পর্ব - ০১, আপলোড ০৬/০৯/২০১৩
পর্ব - ০২, আপলোড ১০/০৯/২০১৩
পর্ব - ০৩, আপলোড ১৩/০৯/২০১৩
--------------------------------------------------------------------
ঢাকায় মুহিতের বাসা থেকে আসার সময় অনেকগুলো ম্যাগাজিন নিয়ে এসেছিলাম। মেডিকেল সাইয়েন্স বিশেষ করে হিউম্যান ব্রেনের ওপর গবেষণাধর্মী কয়েকটি বইও কৌতুহলবশত চেয়ে নেই। মুহিত তাতে কোন আপত্তি করেনি। তবে সে একটি কথা বলেছিল, এইসব জার্নাল পড়ে যেন আমি আমার সহধর্মীনি লতাকে নিয়ে খুব বেশি ভাবনায় পতিত না হই। কারণ লতার মানষিক অসুস্থতা খুবই সামান্য।
তবে ঠিকমত কেয়ার না করলে ঝুঁকি বাড়বে।
নীলফামারি আসার পর এতদিনেও বইগুলো দেখা হয়নি। লতাকে খুঁজে বের করার মিশন নিয়ে কাটলো দু'সপ্তাহ। কলেজের ছাত্ররা সেই প্রথম থেকে চালিয়ে যাচ্ছে বিরামহীন সন্ধান। শিক্ষকের বিপদের সময় ছাত্ররা যে এত আন্তরিক ভাবে এগিয়ে আসবে, তা লতা নিখোঁজ না হলে ধারণাই পেতাম না।
কেবল তারা একা নয়, ইউনিয়নের চেয়ারম্যান, মেম্বর থেকে শুরু করে এলাকার মুদি দোকানদারও খোঁজ খবর চালিয়ে যাচ্ছে। মফস্বলের মানুষগুলোর ভালবাসায় আসলে কোন খাদ নেই। বিপদের দিনে প্রকৃত বন্ধুর মতই তারা বাড়িয়ে দেয় সহযোগিতার হাত। বলতে গেলে "প্রতিবেশি"র প্রকৃত উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে মফস্বলে, পাড়া-গায়ে। এই যেমন লতা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই আমার তিন বেলা খাওয়ার ব্যবস্থা করছে বাড়ির পাশের দুই প্রতিবেশী।
বাড়িতে না ফিরলে ব্যাপার আলাদা। ফিরলেই ছোট ছোট বাটিতে তরকারি আর এক থালা ভাত নিয়ে ঘরে চলে আসেন সোমা বৌদি। আমার খাওয়া শেষ হলে তবেই তিনি বাড়ি ফেরেন।
অনেকক্ষুণ ধরে ম্যাগাজিন গুলোর পাতা উল্টে যাচ্ছি। পড়তেও ইচ্ছে করছেনা।
এভাবেই উল্টাতে উল্টাতে একটি শিরোনাম দেখে থেমে গেলাম। এটির ইংরেজি অনুবাদ করলে শিরোনাম দাড়ায় "মানষিক রোগীর আত্নহত্যার প্রবণতা। " তার মানে মানষিক রোগীর আত্নহত্যার প্রবণতা কেনো হয় বা কেমন হয়, সেটি নিয়েই হয়তো কোন গবেষণাধর্মী প্রতিবেদন। পাতা উল্টে চলে গেলাম লেখার শেষে। সেখানে রেফারেন্স হিসাবে মার্কিন Psychiatrist Robins Eli রচিত "The Final Months" বইটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে ।
একই সাথে আরও কয়েকটি বইয়ের রেফারেন্স দেয়া হয়েছে। লেখক Psychiatrist Robins Eli আত্নহত্যার প্রবণতা ছিল বা আত্নহত্যা করেছে এমন ১৩৪ জন মানুষের ওপর গবেষণা চালিয়ে লিখেছেন The Final Months.
আবার লেখার প্রথমে ফিরে এলাম। মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু করি। গবেষক লিখেছেন, ১৯৭৪-এর জুলাইয়ের এক দিন। ফ্লোরিডার "চ্যানেল ফর্টি" টেলিভিশন চ্যানেলের সঞ্চালিকা ক্রিস্টিন চুবুক তাঁর সহকর্মীদের বললেন, তাঁর নিজের অনুষ্ঠান ‘সানকোস্ট ডাইজেস্ট’ শুরুর আগে তিনি এক্সট্রা একটা লাইভ নিউজ প্রোগ্রাম উপস্থাপনা করবেন।
তার আগে কোনও দিনই ক্রিস্টিন এ রকমটা করেননি, তাই সহকর্মীরা একটু অবাক। ক্রিস্টিন মুচকি হেসে নিউজ অ্যাংকর-এর চেয়ারে বসলেন, সামনে নিউজ কপি।
প্রথমে দু’তিনটে ন্যাশনাল নিউজ, তার পর স্থানীয় একটা পার্কে গোলাগুলির খবর পড়লেন, তার পর বললেন, ‘চ্যানেল ফর্টি যেমন যে কোনও রক্তারক্তির সর্বশেষ ও তরতাজা খবর আপনাদের সামনে দেখায়, ঠিক সে রকমই একটা অ্যাটেম্পটেড সুইসাইড এখন আপনারা দেখবেন। ’ বলেই ডেস্কের নিচে ব্যাগের মধ্যে রাখা পয়েন্ট থ্রি এইট রিভলভার তুলে নিয়ে ডান কানের পিছনে ঠেকিয়ে গুলি করলেন। ক্যামেরাম্যান মানুষটি প্রথমে ভেবেছিলেন ক্রিস্টিন বুঝি মজা করছেন, কয়েক মুহূর্ত পরেই ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া, নিউজ ডেস্কের ওপর ধড়াম পড়ে যাওয়া রক্তাক্ত শরীরটা দেখে বুঝলেন, কী হয়ে গেল।
নিমেষে হইহই গোলমাল, চ্যানেলটা হঠাৎ অন্য একটা রেকর্ডেড অনুষ্ঠান দেখানো শুরু করল। টিভির সামনে বসে থাকা বহু দর্শক হতভম্ব, অনেকেই ভয় পেয়ে টিভি-অফিসে ফোন করে জানতে চান, গুলির দৃশ্যটা বানানো তো? তত ক্ষণে ক্রিস্টিনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাসপাতালে। সন্ধে নাগাদ অফিশিয়ালি টিভির পরদায় আর এক জন বিষণ্ণ সঞ্চালকের ঘোষণা, ক্রিস্টিন মৃত। তাঁর হাতে তখন ক্রিস্টিনেরই লিখে যাওয়া সুইসাইড কপি। ‘আগামী এগারো ঘণ্টার মধ্যে আমি খুব সম্ভবত মৃত।
"
সেখানে এই পূর্বাভাস থাকলেও আদৌ লেখা নেই কেন এই আত্মহত্যা। ওই হাড়-হিম সিদ্ধান্তের আড়ালে দুঃসহ ব্যক্তিগত কি যন্ত্রণা তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন? কী চুপিসারে, অথচ কী প্রকাশ্যেই না চলে গেলেন ক্রিস্টিন!
তিনি কি সত্যি সত্যি কোন মানষিক রোগি ছিলেন? নাকি ব্যতিক্রম কিছু করে দেখানোর ইচ্ছে থেকেই নিজের জীবন নিয়ে খেললেন। সেটি যদি হয়ে থাকে, তবে বলবো, তিনি মানষিক রোগের চুড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে যাচ্ছিলেন। এমন অবস্থায় পৌছানোর পর কারোর আশ্রয় হয় পাগলাগারদে, কেউ করে ফেলেন আত্নহত্যা।
সব মানষিক রোগীর ভেতরে কি আত্নহত্যার প্রবণতা থাকে?
অথবা যদি এভাবে বলা হয়, আত্নহত্যাকারী সকলে মানষিক রোগী, তাহলে কি কথাটা সঠিক হবে।
মানষিক রোগে আক্রন্ত হওয়ার কারণেই যে সব আত্নহত্যা সংঘটিত হয়, তেমনটি নয়। সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে আত্নহত্যা করার উদাহরণ একেবারে কম না। প্রকাশ্যে নিজ শরীরে কেরাসিন ঢেলে আগুনে পুড়ে আত্নহত্যা করার নজির আছে । কিছুদিন আগেই এমন একটি ঘটনার কথা জানলাম। যদিও ৬৩ সালের ঘটনা।
কিন্তু সেটি ওই সময় বিশ্বব্যাপি বেশ আলোড়ন তুলেছিল। তৎকালীন দক্ষিণ ভিয়েতনামের রোমান ক্যাথলিক সরকারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে প্রকাশ্যে আত্নহত্যা করেছিলেন একজন সন্ন্যাসী। ভিয়েতনামের হো চিন মিন শহরে ঘটে সেই সন্ন্যাসীর প্রকাশ্যে আত্নহত্যার ঘটনা।
ঘটনার বিবরণ ছিল এমনই যে, কয়েকজন সাংবাদিককে ডেকে এনে তিনি তাদের সামনে বসেন পদ্মাসনে। কিছুক্ষণ পর একটি দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে ছুয়ালেন নিজের শরীরে।
সম্ভাবত আগে থেকেই দাহ পদার্থ সঞ্চালিত হয় এমন কোন কিছু তিনি শরীরে মাখিয়ে রাখেন। মুহুর্তেই তার লকলকে শরীরে জ্বলে ওঠে আগুন। সেই আগুনের গ্রাসে দগ্ধ ওই সন্ন্যাসীর শরীরটা একটুও নড়েনি, মুখ থেকে বেরোয়নি অস্ফুট কোনও আওয়াজও। ‘অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস’-এর একজন ফোটোগ্রাফার সেই দহনচিত্র ক্যামেরাবন্দি করে "ওয়ার্ল্ড প্রেস ফোটো অব দ্য ইয়ার’"এর সম্মান কুড়িয়েছিলেন ।
ক্রিস্ট্যানা বা ওই সন্ন্যাসী যেকারণেই আত্নহত্যা করুক না কেনো, বা তারা মানষিক রোগী ছিল, কি ছিল না, তা নিয়ে আমার কোন কৌতুহল নেই।
আমি বিশ্বাস করি লতা জীবিত আছে এবং সে আত্নহত্যা করতে পারেনা। মনোচিকিৎসক বন্ধু মুহিতের সাথে আজও সকালে এ প্রসঙ্গে আলাপকালে সে জানায়, লতার ভেতরে সিজোফ্রেনিয়া'র (SCHIZOPHRENIA) লক্ষণ যেহেতু সামান্য পরিমানে ছিল, সেহেতু ধারণা করা যায় যে বাড়ির বাইরে চলে গিয়ে তিনি পথ হারিয়ে ফেলেছেন। পরে আস্তে আস্তে ভুলে যেতে শুরু করেন নিকট অতীত। এখানে সবচেয়ে দু:শ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, লতা একজন নারী। কোন খারাপ মানুষের খপ্পরে পড়ে গেলে তার জীবনের পরিণতি কোন পথে ধাবিত হবে, তা সহজে অনুমান করা যায়।
তবে মুহিত বেশ জোর দিয়ে বলেছে, এটুকু নিশ্চিত থাক বৌদি মানে তোর বউ আত্নহত্যা করতে যাবেননা। তার ভেতরে হীনমন্যতায় ভোগার কোন লক্ষণ দেখা যায়নি।
মুহিত, লতা, মানষিক রোগ, হীনমন্যতা, আত্নহত্যা, সিজোফ্রেনিয়া, ক্রিস্ট্যানাসহ নানা কিছু নিয়ে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ খেয়াল করলাম বাইরে অনেক মানুষ হৈ চৈ । জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি শত শত মানুষ ছুটছে হণ্যেরবিলে ।
কি হয়েছে সেখানে?
এমন সময় হুরমুর করে ঘরের ভেতরে ঢুকলেন সোমা বৌদি।
সাথে তার মেয়ে শ্যমলী। হাফাতে হাফাতে বৌদি বললেন, হণ্যেরবিলের ধারে একটি লাশ পড়ে আছে। চেহারা নাকি বুঝা যাচ্ছে না। ফুলে ব্যাঙ হয়ে গেছে। গায়ে কোন কাপড় নেই।
কি বলছো বৌদি?
হ্যা, একটু আগেই শ্যামলীর ছোট কাকু সেখান থেকে ফিরলো। বলছে সম্ভাবত ওটা কোন নারীর লাশ। হাতে বালা আছে।
আমি আর দাড়িয়ে থাকতে পারলাম না। মোচড় দিয়ে উঠলো বুকের ভেতর।
সারা শরীর হিম হয়ে যেতে লাগলো । বাইরে বেরিয়ে উর্দ্ধোশ্বাসে ছুটতে লাগলাম হণ্যেরবিলে।
(চলবে.....)
আগামী ২০ সেপ্টম্বর সকাল সাড়ে ন'টায় ৫ম পর্ব
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।