ছোট বেলায় পুতুল খেলেন নি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া খুবই দূরহ ব্যাপার। পুতুলের বিয়ে দেওয়া, সংসার, আতিথীয়তা ইত্যাদির মধ্য দিয়েই শিশু তার সমাজ কাঠামোয় নারী পুরুষের কাজ অনেকটাই জেনে নেয়ার প্রয়াস পায়। সামাজিক অবস্থা ও প্রবাহমান সাংস্কৃতিক ধারার অন্যতম একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এই পুতুল খেলা। যা বিশেষ করে মেয়েদের শৈশবের মনন গঠন করে । শৈশবে শিশুদের এ ধরণের খেলাধূলা, সামাজিক মিথস্কিয়া ইত্যাদির মধ্যদিয়েই শিশুকে ‘মেয়েলিপনা’, ‘ছেলেমিপনা’ শেখানো হয়।
এক সময় বাড়িতেই বানানো হত ছেড়া কাপরের রঙ-বেরঙের পুতুল। পুতুল বানানোর মত সৃজনশীল কাজে চলত বান্ধবীদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা। ‘সুন্দর পুতল’ এই বাহবা পাওয়ার জন্য সবাই নিজের পুতুলটিকে মনের মত করে সাজাত। কিন্তু বর্তমানে সুন্দর পুতুল জন্য সৃষ্টিশীলতার চেয়ে ক্রয় করার ক্ষমতা থাকাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অতীতেও গ্রামের মেলায় কুটির শিল্পের পুতুল পাওয়া যেত।
আর এখন শপিং মল থেকে শুরু করে বেগের চেইন পর্যন্ত বিদেশি সাদা চামরার পুতুলের রাজত্ব। কারণ, বিশ্ববাজারে এখন চলছে ‘বারবি পুতুলের’ রমরমা ব্যবসা। বারবি পুতুল কোম্পানি ম্যাটেলের দাবি, পৃথিবীর ১৫০টি দেশে প্রতি সেকেন্ডে ৩টি করে বারবি পুতুল বিক্রি হয়। তবে এটা কেবল শিশুদের খেলনা মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এই পুতুলগুলো নিয়ে তৈরি হয়েছে কার্টুন, প্যারোডি, গান, কমিকস্ ইত্যাদি (সূত্র: সমকাল,২৩.১২.১১ইং) ।
সম্প্রতি ভারতীয় চলচিত্র রা-ওয়ানের প্রচারণায় অভিনেতা শাহরুখ খান রা-ওয়ানের পুতুল শিশুদের হাতে তুলে দিচ্ছেন।
এ পুতুল বিক্রিও হচ্ছে বাজারে। কেননা এর মধ্যে দিয়ে তারা কিছু একটা কিছু প্রচার করতে চান, বাণিজ্যের বিস্তৃতি ঘটাতে চান। এখনকার দিনে শিশুর জন্য নানী-মাকে আর পুতুল গড়তে দেখা যায় না। এই স্থানটি দখল করে নিয়েছে সাদা চামরার আর সোনালী চুলের বিদেশি পুতুল। আর খেলনার দোকানেও চড়া দামে পুতুলগুলো বিক্রি হচ্ছে।
এই বড় বড় আকারের বিদেশি পুতুলদের সামনে কি আমাদের দেশি পুতুলরা দাঁড়াতে পারে? বাল্যকালে দেখা যেত, পুতুল, পুতুলের সংসারের আসবাবপত্র সবই নিজেদের বানানো। কোন বড়সর জুতার প্যাকেট বা বাঁশ-কাঠ দিয়ে পুতুলের ঘর বানানো হত। পুতুলের বিয়ের দিন বন্ধু-বান্ধব মিলে বাড়িতেই ‘বানানো খাবার’ মিছেমিছি খাওয়া হত। পুতুলের মালিকদের বিয়ান-বিয়ান সম্পর্ক ছিল। কিন্ত এখন সব ইতিহাস।
আর এই জায়গাটা এখন বিশ্ববাজারের দখলে। টাকা থাকলেই পাওয়া যায় পুতুল। কিন্তু এর পেছনে আরো অনেক কথা রয়েছে। যেমন: বহুজাতিক পুতুল কোম্পানিগুলো শিশুদের এ খেলনা বিক্রির পাশাপাশি পশ্চিমা সংস্কৃতি আর তাদের ধ্যান-ধারণা মানুষের অন্তকোণে গেঁথে দিচ্ছে। কেননা শিশুরা তাদের চারপাশকে অনুসরণ করে।
তার আশপাশের কোন ঘটনাকে সে খেলার মধ্য দিয়ে অভিনয় করে। এর মধ্য দিয়ে সে সমাজের অনেক আরোপিত নিয়ম-কানুন রপ্ত করে। তাইতো পাড়ায় বিয়ে হলে শিশুদের বিয়ে-বিয়ে খেলতে দেখা যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শিশুদের সংস্কৃতির এ দিকটি বুঝে একটি মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি বাজারে আনল খেলনা বন্দুক, যুদ্ধরত সৈনিকবেশী পুতুল ইত্যাদি। এসব খেলনা শিশুদের সহিংসতা ছাড়া আর অন্য কিছু শিক্ষা দেয় বলে মনে হয় না।
যদি কোমলমতি শিশুরা চোখ ফুটতেই এসব শেখে তবে সে শান্তির পৃথিবী গড়বে কিভাবে? আবার শিশুরা পুতুল খেলার মধ্য দিয়ে নারী-পুরুষের সম্পর্কের মতই সমাজকে চিনছে। পুতুল শিশুর কাছে শুধু খেলনাই নয় বরং একটি আদর্শ। তাইতো প্রাণহীন পুতুল জীবন্ত হয়ে নিয়ন্ত্রণ করছে নারী জীবনকে। কিন্তু আমরা এটাকে সেভাবে গুরুত্ব সহকারে দেখছি না। বাজারের অন্যান্য জিনিস-পত্রের মতোই এটাকে গো-গ্রাসে গিলে ফেলছি।
বারবি পুতুলের বাহ্যিক অবয়বের কথা সবারই জানা। বাররিকে গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপনে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় তাতে প্রশ্ন জাগে বারবি কি নারী শরীরের আদর্শ? যদি আর্দশ হয় তাহলে এমন শরীর তো স্বাভাবিক ভাবে দেখি না! কিন্তু এ পুতুল বাজারে আসে বিভিন্ন ফ্যাশান মডেলের চরিত্রে। আবার সে কখনও বিমানবালা, কখনও শিক্ষিকা, কখনও নার্স, ব্যালেরিনা, বা পাইলট। আবার তাতে গোলাপী রঙের প্রাধান্য। এসব রং-পেশার মধ্য দিয়ে সে নারী চরিত্রের নির্মাণ করছে।
তাতে নারী মানেই মেয়েলি, মানানসই, কোমল, আকর্ষনীয়, শরীরসর্বস্ব, বুদ্ধিবৃত্তিহীন ও কথিত অরাজনৈতিক। তাইতো বারবি প্রস্তুতকারী কোম্পানী ও তাদের গবেষক-কর্মীরা নারীর জন্য গোলাপী রঙের এক মেয়েলি জগত নির্মাণ করতে চায়, যেখানে নারী মানেই সামাজিক দায়বদ্ধতাহীন এক পণ্যদাসী, যে শুধুই দামী দামী জিনিস চায়। ভোগ, বিলাশ, আরাম-আয়েশ, আমোদ-প্রমোদ ইত্যাদি নিয়ে তাদের জীবন। বিভিন্ন সময়ে বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে পুতুলের গড়ন-ফ্যাশান পরিবর্তন করে কোম্পানিগুলো। এ পুতুলগুলো নারী শরীরের সামনে অতিচিকন ফিগারকে আইকন হিসেবে দাঁড় করায়।
তাতে নারীর শারিরীক সুস্থতা ও কর্মক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় সুন্দরী ও আবেদনময়ী হওয়ার চ্যালেন্স। পুতুল কোম্পানীগুলোর মুনাফার স্বার্থেই গণমাধ্যমে এমন মডেল হাজির করা চলছে। কিন্তু এসব আমাদের সংস্কতি, দৈহিক গঠন, মনন ইত্যাদি সাথে খাপ খায় না। আবার সেখানে ‘আর্দশ মানুষ’ হওয়ার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় ছিপছিপে গড়নের যৌন আবেদনময়ী পাতলা শরীরের তৈরি ভোগের উপকরণ হওয়া। তাইতো বাজারের পুতুলগুলো শিশুকে জানিয়ে দিচ্ছে সুস্থ শরীরের মানুষ নয় পুরুষের কামনার কাঙ্খিত চিকন নারী বেশি সমাদৃত।
পুতুলগুলোই বাচ্চাদের ছোটকালে শিখিয়ে দিচ্ছে কিভাবে মোহনীয় ভঙ্গিতে আবেদনময়ী আইটেমে ক্যাটওয়াক করে জগৎ জয় করতে হয়। বারবির বিজ্ঞাপনের গানে যেমনটি ফতোয়া দেয়া হয়, ‘আমি শুধু তোমার মত হতে চাই’। ঠিক সেভাবে চলছে পুতুল হওয়ার প্রতিযোগিতা।
পুতুলের মত হতে চেয়ে নিজের শরীরে চৌদ্দ বছরে একত্রিশ বার প্লাষ্টিক সার্জারী করানো মার্কিন নারী সিন্ডি জ্যাকসন আজও আলোচিত। আমাদের দেশেও নারীদেরও এসবের প্রতি প্রচ্ছন্ন উস্কানির লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
গত শতকের নারী বন্ধি ছিল রান্না ঘরে। আর এ শতকে বাজারি সংস্কৃতির দেহসর্বস্ব ভোগবাদী সমাজে নারী বন্ধি নিজেদের দেহের কারাগারে। তাইতো পুতুলের মত শরীর বানাতে গিয়ে অ্যানোরেন্সিয়া ও বুলিমিয়ার মত না খাওয়াজনিত রোগে আক্রান্ত হয়েছেন বহুনারী। আমেরিকার ন্যাশনাল ইটিং ডিসঅর্ডার অ্যাসোসিয়েশন থেকে প্রকাশিত তথ্যে (২০০৫) জানা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত অর্ধেক টিনেজ মেয়ে স্রেফ না খেয়ে বা বমি করে ওজন কমানোর চেষ্টা করে (সূত্র: পুতুলখেলার রাজনীতি : বারবি কাহিনী, নাসরিন খন্দকার, পাবলিক নৃবিজ্ঞান, অক্টোবর ২০১১)। প্রখ্যাত ব্যাস্ত তারকা ক্যারেন কারপেন্টের মত বহুতারকা এ বিকারে আক্রান্ত।
পুতুল-বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তালিম দিচ্ছে যেন মেদ মুক্তি মানেই নারী মুক্তি। আবার আমাদের দেশেই এ মেদকে নিয়ে চলছে হাজারো পণ্যের ব্যবসা। মেদ কমানোর বিজ্ঞাপন পড়লে বা দেখলে মনে হয় দেশে মেদ ছাড়া নারীদের কোন সমস্যাই নেই। অভাব, ফতোয়ার শিকার, সম্পত্তিতে সমানাধিকার, হিল্লা বিয়ে, সহিংসতা, নারীকে পণ্য বা অশ্লীল উপস্থাপন, নিপিড়িত নারী শ্রমিকদের কম মজুরীর মত হাজারো সমস্যাকে এড়িয়ে মেদকেই নারীর সেরা সমস্যা হিসেবে পুতুলগুলো তুলে ধরছে। অন্যদিকে বর্তমান বাজার-সংস্কৃতিতে বিদেশি পুতুল থাকাটা স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
কার কটা বিদেশি পুতুল আছে, কোনটার দাম কত? তাই যেন আজ সম্মানের অন্যতম মাপকাঠি। কেনাকাটার এ যুগে আমাদের ক্রয়কৃত জিনিসগুলো যেন আমাদের একমাত্র পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পুতুলগুলো সৃজনশীল মানুষের বদলে তৈরি করতে চায় ভোগবাদী মানুষ। যারা অসীম কেনাকাটায় মেতে উঠতে চায়।
কিন্তু মানুষের হাজার বছরের অভিজ্ঞতা বলে পণ্য মানুষকে শান্তি দিতে পারেনি।
তাই আমাদের এ মুহুর্তে প্রয়োজন পণ্যদাসত্ব থেকে নিজেদের মুক্ত করা। বিদেশি পুতুলের বদলে দেশীয় খেলা ও কল্যাণমুখী কর্মকান্ডে উৎসাহিত করা। আর এখনই সময় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বাজারি ভোগবাদের বিপরীতে নৈতিকতা নিয়ে দাঁড়ানো তুলে দাঁড়ানোর। সেজন্য চাই শিশুদের সৃষ্টিশীলতার বিকাশ ঘটানোর জন্য লোগো সেটের মত সৃজনশীল খেলানার ব্যবস্থা করা। যাতে শিশুটি ভোগবাদী বাণিজ্যিক মননের শিশু না হয়ে যায়।
আর একজন সৃষ্টিশীল মানুষ হতে অবিভাবকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এসব অপ-সংস্কৃতির বিপরীতে আমাদেরকে এখনই রুখে দাঁড়ানো উচিত।
লেখক: এম জিয়াউল হক সরকার ও সাজ্জাদ লিয়ন
E-Mail:
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।