আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সৈকতে সঞ্চরণ ঃ শেষ সর্গ

সুন্দরী বালিকাদের যত্ন করে কামড়াই

3. পরদিন সকালে হুলস্থূল কান্ড। কারোই ঘুম হয়নি ঠিকমতো, অনেকের সারা গায়ে ব্যথা, আর ফার্নিচার সরাতে গিয়ে নাজমুল ভাই ডান পায়ের নখে ভয়ঙ্কর ব্যথা পেয়েছেন। বখতিয়ার ভাই অস্ত্রোপচার করে তাঁকে মোটামুটি সাইজে আনলেন। যাবতীয় প্রভাতীকর্তব্য সেরে, উপল উপকূল রেস্টহাউস-এর দেনাপাওনা মিটিয়ে, অফিশিয়াল চিত্রগ্রহণের আড়ম্বর সেরে বেরোতে বেরোতে রোদ চড়ে গেলো। আকাশ আজ স্মিতমুখ।

আজকের গন্তব্য ইনানী, বাংলাদেশের একমাত্র প্রস্তরসৈকত, এশিয়ার প্রশস্ততম সৈকত। মনখালি সৈকতে পৌঁছোনোর পথ এক কথায় অপূর্ব। বেশ কয়েকটা লেগুন, পাশে ঝাউবন, লেগুনে বিভিন্ন ধাঁচের মাছধরা নৌকো, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটির গায়ে বর্মী হরফে আঁকিবুকি কাটা, নোঙর করা রয়েছে। এখানে বালি খুব ঝকঝকে, পানির রঙ অদ্ভূত নীল, আর আকাশও সুর মিলিয়েছে সমুদ্রের সাথে। অভিযাত্রীদের ক্যামেরা ব্যস্ত হয়ে উঠলো তাঁদের পায়ের সাথে।

কিছুদূর এগিয়ে ডাব খাওয়ার জন্যে একটা সাম্পানে চড়ে বসলেন সবাই। যুগে যুগে বহু জমিয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ, গোটা বছরের ডাবের দেনা এই সুযোগে মিটিয়ে নিতে চান সবাই। ঢাকায় যেমন ফোস্কাপড়া পিগমি ডাব আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি হয়, তেমনটা নয়, খুবই সস্তায় প্রমাণ সাইজের ঝকঝকে ডাব মেলে এখানে। মিলন ভাই আজকে অনেকের টার্গেট। মিলন ভাই নাকি গতদিন মোটেও হাঁটেননি, অন্যেরা চোখের আড়াল হওয়া মাত্র চাঁদের গাড়িতে চেপে বসেছেন, মিলন ভাই নাকি পাঁচটা মাত্র তারার নাম জানেন, এগুলোই কুমীরের ছানার মতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখান, মিলন ভাই নাকি জ্বীন সাধনা করেন --- ইত্যাদি ইত্যাদি।

মিলন ভাই অবশ্য বালির ওপর শুয়ে শুয়ে বালির সাথে খেলা করছিলেন, তিনি জ্বীনসাধকদের মতো মিটিমিটি হাসেন, কিছু বলেন না। ডাব খেয়ে পোক্ত হয়ে হাঁটার গতি বাড়ালেন সবাই। বেশ কয়েক কিলো এগিয়ে অভিযাত্রীদের যা চোখে পড়লো, সেটা একটা বিস্ময়, এবং তা পাঠকদের কাছ থেকে গোপন রাখা হলো। কেবল যাঁরা হেঁটে পৌঁছুতে পারবেন, তারাই সেই অপার্থিব সৌন্দর্যের নাগাল পাবেন, বাকিদের জন্যে ঘেঁচু। কিছুক্ষণ সেখানে উদাস মনে কাটিয়ে আবার উঠলেন সবাই।

কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে পারভীন আপার সহকর্মী সাংবাদিক মোরশেদ ভাইকে সস্ত্রীক পাওয়া গেলো। যদিও একই দলে যোগ দেয়ার কথা ছিলো, শেষ মূহুর্তে যোগাযোগের অভাবে এঁরা দুজন দলছুট হয়ে পড়েছিলেন। তবে হাল ছাড়েননি তাঁরা, যাচ্ছেন উল্টো, অর্থাৎ হেঁটে হেঁটে কঙ্বাজার থেকে টেকনাফ। পথলব্ধ উপদেশ-পরামর্শ বিনিময় করে দু'পক্ষ দু'দিকে হাঁটা দিলেন। আজ আর গতদিনের মতো তেজ নেই কারো, বার বার বসা হলো বিশ্রামের জন্যে।

পুতুল আপা স্থানীয়দের কাছ থেকে বরই কিনে খাওয়ালেন সবাইকে। রাতে ভালো ঘুম না হলে এই কড়া রোদে গতি বাড়ানো মুশকিল। অনেকের পায়ে ফোসকা পড়েছে, সেগুলো ফেটে গিয়ে জ্বলছে ভীষণ। কারো কাফ মাসল, কারো ঊরুর পেশীতে টান লেগেছে। তবে নাজমুল ভাই ব্যান্ডেজ করা পা নিয়েও চমৎকার হাঁটছেন।

বালি আর মিলন ভাই নির্বিকার। বালির চারটা পা বলে তার গতিও দ্বিগুণ, আর মিলন ভাই যদিও দ্বিপদ ---। রূপবতীতে কিছুক্ষণ প্রবাল আর সবুজ পাথরের ওপর কাটিয়ে আবার সবাই এগোলেন, কেউ একটু সামনে, কেউ একটু পেছনে। বালি এখানে খানিকটা ঘুমিয়েছে, স্থানীয় এক প্রৌঢ় তাকে পুষ্যি নিতে চেয়ে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু সে ট্রেকারদের পিছু ছাড়বার পাত্রী নয়। সবাই হাঁটা শুরুর সাথে সাথে সে ঘুমটুম ফেলে দে দৌড়।

কিছুদূরে একটা বালিয়াড়ি পেরোনোর পর পেছনের দলটার সাথে বীচ প্যাট্রল (বিডিআর)-এর দেখা হলো। তারা দূরের একটা উঁচু টিনশেড দেখিয়ে বললেন, ওটা ইনানী রেস্টহাউস। সজীব আর শাহুল সাগরের মাঝে জেগে থাকা সৈকতসংলগ্ন ছোট্ট একটা ঝিকিমিকি দ্বীপে পদবালি দিয়ে এসেছে এর মধ্যে। ওয়াহিদ ভাই আর হিমু দ্বিতীয় দফা ডাব খাওয়ার তোড়জোড় করছিলেন, তবে ডাব আসতে আসতে সবাই এগিয়ে গেলেন অনেকটা। কী আর করা, শুকনো গলা নিয়ে আবার হাঁটা শুরু হলো।

কিছুদূর এগিয়ে চোখে পড়লো বিচিত্র দৃশ্য। দূরে একটা কিছু পড়ে আছে সৈকতে, তার একটু সামনে আরো একটা কিছু, তার কিছু সামনে আরেকটা। অনেক দূরে একটা কিছুর সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে চঞ্চল আর ফাইয়াজ। সামিয়া খুবই দুঃখ করতে লাগলো, এইভাবে সমানে তিমির বাচ্চা মারা পড়ছে দেখে, তবে আরেকটু এগোতেই বোঝা গেলো, ওগুলো মানুষের বাচ্চা --- যথাক্রমে পারভীন আপা, ইকবাল, শাহেদ ভাই ---। সৈকতে যে যার মতো চিৎপাত হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন।

সেই দূরের টিনশেডটা আসলে বহুদূরে, সেটাকে শুরুতে যেমন ছোট দেখাচ্ছিলো, ঘন্টাখানেক হাঁটার পরও তেমন ছোটই দেখালো। তারপর একসময় যখন সেটা কাছে এলো, তখন জানা গেলো, সেটা আসলে বিডিআর-এর ফাঁড়ি। সবার মেজাজ খারাপ, গলা শুকনো, বিডিআর সদস্যদের শাপান্ত করে, আবার খানিকটা বসে হাঁটা শুরু করতে হলো। কিছুটা এগিয়ে জনৈক প্রৌঢ়ের সাথে দেখা। তাঁর কাছ থেকে জানা গেলো, অভিযাত্রীদের খবর তিনি পেয়েছেন আগেই, আর ইনানী রেস্টহাউস আরো সামনে।

ঐ যে টিনশেড দেখা যাচ্ছে, ওটা পার হলে রেস্টহাউস চোখে পড়বে। ট্রেকাররা ইতিমধ্যে টিনশেডগুলোর স্বভাব বুঝে গেছেন, এরা অনেকক্ষণ যাবৎ দেখা দেয়, কিন্তু ধরা দেয় না। কাজেই আবার গরম মেজাজ নিয়ে পা টেনে টেনে হাঁটা। হিমুর ঊরুর পেশীতে টান পড়েছে, দশ মিনিট পরপরই বসে পড়তে চাইছে সে, কাজেই মিলন ভাই তার অহমে সুড়সুড়ি দেয়ার জন্যে তার ব্যাগটা কাঁধে তুলে জোর হাঁটা শুরু করলেন। এভাবে তার প্রেস্টিজ হাইজ্যাক হয়ে যাচ্ছে দেখে আবার খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছুটলো সে, মিলন ভাইয়ের হাত থেকে জগদ্দল ব্যাকপ্যাকটা উদ্ধার করা সহজ কথা নয়।

ঘণ্টাখানেক পর যখন ইনানী রেস্ট হাউস চোখে পড়লো, তখন সবাই থামলেন। একটা বড়সড় বিশ্রাম নেয়া হবে। মিলন ভাই, বরুণদা আর শাহেদ ভাই এগিয়ে গেছেন লাঞ্চের খোঁজ নিতে। এই ফাঁকে বিস্কুট দিয়ে ক্ষিদে মারছেন সবাই। বখতিয়ার ভাই সমসাময়িক বাংলা কবিতা এবং ইংরেজি সাহিত্যে এর প্রভাব নিয়ে একটি জটিল তাত্তি্বক আলোচনার সূত্রপাত করতে যাবেন, এমন সময় স্থানীয় জনতা ভিড় করলো সেখানে।

বালি রোদে শুয়ে ঘুমাচ্ছিলো, খামোকাই তাকে ঢিল ছুঁড়তে লাগলো একদল বাচ্চাকাচ্চা। এতোদূর হেঁটে হেঁটে সামিয়ার মেজাজ খারাপ, সে উঠে এসে এমন কড়া ঝাড়ি লাগালো যে জনতার ভিড় খুব জলদি জলদি পাতলা হয়ে গেলো। এরই মধ্যে বরুণদা ফিরে এলেন বিস্কিট আর হালকা পানীয় নিয়ে। সামনে কোথাও ভাত খাওয়ার ব্যবস্থা নেই। সব দোকান বন্ধ, আর রেস্টহাউসের বাবুর্চি কোন রকমের সহযোগিতা করতে নারাজ।

বরুণদা ইনানীতে অফিশিয়াল ক্যাপাসিটিতে এসে ভবিষ্যতে তাকে কঠোর শাস্তি দেয়ার সংকল্প নিয়েছেন। বিস্কিট খেয়ে আবার উঠলেন সবাই। সূর্য টলে গেছে অনেকখানি। চাঁদের ত্রয়োদশী চলছে, সমুদ্র বেশ উত্তাল। সমুদ্র আর বাতাসের গর্জনে অবশ্য সবাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।

অপূর্ব বীচ, আর সন্ধ্যেবেলা পশ্চিমে সূর্য আর পূবে চাঁদ অন্য রকম আলো এনে দিয়েছে সৈকতে। আরো বেশ কিছুদূর হেঁটে, কয়েকটা খাল পার হয়ে একসময় অভিযাত্রীরা পৌঁছালেন সীকিং হ্যাচারিতে। এখানেই রাতে আশ্রয় নেয়া হবে। হ্যাচারিতে পৌঁছে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে হাতমুখ ধুয়ে রান্নার তোড়জোড় নেয়া হলো। খাসির বারবিকিউ করার আয়োজন চলছিলো, কিন্তু সাতপাঁচ ভেবে সেটা বাতিল করা হলো।

চাল-ডাল-আলু-ডিম কিনে দেয়া হয়েছে হ্যাচারির বাবুর্চি সেলিম ভাইকে, খিচুড়ি হবে রাতে। কিছুক্ষণ আড্ডা মেরে একদল গেলেন হ্যাচারির অপারেশন দেখতে, একদল জখম হাত পা নিয়ে পড়ে রইলেন। রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে জলদি জলদি ঘুমুতে গেলেন সবাই। তিরিশ কিলো হাঁটা হয়েছে আজ। পরদিন আরো তিরিশ কিলো।

কাজেই উঠতে হবে ভোরে। পুতুল আপা, শিলা আপা, পারভীন আপা আর সামিয়া রইলেন হ্যাচারির গেস্টরুমে, বাকিরা বাইরে ওয়াচহাউসে। ওয়াচহাউসটা একটা গোল দোতলা ঘর, ধূসর সাগর আর মাখনরঙা চাঁদ চোখে পড়ে সেটা থেকে। মোটামুটি ঠান্ডা পড়েছে, স্লিপিংব্যাগ বিছিয়ে আড্ডা মারতে মারতে সবাই ঘুমসাগরে তলিয়ে গেলেন। 4. ভোরে অ্যালার্মের একটা ছোটখাটো অপেরা হয়ে গেলো।

নানা সুরে, নানা তালে একেক জনের অ্যালার্ম সোচ্চার হয়ে উঠলো। রাত ফুরিয়েছে। চাঁদ আস্তে আস্তে হলদে হয়ে ঢলে পড়ছে সাগরে। অপূর্ব একটা দৃশ্য, একে একে রেশম পোকার মতো ঘুমের গুটি কেটে স্লিপিং ব্যাগ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন সবাই। আজকে সবাই কিঞ্চিৎ টাটকা।

আজই কঙ্বাজারে পৌঁছে ঢাকার বাসে চড়ে বসতে হবে। পরদিন সবার অফিস, ইউনিভার্সিটি খোলা। সবকিছু সেরে চটজলদি বেরিয়ে পড়লেন সবাই। আজ সৈকতে নেমে মিলন ভাই আরো কয়েকটা কুকুরকে দলে জুটিয়ে নিলেন। বালির সাথে ভাব হয়ে গেলো একটার, তার নাম বাঘা।

মিলন ভাই অবশ্য আরো তিন চারটাকে টোস্ট বিস্কুটের লোভ দেখাচ্ছিলেন, কিন্তু তারা মনে করে উল্টো দিকে চোঁ চাঁ দৌড়ে পালালো। মিলন ভাই, পারভীন আপা, হিমু আর শাহুল আজ একটু পিছিয়ে, বাকিরা পা চালিয়ে এগিয়ে গেছে। চলতে চলতে শুরু হলো গান। লাকি আখন্দ, আজম খান, সুমন চট্টোপাধ্যায়, মৌসুমী ভৌমিক, জিনাত রেহানা, শামশাদ বেগম, জন ডেনভার, লস লোবোস ্#61630; কাউকে রেহাই দেয়া হলো না। টানা দেড়ঘণ্টা গাইতে গাইতে আর হাঁটতে হাঁটতে একসময় রেজু খালের ওপর ব্রিজের ধারে একটা চায়ের দোকানে গিয়ে বসা হলো।

রেজু খালের দু'ধারে দৃশ্যপটের সৌন্দর্যের জন্যে বিশেষণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সামনে খানিকটা পথ বীচ ছেড়ে মেরিন ড্রাইভের জন্যে নিধর্ারিত পথে হাঁটতে হবে। সামনের দলটা একটু এগিয়ে গেছে। চা খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগিয়ে একে একে চোখে পড়লো সেনা প্রকৌশলীদের বুলডোজার, নিমর্ীয়মাণ ম্যারিন ড্রাইভ, স্নিগ্ধ সবুজ সুপারি গাছের সারি, গম্ভীর নীল আকাশ, বাদামি বাঁশের কঞ্চিতে ঘেরা পানের বরজ, পান্নাবরণ ধানের ক্ষেত, বেঁটে পাহাড়ের গায়ে নানা চেহারার হাসিমুখ ঝাউবন, দূরে হলদে সৈকত আর নীল সমুদ্র ্#61630; রঙের রায়ট একেবারে, সব মিলিয়ে সব দৃশ্যে স্বপ্ন স্বপ্ন ভাব, যদিও স্বপ্ন নাকি লোকে সাদাকালো দেখে। প্যাঁচার দ্বীপ একটা গ্রামের নাম, সেটা পার হয়ে আবার সৈকতে নেমে পড়েছেন অভিযাত্রীরা।

পথে স্থানীয় শিশুরা দল বেঁধে তাদের পিছু নিয়েছে, মিলন ভাই তাদের ডেকে জানালেন, বন্ধুরা, তোমরা পপি আপাকে চেনো? বাংলা সিনেমা দেখো নাই? এই যে আপামণিকে দেখছো, ইনি পপি আপার ছোট বোন। ছেলেমেয়ের দল নিজেদের মধ্যে আলাপ করে পটাপট পারভীন আপার সামনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেলো, ছবি তুলবে তারা। পপি আপার পরিবারের একজনের সঙ্গ খোদার ইশারায় মিলে গেছে, এ সুযোগ মাঠে মারতে তারা নারাজ। অবশ্য পারভীন আপাও এই মিথ্যাচারে আপত্তি করলেন না, পপিআপারছোটবোনসুলভ গ্ল্যামার আমদানি করে ছবিতে পোজ দিয়ে দাঁড়ালেন। মিলন ভাইও শিশুপাচারকারীদের মতো হাবভাব নিয়ে, একহাতে একটা কাটারি, অন্য হাতে একটা পিচ্চির কব্জি ধরে কয়েকটা ছবি তুললেন।

শাহুল আর হিমুর মাথা আশেপাশের দৃশ্য দেখে গরম, তারা সমানে আকাশসাগরঅরণ্যের ছবি তুলছে। সৈকতে নেমে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে পামের বন চোখে পড়লো। এতক্ষণ সৈকতে কোন আবর্জনা চোখে পড়েনি, কিন্তু যতই হিমছড়ি কাছে চলে আসছে, তত বেশি করে অবিবেচক টু্যরিস্টদের উপস্থিতির পরিচয় পেলেন অভিযাত্রীরা। যেখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে নানা রকম পলি প্যাক, চিপস, বিস্কিট, এমনকি ডিটারজেন্টের প্যাকেট। বিয়ারের খালি কৌটোর কথা না বললেও চলে।

পামের বনের ভেতরে একটা খামার বাড়ি, টু্যরিস্টদের জন্যে তৈরি এবং সজ্জিত করা। সেখানে ডাব পাওয়া এবং খাওয়া গেলো। গলা ভিজিয়ে আবার শুরু হলো হাঁটা। কিছুদূর এগিয়ে দেখা গেলো, সামনের দলটা বালির ওপর মেসেজ লিখে গেছে। সেটা পড়ে জানা গেলো, পেছনের দলটা ঘন্টাখানেক পিছিয়ে পড়েছে, কাজেই তাঁরা জোরে পা চালালেন।

পথে দু'এক জায়গায় তাঁরা প্লাস্টিক পেতে বসেছিলেন, কিন্তু তীব্র বাতাসে বালির কণা এত জোরে গায়ে বেঁধে যে বেশিক্ষণ বসে থাকা যায় না। আর এ বালি উড়ে আসে মাটি ঘেঁষে, তাই দাঁড়িয়ে থাকলে সমস্যা নেই, বসলেই ঝামেলা। আরো ঘণ্টাখানেক পা চালিয়ে কয়েকটা জীপ দেখা গেলো। সেজেগুজে সমুদ্রদর্শনে এসেছেন কয়েকজন টু্যরিস্ট। তাদের অনেক সামনে হেঁটে চলেছে কয়েকজন, পিঠে হ্যাভারস্যাক।

হুম, এক্সপ্লোরারস' ক্লাবের মেম্বার না হয়েই যায় না। মিলন ভাইকে দূর থেকে সনাক্ত করতে পেরে থেমে পড়লেন অগ্রবতর্ীরা। সবাই একসাথে হওয়ার পর একটা লম্বা বিশ্রাম নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। সামনের দলের অভিযাত্রীরা পথে তরমুজ কিনেছেন পিছিয়ে পড়া চারজনের জন্যে, কাজেই পশ্চাদবর্তী দলের সদস্যরা হামলে পড়লেন সেগুলোর ওপর। কিছুক্ষণ সমুদ্রে হাত পা ছুঁড়ে একে একে সবাই এগিয়ে চললেন আবার।

এবার মিলন ভাই এগিয়ে গেলেন সামনে, শিলা আপা পিছিয়ে পড়লেন। হিমছড়ি পার হয়ে কঙ্বাজারের দিকে এগিয়ে চলতে চলতে চোখে পড়লো অসংখ্য জীপের ট্র্যাক। এবং দুঃখজনকভাবে, অসংখ্য বজর্্য। এভাবেই মনোরম এই বালুকাবেলাকে নষ্ট করতে করতে এগিয়ে চলছে টু্যরিস্টভর্তি গাড়িগুলো। প্লাস্টিকের প্যাকেট সৈকতে ছুঁড়ে ফেলতে কারো কোন দ্বিধা নেই।

হিমছড়ি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সৈকতের রূপ খানিকটা একঘেয়ে, লোকালয়ের কারণে কিছুটা বিনষ্টরূপ। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এই বিশাল বীচের সবচেয়ে নোঙরা অংশটি হচ্ছে হিমছড়ি থেকে কঙ্বাজার। তিন দিনের এই অভিযাত্রায় কোন শ্বেতাঙ্গ পর্যটক অভিযাত্রীদের চোখে পড়েনি, যদিও টু্যরিস্ট সীজন এখন তুঙ্গে। অর্থাৎ, সৈকতের মূল সুষমাময় অংশটিতে বহির্বিশ্বের পর্যটকদের চোখ পড়েনি। এই নিয়ে গল্পগুজব করে পথ চলতে চলতে বিকেলবেলা কঙ্বাজারে পৌঁছে গেলো পেছনের দলটাও।

বরুণদা অনেক আগে পৌঁছেছেন, জরুরি কাজে তিনি চলে গেছেন চট্টগ্রাম। সবার আগে পৌঁছেছেন বখতিয়ার ভাই। এক এক করে সবাই সৈকত থেকে কঙ্বাজার শহরে হোটেল সায়েমানে নজরুল ভাইয়ের রুমে গিয়ে হাজির হলেন। নজরুল ওরফে খোকন ভাই কঙ্বাজারে একটা কাগের্া এয়ারলাইন্স-এর পরিচালক, মূলত ইউক্রেনিয়ান ক্রু নিয়েই চলছে তাঁর জেড এয়ারলাইন্স। পুতুল আর শিলা, দুই বোন চলে গেছেন বার্মিজ মার্কেটে, তাঁরা একবারে সন্ধ্যে আটটার সময় বাস কাউন্টারে হাজির হবেন।

সবাই গোসল সারতে সারতে সন্ধ্যে হয়ে এলো। গায়ে মৃদু ব্যথা সবারই, খোলা আকাশ ছেড়ে ছাদের নিচে মাথা গুঁজে দেয়ায় সবাই একটা ঘোরের মধ্যে, ভাবখানা এমন, এইটা আবার কী জিনিস? সন্ধ্যেবেলা খোকন ভাই সবাইকে নিয়ে হাজির হলেন তাঁর বন্ধু সাজ্জাদ ভাইয়ের ক্যাফে 'অ্যাঞ্জেল ড্রপ'-এ। সেখানে কফি খেতে খেতে বাসের সময় হয়ে এলো, হুড়োহুড়ি করে সবাই আবার ছুটলেন বাস কাউন্টারের দিকে। মিনিট পাঁচেক দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিলো বাসটাকে, বাসের যাত্রীদের কাছে সেজন্যে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে একে একে সবাই চড়ে বসলেন। একশো কিলো ট্রেকিং শেষে খানিকটা ক্লান্ত পা নিয়ে ঢাকায় ফিরে চললেন সবাই।

ফেরার রাতে পূর্ণিমা। চারদিকে নরম আলো ছড়িয়ে চাঁদ উঠেছে। আজ সাগরে জোয়ার সবচে জোরালো হবে। সাগরের তীর ছেড়ে আবার ধূলিমলিন ঢাকা শহরে ফিরে চলছেন সবাই। এ ক'দিনে টাটকা নোনা বাতাসে অভ্যস্ত সবাই, ঢাকায় ফিরে আবার সেই ধূলা আর কালো ধোঁয়ায় কী হয় কে জানে! বিশেষ দ্রষ্টব্য: বালি অভিযাত্রীদের সাথে কঙ্বাজার পর্যন্ত এসেছিলো।

বখতিয়ার ভাই বাস কাউন্টারে যাওয়ার জন্যে রিকশা ঠিক করেছিলেন, সে রিকশার পাশে ছুটতে ছুটতে যাচ্ছিলো। রিকশাওয়ালা গতি বাড়িয়ে দেয়ার পর সে আর বেশিক্ষণ তাল মিলিয়ে ছুটতে পারেনি ক্লান্ত শরীর নিয়ে, পিছিয়ে পড়েছিলো। পরে পর্যটন মোটেলের কাছে সে পারভীন আপাকে খুঁজে বের করেছিলো, কিন্তু পারভীন আপা কুকুর ভয় পান বলে তাকে কাছে ঘেঁষতে দেননি। মন খারাপ করে সেখানেই কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়েছিলো সে। ফরিদ ভাই তাকে শেষ দেখেছেন আরেকদল অভিযাত্রীর সঙ্গ নিতে।

5. পাঠকদের জন্যে দু'টি অনুরোধ। এই অপূর্ব রূপময়ী সৈকতের সানি্নধ্যে যখন যাবেন, দয়া করে এমন কিছু ফেলে আসবেন না, যা জৈবপচনশীল (বায়োডিগ্রেডেবল) নয়। প্লাস্টিকের ব্যাগ বা বোতল, চকলেট বা ব্যান্ডেজের খোসা, পানীয়ের ক্যান ্#61630; কিছুই না। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, এঙ্প্লোরারস' ক্লাব অব বাংলাদেশের সদস্যরা তাঁদের ব্যবহৃত প্রত্যেকটি অপচনশীল বর্জ্য নিজেদের সাথে ফিরিয়ে এনে ঢাকার ডাস্টবিনে ফেলার ব্যবস্থা করেছেন। আপনার ফেলে যাওয়া আবর্জনা কিন্তু সৈকতে পড়ে থাকবে বহুদিন।

পরবর্তী পর্যটকদের বিরক্তি উৎপাদন করা ছাড়া আর কোন ভূমিকা সেগুলো রাখবে না। নিজের রূপের মতোই নিজের দেশের সৌন্দর্যের প্রতি যত্নবান হোন। আর, কেউ যদি বালিকে খুঁজে পান, দয়া করে ভালো কয়েকটা বিস্কিট খাওয়াবেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।