প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর পঞ্চমবারের মতো জাতিসংঘের বার্ষিক অধিবেশনে ভাষণ দিলেন বারাক ওবামা। গুরুত্বপূর্ণ এ ভাষণটিকে অনেকে তাঁর সেরা কূটনৈতিক ভাষণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তবে বেশি কথা বলা হচ্ছে ওবামা ও ইরানের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির করমর্দন নিয়ে।
না, ওবামা ও রুহানির মুখোমুখি দেখা হয়নি, ফলে করমর্দনও ঘটেনি। তবে দুটোই হতে পারত।
গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের মহাসচিব সাধারণ পরিষদের বার্ষিক বিতর্কে অংশ নিতে আগত বিশেষ অতিথিদের সৌজন্যে যে মধাহ্নভোজ দিয়েছিলেন, ভাবা হয়েছিল, সেখানেই দুই নেতার ‘হাই-হ্যালো’ হবে, চাই কি করমর্দনও হয়ে যেতে পারে। এর আগে ওবামা এক পত্রে নির্বাচনে বিজয়ের পর রুহানিকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তাতে পারমাণবিক অস্ত্র প্রশ্নে ইরানের সঙ্গে বিবাদ মেটানো সম্ভব হবে, এমন আশাবাদ ছিল। জবাবে রুহানিও ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন। সেই থেকে আমেরিকার পত্রপত্রিকা ওবামা ও রুহানিকে একে অপরের ‘পত্র মিতা’ হিসেবে পরিচয় দেওয়া শুরু করেছে।
দীর্ঘদিন থেকে এ দুই দেশের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কারণেই ইরানের ওপর কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করা হয়েছে। মধ্যপন্থী রুহানির নির্বাচনের পর এই দুই দেশের পারস্পরিক সম্পর্কে বরফ গলার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এ অবস্থায় এই দুই নেতার যদি দেখা হয়েই যায়, মন্দ কী!
কিন্তু সাক্ষাৎ যে হলো না, তার কারণ অবশ্য ওবামা নন, রুহানিই। আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যায় ইরান জানিয়েছে, মধ্যাহ্নভোজে সুরার ব্যবস্থা ছিল।
ইসলামিক ইরানের প্রেসিডেন্ট সে কারণে ভোজসভা এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু অপর অঘোষিত ব্যাখ্যা হলো, ‘দ্য গ্রেট স্যাটান’ হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একই ফটোতে যদি ইরানের প্রেসিডেন্টকে দেখা যায়, আয়াতুল্লাহ খামেনির ইরানে তা হয়তো গুরুপাক ঘটাতে পারে। রুহানির সঙ্গে করমর্দনের ছবি ছাপা হলে তা ওবামার জন্যও কম বিব্রতকর হতো না। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবাজ লবি অনেক আগে থেকেই ইরান ও সিরিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি ব্যবহারে অনাগ্রহের কারণে ওবামাকে কাপুরুষ ও দুর্বলচিত্ত বলে গাল দিয়ে আসছে। ওবামার পররাষ্ট্রনীতির মূলে রয়েছে ‘আত্মসমর্পণ’—এ কথা তো এই লবির লোকজন হরহামেশাই বলে আসছেন।
পল উলফোভিৎস, ইরাক যুদ্ধের ব্যাপারে যিনি একসময় সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন, সিএনএনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী করে বসেছেন: ইরানের সঙ্গে সংলাপের চেষ্টা বৃথা। হাসান রুহানির কোনো ক্ষমতা নেই; সে দেশের প্রধান ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির কথার বাইরে একচুল নড়াও তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। উলফোভিৎস যুক্তি দেখিয়েছেন, ইরানের অর্থনীতি এখন প্রবল চাপের মুখে। এই অবস্থায় জান বাঁচাতেই কূটনীতির কথা বলছে ইরান। তার আসল লক্ষ্য হলো পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য কালক্ষেপণ।
ইরানের সঙ্গে সংলাপের বিরুদ্ধে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ হলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। তিনি বলেছেন, ইরান পারমাণবিক কর্মসূচি বাতিল করেনি, সে ইঙ্গিতও দেয়নি। এ অবস্থায় আগ বাড়িয়ে ইরানের সঙ্গে কোলাকুলি করা মস্ত ভুল হবে। তাঁর মতে, ইরান যতক্ষণ না তার পারমাণবিক কর্মসূচি পুরোপুরি বন্ধ করছে, বিশেষত তার অতি-গোপনীয় ও সুসংরক্ষিত ফরদো আণবিক কেন্দ্র ভেঙে না ফেলছে, ইরানের সঙ্গে সংলাপে ফল হবে উল্টো।
ওবামা সিরিয়া প্রশ্নেও একই সঙ্গে কূটনীতি ও সামরিক শক্তি ব্যবহারের যে নীতি অনুসরণ করেছেন, সে জন্যও তিনি আমেরিকায় তোপের মুখে আছেন।
রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহূত হলে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদকে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে, এ কথা তিনিই আগ বাড়িয়ে বলেছেন। কিন্তু একতরফাভাবে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক শক্তি প্রয়োগ করুক, দেশের ভেতরে বা বাইরে অধিকাংশ মানুষ তা চায় না। কংগ্রেসে সমর্থন নেই, এক ফ্রান্স ছাড়া অন্য কোনো নিকট মিত্রেরও সমর্থন নেই। তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র যদি সামরিক হামলা চালায়, তার কোনো ফল হবে না বলেই অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের অভিমত। ক্রুজ মিসাইল দিয়ে আঘাত হানলে আসাদের গায়ে বড়জোর কুটোটি লাগবে, তার বেশি নয়।
এই বিরুদ্ধ অবস্থায় ওবামা যদি সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদাহানি হবে। ওবামা নিজে অপদস্থ হবেন। এমন এক জটিল সময়ে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় সিরিয়া তার রাসায়নিক অস্ত্রভান্ডার আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে ধ্বংস করতে সম্মত হয়েছে। ফলে আশু বিপদ কাটিয়ে উঠে ওবামা সবচেয়ে বুদ্ধিমানের মতো কাজটিই করলেন। জাতিসংঘে গিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, সিরিয়ার প্রশ্নে কূটনৈতিক পথই তিনি অনুসরণ করবেন।
ইরানের ব্যাপারে ওবামার উল্টো-হাঁটা আরও স্পষ্ট। তিনি ঘোষণা করেছেন, তাঁর প্রশাসনের অবশিষ্ট বছরগুলো তিনি ইরানের সঙ্গে সংকট সমাধানে কূটনৈতিক পথ অনুসরণ করবেন। সে উদ্দেশ্যে অনতিবিলম্বে ইরানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরুর জন্য তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী কেরিকে নির্দেশ দিয়েছেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে ইরানের সন্দেহ ও অবিশ্বাস একদম অযৌক্তিক নয়, এমন একটা কথাও বলে বসলেন ওবামা। ১৯৫৩ সালে ইরানের নির্বাচিত সরকার উৎখাতের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল, ফলে তখন থেকেই ইরান ওয়াশিংটনের ব্যাপারে গভীরভাবে সন্দিহান।
তাঁর এ কথায় যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ লবি নাখোশ হলেও ওবামা যে ইরানের ব্যাপারে বস্তুনিষ্ঠ, আংশিক হলেও তার পরিচয় মিলল।
ওবামার ভাষণের তৃতীয় উল্লেখযোগ্য দিক ছিল ফিলিস্তিন-ইসরায়েল প্রশ্নে তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য। তিনি বললেন, শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব। সে লক্ষ্যে তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন। এর আগে প্রতিবছরই ওবামা তাঁর ভাষণে মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা শুরুর তাগিদ দিয়েছেন, কিন্তু প্রতিবারই সে কাজে ব্যর্থতার দায়ভার চাপিয়েছেন ফিলিস্তিনের ওপর।
ইসরায়েল তার ঘনিষ্ঠ মিত্র, তাকে ও ফিলিস্তিনকে তিনি একই পাল্লায় মাপতে সম্মত ছিলেন না। এবার মনে হলো ওবামার সুর যেন কিছুটা ভিন্ন। ইসরায়েলকে ‘ইহুদি রাষ্ট্র’ হিসেবে বর্ণনা করলেন বটে, কিন্তু ফিলিস্তিনের সঙ্গে তুলনায় তাঁর নৈতিক অগ্রাধিকার রয়েছে, এমন কথা শোনা গেল না। এর আগের বছরগুলোতে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভারসাম্য রক্ষার কোনো চেষ্টা তাঁর ছিল না। এবার তাতে একটি প্রচ্ছন্ন পরিবর্তন ধ্বনিত হলো।
সম্ভবত, ভোটের রাজনীতির ওপর তিনি আর নির্ভরশীল নন, তাঁর পরিবর্তিত অবস্থানের সেটি একটি কারণ।
মোদ্দা কথা হলো, বহুপক্ষীয় কূটনীতিকে ওবামা তাঁর বৈদেশিক নীতির কেন্দ্রীয় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারে প্রস্তুত, এ কথা তিনি বিশ্বসভায় ঘোষণা করলেন। সামরিক শক্তি ব্যবহারে যুক্তরাষ্ট্রের অধিকার তিনি বাতিল করছেন না, প্রয়োজন হলে যুক্তরাষ্ট্র তার জাতীয় স্বার্থ
রক্ষায় সব পথই অনুসরণ করবে, এমন কথা তার সব পূর্বসূরির মতো ওবামাও বলেছেন। কিন্তু যে ভাষায় ও প্রতীকী পদক্ষেপের মাধ্যমে তিনি সে কথা বলেছেন, তাতে এমন ভাবা অযৌক্তিক নয় যে শান্তির জন্য নোবেল বিজয়ী এই প্রেসিডেন্ট তাঁর নিজের ও পূর্বসূরিদের ভুল শোধরাতে আগ্রহী।
ওবামা যে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতির ব্যাপারে একটি মোড় ফেরার ইঙ্গিত দিচ্ছেন, সে কথা কারও কারও নজর এড়ায়নি।
নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ওবামার মতাদর্শে পরিবর্তন আসছে, সঙ্গে সঙ্গে একটি ‘ওবামা ডকট্রিন’-এর রূপরেখা স্পষ্ট হয়ে আসছে, যার কেন্দ্রে রয়েছে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে কূটনীতির অধিক ব্যবহার। শুধু সামরিক শক্তি ব্যবহার করে পূর্ণ বিজয় অর্জন সম্ভব নয়, গত দেড় দশকের অভিজ্ঞতা থেকে যুক্তরাষ্ট্র সে কথা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে। এই অনুধাবন থেকেই ওবামা কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। প্রথম দফা প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি সামরিক শক্তি ব্যবহারে ইতস্তত করেননি। আফগানিস্তানে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছেন, আল-কায়েদা নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে চালকবিহীন ড্রোনের ঢালাও ব্যবহারে সম্মতি দিয়েছেন, লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে বিমান হামলায় অংশ নিয়েছেন।
কিন্তু সামরিক শক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার সত্ত্বেও কোথাও যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জিত হয়েছে, তা বলা যাবে না। ওবামার নিজের ‘ইমেজ’ও এখন টুটাফাটা। তার চেয়েও বড় কথা, একই সঙ্গে একাধিক যুদ্ধ চালানোর পর যুক্তরাষ্ট্র এখন প্রায় দেউলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র নতুন কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ুক সে দেশের জনগণ তা চায় না। ফলে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা স্বীকার করেই যুক্তরাষ্ট্রকে ভিন্ন পথ ধরতে হবে।
এই ভিন্ন পথটি যদি কূটনীতি হয়, তাহলে বিশ্বের মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে পারে।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।