জাপানে আসার পর গোমি (ময়লা) ফেলা নিয়ে জাপানিদের নিয়মকানুন প্রথম প্রথম একটু বাড়াবাড়ি বলেই মনে হতো। নির্দিষ্ট স্থানে, নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট ধরনের ময়লা ফেলতে হবে। তাও আবার যেনতেনভাবে ফেলে এলে চলবে না। সিটি অফিসের নির্দিষ্ট পলিথিন ব্যাগে, নির্দিষ্ট উপায়ে প্যাকিং করে ফেলতে হবে। যখন ময়লার ব্যাগ রেডি করে ফেলতে যেতাম, মনে হতো যেন কারও জন্য গিফটের প্যাকেট রেডি করে নিয়ে যাচ্ছি! এখন অবশ্য অভ্যাস হয়ে গেছে (না হয়ে উপায় নেই; কারণ ঠেলার নাম বাবাজি!)।
তবে এটা ঠিক, শুধু সিটি অফিসের কড়াকড়ি নিয়মকানুনই নয়, সাধারণ মানুষের সচেতনতার ফলেই জাপান আজ পৃথিবীর পরিচ্ছন্ন দেশগুলোর অন্যতম। ‘ময়লাকে ময়লা বইলা কইরো নাকো হেলা...’ ... হ্যাঁ; ময়লাকে হেলা করেই আমাদের শহরগুলোর আজ এই চেহারা হয়েছে! বিশেষ করে বিভিন্ন জরিপে ঢাকা শহরকে যে বিশ্বে বসবাসের অন্যতম অযোগ্য শহর বলা হয় তার জন্য বহুলাংশে দায়ী শহরটির অপরিচ্ছন্নতা। শুধু অপরিচ্ছন্নতা বললে সম্ভবত কম বলা হবে; অনেকে শহরটিকে বৃহদাকার একটা ডাস্টবিনের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। জাপানের শহরগুলোর সঙ্গে ঢাকা শহরকে তুলনা করলে এটাকে অত্যুক্তি বলা যায় না। আসুন দেখি জাপানিরা কীভাবে তাদের দেশটাকে এতটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখেছে।
বিগত পাঁচ বছরে আমি কখনো কোনো জাপানিকে রাস্তাঘাটে থুথু বা কাগজের টুকরা বা অন্য কোনো উচ্ছিষ্ট ফেলতে দেখিনি। বরং কেউ যদি কোথাও কিছু পায় সেটা তুলে নিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলে দেয়। এরা যখন কুকুর নিয়ে হাঁটতে বের হয় তখন সঙ্গে একটা প্যান নিয়ে বের হয়, যাতে কুকুরের পথে পায়খানা চেপে গেলে সেটাতে করতে পারে। জাপানিরা তাদের রাস্তাঘাট পরিচ্ছন্নতার জন্য শুধু সরকার বা সিটি করপোরেশনের ওপর ভরসা করে বসে থাকে না, প্রতিটা মানুষ এই ব্যাপারে খুবই সচেতন।
শুধু রাস্তাঘাটের বা নিজের বাসার ময়লা ফেলা নয়, বিল্ডিংয়ের আশপাশের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে এদের একটা নিয়ম আমার খুব ভালো লাগে, সেটা একটু শেয়ার করব।
আমি একটা ছোট্ট আবাসিক এলাকায় থাকি; প্রতি মাসের প্রথম রোববার (সাপ্তাহিক ছুটি) সকাল আটটা থেকে সাড়ে আটটা এখানে বড় সৌজির (পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন) জন্য সময় নির্ধারিত। নির্দিষ্ট সময়ে প্রতি পরিবার থেকে একজন করে সদস্য এসে সবাই মিলে বিল্ডিংয়ের আশপাশে এবং সংলগ্ন ফুটপাত/রাস্তার ময়লা পরিষ্কার করে। ছয় মাসের জন্য একজন লোককে এই কাজের তদারকির দায়িত্ব দেওয়া হয়। কোনো ফ্যামিলি থেকে কোনো মাসে কেউ না আসতে পারলে কিছু জরিমানার ব্যবস্থা আছে; সেই টাকা দিয়ে যন্ত্রপাতি কেনা হয় বা মাঝে মাঝে সামান্য নাশতার ব্যবস্থাও করা হয়। সপ্তাহে দুই দিন দহনযোগ্য ময়লা ফেলার রুটিন।
সকাল ১০টার ভেতর সিটি করপোরেশনের গাড়ি এসে ময়লা নিয়ে যায়। ময়লা নিয়ে যাওয়ার পরে সেই ময়লার ঘরটা আবার ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে রাখতে হয় ওই দিনের ভেতরই। এই কাজও বিল্ডিংয়ের প্রতিটা ফ্ল্যাটের জন্য রুটিন করা আছে। একটা কথা না বলে পারছি না, এদের ময়লার ঘর যতটা পরিচ্ছন্ন থাকে আমাদের দেশের অনেক পরিবারের রান্নাঘরও ততটা পরিষ্কার থাকে না।
একটা কথা মনে হলো, আমাদের শহরগুলোতে যদি এই সিস্টেম চালু করা যেত! কোনো বিশাল বাজেটের দরকার নেই, শুধু একটু সচেতন হলেই আমরা আমাদের শহরটাকে বসবাসের উপযুক্ত করে ফেলতে পারি।
কিন্তু আমাদের দেশে সেটা কি সম্ভব? আমরা ময়লা পরিষ্কার করার সব দায়িত্ব সিটি করপোরেশন আর কাজের মেয়েদের ওপর দিয়ে রেখেছি। জাতিগতভাবে আমরা নিজেদের কাজ অন্যকে দিয়ে করিয়ে নিতে পারাকে স্ট্যাটাস গণ্য করি। দেশে ফিরলে ঢাকা শহরেই হয়তো থাকতে হবে। আমি আমার ফ্ল্যাটে এই সিস্টেম চালু করার চেষ্টা করব। আপনারাও একটু চিন্তা করে দেখবেন কি?
ড. মো. মাহবুবার রহমান
ওসাকা ইউনিভার্সিটি, জাপান
<md.mahbubar@gmail.com>
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।