এটা কী বললেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা? এসব কী তাঁরা বলেই চলেছেন?সোমবার প্রথম আলোর একটি সংবাদ প্রতিবেদন জানিয়েছিল, দেশের ১০টি বড় শিল্প খাতের জন্য মজুরি বোর্ডের ধার্য করা ন্যূনতম মজুরির মধ্যে পোশাক খাতের মজুরিই সবচেয়ে কম। ন্যূনতম মজুরি সবচেয়ে বেশি নির্মাণশিল্প ও কাঠের কাজে এবং চামড়াশিল্পে। দুটিতেই মাস গেলে এ মজুরি নয় হাজার টাকা ছাড়ায়। পরদিন বিজিএমইএ এই প্রতিবেদনকে ধুয়ে দিয়ে পত্রিকাটির কাছে এক ‘ব্যাখ্যা’ পাঠায়। সেখানে তারা বলে, নির্মাণ ও ট্যানারির শ্রমিকের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও ক্ষতিকর বস্তুর সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি অনেক বেশি দেখে স্বাভাবিকভাবেই তাদের ন্যূনতম মজুরিও বেশি।
বিজিএমইএ তাহলে বলতে চাইছে, পোশাক কারখানায় কাজে ঝুঁকি নেই বা কম? শুনে বেকুব বনে গেলাম। বাংলাদেশে অন্য কোনো শিল্পে শ্রমিকেরা এত জীবনঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন বলে মনে করতে পারছি না। স্পেকট্রাম, গরীব অ্যান্ড গরীব, তাজরীন, রানা প্লাজা—চোখের সামনে ভয়াবহ সব ছবি ভেসে উঠছে। কেউ বলেন ৩০ লাখ, কেউ বলেন ৪০ লাখ। এত এত শ্রমিকের জীবিকা জোগাচ্ছে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্প।
কিন্তু জীবিকাদাতা এ শিল্পকে প্রাণঘাতী শিল্প বললেও বোধ হয় ভুল হবে না। এই যে একটা অসহনীয় বিপরীতমুখী বাস্তবতা, মালিকেরা এর নিরসন করতে না পারেন, একটু অন্তত চক্ষুলজ্জা তো রাখতে পারতেন। ‘ঝুঁকি’র প্রসঙ্গটা না-হয় তাঁরা আর না টানতেন। বস্ত্র ও পোশাক খাতের মালিক-রপ্তানিকারকদের তিন মুরব্বি সংগঠন (বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিএমএ) মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলন ডাকে। সেখানেও পোশাক-কর্তারা প্রথম আলোর নাম না করে জোর গলায় এই ‘ঝুঁকি’র বিষয়টি নিয়ে শোর তুলেছেন।
কথা আরও আছে। সংবাদ সম্মেলনে তিন সংগঠন একজোট হয়ে রায় দিয়েছে যে, পোশাকশিল্পের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী চক্রান্তে দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোও শামিল আছে। পোশাকপতিরা এমনও বলেছেন, এ খাতে পাঁচ দিন ধরে চলমান বিক্ষোভ-অস্থিরতার পেছনে এসব সংবাদমাধ্যমের উসকানি রয়েছে। কারা এই সংবাদমাধ্যম? সংবাদ সম্মেলনে প্রথম আলোর নাম ঊহ্য থেকেছে, কিন্তু উচ্চারিত হয়েছে বিবিসি ও গার্ডিয়ান-এর নাম। সোমবারই বিবিসি টেলিভিশনের ‘প্যানোরামা’ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের কিছু পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ ও ঝুঁকি নিয়ে চমৎকার একটি অনুসন্ধানী কাজ সম্প্রচারিত হয়েছে।
জানা-সত্যটি সপ্রমাণ মুখের ওপর ছুড়ে দিয়েছে প্যানোরামা। বিবিসির ওয়েবক্ষেত্রে প্রতিবেদনটির লিখিত সংস্করণ মিলবে। তো সাংবাদিকদের এসব প্রতিবেদন নাকি ‘কোমলমতি’ পোশাকশ্রমিকদের বিভ্রান্ত করে পথে নামাচ্ছে! জেগে ঘুমালে কে আর কাকে কীভাবে জাগাবে? পোশাকশ্রমিকেরা কেন কিছুদিন পর পরই রাস্তায় নামেন, তা কি সত্যিই মালিকেরা জানেন না? আমরা তো বুঝি, এ সাংবাদিকেরা কেবল সত্যটুকুই দেখাতে চেষ্টা করছেন। বাদবাকি কাজ করছে সত্য নিজেই। এই অস্থিরতা চলতে থাকলে মালিকেরা নাকি সামনে ঈদের বেতন-বোনাস দিতে পারবেন না।
আরেক চেনা বাঁশিও বেজে চলেছে—অচিরেই ব্যবসা হারাতে হবে। কথাগুলোকে মালিকদের ‘হুমকি’র হুংকার হিসেবে দেখা যায়। চক্ষুলজ্জার আকালটা বড়ই প্রকট। মজুরি বোর্ডে মালিকেরা দর-কষাকষি শুরু করেছেন ন্যূনতম মজুরি বাড়িয়ে তিন হাজার ৬০০ টাকা করার প্রস্তাব নিয়ে। এমন প্রস্তাব শুনতেও কান লজ্জা পায়।
তাঁরা এ প্রস্তাব ফলাও করে বলে যাচ্ছেন কোন মুখে? আবার শুনলাম, এটা নাকি একটা কৌশল। নিচের থেকে শুরু করলে দরাদরি কমের মধ্যে থাকবে। কৌশলই যদি হয়, দরাদরি নিচ থেকেই শুরু হতে হবে কেন? গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) তিনভাবে হিসাব করে তিন মাত্রায় সর্বনিম্ন মজুরির ধারণা দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্যের দাম বিবেচনায় নিলে একজন বিবাহিত শ্রমিকের জন্য প্রায় ১৮ হাজার টাকা মজুরি ধরতে হবে। দরাদরি তো সেখান থেকেও শুরু হতে পারে! সিপিডি-প্রাক্কলিত মধ্যম মাত্রার মজুরিটি জীবনযাত্রার প্রকৃত ব্যয় ও মূল্যস্ফীতি আমলে নিয়ে করা হয়েছে।
বিবাহিত শ্রমিকের ক্ষেত্রে এটা আট হাজার ২১৬ টাকা। শ্রমিকদের দাবিও অনেকটা এমনই। তবে সিপিডি বলছে, এটা দুই বছরে বাস্তবায়ন করার কথা। তাতে প্রথম বছরে আসবে মাসিক ছয় হাজার ৫০০ টাকার মতো। সেটা বর্তমানের তিন হাজার টাকা মজুরির দ্বিগুণ বটে, কিন্তু আজকের বাজারে সেটা কি যথেষ্ট হবে? এদিকে দেখা যাচ্ছে, নির্লজ্জতা পোশাকমালিকদের একচেটিয়া নয়।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার পয়সায় মজুরি বোর্ডের সদস্যরা যাচ্ছেন সাত দিনের জন্য তিন দেশ ঘুরে আধুনিক মজুরি কাঠামোর ধারণা নিতে। আবারও বেকুব হই। শ্রমিকের খেয়েপরে বেঁচে থাকার মতো ন্যায্য মজুরি ঠিক করতে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা উড়িয়ে বিদেশ ঘোরা লাগে? তাঁরা বরং সাভার-আশুলিয়ায় শ্রমিকদের মলিন বসতি আর লাগোয়া বাজারগুলো ঘুরে দেখতে পারেন। এক বেলা সময় করে কথাবার্তা বলে দেখে নিতে পারেন, কে কী দিয়ে কতটা ভাত খাচ্ছেন। মালিকেরা কোন সত্যটা না জানেন? গতকালের কাগজে পড়লাম, সিপিডির সংলাপে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি ও বিজিএমইএর এক পরিচালক বলে ফেলেছেন, মজুরি যথেষ্ট হলে কি আর শ্রমিকেরা ‘ওভারটাইম’ খাটার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকত? বড় কৌতূহল হয় জানতে, এঁদের গৃহপরিচারিকা, পাচক বা আয়া-ন্যানিরা কেমন বেতন পান? আর বাড়ির পোষা কুকুরের জন্য কত বরাদ্দ? সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পাদটীকা’ গল্পটির কথা মনে পড়ছে।
ইংরেজ লাট সাহেবের এক ঠ্যাং খোঁড়া কুকুরের পেছনে মাসে ৭৫ টাকা খরচ হয়। সেটা জানার পর ২৫ টাকা বেতনের পণ্ডিতমশাই ছাত্রকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এখন বল তো দেখি, তবে বুঝি তোর পেটে কত বিদ্যে, এই ব্রাহ্মণ পরিবার লাট সায়েবের কুকুরের কটা ঠ্যাঙের সমান?’ এখন আবার ফুটন্ত ক্ষোভের মাঠে নেমেছেন বহুরূপী নৌমন্ত্রী। যা বোঝা যাচ্ছে, নভেম্বরেও ন্যূনতম মজুরি নিয়ে খেল শেষ হবে না। আর শ্রমিকের খাওয়া-পরার বাস্তবতা আমলে নিয়ে ক্ষোভ দূর করার মতো ব্যবস্থা করা হবে, এমন ভরসা পাচ্ছি কই?
কুর্রাতুল-আইন-তাহিমনা: সাংবাদিক।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।