সিরীয় সংকটের এক কঠিন সময়ে জাতির উদ্দেশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার দেশের প্রত্যাশিত সিরিয়ায় আক্রমণ আরও পিছিয়ে ছিলেন। বাংলাদেশ সময় বুধবার সকাল ৯টায় এ ভাষণে তিনি সিরিয়ার আসাদ সরকারকে গৃহযুদ্ধে বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করার গুরুতর অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। তিনি এটাও বলেন, বিশ্বের 'শান্তি ও স্থিতিশীলতা' রক্ষার অতন্দ্রপ্রহরী হিসেবে আমেরিকার কর্তব্য হলো এমনি অমানবিক ও জঘন্য কর্মের জন্য সিরিয়ার আসাদ সরকারকে শাস্তি দেওয়া। ওবামা বলেন, ইরাক কিংবা আফগানিস্তানের মতো সর্বাত্দক যুগ্ধ নয়, শুধু বিমান ও মিসাইল আক্রমণ করে তিনি আসাদ সরকারকে শিক্ষা দিতে চান। তা ছাড়া তিনি মনে করেন যে, আসাদের কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রতিও বড় হুমকি।
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট সহসা কোনো আক্রমণের কথা উল্লেখ করেননি, যদিও সারা বিশ্ব গভীর আগ্রহে তার ভাষণ শুনেছে এবং উৎকণ্ঠিত ছিল এই মনে করে যে হয়তো ওবামা বলবেন সিরিয়ায় আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে। অবশ্য আমেরিকার সিরিয়া আক্রমণের পরিকল্পনা খুব সহজ ব্যাপার নয় এবং এর সঙ্গে নানাবিধ সমস্যা জড়িত। মার্কিন জনগণের অধিকাংশই এর বিরুদ্ধে।
কিন্তু ওবামা বিভিন্ন কারণেই এ আক্রমণে এখনো যাচ্ছেন না। সর্বশেষ একটি নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে সিরীয় সংকটে এবং এটাই এ সময়ে মার্কিন আক্রমণের বিলম্বের কারণ।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি বলেছেন, আসাদ সরকার যদি সব রাসায়নিক অস্ত্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে হস্তান্তর করে তাহলে সিরিয়ায় আক্রমণ নাও হতে পারে। দামেস্ক সরকারের পরম বন্ধু রাশিয়া এটাকে সমর্থন করে এবং আসাদ সরকারও এ প্রস্তাবে সম্মত হয়ে যায়। ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত ইতিবাচকভাবে পরিবর্তিত হয় এবং মার্কিন হামলার সম্ভাবনা হ্রাস পায়। আগে ব্রিটেনের পার্লামেন্ট কর্তৃক প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরুনের সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করায় আমেরিকায় ওবামা প্রশাসন বেশ কিছুটা হতাশ হয়েছে। কারণটি সুস্পষ্ট।
২০০৩ সালে ইরাকে সামরিক অভিযানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পরম বন্ধু হিসেবে পাশে পেয়েছিল ব্রিটেনকে। ইঙ্গ-মার্কিন সেই আক্রমণে ইরাকে তৎকালীন সাদ্দাম হোসেন সরকার উৎখাত হয় এবং দেশটির সর্বক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন হয়। অবশ্য সেই সময় আমেরিকায় ক্ষমতায় ছিল রিপাবলিকান পার্টি এবং যুদ্ধংদেহী হিসেবে পরিচিত প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লেবার পার্টির টনি ব্লেয়ার। ইরাকে 'মারণাস্ত্র' বিরাজ করছে এই অজুহাতে রুশ ব্লেয়ার সেই দেশে সর্বাত্দক হামলা চালালেও পরবর্তীতে কিন্তু সেই কথিত 'বিপজ্জনক' অস্ত্র আর ইরাকে পাওয়া যায়নি।
এটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যে ইরাকে সামরিক অভিযানের জন্যই সেই 'মারণাস্ত্রের' ধুয়া সৃষ্টি করা হয়েছিল যদিও সাদ্দাম হোসেন নিজেও একজন নির্মম শাসক ছিলেন। কিন্তু কথা হলো, জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়াই সেই ইঙ্গ-মার্কিনিদের ইরাক হামলার তীব্র প্রতিক্রিয়া পড়েছিল সারা বিশ্বে এবং এখনো ইরাক একটি স্থিতিশীল রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে না। পশ্চিমাপন্থি ইরাক সরকার ক্ষমতায় থাকলেও দেশটিতে সহিংসতা এবং জাতিগত ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড লেগেই আছে।
সেই ইরাক আক্রমণের প্রায় দশ বছর পর বিশ্বের রাজনৈতিক চালচিত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে বর্তমান সময়ে অবস্থান করছে আরও একটি আরব মুসলিম রাষ্ট্র এবং সেটা হলো সিরিয়া। দুটি দেশই অর্থাৎ ইরাক এবং সিরিয়া আরব বিশ্বে বেশ প্রগতিশীল হিসেবে পরিচিত এবং 'বাথ' পার্টি কর্তৃক শাসিত।
বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের কারণে আজ সিরিয়ার ওপর সামরিক আক্রমণে তৈরি আমেরিকা ও মিত্ররা। অভিযোগ সেই দেশটির সরকার নিজ দেশে বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করেছে।
সিরিয়ার বাশার আল আসাদ সরকার এ রাসায়নিক অস্ত্র ২৮ মাসব্যাপী গৃহযুদ্ধে ব্যবহার করুক আর না-ই করুক, অন্তত পশ্চিমাবিশ্ব এটাকে সত্য মনে করছে। সেই ভিত্তিতেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্ররা বিশেষ করে ব্রিটেন ও ফ্রান্স সিরিয়ায় সামরিক অভিযান চালাতে উদ্যত হয়েছিল। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সিরিয়ায় সামরিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার সম্ভাবনা হ্রাস পেয়েছে।
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দমবার পাত্র নন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের জলসীমায় অবস্থানরত মার্কিন রণতনী থেকে যুদ্ধবিমান এবং 'ক্রুজ' মিসাইল সিরিয়ায় সামরিক এবং অন্যান্য 'টার্গেটে' আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বিভিন্ন কারণে সেই প্রত্যাশিত সামরিক হস্তক্ষেপ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরে দাঁড়িয়েছে।
আমেরিকায় তখন ডেমোক্রেট দলীয় সরকার যার কর্তৃত্বে রয়েছেন ক্ষমতাশালী দেশটির প্রথম আফ্রিকান-আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের সৃষ্ট ইরাক এবং আফগান সংকটকে দীর্ঘদিন স্থায়ী না করে সেইসব সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করছেন।
ব্রিটেনে বর্তমান রক্ষণশীল দলের ক্যামেরুন আছেন ক্ষমতায়। তারা আগের লেবার পার্টির ইরাকে সামরিকভাবে স্বীয় দেশকে জড়িয়ে ফেলাকে সমর্থন করে না। তাহলে এ সরকার কেন সিরিয়ায় তাদের সংশ্লিষ্টতায় এত উৎসাহী? অবশ্য আমেরিকা এবং ব্রিটেন বলছে, সিরিয়ায় সম্পৃক্ততা হবে খুবই 'সীমিত' আকারে শুধু বিমান আক্রমণে সীমাবদ্ধ। তাহলে এটাও সামরিক হস্তক্ষেপ। ব্রিটিশদের ইরাকে এবং আফগানিস্তানে সামরিক সম্পৃক্ততার অভিজ্ঞতা তাড়া করছে এতদিন পড়ে।
সে কারণেই স্পষ্টত ব্রিটেনের পার্লামেন্ট এই সরকারের সিরিয়ায় সামরিক অভিযানের উদ্যোগে পানি ঢেলে দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ_ সৌদি আরব, কাতার এবং সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র এই সামরিক অভিযানের পক্ষে। তুরস্কও আমেরিকার সমর্থর্ক। তবে মার্কিন মিত্র জর্ডান এর পক্ষে নয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রকে কিছুটা হতাশ করেছে।
কিন্তু ওবামা প্রশাসন মনে করছে যে, সিরিয়ায় সামরিক অভিযান চালানোর জন্য যেমন জাতিসংঘের অনুমোদন প্রয়োজন নয়, তেমনি নিজ দেশের কংগ্রেসেরও সমর্থন অত্যাবশ্যকীয় নয়। অথচ অনেক বিরোধী এবং শাসক দলের সদস্যরা চাচ্ছেন যে এই বিষয়ে কংগ্রেসে আলাপ-আলোচনা করা হোক।
এটা সত্য যে, সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে। তিনি গৃহযুদ্ধে কঠোরনীতির পরিচয় দিচ্ছেন। এ পর্যন্ত এই যুদ্ধে এক লাখের বেশি মানুষ নিহত এবং পনের লাখের বেশি গৃহহারা হয়েছে।
সরকার এবং বিদ্রোহীদের সংঘর্ষে কোনো পক্ষই চূড়ান্ত সাফল্য প্রদর্শন করতে পারছে না। আমেরিকা ও মিত্ররা বিদ্রোহীদের অর্থ-অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। পক্ষান্তরে, রাশিয়া, ইরান ও চীন আসাদ সরকারকে সমর্থন করছে।
বর্তমানে তীব্র উত্তেজনার কারণ হচ্ছে বিদ্রোহীরা অভিযোগ করেছে যে আসাদ সরকার রাজধানী দামেস্কের পূর্বে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করে কয়েক শ মানুষ যার মাঝে নারী-পুরুষ আছে হত্যা করেছে। কিন্তু আসাদ সরকার এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলছে, এটা বিদ্রোহী এবং তাদের মিত্রদের কারসাজি, যাতে করে সিরিয়ায় বিদেশি হস্তক্ষেপের পথ সুগম হয়।
ইরান বলেছে এটা হলো চরম সিরীয় বিদ্বেষী ইসরায়েলের কাজ হতে পারে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ওবামা মনে করেন যে, এটা আসাদ সরকারই করেছে। তার প্রশাসন এটাও মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ বিঘি্নত হতে পারে এমনি ইস্যুতে আমেরিকা বিদেশে সামরিক হস্তক্ষেপ করতে পারে। এর জন্য জাতিসংঘের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই বলেও তাদের অবস্থান। ওবামা জানেন যে নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়া এবং চীন এমনি প্রস্তাবে 'ভেটো' দেবে।
মস্কো বলছে, সিরিয়ায় সামরিক হামলা সংকটকে আরও জটিল করবে। কিন্তু ওবামা প্রশাসন এসব বক্তব্যে কর্ণপাত করবে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
তবে প্রেসিডেন্ট ওবামার জন্য এ সিরীয় সংকট বড় পরীক্ষা। কেননা সিরিয়ায় হামলা করে তিনি আসাদ সরকারকে দুর্বল করলেও পতন করাতে পারবেন কিনা- সন্দেহ আছে। তা ছাড়া এই আক্রমণ আসাদবিরোধী, কিন্তু আল-কায়েদার সমর্থিত বিদ্রোহীদের সহায়তা করতে পারে।
তা ছাড়া আন্তর্জাতিক আইন এমনি আক্রমণ সমর্থন করে কিনা, এই বিষয়টিও আলোচনায় আসে। প্রেসিডেন্ট ওবামা কংগ্রেসে অর্থাৎ সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদে সিরীয় আক্রমণ নিয়ে তেমন সাড়া পাচ্ছেন না। তিনি তার বুধবারের ভাষণেই বলেছেন যে, আমেরিকা দীর্ঘ ইরাক ও আফগান যুদ্ধ নিয়ে ক্লান্ত। ২১ আগস্ট দামেস্কের উপকণ্ঠে রাসায়নিক অস্ত্র অর্থাৎ বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহারে নারী ও শিশুসহ এক হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। আমেরিকা এই কর্মের জন্য আসাদ সরকারকে দায়ী করে এবং সিরিয়া আক্রমণের কথা বলে।
আমার সুযোগ হয়েছিল সেই সময় ওয়াশিংটনে অবস্থান করার। হোয়াইট হাউসের সামনে এই আক্রমণের পক্ষে ও বিপক্ষে সভা হয়। বলাবাহুল্য, আক্রমণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। দুই পক্ষের মাঝে প্রচণ্ড তর্ক-বিতর্ক হয়।
সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি যেন অনেকটা হঠাৎ করেই সমস্যার প্রচণ্ড উত্তেজনাকে অন্তত সাময়িকভাবে হলেও প্রশমিত করেছে।
তিনি বলেছেন যে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে আমেরিকার মিত্র ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সঙ্গে সিরিয়ার মিত্র রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রই সিরিয়ার রাসায়নিক অস্ত্র আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে সমর্পণের প্রস্তাব দিয়েছে। সিরিয়া তা মেনে নিয়েছে। এখন দেখার বিষয় পরিস্থিতি কোন দিকে যায়। বিষয়টি নিয়ে জটিলতাও আছে।
পরম সিরীয় বিরোধী তুরস্ক, সৌদি আরব ও ইসরায়েলে মার্কিন হামলা চায়। কিন্তু আমেরিকার জনগণ পক্ষে নয়। মার্কিন অর্থনীতিও ভালো নয়। ফলে ওবামাকে বাধ্য হয়ে পিছু হটতে হয়েছে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের বিশ্লেষক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।