আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বার্লিন! বার্লিন!!

(বার্লিন প্রাচীরের সামনে)
ইউরোপের কোন শহরের দর্শনার্থীদের ভিড় সবচেয়ে বেশী বলুন তো? রোম? প্যারিস? লন্ডন? উহু, হলো না! ভেবে নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন যে আর কোন শহর পর্যটকদের এতটা আকৃষ্ট করতে পারে? উত্তর একটাই- বার্লিন।
ইউরোপীয় মহানগরীগুলোর মাঝে বার্লিনে পর্যটকদের জনসমাগম সবচেয়ে বেশী, বার্লিন পৃথিবীর একমাত্র শহর যাকে একসময় নিষ্ঠুরভাবে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছিল ১৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এক প্রাচীর দ্বারা। দুই জার্মানির একত্রীকরণের পর রাজধানী স্থানান্তরিত হয় বার্লিনে, তারপর থেকেই যেন এর নবউত্থান, সর্বত্র চলছে নয়নাভিরাম নব স্থাপত্য স্থাপনের প্রতিযোগিতা, নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে অসংখ্য জাদুঘর, রাস্তা, ট্যুরিস্ট স্পট। আজকের বার্লিন যেন এক চলমান মহা সৃষ্টিযজ্ঞ।
২০০৩এর ডিসেম্বরে প্রথমবার বার্লিন দেখেই যে দুইটি শব্দ মাথায় ভিড় করেছিল সেগুলো হচ্ছে বার্লিন তুলনাহীন।

এই বিশাল মহানগরীর সর্বত্রই কেমন যেন উৎসবের আমেজ, পর্যটকদের ভিড়। দিন নেই, রাত নেই, সর্বদাই প্রাণোৎসবে উচ্ছল, বহুমাত্রায় বর্ণীল।
প্রথমদিন বেশ রাত করে পৌঁছানোতে হোটেল খোজার ঝামেলায় বিশেষ কিছু দেখা হয় নি, পরদিন প্রথমেই দেখতে গেলাম বিখ্যাত (!) বার্লিনের প্রাচিরের অবশিষ্টাংশ। Cold War এর ফলশ্রুতিতে ১৯৬১ সালে বার্লিনকে পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্ত করে ১৬৫ কিমি দীর্ঘ এই প্রাচীর তৈরি করা হয়। এ যেন ছিল পূর্ব (Communism) ও পশ্চিমের (Capitalism) মিলনরেখা।

নানা ঘটনার ঘনঘটায় ১৯৮৯ সালে বার্লিন প্রাচীরের পতন ঘটে এবং ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর পূর্ব ও পশ্চিম দুই জার্মানি একত্রিত হয়। বর্তমানে বার্লিন প্রাচীরের মাত্র ৩০০ মিটার অবশিষ্ট আছে, যা রেলস্টেশন Ostabanhofএর খুব কাছে অবস্থিত। যদিও তা দেখতে খেয়ালি কোন চিত্রকরের বিশাল ক্যানভাসের মত নানা রঙে রাঙানো। পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই কিছু না কিছু লেখা আছে দেয়ালের উপরে, আছে বিচিত্র সব পেইন্টিং। খুবই অবাক হলাম বাংলায় কোন লেখা না দেখে, আমার ধারণা ছিল এই ব্যাপারটাই আমরা ওস্তাদ ।



দেখা হল কাইজার ভিলহেম মেমোরিয়াল চার্চ যা বিশ্বখ্যাত যুদ্ধবিরোধী প্রতীক। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় বোমার আঘাতে এর অনেকখানি ধ্বংস হয়, এর অবশিষ্টাংশ আজ সংরক্ষিত,অনেকটা পোড়োবাড়ীর মত দেখতে। চারিদিকে অসংখ্য নতুন স্থাপত্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করছে যুদ্ধের ভয়াবহতা, বলছে মানববিশ্বের অস্তিত্বের জন্য যুদ্ধ নয় শান্তি।
পরদিনের গন্তব্য বার্লিনের অন্যতম দর্শনীয় স্থান অ্যালেক্সান্ডার প্লাতস। ১৮০৫ সালে রাশিয়ার জার প্রথম অ্যালেক্সান্ডারের বার্লিন ভ্রমণের স্মরণে এর নাম রাখা হয়েছে।

সেযাত্রার ভ্রমণসঙ্গিনী প্রাচ্যদেশীয় প্রেমিকার আপত্তি না থাকাতে হোটেল থেকে পদব্রজেই গেলাম, পথ চিনতে নিতে কোন সমস্যা হয় নি কারণ বার্লিনের প্রায় সবখান থেকেই আপনি দেখতে পাবেন Alexandar Platz এ অবস্থিত টেলিভিশন টাওয়ার। এই শহরের সবচেয়ে উঁচু স্থাপত্য, ৩৬৫ মিটার উঁচু। চাইলে টাওয়ারে উঠে চিত্তহরণকারী বার্ড আই ভিউ নিতে পারবেন, রোদ ঝকঝকে দিনে ৪০ কিমি দূর পর্যন্ত দেখা যায় টাওয়ারের দর্শনার্থী প্লাটফর্ম থেকে।

এর কাছেই অবস্থিত লাল ইটের তৈরি বার্লিনের নগর ভবন, যা পরিচিত Rotes Rathaus নামে, সুদৃশ্য এক স্থাপত্য। সেখান থেকে গুটি গুটি পায়ে কখন যে Museum Island-এর বিখ্যাত বার্লিন ক্যাথেড্রাল আর জাদুঘরগুলোর সামনে চলে এসেছি বুঝতেই পারিনি।

হঠাৎ নজরে আসার পরপরই মনে হল পাবলো নেরুদার অসামান্য কবিতার মত বলে উঠি এ কী অসামান্য গুপ্তধন। সারি সারি গ্রীক ভবন যেন তুলে নিয়ে এসে বসিয়েছে ময়দানব। আমি মুগ্ধ, বিমোহিত, অভিভূত।

এই Museum Islandএ বার্লিনের প্রথম জনবসতি গড়ে ওঠে ১২৪৪ সালে, বিশ্বের সেরা জাদুঘরগুলো কয়েকটি বর্তমানে এই দ্বীপেই অবস্থিত, অসংখ্য অমূল্য ঐতিহাসিক নিদর্শন, চিত্রকর্মে জাদুঘরগুলো সংগ্রহশালাগুলো যে কতটা সমৃদ্ধ তার বর্ণনা এত স্বল্প পরিসরে না দিয়ে আলাদা কয়েকটা পোস্ট দিলেই মনে হয় ভাল লাগবে, তবে ২৬০০ বছরের পুরনো ব্যবিলনের ইসথার গেটের কথা আলাদা ভাবে উল্লেখ করতেই হল, প্রাচীন ব্যবিলন নগরীর এই ফটক, যার নিচ দিয়ে আলেক্সান্দার বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করেছিলেন তা প্রত্নবিশ্বের অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ হিসেবে পরিচিত, এখন Pergamon জাদুঘরে এর অবস্থান।

(ইসথার গেটের ছবিটি উইকি থেকে নেয়া)
সময়ের স্বল্পতা হেতু ১০০ নং বাসে চেপে বসলাম যা বার্লিনের ১৭টি প্রধান আকর্ষণের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে যাত্রাপথে।

দেখা হল ভিক্টোরিয়ার বিজয় স্তম্ভের (Triumphal Column) সাথে, ১৮৬৪ সালে জার্মানির এক যুদ্ধ জয়ের ভিত্তিতে নির্মাণ করা হয় এই সুউচ্চ কলাম যার শিখরে অবস্থিত একটি সোনালি, উড্ডয়নের চেষ্টারত দেবীমূর্তি, যিনি বিজয়ের প্রতীক।


চোখে পড়ল ১৮৪৪ সালে প্রতিষ্ঠিত বার্লিন চিড়িয়াখানা, একক চিড়িয়াখানা হিসেবে সমগ্র বিশ্বে এরই রয়েছে সবচেয়ে বেশী ধরনের প্রজাতির সংগ্রহ। তার পরপরই নজরে আসল বার্লিনের বিখ্যাত সংসদ ভবন

এবং বার্লিনের প্রতীক হিসেবে পরিচিত Brandenburg গেট বা বার্লিন গেট। গ্রীকপুরাণের উপকথার ভিত্তিতে নিরমিত এই গেট এবং এর সুউচ্চ কলামগুলোতে খোদাই করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নানা পুরাণ কাহিনী। গেটের সর্বোচ্চ অবস্থানে আছে বিখ্যাত ভাস্কর্য QUADRIGA, চারটি ঘোড়াটানার রথে উপবেস্টিত রমান যুদ্ধজয়ের দেবী ভিক্টোরিয়া।


Reichstag বা জার্মান পার্লামেন্ট ভবন অনুপম স্থাপত্যশৈলীর আরেক অনুপম নিদর্শন। এর ছাদে অবস্থিত কাঁচের তৈরি বিশালাকৃতির গম্বুজ, ফলে অনেক দূর থেকেই এর ভিতরে অবস্থানকারীদের দেখা যায়। এটি নিউ রেনেসা ধাঁচে নির্মিত, এবং কোন প্রবেশমূল্য নেই!

বার্লিন গেটের সামনে বিশাল রাস্তা, খোলা সবুজ প্রান্তর, শীতের অত্যাচারে পাতাহারা গাছগুলোতে ছোট ছোট অসংখ্য বৈদ্যুতিক বাতির সংযোগ দেয়া হয়েছে সন্ধ্যার পর, যা রাতের বার্লিনকে করেছে অপরূপা। এ যেন রূপকথার রাজ্য, অদূরে দেবী ভিক্টোরিয়ার সোনালি ভাস্কর্য, জোনাকির মত জলন্ত-নিভন্ত লাখো লাখো বৈদ্যুতিক বাতি, জাত-বেজাতের খাবারের দোকান, ট্যুরিস্ট শপ, দোকানীদের হাঁকডাক, বিশ্বের প্রায় সব বর্ণের, সব ধর্মের পর্যটকদের ভিড়, সবমিলিয়ে জায়গাটি পরিণত হয়েছে বিশ্ব মানবতীরে।
সম্ভবত বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভবনে দেখি দুই দশক ছাত্র পড়িয়েছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন , তার স্মরণে খোদাইকরা প্রতিকৃতি।



কাছেরই আরেক ভবনে খোদাইকৃত নোটিশে দেখি লেখা আছে এই ভবনের শিক্ষকতা করতেন পদার্থবিজ্ঞানের অন্যতম প্রধানশাখা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জনক Max Planck, এই দুই মহান পদার্থবিদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সোজা হোটেলে ফেরত।
পরদিন বার্লিনে অবস্থানের শেষ দিন, এত অল্প সময়ে এই বিশাল মহানগরীর ছিটেফোঁটাও দেখা সম্ভব না, সময়ের অভাবে দেখা হল না নরদানব হিটলারের বাংকার যেখান তার জীবনে সমাপ্তি ঘটেছিল আত্মহত্যার মাধ্যমে , নাৎসি বাহিনীর নির্মিত অলিম্পিক স্টেডিয়াম যেখানে ১৯৩৬ সালে অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এমনই অসংখ্য জায়গা।
শেষ দিনের অল্প সময়ে বোঝার চেষ্টা করলাম বার্লিনকে, এর অধিবাসীদের। বাস আর পাতালরেলে চেপে ঘুরে বেড়ালাম শহরের এই প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, দেখা দিল ইহুদী ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয় সিনাগোগ, ২য় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত নাৎসি বাহিনীর কিছু অফিস, বন্দী নির্যাতনের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, কিছু বিখ্যাত উদ্যান, দারিন সব ভাস্কর্য।
উল্লেখ্য, অন্যসব রেকর্ডের সাথে সাথে বার্লিন আরেকটি রেকর্ডেরও অধিকারী, ইউরোপের সবচেয়ে বেশী সমকামী বাস করে এই শহরে, বেশ কবার দেখলাম দেয়ালে লেখা Super Gay Berlin, The Gayest City ইত্যাদি।


যারা বার্লিন যাবেন ভ্রমণের উদ্দেশ্যে তাদের প্রতি প্রত্যাশা, চেষ্টা করবেন বার্লিন Walk Tourএ অংশ নেবার, এতে মহানগরীর অসংখ্য স্থান আপনার দেখা হয়ে যাবে, আর যাদের একান্তই সময়ে কুলোবে না, তারা ১০০ অথবা ২০০ নং বাসে চেপে শহরটা ঘুরে দেখবেন, ফলে খুবই সস্তাতে বার্লিনের প্রায় সমস্ত আকর্ষণগুলো আপনার দেখা হয়ে যাবে যাত্রাপথেই।
Ostabanhof রেলস্টেশন আমাদের শেষ গন্তব্য, ট্রেনে উঠে না দেখার অসন্তুষ্টিতে নয় বরং অল্প কয়দিনে বার্লিন ভ্রমণের টুকরো টুকরো স্মৃতি বুকটাকে আনন্দে ভরিয়ে তুলল। মনে মনে বলছিলাম- Berlin- The Most Impressive City, বিদায় বার্লিন, আবার দেখা হবে।
ট্রেনে ছুটে চলেছে, কুউউ, শেষবারের মত দেখা দিল বার্লিনের প্রাচীর। আবার যাত্রাপথে আমরা, পরবর্তী গন্তব্য- হামবুর্গ ।



( বার্লিন খুবই প্রিয় শহর আমার, পরে আরও অনেকবার যাওয়া হয়েছে সেখানে, কিন্তু এটি ছিল সেখানে প্রথম ভ্রমণের স্মৃতি, পুরনো রোজনামচা ঘাঁটতে গিয়ে ২০০৪ সালে লেখা অংশটি পেয়ে শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না। ছবিগুলো নানা সময়ে তোলা তবে এই এক দশকে উল্লেখিত কোন কোন তথ্য পরিবর্তিত হয়ে থাকতেও পারে ! কাঁচা আবেগ মোড়া লেখায় উৎসাহময় আতিশয্যের বাহুল্য ক্ষমাপ্রার্থনীয়। )

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.