মতিনের বুকটা প্রতিদিন দুইবার ধড়াস করে ওঠে। একবার সকাল সাড়ে দশটার দিকে আবার বিকাল সাড়ে চারটার দিকে। এ বুকধড়াস অনুভুতিটুকু ভোগ করার জন্য যে কোন ভাবেই হোক তাকে এ দুসময় চা দোকানে এসে বসে থাকতে হবে। এ দুমুহূর্তের অনুভুতিকে তার কাছে কখনো মনে হয় অত্যাধিক সুখের, কখনো মনে হয় অত্যাধিক দুখের আবার কখনো হঠাৎ ভুত দেখার মতোও মনে হয়। প্রতিদিন তার এ পথ দিয়ে হেটে যাওয়া দেখার মধ্যে অশ্চর্য রকম এক নেষা রয়েছে।
এ নেষার অভিজ্ঞতা যাদের রয়েছে তাদের প্রতিদিন এ সময় দোকানের সামনে থাকতেই হবে। এটা মতিনের বিশ্বাস। এ দিক থেকে বিচার করলে শফিক, কালুসহ আরো অন্যান্যদের কোন দোষ বিবেকে তার ধরে না। তবে মন বলে কথা। মনটা অন্যদের দেখলে একটু জ্বালা দেয় বৈকি।
মতিন শফিকের নোংরামীটাকেও একেবারে পছন্দ করে না। নোংরামি নয়তো কি? মতিন প্রতিদিন ল করেছে যখন সে এ পথ দিয়ে যায় তখন শফিক চোখ ডেব ডেব করে অনড় দৃষ্টিতে নজর দিতে থাকে তার বুক এবং নিতম্বের দিকে। তখন তার ইচ্ছে করে তার চোখে একটা খেজুর কাঁটা পাঁচ ইঞ্চি ঢুকিয়ে দিতে। ‘কি অসভ্য! শালার বেটা ভুইল্লা যায়, তার একটা ডাঙ্গর মাইয়া আছে। ’
এ বিষয়ে শফিকের অনুভূতিটা একটু ভিন্ন।
সে তাকে দেখার সাথে সাথে তার মনটি বৃষ্টি স্নাত বনানী হয়ে যায় আর সমস্ত অন্তকরণ জুড়ে বিরাজ করে অসহনীয়, অবর্ণনীয় ভেজা ভেজা ক্ষুধা। ক্ষুধা তার শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ে। রোমকুপের গোড়ায় গোড়ায় অনুভূত হয়। তার আপাদমস্তকের পশমগুলি চটাং করে দাঁড়িয়ে যায় সজারুর কাঁটার মত এবং তা পাঁচ মিনিট পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে। এ পাঁচ মিনিট হলো তার সমস্ত দিনের প্রিয় সময়।
কিন্তু তাকে সবর করতে হয় মতিনের সুঠাম দেহের দিকে চেয়ে। শফিক মনে করে এ অধিকার তার বেশী আছে কারণ, তার এ অনুভূতির স্থায়ীত্ব প্রায় সাত বছর। যখন মেয়েটি একটি উরুকাটা পেন্ট পরে বাবার সিগারেট নেয়ার জন্য দোকানে আসতো। শফিক তাকে দেখলেই ডেব ডেব করে চেয়ে থাকতো তার উরুর দিকে। এভাবে চেয়ে থাকতে থাকতে একদিন সে কচি উরু সেলোয়ারে ঢেকে গেলো।
তার পর বছর চারেকের বিরতি। কিন্তু আবার যখন পোষাক ফুড়ে মেয়েটির যৌবন দৃষ্টিমানের চোখে আশ্রয় খুঁজতে শুরু করে, তার সে অনুভূতি পূনর্বার জন্ম নেয়। এ পর্যায়ে তার অনুভূতি এত ধারালো হয় যে, সে তার ছয় বছরের মেয়ের পিন্দন হতে উরুকাটা পেন্ট সরিয়ে সেলোয়ার ধরিয়ে দেয় এবং নিয়ত করে বোরখা ছাড়া দশ বছর বয়স হতে মেয়েকে ঘর হতে বেরুতে দিবে না। আল্লার অশেষ রহমতে মেয়েটি তার নানীর মত খুব সুন্দরী হয়েছে।
শুধু কেবল মতিন, শফিক কিংবা কালাম ওরফে কালুই নয় এসময় দোকানে যারা বসে থাকে কাজে কিংবা অকাজে সবাই তার দিকে চোখ ডেব ডেব করে চেয়ে থাকে।
যারা মোটামুটি আদিমতার প্রতি অনাগ্রহী কিংবা বলা যায় দোযখের আগুনকে একটু বেশী ভয় পায় তারা হয়তো শুধু তাকে দেখে মনে মনে একবার সোবহানাল্লার হক আদায় করে আর তাদের বেহেসতের সীমানাকে পরের ধাপে উন্নীত করে। কিন্তু বাঁকিদের আপাদমস্তক কিংবা আপাদমস্তক না হলেও অঙ্গ বিশেষ কেমন যেন নিষপিশিয়ে ওঠে আর কেমন যেন বুকের ভিতর দুম দুম আওয়াজ শুরু হয়ে যায় ণিকের জন্য। সমভাবাপন্ন দুচারজন একত্রে থাকলে তারা তাদের কাঙ্খাকে প্রশমিত করার প্রয়াস পায় এবং এ কল্পে তারা নানা রকম রসিক বাক্যবানে একে অপরকে জর্জরিত করে। আর এ সময়টা তাদের মধ্যে সর্বৎকৃষ্ট বিনোদনের সময়। এভাবে ক্রমাগত বিষয়টা চর্চা ও প্রতিচর্চা হতে হতেই অনেকের মনে তাকে একবার একান্ত নিকটে পাওয়ার একটা আশা শিশু বৃরে আকারে অংকুরিত হয়।
মেয়েটি যতবার এ পথ দিয়ে আসা যাওয়া করে ততবারই এ বৃরে গোড়ায় একবার করে সার-পানি পড়তে থাকে এবং বৃটি দ্রুত শাখাপ্রশাখা মেলে পরিণত হতে থাকে। এর পর থেকে ধীরে ধীরে নানা রকম ফল দিতে থাকে গাছটি। অবশেষে এ পরিণত ফল বাস্তব পরিকল্পনা প্রণয়নে রূপান্তরিত হয়।
তবে মারিয়া সচেতন যদিও তার এ সচেতনতা তার প্রেমপ্রার্থীদের আশা-বৃরে শিকড়ের মত অত গভীর নয়। তাই সে যখন তার বান্ধবীদের সাথে স্কুল টু বাড়ি আর বাড়ি টু স্কুল পথটুকু পাড়ি দেয় তখন সে জনসমে তার শরীরটাকে আরেকটু টান টান করে দেয়।
তার সচেতন দৃষ্টি পথিকের ডেবডেবে চোখগুলোকে কখনো উপো করে না। কারণ সে সবার কাছে উপমান সুন্দরী। তার বডি-গড়ন আদর্শ তরুণীর মত। এটাও সে ভালভাবেই জানে, আশেপাশের দুচারটি প্রায় দারিদ্র পীড়িত গ্রামের মধ্যে সেই সবচে সুন্দরী। সে নিজের সৌন্দর্যকে আরো চর্চিত করার জন্যই তার পিছে ঘুর ঘুর করা ছেলে চোকরাদের একটু আধটু প্রশ্রয় দিয়েই চলে।
তার ভালো লাগে এ ভেবে যে অনেক বড় বড় ঘরের ভালো ভালো ছেলে তাকে বউ হিসাবে পেতে চায়। এ ছাড়াও তার রয়েছে পনের শতকের উপর তার বাবার গড়ে তোলা একটা সুন্দর বাড়ি যা অনেকেরই লোভের বস্তু আর বিঘা পাঁছেক ফসলি জমি। বাবা মাত্র ছমাস হল মারা গেছেন হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে। সবাইকে তিনি সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত করে রেখে গেছেন। তিনি বেঁচে থাকলে কোন চিন্তাই তার ছিল না কেননা বাবা ছিলেন আস্থারাখার অপ্রতিদ্বন্দী পাত্র।
কিন্তু বাবা মারা যাবার পর সে আর তার মাকে প্রতিনিয়ত ভয়ের মধ্যে কাটাতে হচ্ছে। সে নিজেই বোঝে তার যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে হওয়া অতি জরুরী। তার উপর তাদের হাতে তেমন নগদ টাকা নেই। প্রথম প্রথম ভেবেছিল তার অপার সৌন্দর্যই তার বিয়ের জন্য যথেষ্ঠ। কিন্তু দিনে দিনে সে বুঝলো উঠতি বয়সের তরুণদের সুন্দর্য পিপাশা প্রবল থাকলেও পূর্ণ যৌবনে পদার্পণ করলে তাদের কাছে নগদ টাকাটাই বড় হয়ে যায়, তার ওপর অভিবাবকদের কথাই যে সমাজে চুড়ান্ত।
এ সব হলো তা যা সম্পর্কে মারিয়া এ পর্যন্ত সচেতন। তারপর আরো কিছু রয়েছে যা মারিয়া জানে না। তার সুন্দর শরীরের নেতিবাচক প্রভাব যা তার ভবিষ্যতকে তারই অজান্তে নিশ্চিত করে রেখেছে।
মারিয়ার সমস্ত অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে অবশেষে তার সিদ্ধান্ত স্থির করে মতিনের দিকে। ছেলেটি সুন্দর, সুঠাম ও সুস্বাস্থের অধিকারী।
ছেলেটি গ্রাজুয়েট এবং বেকার। না একেবারে বেকার নয়। রাজনীতি করে। এখনকার দিনে রাজনীতি হলো পেশা। এক যাদুররী পেশা।
এর মূলমন্ত্র পেশী। পেশী দেখাতে জানলে টাকা সয়ংক্রিয়ভাবে পকেটে স্থান খোঁজে। আপাতত তার চাল-চুলো নেই। কিছুদিন আগে বাবা মারা গেছে। দাদা বেঁছে আছে বলে দাদার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হবে কারণ চাচারা বেশ প্রভাবশালী।
অপরপে দাদা মৃত্যুপথযাত্রী। সুতরাং মারিয়া ভাবে এখানে অভিবাবকত্বের কোন বালাই নেই। মতিনের মা বেঁচে আছেন না থাকার মত। দুনিয়ার প্রতি তার কোন দৃষ্টি নেই। ছেলের জন্য একবেলা দু মুঠো রেধে রাখেন আর ছেলের মনে ধরলে এসে খেয়ে দেয়ে পূনরায় আপন ধান্দায় মনোযোগ দেয়।
মারিয়া এসব কিছু ভেবে নিয়ে তার সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত করে। এসএসসি’টা হয়ে গেলেই ঝুলে পড়বে মতিনের গলায় যৌবনে মালা হয়ে। তবুও আপাতত সে মতিনকে কিছুই বুঝতে দেয় না। মতিন যখন পিছু পিছু আছেই তখন খেলিয়ে বেড়িয়ে আরো কিছু দিন যাক না।
মতিনও বিষয়টি নিয়ে বড় একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটাচ্ছে।
তার ভয়ও হচ্ছে। তার কার্যকরী কোন অভিবাবক নেই যে তার বিষয়গুলি নিয়ে ভাববে। যা করার তাকেই করতে হবে। কিন্তু তারতো চালচুলো নেই। মারিয়া তার কাছে আসবে কেন? মারিয়াদের খানদান বেশ মানী খানদান।
চলার মত জায়গাজমিও আছে। কিন্তু তারতো কিছুই নেই। আইনের দৃষ্টিতে সে দাদার সম্পত্তির মালিক হতে পারে না। চাচারা তাকে কিছু দিবে বলে মনে হয় না। তার মনে হচ্ছে সে রাজনীতি করে বলে তার চাচারা এখনও কিছু বলতে ভয় পাচ্ছে।
তা ছাড়া দাদা এখনও বেচে আছেন। তাই চাচারা হয়তো তার এ শেষ বয়সে তাকে কষ্ট দিতে চায় না। তার দৃষ্টি আবার নিজের দিকে ফিরে। সে তো নিজে একটা গ্রাজুয়েট ছেলে। রাজনীতি করে।
এলাকার মানুষ তাকে বিচার আচারে যুব প্রতিনিধি হিসাবে ডাকে। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান কাজে কর্মে তাকে সাথে রাখে। সে থানার অন্যতম যুবনেতা। এ বয়সেই ছোট খাট গোপন একটা ব্যাংক ব্যালেন্স আছে। ব্যালেন্সটা একটু সাইজমতো হলেই তার রেজিষ্টার্ড কন্টাক্টর হওয়ার খায়েশ আছে।
টেন্ডার যুদ্ধটা তার নিকট খুব রোমান্স রোমান্স মালুম হয়। আরেকটা জিনিস ভাববার আছে। মারিয়ার বাবা মারা যাওয়ার পর তারা পারিবারিকভাবে অভিবাবকহীন হয়ে পড়েছে। পাশে দাঁড়ানোর মত নিকটাত্মীয় দুচার গ্রামে তাদের নেই। তাই বলা যায় তারা বেশ বিপদের মধ্যেই আছে।
তাই সে নিজেকে তাদের প্রতিবেশী হিসাবে যোগ্য অভিবাবক ভাববার অধিকারী মনে করে। চেয়ারম্যানকে দিয়ে প্রস্তাব দিলে তার মা রাজী হবে বলে তার দৃঢ় বিশ্বাস। তবে মারিয়ার পরীাটা হয়ে যাক। ছাত্রী হিসাবে মেয়েটি ভাল।
কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ একটা বিরাট ছন্দপতন ঘটে যায়।
যারা একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রতিদিন সকাল সাড়ে দশটা এবং বিকেল সাড়ে চারটায় চা দোকানে একটি তাৎণিক কিন্তু অত্যান্ত শক্তিশালী দুর্ব্যায়ে অনুভূতি উপভোগ করার জন্য অধির আগ্রহে বসে থাকতো, তাদের রুটিনে একটা ছেদ পড়ে যায়। মারিয়া চার-পাঁছ দিন ধরে এপথ মাড়াচ্ছে না। আকাশে বাতাসে তখন মারিয়ার বিয়ের গন্ধ। একেবারে হঠাৎ করে। প্রথমে জানতে পারে মসজিদের মাওলানা, কাজী সাহেব এবং তাদের ঘরের কাছের দুচারজন মুরুব্বি।
মারিয়ার বাসর রাতের খবর পরদিন সকালের সূর্য তার কিরণের সাথে সাথে সমস্ত দেশে ছড়িয়ে দেয়।
উদ্যোগী যুবকেরা ভাবে এটা একটা সুযোগ হতে পারে। বিষয়টাতো ভুয়াওতো হতে পারে। ভুয়া হলে তাদের বাড়িতে জামাই আদরে থাকা ছেলেটাকে কোন এক রাতে গিয়ে একটা রামধোলাই দেয়ার উসিলায় একটা সুযোগ হাতের কাছে পেয়েও যেতে পারে। কিন্তু তাদের আশার গুড়ে বালি হয় যখন মসজিদের হুজুর নিজেই সত্যের সাক্ষী দেন।
অবশেষে তারা এ সিদ্ধান্তে উপনিত হয় যে মারিয়া এবং তার মা কাজটি ভাল করে নি। গ্রামে এত উপযুক্ত ছেলে থাকতে একটা ভিন দেশের ছেলের কাছে তার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে বুদ্ধিমানের মত কাজ করে নি। তাদের গাঁয়ের একটি উর্বর জমির মালিক অচেনা এক ছেলে হবে তাতে সে নির্বিগ্নে চাষ-বাস করে যাবে তা মেনে নেয়া তাদের জন্য অত্যন্ত বেদনা দায়ক হবে। কিন্তু তারা অসভ্য যুগের মানুষ নয়। তারা তাদের মেয়েকে এবং গাঁয়ের জামাইকে বরন করে নেবে এবং তাদের নিরাপত্তা বিধান করবে।
মতিনও ঘটনাটিকে স্বাভাবিকভাবে নেয়। সবাই ভেবেছিল মতিন হয়তো একশন নিতে পারে। হয়তো জামাই ছেলেটার কোন তি করতে পারে। কিন্তু না। সে রকম কিছুই হয় না।
মতিন স্বাভাবিকভাবেই তার রুটিন মাফিক কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। শপিক, কালু ও অন্যান্যরা তাদের চা দোকানে আসার রুটিন বদল করে ফেলে। চা দোকানের মারিয়া সম্পর্কিত উষ্ণ আলোচনা এখন নতুন দিকে মোড় নেয়।
এই যখন মারিয়ার প্রেমপ্রার্থীদের অবস্থা তখন মারিয়া তার সমস্ত সৌন্দর্যকে মেলে ধরে শুয়ে আছে একান্ত নির্ভরতায় সংক্ষিপ্ত সময়ে ফুল ও ভ্রমর কিংবা মাছ ও পানির পরিচয় নিয়ে তার স্বামীর কোলে। মারিয়া তাকে জড়িয়ে ধরছে, তার নাক টিপে দিচ্ছে, তাকে আদর করছে নানানভাবে।
একটি স্বীকৃতির কি অদ্ভুত নীবিড়তা। ছেলেটির নাম আতিক খন্দকার। দীর্ঘ সাত বছর বিদেশ করে এসেছে। মারিয়ার মায়ের চাচাতো বোনের ছেলে।
মারিয়াদের বাড়ি বগুড়া আর তার নানার বাড়ি কুমিল্লা।
তার মা তার বাবার সাথে পালিয়ে চলে আসে বগুড়া। এখানেই তার বাপ নিজের বসতির পত্তন করে।
ঢাকায় আতিকরা সপরিবারে থাকতো। আতিক তার বাবা-মার প্রায় শেষ জীবনের একমাত্র সন্তান। তারা তাদের সন্তানের রুজি রোজগার খেয়ে যেতে পারেন নি।
নুরী বেগম তাদের মৃত্যুর খবর শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, “তোমার বাবা মা খুব ভাল মানুষ ছিলেন। ” মারিয়া জানলো, আট বছর আগে তার বয়স নয় বছর ছিল যখন, তখন তার বাবার চিকিৎসার জন্য তারা ঢাকা গেলে আতিকদের বাসায় ওঠে। ‘‘আতিক তখন তোর বাবাকে হাসপাতালে নিয়া গেছিলো, সববিছু খুব যতন কইরা শেষে আমাদের বগুড়া পৌছায়ে দিয়াছিল। ” মারিয়ার তখনকার কথা খুব অল্প অল্প মনে পড়ে। আতিকের হাত ধরে সে চিড়িয়াখানায় গিয়েছিল।
গত কয়েকটা দিন মারিয়ার কাছে আজিব এক স্বপ্নের মত মনে হয়। সে স্কুল থেকে এসেই দেখে এক অপরিচিত যুবক তাদের ঘরে। বেশ লম্বা। ফর্সা তার গায়ের রং। চেহারা গোলগাল।
পরনে জিনসের পেন্ট। দামি সু তার পায়ে। মাকে ডাকতে ডাকতে তার মায়ের ঘরে আসতেই তার পা থমকে যায় চৌকাঠের নিচে এসে। ধীর ও নীরব পায়ে এসে দাঁড়ায় তার মায়ের পাশে। তাকে কোন প্রশ্ন করতে হয় নি।
প্রশ্ন তার মাই করে,
“দেখতো কে এসেছে?”
উত্তরও তাকে দিতে হয়নি। “এ তোর আতিক ভাই যে। ”
মারিয়া ফেল ফেল করে তার মায়ের মুখে তাকিয়ে থাকে। “ওরে চিনতে পারলি না? ঐযে ঢাকাতে তোরে চিড়িয়াখানায় নিয়া গেছিল। ”
মারিয়ার মনে পড়ে।
তবুও অপ্রস্তুতি ভাব কাটে না। জড়ানো কণ্ঠে কেবল কুশলটুকু জিজ্ঞেস করে। জড়তা কাটলে জানতে চাইলো হঠাৎ কি করে তাদের মনে পড়লো।
‘‘আমার এক কলিগের বাড়ি এখানে। তার কিছু টাকা-পয়সা আর কিছু গহনা ছিল।
সেগুলো দিয়ে যেতে আসলাম। ভাবলাম এতদুর যখন আসলাম তখন খালাকে আর তোমাকে একটু দেখে যাই। ” সে দিনের মত আতিকের সাথে মারিয়ার কথা এতটুকুই।
সন্ধার পর পাশের বাড়ির চাচি, তার মা আর আতিক রূদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন। দীর্ঘ দুঘন্টা একটা গোপন আলোচনার পর তাদের সে বৈঠক শেষ হয়।
রাতের মেহমানদারী শেষ করে, নানা রকম গল্পের ভিতর দিয়ে রাত যখন একটা বাজলো তখন নূরী বেগম বললেন,
“বাবা, আজ আর নয়, অনেক রাত হয়েছে এবার শুয়ে পড়। ” নিজ তদারকীতে অতি আদরের সহিত বোনপোকে শুইয়ে দিয়ে নিজে শোয়ার জন্য নিজের ঘরে চলে আসেন। মারিয়া তার মায়ের সাথে একসাথে শোয়। মারিয়া মশারী টানিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লে তার মায়ের আদুুরে হাত মেয়ের মাথার উপর চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। আবেগ আরেকটু প্রবল হলে মেয়ের কপালে একটা চুমু খান।
অত্যন্ত দরদ মাখা কণ্ঠে মেয়েকে সওয়াল করেন,
“জাদু আমার, আতিককে তোর কেমন লাগে?” মারিয়া এ প্রশ্নের অর্থ বোঝে। কোন জবাব তার মুখ দিয়ে বের হয় না। সে আরো নিবিড়ভাবে তার মাকে জড়িয়ে ধরে। মা আবার বলেন,
“দেক ছেলেটা দেখতে রাজপুত্রের মত। খুব কর্মঠ।
টাকা পয়সা করেছে অনেক বিদেশে থেকে। দেশে এবার ব্যবসা শুরু করবে বলেছে। তোকে খুব সুখে রাখবে। ” থামলেন নূরী বেগম।
মারিয়া এবারও নিরব।
অন্ধকার না হলে তার মুখটা এসময় পূর্ণিমা চাঁদ বলে মনে হতো। মা আবার জানতে চান,
“কিরে কিছু বলিস না যে? তোর পছন্দ না হইলে আমি বাদ দিমু এ চিন্তা। ”
মারিয়াকে এ সময় আর চুপ থাকলে চলে না। সে তার মাকে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে। বলে, “মা, তুমি যা ভাল মনে কর, কর।
”
পরদিন সন্ধায় পাশের বাড়ির চারজন মুরুব্বির উদ্যোগে কাজী ডেকে, মসজিদের মাওলানাকে এনে নূরী বেগম সূচনা করলেন তার একমাত্র মেয়ের স্বপ্নের সংসার। নবদম্পতির প্রাথমিক ইমেজ একসপ্তাহ পর কিছুটা মিইয়ে এলে আতিক শাশুড়ী ও স্ত্রীকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, কিছু দিনের মধ্যে সে তার গ্রাম এবং ঢাকার পাঠ চুকিয়ে দিয়ে বগুড়া স্থায়ীভাবে চলে আসবে আর বগুরা শহরে বড় করে একটা মুদি দোকান দিয়ে মনের সুখে সংসার কর্ম চালনা করবে। এতে শাশুড়ী একশ পার্সেন্ট খুশি হন এবং মারিয়া হাজার পার্সেন্ট খুশি হয়। পঁনের দিন থেকে আতিক আবার ঢাকায় চলে যায় তার অর্থনৈতিক কাজ আনজাম দেয়ার উদ্দেশ্যে।
তারপর আতিক পঁনের দিন পর পর পাঁচ বার আসে এবং দু তিনদিন করে থাকে।
এরপর সে একমাস পর পর ছমাস আসে এবং প্রতিবার এক সপ্তাহ করে শশুর বাড়ি থাকে। তারপর বছর চলে যায়, আতিকের আর দেখা নাই। কোন খোঁজ খবর নেই। মা মেয়ে দুজন চাতক পাখির বৃষ্টির আকাঙ্খা নিয়ে তাকিয়ে থাকে আতিকের পথের দিকে। কিন্তু প্রতিটা দিন তাদের কাটে হতাশা নিয়ে।
চিন্তায় টেনশনে নূরী বেগম অসুস্থ হয়ে যেতে থাকেন। ছেলেটার কোথায় যে কি হলো খোদাতায়ালাই কেবল জানেন। বিদেশ চলে যায় নি তো আবার। অন্তত একটা চিঠি দিতেতো পারতো। আবার মনের মধ্যে কেমন কুচিন্তা বাসা বাধে, “ছেলেটা আমার মাইয়ার লগে প্রতারণা করে নাই তো।
” আবার নিজেই গালে হাতের তালু ছুয়ে তওবা করে, “খোদা যেন শত্র“রেও এমন শাস্তি না দেয়। ”
মারিয়ার জামাইয়ের যে একবছরের মত কোন খবর নেই তা গাঁয়ের লোকেরও হিসাব করা আছে। সবাই ধরেই নেয় “ছেলে ভাইাগা গেছেগা। ” কিছুদিনের মধ্যে গ্রামের সবাই বলাবলি করতে থাকে যে আতিকের ঢাকায় আরেকটা বউ আছে। এটা সে গোপন করে মারিয়াকে বিয়ে করেছে।
এ গুজব শোনার পর নূরী বেগমের টেনশন আরো বেড়ে যায় এবং খুব দ্রুত তিনি আমৃত্যু বিছানা নেন।
মারিয়া এখন মায়ের খেদমত করেই দিন গোজরান করে। খুব একটা বাড়ির বাইর হয় না। পাড়া প্রতিবেশীর খোচা মারা করুণা বাক্য তার খুব অসহ্য ঠেকে। পারতপে সে এখন তাদের বাড়িতে কোন স্ত্রীলোককে জায়গাই দেয় না।
কেউ আসলে তাকে গালিগালাজ করে বিদায় করে। আতিককে হয়তো এতদিনে সে ভুলেই যেতো কিন্তু পাড়াপ্রতিবেশী তাকে ভুলতে দেয়নি। তাকে এখন আর আতিকের প্রতারণা কষ্ট দেয় না। তার মনের ভিতরে কষ্ট থাকলেও তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার অন্যান্য দিক স্বাভাবিক আছে। তার এখন খাবারে রুচিবোধ আছে।
তার কাজ কর্মে মনোযোগ আছে। তার সৌন্দর্য চর্চা অব্যহত আছে। তাদের জমিজমার আয় ভালই আছে। দুজন মানুষের বছরজুড়ে ভরন পোষনের পর উদ্বৃত্তও থাকে। সুতরাং জন্মের পর হতেই তার প্রসাধনির সাথে পরিচিতি আছে।
বাড়িতে একটি পঁনের ষোল বছরের কাজের ছেলে আছে। সে দেখে বহিরাঙ্গন আর মারিয়া দেখে ভেতরাঙ্গন।
কিন্তু মারিয়ার আপন জগতের বাহিরে আরেকটি ভিন্ন জগৎ তৈরী হচ্ছে। একসময়ের মারিয়ার রূপে মগ্ন নওজোয়ানেরা বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারল না। একটি ভিনদেশী ছেলে তাদের গাঁয়ের মেয়ের সাথে প্রতারণা করে পার পেয়ে যাবে এটা তারা হতে দিতে পারে না।
ছেলেটির নিকট হতে মেয়েটির অধিকার ছিনিয়ে নিতে হবে। হয় ঐ ছেলেকে চিরস্থায়ীভাবে এ গাঁয়ে বসবাস করতে হবে নয়তো উপযুক্ত জরিমানা দিয়ে তাকে বিদায় নিতে হবে। এখনো মারিয়াকে বিয়ে করে ঘরে তোলার মতো ঘর এ গাঁয়ে অনেক আছে। মতিন চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করে, এর একটা বিহিত করতে। তিনি বিষয়টাতে রাজী হলেন।
মেয়েটির ব্যবস্থা তিনি না করলে করবে কে? জগতে মেয়েটি বড়ই এতিম। বাপ চলে গেল। মাও চলে যেতে বসেছে। চেয়ারম্যান মতিনকে নির্দেশ দিলেন, ছেলেটিকে সম্ভাব্য সকল স্থানে খুঁজতে। প্রয়োজনে তাকে ধরে আনতে তিনি পুলিশের আশ্রয় নিবেন বলে এলাকাবাসীকে আশ্বাস দিলেন।
প্রথম বিয়ে গোপন করে দ্বিতীয় বিয়ে করা কোন ছোট খাট অপরাধ নয়।
কিন্তু সকল চেষ্টার গুড়ে বালি। আতিকের খোঁজ কেউ পায় না। একটা মহৎ প্রচেষ্টা মাঠে মারা গেলো এ হতাশা ভরা লজ্জা নিয়ে সবাই যখন হাল ছেড়ে দেয় তখন মতিনের কানে কালু জানান দেয়, আতিককে গ্রামের দিকে আসার পথে আটক করা হয়েছে। কথাটি মতিনের কানে যাওয়ার সাথে সাথে তার সারাদেহের রক্ত শ্রোত কাল বৈশাখীর গতি পেল।
ঝংকার দিয়ে উঠলো তার সমস্ত শরীর। আতিককে সদল বলে ধরে এনে তার নিজের ঘরে আটকে রাখলো। কাজটি সমাধা করতে করতে বেজে গেল রাত দশটা। মতিন দশ বারো জনকে দ্বায়ীত্ব দিলো আতিককে নিয়ে চেয়ারম্যানের বাড়ি যেতে। একজনকে পাঠালো মেম্বরদের সহ গায়ের মুরুব্বিদের খবর দেয়ার জন্য।
বিচারের কাজ আজ রাতেই সমাধা করা হবে। আর মতিন শফিক, কালু আর তার চাচাত ভাই আজিজকে নিয়ে মারিয়াদের বাড়িতে যায়।
অনেকটা জোর করেই মারিয়াকে নিয়ে মতিন চেয়ারম্যান বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। অবশ্য সে নূরী বেগকে আশ্বাস দেয় মারিয়ার উপর দিয়ে একটি মশাও উড়তে দেওয়া হবে না। “আসলে চেয়ারম্যান কালকে শহরে চলে যাবেন জরুরী কাজে কয়েক দিনের জন্য।
তাই তিনি আজই কামডা সমাধা করতে চাচ্ছেন। তিনি চান আতিক স্থায়ীভাবে এ গাঁয়ে থাকুক। তিনি কথা দিয়েছেন প্রয়োজনে আতিককে তিনি বাজারে দোকান করে দিবেন। বিচারটা শুধু এ জন্য যে গায়ের সবার সামনে যেন আতিক এ ব্যাপারে একটা হলফনামা দেয়। মারিয়ার ভবিষ্যতের কতা মনে থুইয়াই আমরা এ কামডা করতাছি।
”
নূরী বেগমের অতকথা বোঝার সময় এখন আর নেই। মতিন কি বললো হয়তো তিনি তাও বুঝতে পারেন না। তিনি শুধু আতিকের কথায় মাথা নাড়েন সায় দেয়ার মত।
মারিয়াকে নিয়ে রাত সাড়ে দশটার দিকে মতিনরা রওয়ানা দেয় চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে। দুই বাড়ির পথ এক কিলোমিটার হবে।
মতিনের বাড়ির আশে পাশে এ বিচার সবার ঘুম কেড়ে নিলেও মারিয়াদের এদিকটা অনেকটা নিরব। বিচারটা আজ রাতেই হবে অনেকেই এ ধারণা করছে না । রাতের আকাশে ঝাকে ঝাকে তারা ছাড়া আর কিছু নেই। বাতাশে জৈষ্ঠের গরমের ঘন্ধ। চার জনের হাতে চারটি টর্চ লাইট তাদের পথকে আলোকিত করছে।
পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট দলটির কারো কারো মাথার ভিতর না না রকম চিন্তার জট অনেকটা সরলিকৃত হচ্ছে। কিন্তু সবাই কেমন যেন আশ্চর্য রকম নিরব। শুধু কেবল তাদের পায়ের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। ণে ণে মারিয়ার শরীরের রোমগুলো চটাং করে দাঁড়িয়ে যায়। তখন মারিয়ার শরীরটা প্রচণ্ড জ্বরে ভোগা রোগীর মত শির শির করে কেঁপে ওঠে।
মারিয়া তখন মতিনের গা ঘেসে হাটতে থাকে। মতিনের হাত জড়িয়ে ধরে বলে সে,
“মতিন ভাই, খুব ভয় করছে। ”
মারিয়ার কথা যেন কোন এটম বোমায় আঘাত করে। হঠাৎ করে সবাই দাঁড়িয়ে যায় আর সমস্ত নিরবতা খান খান করে দিয়ে উচ্চস্বরে একযোগে হেসে উঠে। মারিয়া বাঁচাও বলে চিৎকার করে রাস্তার উপর বসে পড়ে।
মতিন মারিয়ার উপর ঝুকে পড়ে, “আরে মারিয়া, কি হয়েছে তোর। ভয় কিসের, আমরা আছি না?” মারিয়ার কানে কথাটা যেতেই যেন সব আবার আগের মত নিরব হয়ে যায়।
“আপনারা সবাই এমন জোরে হাইসা উঠলেন কেন? এইজন্য আমি ডরে চিৎকার করছি। ” মারিয়া কাঁদতে কাঁদতে বললো।
তারা চারজন একে অপরের দিকে তাকায়।
কালু আশ্চর্য হয়ে বলে, “কই আমরাতো কেউ হাসি নাই আর তুমিও কোন চিৎকার কর নাই। তুমি শুধু মাথায় হাত দিয়া বইসা পড়ছ। ”
“কিন্তু আল্লার কসম আমি আপনাদের প্রচন্ড হাসি শুনছি আর ভয়ে চিৎকার কইরা বইসা পড়ছি। ”
মারিয়ার জোরালো কসম খাওয়া কথা সবার মনকে এতটা বিগড়ে দিলো যে তাদের মস্তিস্কের সরলিকৃত স্ব স্ব চিন্তাগুলি এতটা জট পেকে গেল যে চেয়ারম্যান বাড়ি আসা পর্যন্ত তাদের মাথাটা খোলাসা হলো না।
কিন্তু তারা এসে দেখলো বাড়িতে জোয়ান ছেলে ছোকরা আর চেয়াম্যান স্বয়ং ছাড়া আর কেউ নেই।
চেয়ারম্যান তাদের দেখেই বলেন, “মতিন, তোর দেখি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এ দুপুর রাইতে কে আসবে শালিশ করতে। এক কাম কর। মাইয়াডা আমাগো বাড়ি থাক। আর আতিকরে নিয়া তুই বাড়ি যা।
কাইল সকালে বহুম নে। ”
মতিনের সাথে এতরাতে নির্বিগ্নে আসতে পেয়ে মারিয়ার ভয় অনেকটাই কেটে যায়। সে বলে, “কাকা মায় ভিষন অসুস্থ। মারে একলা থুইয়া আমি এখানে একলা থাকতে পারুম না। আমার একটা অনুরোধ কাইল যা করেন আমগো বাইতে কইরেন।
আমারে বরং মতিনভাইরা দিয়ে আসুক। আমার কোন অসুবিদা হইবো না। ”
চেয়ারম্যান সাব একটু চিন্তা করলেন, তারপর বলেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। যা মতিন ওরে বাড়ি রাইখা আহিস। ’ বুদ্ধি করে তিনি তার মেঝ ছেলে রনিকে তাদের সাথে দিলেন।
বলাতো যায় না কখন বিপদ চেপে বসে।
এবার আরেকটি বাড়তি মানুষ নিয়ে তারা ফিরতি পথে রওয়ানা দেয়।
রাত তখন এগারোটার মতো। গাঁয়ের নিস্তব্ধ পথের বুক দিয়ে হেটে যাচেছ ছয়টি মানুষ। দুপাশে বিশাল বি¯তৃত মাঠের মাঝ দিয়ে পথটি চলে গেছে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে।
এ মাঠটা পার হলেই মারিয়া দের বাড়ি।
পাশের কোন আখ খেতে একযোগে কয়েকটা শিয়াল ডেকে উঠে। মারিয়া প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। সে চিৎকার করে তার হাতের কাছে যাকে পায় তার বাহু টেনে নিয়ে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে তার গায়ের সাথে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
মারিয়ার শরীরের উষ্ণ স্পর্শে চেয়ারম্যানের ছেলে অনেকটা ব্যাভাচ্যাকা খেয়ে যায়।
কিন্তু পরণেই নিজেকে সামলে নেয়। পরণে মারিয়ার কিছু বুঝতে বাকি থাকে না সে কি করে বসেছে। সে তার হাত ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে এসে মতিনের পাশে এসে তার পাশা পাশি হাঁটতে থাকে।
মাত্র কয়েক মুহূর্তের মারিয়ার শরিরের স্পর্শ যেন রনির শরীরে স্থায়ীভাবে লেগে থাকে। রনির শরীর ক্রমাগত শিহরিত হতে থাকে।
বুকটা ধড়পড় ধড়পড় করতে থাকে আর তার হাতদুটো যেন প্রবলবেগে ছুটে যেতে চায় মারিয়ার দিকে। এমন দুটি হাত যদি তাকে চির দিন জড়িয়ে থাকতো। রনি শফিকের হাত হতে টর্চটা নিজের হাতে নেয়। সানিও রিচার্জেবল টর্চের জ্বলমলে আলো গিয়ে আলোকিত করতে থাকে মারিয়ার শরীরকে। মারিয়া মতিনের পাশাপাশি সবার সামনে থাকায় টের পায়নি চারজনের আটটি চোখ তার পশ্চাতদেশের সৌন্দর্য সুধা আকণ্ঠ পান করে যাচ্ছে।
অনেকদিন পর শফিকের সেই পুরানো অনুভূতি মাথাছাড়া দিয়ে উঠে। তার মনটি বৃষ্টিøাত বনানী হয়ে যায় আর সমস্ত অন্তকরণ জুড়ে অনুভূত হয় অসহনীয়, অবর্ণনীয় ভেজা ভেজা ক্ষুধা। ক্ষুধা তার শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ে। রোমকুপের গোড়ায় গোড়ায় অনুভূত হয়। চটাং করে তার শরীরের পশমগুলি সব দাঁড়িয়ে যায়।
এবার যেন পাঁচ মিনিটের জন্য নয়, আজীবনের জন্য। শফিক হাত বাড়িয়ে রনির হাতটি ধরে। একে অপরের দিকে তাকায়। চার চোখ যেন কোন এক সিদ্ধান্তের আলোকে জ্বলে উঠে। রনি কালুর হাত ধরে টান দেয়।
কানে কানে পিশপিশিয়ে কিছু বলে। কালুর চোখও আনন্দে নেচে উঠে।
শফিক একটু সামনে এগিয়ে মারিয়ার পাশাপাশি হাটে। ”মারিয়া একটা কথা কই?”
মারিয়া একবার তার চেহারার দিকে তাকায়। তার ঠোটে একটা ঝাপসা হাসি ঝুলে আছে।
“বলেন। ”
“তোর এতবড় একটা উপকার করে দিতাছি, তুই আমগোরে কি দিবি?” মারিয়া তার কথার তীর্যকতা বোঝে না। বলে “কি চান আপনারা?
“না থাক, তুই আবার আমগোরে খারাপ মনে করবি” মতিনের কানটা এ কথা শুনলে তার সমস্ত নার্ভ টান টান হয়ে যায়। কি কইতে চায় হারামির বাচ্চা।
“না, বলেন না? আপনারা আমার জন্য করবেন আমি আপনাদের কিছু দিব না তা কেমনে হয়।
পাঁচ হাজার চান দশ হাজার চান বলেন। আমি রাজি। ” সরল মনে বলে যায় মারিয়া তার কথা।
“না মারিয়া, আমরা টাকা পয়সা চাই না। তুই শুধু আইজকা আমাগোরে একটু আনন্দ দিবি।
” কথা শুনে মতিন আর মারিয়া পাথরের স্থবিরতা নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। রনি এসে মতিনের গা ঘেসে দাঁড়ায়। মতিন তার পেন্টের পকেটে ঢুকানো হাত বের করে আনতেই রনি তার হাত থেকে কি যেন ছো মেরে ছিনিয়ে নেয়। তার হাতটি মতিনের কপাল বরাবর উঠতেই দেখা গেল তার হাতে উদ্ধত যন্ত্র।
“মতিন ভাই, যন্ত্রটা আইনা ভালই করছো।
কাজটা সহজ হয়ে গেলো। ”
আচমকা এসব ঘটতে দেখে মারিয়া ভয়ে একটি পাথরের মুর্তি হয়ে যায়। শফিক পাথরের মূর্তিটাকে কাঁধে তুলে রাস্তার নিচে আখখেতের আড়ালে নিয়ে ঘাস বিছানো জমিনের উপর চিৎ করে শুইয়ে রাখে। সবার পিছে রনি যন্ত্রটা উচিয়ে ধরে রেখেছে মতিনের মাথা বরাবর। পাথরের মূর্তিটির সাতে একে একে সবাই তাদের সহজ কাজটি সারিয়ে নেয় মাতিনের সামনে।
মতিনের মনের জন্য কাজটি অত্যন্ত কঠিন হলেও সে একজন পুরুষ বৈকি। তার সামনে একটা খোলা শরীর আর বাকি চার জনের সহজ কর্মগুলো তার কাঠিন্যকে বরফের মত গলাতে থাকে। অবশেষে সেও সহজ কাজটি সেরে নেয় কিছুটা যন্ত্রের মুখে আর বাকিটা তার শরীরের আগ্রহে। তাদের সবার সহজ কাজটি সমাপ্ত হলে অসাঢ় মারিয়াকে জড়িয়ে ধরে খাড়া করে তোলে রনি। টলায়মান শরীরটাকে শফিক ধরে রাখলে মতিন তার জামা কাপড় পরিয়ে দেয় অতি যতেœর সাথে।
রাত পার হয়ে গেলে সকালবেলা নূরী বেগমকে প্রতিবেশীরা মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করে। আর মারিয়াকে খুঁজতে সবাই রই রই করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।