রবিবার রাত সাড়ে ১১টা। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে পলিথিন ব্যাগের ভেতর কি যেন ঢুকিয়ে পলিথিনের খোলা অংশে নাক-মুখ দিয়ে গন্ধ নিচ্ছে পাঁচ পথশিশু। তাদের নাম ইমরান, নাছিমা, মিজান, গিট্টু মিয়া ও মিনহাজ। ওই পথশিশুরা জানায়, তাদের হাতে থাকা পলিব্যাগের ভেতরে রয়েছে আইকা বা পায়ের জুতোয় ব্যবহৃত এক ধরনের আঠা। ব্যাগের ভেতরে ঢুকিয়ে কয়েকবার ঝাঁকি দিলেই প্রস্তুত হয়ে যায় নেশার ওই পথ্য। তারপর শুধু নাক লাগিয়ে ঘ্রাণ নিলেই হয়ে যায় নেশা। ডান্ডি সেবনে রোদ, বৃষ্টি, ক্ষুধা, তৃষ্ণা কিছুই বোঝা যায় না। ডান্ডির নেশায় ক্ষুধার জ্বালা টেরই পাওয়া যায় না। ডান্ডি এখন সহজলভ্য ও জনপ্রিয় রাজধানীর পথশিশুদের কাছে।
টোকাই ইমরানের বাড়ি চৌমুহনী। প্লাস্টিক, কাগজ, লোহা ইত্যাদি কুড়িয়ে বিক্রি করা তার পেশা। দিনশেষে আয় বড়জোর ৫০-৬০ টাকা। তার ওপর একদিন রোজগার ভালো তো আরেকদিন খারাপ। পরিশ্রমের এ কাজ করতে গিয়ে কিছুক্ষণ পর পরই ক্ষুধা লাগে ১০ বছরের এই শিশুটির। কিন্তু পকেটে নেই টাকা। ক্ষুধা লাগলেই খাবার কিনতে পারে না। তাই সে এ মরণনেশা বেছে নিয়েছে বলে জানায়। এতে খরচ হয় মাত্র ২০ টাকা। আর ২০ টাকা খরচ করলেই দীর্ঘ সময় ক্ষুধাবিহীন কাটিয়ে দিতে পারে। ডান্ডির নেশায় সারা দিনই পেটের জ্বালা ভুলে থাকা-এমন দাবি করে ঠিকানাহীন পথশিশু গিট্টু মিয়া বলে, একবার ব্যবহার করলে সারা দিনই মাথা ঝিমঝিম করে। রোদ, পানি, ক্ষুধা কিছুই বোঝা যায় না। ১১ বছরের আরেক পথশিশু মিনহাজ জানে না কোথায় তার বাড়ি। কোথায় থাকে বাবা-মা। হাতে ডান্ডি কেন জানতে চাইলে সে এক বাক্যে বলে, সারা দিন কাজ করে মাত্র ৩০ টাকা পাই। এত কম টাকায় তো সারা দিনের খাবার জোগাড় করা যায় না। সে জন্য দুপুরে ১৫ টাকার ভাত আর রাতের জন্য ২০ টাকার ডান্ডি কিনে নিয়েছি। ডান্ডি শরীরের কোনো ক্ষতি করে কি না, এসব জানার বিষয় নয় মিনহাজের। ইমরানের মতো তারও বিশ্বাস ডান্ডির ঘ্রাণে কাছে আসে না ক্ষুধা নামক যন্ত্রণা।
পথে পথে না ঘুরে অন্য কিছু করলে তো পার? এমন প্রশ্নের জবাবে বলে, মানুষ তাদের চোর মনে করে। কারও বাসায় কাজের জন্য গেলে বাড়িওয়ালারা মনে করে চুরি করে জিনিসপত্র নিয়ে পালিয়ে যাব। তবে আজ পর্যন্ত কোনো চুরি বা অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত হয়নি বলে দাবি তাদের। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের ৪ নম্বর গেটের সামনে বসে সোমবার বিকালে ডান্ডি নিচ্ছিল আরেক পথশিশু নাছিমা। বয়স আনুমানিক ১১-১২ বছর। ডান্ডি তৈরির কৌশল জানতে চাইলে মেয়েটি বলে, জুতার আঠা একটি পলিব্যাগে নিয়ে ভালো করে ঝাঁকুনি দিতে হয়। তারপর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই প্রস্তুত হয়ে যায় 'ডান্ডি'। তার মতে, এ নেশা করলে পৃথিবীটা রঙ্গিন লাগে। পেটে ক্ষুধা লাগে না। কারও কথা মনেও পড়ে না। তাই ডান্ডি কোনো ক্ষতিকারক কিছু হতেই পারে না। আর ক্ষতি হলেও তার নাকি কিছুই যায় আসে না। এভাবে শুধু ইমরান, নাছিমা, মিজান, গিট্টু মিয়া ও মিনহাজ নয়, রাজধানীতে শত শত পথশিশু ডান্ডি নামের এ মরণনেশায় আসক্ত। এ মরণনেশা ডান্ডির বিষয়ে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রো বায়োলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. রাশেদ নূর জানান, ডান্ডি অর্থাৎ জুতো তৈরির আঠাতে টলুইন নামে এক প্রকার তরল পদার্থ থাকে যা বাষ্পীভূত হয়ে নিঃশ্বাসের সঙ্গে এ সেবনকারী শিশুদের দেহে প্রবেশ করে। টলুইন ক্ষণস্থায়ীভাবে ঝিমুনি, মাথাব্যথা, ক্ষুধা না লাগা এবং নিয়ন্ত্রণহীনতার উদ্রেক করে। দীর্ঘদিন এর সংস্পর্শে থাকলে স্নায়ুতন্ত্রে চিরস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। এসকেএফ ফার্মাসিটিউক্যালসের মিয়ানমারের কান্ট্রি ডিরেক্টর বাংলাদেশি কেমিস্ট রাকিব নাজির বলেন, ডান্ডিসেবী এসব শিশুর ভবিষ্যৎ পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। লিভার, কিডনিসহ ব্রেইনের গুরুত্বপূর্ণ আংশগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলে ডান্ডি অর্থাৎ টলুইন। এ ছাড়া নিয়মিত ডান্ডি সেবনে বেনজিন মিথানলের প্রভাবে এ পথশিশুদের মস্তিষ্ক বিকৃতির আশঙ্কা রয়েছে শতভাগ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।