসে বর্ষা মৌসুম। এক সময় অনেক বাড়ির চারদিকে পানিতে ছয়লাব হয়ে যায়। তখন এই ভেলায় চড়ে বড় রাসত্দায় যাওয়া-আসা করে মানুষ।
আবার বিশুদ্ধ খাবার পানি এবং রান্নার পানির জন্য কোনো পুকুর বা টিউবওয়েলে যায় একাধিক কলস সাজিয়ে।
বর্ষার দিনে বৃষ্টি নামলেই মাটির গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে নানা জাতের ব্যাঙ। শুরম্ন হয়ে যায় ব্যাঙের একটানা ঘঁ্যাঘু ঘঁ্যাঘু। ডোবা নালায় জমে ওঠা পানিতে ওদের লাফালাফি ঝাঁপাঝাঁপির অনত্দ থাকে না। গলার দুদিকে নীল বলের মতো ফুলিয়ে হলদে ব্যাঙ আর কালো ব্যাঙের এমন ডাকাডাকি শুরম্ন করে যে, রাতের বেলা দু চোখের পাতা এক করা দায় হয়ে পড়ে।
ছোট ছেলেরা পাটকাঠির মাথায় খেজুরের কাঁটা বেঁধে ব্যাঙের পেছনে ছুটোছুটি করে বেড়ায় সকাল-সন্ধ্যায়। ব্যাঙের ছড়াও কাটে তারা।
বর্ষাকালে ব্যাঙ নরম মাটি খুঁড়ে গোলাকার গর্ত করে সেখানে সাবু দানান মতো অসংখ্য সাদা ডিম পাড়ে। ডিমগুলো একত্রে দলা বেঁধে থাকে। আবার ডোবার কুলের কোনো হিজল অথবা বাবলাগাছের উঁচু চিকন ডালে সাবানের ফ্যানার মতো জমাট বাঁধা লম্বা সাদা পুঁটুলির মতো ঝুলতে দেখা যায়।
সেটা এক ধরনের গেছো ব্যাঙের ডিম।
বর্ষকালে ব্যাঙের মতো মাছেরও সাড়া পড়ে যায় দেশ জুড়ে। খানা ডোবা, বিলঝিল, নদীনালায় কাদা পানির তলায় গর্ত করে লুকিয়ে থাকা ছোট-বড় নানা জাতের মাছ বেরিয়ে আসে এই বর্ষা মৌসুমে। ঢাল বেয়ে নানা হালকা পানির স্রোতে কৈ, শিঙ এবং পুঁটির ঝাঁক চলে আসে ওপর দিকে। কৈ মাছ কানে হেঁটে চলে যেতে চায় কোনো বড় জলাশয়ে।
কিন্তু বৃষ্টি থেমে যেতেই ভেজা মাটির ওপর ঝাঁক বেঁধে ওরা আটকা পড়ে যায়। তবু চলতে থাকে। এ সময় কারো চোখে পড়ে গেলে আম কুড়াবার মতো দ্রম্নত কোঁচর ভরতে থাকে। অবস্থা বুঝে ছুটে আসে আরো অনেকেই। এভাবেই বড় নদী থেকে খাল বেয়ে নানা জাতের মাছ এসে ছড়িয়ে পড়ে মাঠে আর গ্রামের ডোবা নালায়।
কখনো ধানের মাঠে উঠে আসা কোনো বড় মাছের পেছনে ছোটে গাঁয়ের মানুষ। তখন তাদের হাতে শোভা পায় মাছ মারা কোচ অথবা যুতি। কিশোর ছেলেরা বড়শিতে বলস্নার টোপ অথবা কেঁচো গেঁথে ঘোলা পানিতে মাছ ধরে।
বর্ষার দিনে আকাশ প্রায়ই মেঘে ঢাকা থাকে। কখনো কখনো সূর্যের মুখ একেবারেই দেখা যায় না।
যখন তখন মেঘ গুড়গুড় শব্দে ডেকে ওঠে এবং তার পরই অঝোর ধারায় ঝরতে থাকে বৃষ্টি।
কিন্তু কবি মানা করলেই তো মানুষ ঘরের কোণে বসে থাকতে পারে না! বৃষ্টি ধরলে বা আকাশ একটু ফর্সা হলেই মানুষ বেরিয়ে পড়ে যার যার কাজে। ছেলেমেয়েরাও স্কুলে যায়। হঠাৎ বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দেয় পথের মানুষগুলোকে। তখন তারা দৌড়ে ঠাঁই নেয় কোনো বড় গাছের তলায়।
কেউবা কলার ডগা কেটে মাথায় ধরে পথ চলতে শুরম্ন করে। কেউবা রাসত্দার পাশ থেকে মানকচুর বড় পাতা ছিঁড়ে বৃষ্টি থেকে রৰা করে নিজেকে। এ দৃশ্য কেবল পাড়া-গাঁয়েই চোখে পড়ে। শহরের মানুষের মতো তাদের তো আর জনে জনে ছাতা নেই যে যাত্রাকালে ছাতা হাতে বের হবে। তা ছাড়া গ্রামের রাসত্দায় শহরের মতো গাড়ি-ঘোড়াও নেই।
প্রতিটি গ্রামের মেঠোপথ, কাঁচা রাসত্দা এবং বাড়ির আঙিনা পর্যনত্দ কাদা পানিতে খারাপ অবস্থার সৃষ্টি হয়। কাদা পানিতে আটকে যায় গরম্নর গাড়ি, হঠাৎ শহর থেকে আসা কোনো মোটরগাড়ি। তখন তাদের কি যে দুর্ভোগ পোহাতে হয় তা শুধু ভুক্তভোগীরাই জানেন! তখন গাঁয়ের ছেলেরা দল বেঁধে কাদা-পানি মেখে অনেক পরিশ্রম করে কাদা থেকে মুক্ত করে সেসব গাড়ি। দেখা গেলো বাড়ির কোনো খোলা জমিতে ছেলেরা মেতে উঠেছে ফুটবল অথবা হা-ডু-ডু খেলায়। সে কি আনন্দ! খেলতে খেলতে সবার চেহারা বীভৎস মতো হয়ে যায়।
তারপর দল বেঁধে সব ঝাঁপিয়ে পড়ে কোনো পুকুরে কিংবা নদীতে। সেখানকার পানি তখন বেশ গরম গরম মনে হয়। বৃষ্টির মধ্যে তখন আর কারো উঠতে মন চায় না সেই পানি থেকে। মানুষ বৃষ্টির মধ্যে বের হতে না চাইলেও ঘরের খাবারের জন্য টোকা বা মাথাইল মাথায় বেঁধে বের হতে হয় তাদের।
গ্রাম বাংলায় একটা প্রবাদ আছে যে, শনিতে সাত, মঙ্গলে তিন_ আর সব দিন দিন।
যদি হয় মঙ্গলে শুরম্ন, তিন দিন গুরম্নগুরম্ন। বুধের সকালে নামে ঢল, বিকেলেই বলে চল।
আষাঢ়ে ঢল নামতে নামতে এক সময় ডুবতে বসে মাঠ-ঘাট। তখন শুরম্ন হয় শ্রাবণের রিমঝিম। একটানা ঝরছে তো ঝরছেই।
সকাল সন্ধ্যা রাত, এমনিভাবে পার হয় তিনদিন, পাঁচদিন, এমন কি সাতদিনও। তখন হাটবাজারও এক রকম বন্ধ হয়ে যায়। কেউ ঘর থেকে বের হতে চায় না। কাঁঠাল আর আনারসের ছড়াছড়ি পথে ঘাটে।
শ্রাবণে মনে পড়ে যায় সেই কবিতার কথা_
ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি
ইলিশ মাছের ডিম,
ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি
দিনের বেলা হিম।
কিংবা_
ঝুমুর ঝুমুর
টাপুর টুপুর
বৃষ্টি নামে সকাল দুপুর...
তখন বড় নদীতে প্রচুর ইলিশ মাছ ধরা পড়ে। মাঝিরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে মাছ বিক্রি করে। টাটকা মাছ অথচ দাম কম। এমন দিনে সবারই মনে পড়ে খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ খাওয়ার কথা। ঘরে ঘরে তখন ভাজা ইলিশের গন্ধ।
তার সাথে অন্যান্য মাছ তো আছেই।
দু'তিন দিন আর সূর্যের মুখ দেখা যায় না। মেঘের আড়াল দিয়ে প্রতিদিন সূর্যটা পূর্ব থেকে পশ্চিমে পাড়ি জমায়। অথচ কেউ তা টেরও পায় না। সে খবর পাওয়া যায় শুধু ঘড়ির কাঁটায়।
এই অফুরনত্দ অবসরে মানুষ খায় আর কাঁথা গায়ে জড়িয়ে অলস ভঙ্গিতে শুয়ে শুয়ে সময় কাটায়। কেউবা মজার মজার সব গল্পের আসর মজায়। অনেকে বারান্দায়, মাটিতে ঘর কেটে সাতগুটি বাঘ-বন্ধ খেলায় মেতে ওঠে। আবার অনেকে সাদা আর কালো কচুর ডাঁটা কেটে ছোট ছোট গুটি তৈরি করে খেলে বারো প্যাতে অথবা চবি্বশ প্যাতে। এ খেলার বেলাতেও মাটিতে ঘর কেটে নিতে হয়।
বড়রা নিরিবিলি কোনো কাচারি ঘরে গিয়ে তাস খেলতে খেলতে কাবার করে দেয় দিন। অনেক বুড়োরা আবার পাট-টাকুরে পাটের রশি তৈরি করে দিন ভর। কেউবা বোনে ঝাঁকি জাল। আবার কেউবা মাছ ধরার যন্ত্রপাতি তৈরি করে।
বৃষ্টিতে বৃষ্টিতে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায় গাছপালা।
তখন ভেজা মাটির সোদাগন্ধে মন যেনো কেমন করে ওঠে। মাটি আর দেশ বড় আপন মনে হয়। হালকা রোদের ছোঁয়ায় প্রকৃতি যেনো আনন্দে নির্ঝরের মতো হাসতে থাকে। বাড়ির আঙিনায় লক লক করে বেড়ে ওঠে নানা ধরনের চারা জাতীয় গাছ। বৃষ্টি ঝরা সাঁঝবেলা রান্না ঘরের মনটাকে কেমন কাছে ডাকে।
উঠোনের পাশে ছোট্ট জাংলায় সবুজ লতাপাতার ফাঁকে ফাঁকে হলুদ রঙের ঝিঙে ফুলগুলো যেনো রূপের প্রদীপ জ্বেলে চেয়ে থাকে। সে রূপ একদিন দেখেছিলেন আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরম্নল ইসলাম।
বর্ষা ঋতুর এমন অবিরাম বর্ষণে মানুষ আবার অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। আর ভালো লাগে না। এখন নতুন কিছু চাই।
তাই তো কিশোর কিশোরীরা ছড়ায় ছড়ায় বলে,
লেবুর পাতা করম চা
যা বিষ্টি ঝরে চলে যা।
শাওনের মেঘ যেনো বাংলার মানুষের মনের কথা বুঝতে পারে_ তাই একদিন দেখা যায় মেঘের ফাঁকে- সূর্যটা আবার হেসে উঠেছে। ঝকমকা আলোর রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। পানি থইথই মাঠ ঘাট। গ্রামের অনেক বাড়িই দ্বীপের মতো দেখায়।
বিল ঝিলে ফুটে থাকে হাজারো শাপলা শালুক। সন্ধ্যায় ব্যাঙের সাথে পালস্না দিয়ে ডাকে ঝিঁঝি পোকারা। রাতে চাঁদ হাসে আকাশে।
সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে মধুর সেই সময়ের কথা কেউ কখনো ভুলতে পারে না। যখন মেঘমুক্ত নীল আকাশের গায়ে ভাসে চাঁদ।
নিচে থই থই নদী নালা, বিলঝিল। সেই বর্ষার পানিতে নৌকা ভাসিয়ে মনের সুখে গাঁয়ের ছেলেরা বেয়ে বেড়ায় এখানে সেখানে। বাড়ির বৌ-ঝিরা জোছনা ঝরা রাতে নৌকা করে বেড়াতে যায় এ-পাড়া সে-পাড়া, এ গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে।
যুবকরা ভালোলাগার এই আবেসে নৌকা বেয়ে চলে যায় কোনো বিলের মধ্যে। মনের আনন্দে গান গায়, ভাটিয়ালি, পলস্নীগীতি অথবা মরমী।
এই আনন্দ শুধু বর্ষা মৌসুমেই।
বর্ষাকালে নতুন নতুন আনন্দের মধ্যে সময় কাটলেও কমবেশি অনেক মানুষই নানা ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়ে যায়। বিশেষ করে গরিব মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। কাঁচা ঘরবাড়ি ভেঙে যায়। ডুবে যায় অনেক বাড়ি।
তখন তারা আশ্রয় নেয় কোনো স্কুল ঘরে অথবা উঁচু কোনো রাসত্দার ওপর। অনেক সময় খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাতে হয় তাদের। তাদের থাকে না কোনো কাজ। ঘরে ঘরে দেখা দেয় জ্বালানির অভাব। শুরম্ন হয় ছেলেমেয়েদের পেটের পীড়া, অসুখ-বিসুখ।
অতি বর্ষণে কখনো দেখা দেয় বন্যা। ডুবে যায় ফসলের মাঠ। বন-বাদারের পোকা-মাকড়, সাপ-বিচ্ছু এসে আশ্রয় নেয় মানুষের ঘরবাড়িতে। এ সময় সাপের কামড়ে, পানিতে ডুবে মারা যায় গ্রামের ছেলেমেয়ে। তখন লাশ কবর দেয়াও বড় দায় হয়ে পড়ে।
মাটি খুঁড়লেও তলায় জমে ওঠে পানি।
বর্ষাকালে বেড়ে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। চাহিদা বেড়ে যায় কেরোসিনের। সেই সাথে তার মূল্যটাও। অসহায় মানুষের আর কিছুই করার থাকে না।
গ্রামের মতো শহরের বসত্দিবাসীরাও এই বর্ষায় নানা সমস্যার মধ্যে পতিত হয়। তাদেরও থাকা-খাওয়ার বড় অসুবিধা দেখা দেয়। তবু শহরের গবির ছিন্নমূল মানুষ সরকার থেকে বেশ সাহায্য পেয়ে থাকে। কিন্তু গ্রামের মানুষ এসব থেকে বঞ্চিত_ কখনো হয় প্রতারিত। কবির ভাষায় :
ঝুমুর ঝুমুর
টাপুর টুপুর
জলে-কাদায় ঘোল,
ভাঙা ঘরে শূন্য হাঁড়ি
একটুতে খায় দোল!
একদিন আষাঢ়-শ্রাবণের দিন শেষ হয়ে যায়।
প্রকৃতিকে সজীব আর মাটির প্রাণশক্তি যুগিয়ে বর্ষা নেয় বিদায়। পানির টানে ধুয়ে মুছে যায় চারপাশের আবর্জনা। দেখতে দেখতে মাঠের ফসল হয়ে ওঠে সবুজ আর সজীব। অনেক দানের মধ্যে বর্ষা আমাদের মনে কিছু কষ্টের স্মৃতিও রেখে যায়। তারপর শরতের সূর্য এসে প্রকৃতিকে আবার চঞ্চল করে তোলে।
বর্ষার মতো শরৎও বাংলাকে দখল করে নেয়। মনে করিয়ে দেয় নতুন স্বপ্নের কথা। আমরা ছয়টি ঋতুকেই সমান ভালোবাসি। ছয়টি ঋতু যেনো বাংলার ছয়টি রঙের পাখি, ছয়টি সুরের পাখি!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।