আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গল্পঃ একটি অনুভুতির জন্ম



জানালায় টাঙ্গানো শৌখিন ঘন্টাটি হঠাত আসা মৃদু হাওয়ায় টুংটাং করে বেজ়ে উঠে। আমার ঘোর কেটে যায়। অনেকক্ষন হয় এলোমেলো ভাবনায় ডুবে আছি। জানালা দিয়ে আসা চাঁদের নরম আলোর কিছুটা বিছানায় এসে পড়েছে। বাতাসে ফুলের সুবাস।

মায়াবীনি রাত যেন তার রুপের সমস্ত মাধুরী ছড়িয়ে দিচ্ছে এই নিস্তব্ধ চরাচরে। আমার ঘুম আসছেনা বরং অতীত নিয়ে ভাবতে ভাললাগছে। আমার মন ফিরে যায় আজ থেকে দুমাস আগের সেই দিনে যে দিন হঠাত করেই আমার জীবনের মোড় ঘুরে গিয়েছিল। যেদিন থেকে আমার অনন্ত পতনের শুরু। সেদিন সকালটা ছিল রৌদ্রে ভরা ঝলমলে।

আমার মনটা ভীষন ভাল। প্রিয় একটি গানের সুর গুনগুন করতে করতে রেডি হচ্ছিলাম ক্লাসে যাওয়ার জন্য। ক্লাস না ছাই। আজ আমরা সবাই মিলে পিকনিকে যাব ঠিক করেছি। আমাদের এক বন্ধুর বাড়ি গ্রামের দিকে।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেড় কি দু ঘন্টার পথ। সেখানেই সবকিছুর আয়োজন হয়েছে। সবার জন্যই সুবিধা কারন সন্ধ্যার মধ্যই বাসায় ফেরা যাবে। বাসায় জানাতেও হবেনা। আমি নিশ্চিত আমার বাসায় যদি অনুমতি চাইতাম জীবনেও দিত না।

ওরা সবাই দূরে দূরে পিকনিকে যেয়ে তিন চার দিন থাকে,কত মজা করে। প্রতিবারই আমি মিস করি। এবারই প্রথম ক্যাম্পাসের বাইরে কোনো পিকনিকে যেতে পারছি। সারাদিনের বেপার তাই সকাল সকাল ই স্নান করে নিয়েছি। সুন্দর দেখে একটা সালোয়ার কামিজ পড়ে খুব যত্ন করে সেজে নিলাম।

আশা করছিলাম যেন কোনোভাবেই পিংকিকে আমার চেয়ে সুন্দর না লাগে। রনির সাথে যখন থেকে মেশা শুরু করেছি মনে হচ্ছে যেন এই বেয়াদপ মেয়ে বেশি বেশি সাজগোজ করে রনির সামনে পিছনে বেড়ানো শরু করেছে। যদিও রনি আমাকে প্রোপোজ করেছে তাই এখন আমরা এফেয়ারে আছি এবং রনি বলেছে তার এ পর্যন্ত সব গার্লফ্রেন্ডের মাঝে আমি সবচেয়ে সুন্দর তারপরও বলা যায়না সাবধান থাকা উচিত। রনি খুবই স্মার্ট আর স্টাইলিশ ছেলে যদিও পড়ালেখায় একটু কাঁচা এবং একব্যাচ সিনিয়ার হলেও ড্রপ করে এবছর থেকে আমাদের সাথে পড়ছে। সে আমাকে প্রোপোজ করেছে মাস ছয়েক আগে।

গুনে গুনে তিন মাস ফোনে,মেইলে আর ফেসবুকে কয়েক কোটিবার আই লাভ ইউ পাঠানোর পরই আমি রাজি হয়েছি। যদিও আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড নওরিন রনিকে একদমই দেখতে পারেনা। রনি অন্য ক্লাসে থাকার সময় সে ওকে দেখলেই বলে উঠত দেখ ছেলেটার মধ্যে কেমন ষাঁড় ষাঁড় ভাব, নাকে কানে কিছু রিং পড়িয়ে দিলে একদম মানিয়ে যেত। এখন আর কিছু বলেনা শুধু নাক কুচকায়। যেদিন ওকে বললাম আমি ভাবিনি কেউ আমাকে এত ভালবাসবে যে ক্রমাগত পুরো তিন মাস সারা দিনে হাজার হাজার বার ভালবাসার কথা লিখে পাঠাবে ও বলেছিল তোর মত একটা মেয়ের সংগ পাওয়ার জন্য অনলাইনে অন্য মেয়েদের সাথে টাংকি মারার পাশাপাশি এসব কথা কপি পেস্ট করে পাঠানোই যায়।

ক্রমাগত একই কথা কপি করার ক্ষমতাকে ভালবাসা ভেবে ভুল করিস না,তোর বরং উচিত ওর বদলে ওর ল্যাপটপের প্রেমে পড়া কারন এসব ওটারই কারসাজি। সে নওরিন যাই বলুক আমি বেশ খুশি ওর সাথে। সেজেগুজে বের হতে যাব বসার ঘর থেকে বাবার ডাক শুনলাম। যেয়ে দেখি বয়স্ক একলোক আর এক ভদ্রমহিলা বসে আছেন। আমি মুখে হাসি টেনে সালাম দিতেই বাবা পরিচয় করিয়ে দেন এই আমার মেজ মেয়ে মিতালী,কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে পড়ছে,এবার ফোর্থ ইয়ারে।

ভদ্রলোক বললেন তোমার পড়ালেখা কেমন চলছে মা,আমি উত্তর দিতেই ভদ্রমহিলা (যিনি পলক না ফেলে এতক্ষন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন) বললেন ভাই আপনার মেয়েটির চেহারা কিন্ত ভীষন মিষ্টি,বিশেষ করে চোখদুটি যেন প্রতিমার মত। বাবা হেসে বললেন ও ওর দাদির মত চোখ পেয়েছে। আমি বিদায় নিয়ে বের হতেই মা আমার ঘাড়ে মেহমানদের নাস্তা তদারকির দায়িত্ব ফেলার উপক্রম করছিলেন। কোনোমতে তাকে বুঝিয়ে আর কোনো আপদ আসার আগেই বাইরে পালিয়ে এলাম। আজ কোনোভাবেই কিছু মিস করা চলবে না।

সেবার খুব মজা করেছিলাম সারাদিন। ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি ফিরে আমি বেশ অবাক হলাম। বড় আপা দুলাভাই আর বাচ্চাদের নিয়ে এসেছে। ছোটখালাও এসেছেন দুই খালাত বোনকে নিয়ে। ভালই হল এত মানুষের মাঝে কেউ দেরি করে ফেরার জন্য কিছু বলবে না, মা হয়ত খেয়ালই করবে না যে আমি এসেছি।

রান্নাঘরে যেয়ে দেখি খালা অনেক রকম পিঠা বানাচ্ছেন। পিঠা আমার খুবই পছন্দ আর খালার হাতের পিঠার কোনো তুলনা নেই। অবাক হলাম এটা দেখে যে আমার ছোটবোনটাও কাজে হাত লাগিয়েছে। এমনিতে তো অলসটাকে দিয়ে একটা কাজ করানো যায় না। এই আয়োজন দেখে খুশিতে এক চিতকার দিয়ে আমি পেছন থেকে খালাকে জড়িয়ে ধরি সেইসাথে একটা রসাল পিঠা মুখে পুড়ে চিবাতে থাকি।

খালা হাসি মুখে বলেন কিরে পাগলী, নিজের বিয়ের পিঠা দেখে এত খুশি। আমি প্রথমে বুঝে উঠতে পারিনা উনি কি বলেছেন। তখন ছোটবোন বলে ওঠে মিতুপা তো সারাদিন বাড়িতেই ছিলনা খালা, ওতো জানেই না যে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমি কিছুক্ষন বোবা হয়ে থাকি তার পর চিতকার দিয়ে উঠি- কি বলছিস এসব!ও বলে সত্যি মিতুপা ,সকালেই পাত্রের বাবামা তোমায় দেখে গেছে। তাদের তোকে খুব পছন্দ হয়েছে।

ছেলেকও আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে যদিও আমি সামনাসামনি দেখিনি। বড়পা দুলাভাই আর বাবা মা গতকাল ছেলে দেখেছে। ছেলে খুবই ভাল শুধু বয়েসে তোর চেয়ে সাত বছরের বড়। ছেলে দেশের বাইরে যাবে তো তাই সময় নেই। ছেলেপক্ষের অনুরোধে তাই দুইদিন পরে বিয়ের দিন পাকা করা হয়েছে।

বাবা রাজি হচ্ছিল না এত তারাতারি দিতে কিন্ত ওরা বলে খুব নাকি সমস্যা হয়ে যাবে দেরি হলে। সময় কম তাতে কি,দেখিস আমরা ঠিকই সব আয়োজন করবো। কাল সকালে তোর গায়ে হলুদ মিতুপা সেই জন্যই সে কখন থেকে খালার সাথে কাজ করছি। ও যখন এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল। রাগ, দুঃখ,হতাশা আর অভিমানে আমার চোখে তখন অবিরাম জলের স্রোত যাচ্ছে।

একছুটে আমি মায়ের ঘরে হাজির হয়ে মাকে জিগাসা করি মা এসব আমি কি শুনছি। মা তখন বড়পার সাথে কথা বলছিলেন আমায় বললেন সত্যি কথায় শুনছ। বড় হয়েছ,বয়স হয়েছে এখন আমাদের দায়িত্ব আমরা পালন করছি। আমি বলি একবার আমাকে জিগাসা করলেনা আমি রাজি কিনা। মা বলেন সময় খুবি কম ছিল তাছাড়া এখানে তোমার অমত করার কোনো কারন নেই।

ছেলের পরিবার ভাল,ছেলেও ভাল। চেহারা,শিক্ষাগত যোগ্যতা,আচার ব্যবহার সবকিছুতেই তোমার সাথে তাকে মানায়। আমরা সব দিকে লক্ষ্য রেখেই বিয়ে পাকা করেছি। জানা শোনার সময়টা দিতে পারিনি সময়ের অভাবে। যেহেতু সে দেশের বাইরে পড়তে যাবে বিয়ের পর তাই এত দ্রুত সব করতে হল।

আমি বলি কিন্ত মা আমার পড়ালেখা। মা বলে তাতে সমস্যা কি?তুমি তোমার অনার্স শেষ করবে এখানে তারপর ঐদেশে চলে যাবে। যদি চাও মাষ্টার্স ও করতে পারো এখানে। বিয়ের পরে দুজনে ঠিক করো কি করবে। আমি বুঝি আমি হঠাত করেই খুব বড় ঝামেলার মাঝে পড়ে গেছি।

কোনোকিছুই যেন বিশ্বাস হতে চায় না আমার। এও কি সম্ভব! এই আমি যে আজ সারাদিন বন্ধুদের সাথে হইচই করে কাটালাম,দুদিন পরেই সারা জীবনের জন্য একটা বাঁধনে জড়িয়ে পড়বো। আমার জগতটা এমন হঠাত করেই পালটে যাবে!আমি ভাবতে পারিনা কিছুতেই এসব,একছুটে নিজের রুমে চলে আসি। একটু পরেই বড়পা আমার রুমে এসে আমার মাথায় হাত রাখেন। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি।

বলি আপা আমার কি হবে,আমায় বাঁচা,আমি এখন বিয়ে করবো না,প্লিজ কিছু কর। আপা বলে বিয়ের আগে এমন খারাপ লাগেই,আর তুই হঠাত শুনেছিস তাই এমন লাগছে,শাহেদ খুবি ভাল ছেলে, তোকে খুবই ভাল রাখবে। হঠাত করেই আমার রনির কথা কথা মনে হয়,আমি বলি আপা অন্য একটা ছেলের সাথে আমি মিশি। আপা বলে ঐ ষন্ডামার্কা ছেলের চিন্তা ছেড়ে দাও। চৈতি তোর কম্পিউটারে ছবি দেখিয়েছে,ঐসব ভাল ছেলে না তাছাড়া তোর সাথে মানায়ও না (এত দুঃখের মাঝেও আমার ছোটবোন আমার পারসোনাল ড্রাইভের পাসওয়ার্ড ভেঙ্গেছে জেনে অবাক হই এবং তাকে এর জন্য আচ্ছামত শিক্ষা দেওয়ার সংকল্প করি)।

আপা চলে যায়। আমি বুঝতে পারি আমি কারো কাছে কোনো সাহায্য পাবনা,আমার সব আপনজন আমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্রে মেতেছে। হঠাত মনেহয় রনিকে জানানো দরকার। সে চাইলে হয়ত আমায় সাহায্য করতে পারে। তাকে বেশ কয়েকবার ফোন দিই কিন্ত সে ফোন ধরেনা।

নিশ্চয় সেট সায়লেন্ট করে ঘুমাচ্ছে। হতাশায় আবার আমার চোখে পানি চলে আসে। তাকে একটা মেসেজ পাঠিয়ে আমি নওরিন কে ফোন দিই। সব শুনে নওরিন বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে,সে চেষ্টা করে আমাকে শান্তনা দিতে কিন্ত মন তো কিছুতেই মানতে চায় না। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ি,কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে যাই।

পরদিন আমার ঘুম ভেঙ্গেছিল খুব ভোরে। আমার স্পষ্ট মনে আছে সেদিন আকাশটা ছিল বেশ মেঘলা কিন্ত চারিদিকে ভোরের নরম আলো। আমি বিছানায় উঠে বসি এবং আমার সবকিছু মনে পড়ে যায়। কি ভয়ানক ছিল কালকের রাতটা। কি সব আবোলতাবোল স্বপন দেখেছি রাতে!একটার কথা এখনো মনে আছে।

দেখলাম আমি সেজেগুজে বউ এর মত একটা স্টেজে বসে আছি আর আমার পাশে বরের আসনে ইয়া বিশাল একটা গরিলা। গরিলার গলায় আবার একটা লাল টাই। সবচে অবাক ব্যপার স্টেজের পাশে রনি এক কাঁদি কলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং একটি করে কলা সেই গরিলাটাকে খাওায়াচ্ছে। হঠাত দেখি রনির জায়গায় একটা ভীষন দেখতে ষাঁড় আর একদল ছেলেমেয়ে সেই ষাঁড়কে লাঠি দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তখন আমার পেছন থেকে কেউ ভরাট গলায় বলে উঠে তুমি ভয় পেওনা মিতু।

পেছনে ফিরে তাকাতেই আমার চোখ পরে অসম্ভব সুদর্শন এক পুরুষের দিকে। এই সময়ে আমার ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। আমার নড়াচড়াতে পাশে ঘুমিয়ে থাকা চৈতি ঘুম থেকে জেগে উঠে। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলে আপা তুই এখন মন খারাপ করছিস তাইনা?কিন্ত দেখিস একদিন তুই এইদিনের কথা ভেবে অনেক খুশি হবি। আমি চোখের আগুনে কিছুক্ষন তাকে ভস্ম করার চেষ্টা করি।

সে আমার দৃষ্টিকে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে বলে যায় আপা তোর বরের ছবি দেখবি?দেখতে কিন্ত বেশ হ্যান্ডসাম। আমি কোনো কথা না বলে ওয়াসরুমে ঢুকে যাই। বের হয়ে দেখি বড়পা আমার জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে। সবার মুখে হাসি শুধু আমারই কিছু ভাললাগছেনা। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা যে আমি বিপদে পড়ে বিয়েটা সত্যিই করতে যাচ্ছি।

আমার মনেহয় রনি কিছু একটা করবে,আমার বন্ধুরা কিছু একটা করবে। দরকার হয় আমি পালিয়ে যাব বাড়ি ছেড়ে। দরকার হয় আমি বান্দরবনের গহীন অঞ্চলে গিয়ে বাস করবো। কল্পনা করার চেষ্টা করলাম যে রনি পাহাড়িদের মত কাপড় পরে মাথায় ঝাঁকা নিয়ে পাহাড় বেয়ে উঠছে। কিন্ত কেন জানি চিন্তাটা বেশি সুবিধার মনে হলনা।

কারন এমন পরিবেশে রনি বাস করতে পারবেনা আমি জানি। এও জানি যে তাকে মানাবেও না সেখানে। এটা নাহয় বাদ দিলাম কিন্ত অন্য কিছু একটা হতেও তো পারে। যাই হোক,যে করেই হোক এই বিয়ে আমাকে থামাতেই হবে। তবে মাথায় যাই চলুক অন্য কাওকে কিছু বুঝতে দেয়া যাবেনা।

আমি শান্ত মুখে খেয়ে নিলাম। খাবার সময় নওরিন আমার ঘরে ঢুকলো। এত সকাল বেলা তাকে দেখে আমি অবাক। সে বললো রাতেই বড়পা গাড়ি পাঠিয়ে তাকে নিয়ে এসেছে বাসা থেকে আমাকে বোঝানো আর সাহস দেওয়ার জন্য কিন্ত আমি ঘুমাচ্ছিলাম বলে সে ডাকেনি। রুমে একা হওয়া মাত্রই তাকে বললাম প্লিজ দোস্ত আমাকে হেল্প কর।

এই বিয়ে আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব না। সে বললো কিন্ত বাসার সবার বিরুদ্ধে কিভাবে যাবি কিভাবে অন্যদের বোঝাবি?যা বুঝতে পারছি ছেলেকে সবাই ভীষন পছন্দ করে ফেলেছে। আর আমার মনে হয় রনির চেয়ে বাসার পছন্দ করা যেকোন ছেলে তোর জন্য ভাল হবে। মিতালী তুই প্লিজ একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখ। ওর কথা শুনেই আমার রনির কথা মনে পড়লো।

রাতে ফোন অফ করে ঘুমিয়েছিলাম। সেট অন করেই রনিকে ফোন দিই এবং সে বেশ ভীত গলায় বলে উঠে ফোন অফ কেন তোমার,কি মেসেজ করেছ এটা?আমি কাঁদ কাঁদ স্বরে তাকে সব ব্যাখ্যা করি। সবশুনে সে বলে, মিতু তুমি এভাবে আমায় ছেড়ে চলে যাবা?আমি তাকে অনুরোধ করি সে যেন কিছু একটা ব্যবস্থা করে। সে বলে তুমি বাসা থেকে চলে আস আমার কাছে। আমি বলি তুমি এসে আমায় নিয়ে যাও কারন আমার পক্ষে বের হওয়া সম্ভবনা এখন বাসা থেকে।

সে বলে মিতু তুমি কোনো চিন্তা করোনা দুপুরের মধ্য কিছু একটা করবো। নওরিন এতক্ষন চুপচাপ সব শুনছিল। সে আমায় বলে যত যাই বলিস রনি তোকে নিতে আসবে না,কারন সে আসলে একটা কাপুরুষ। শুধু তাই না সে কেবল মাত্র মেয়েদের সাথে ঘুরাঘুরি করে তাদের সংগ উপভোগ করতে এক্সপার্ট কাওকে ভালবাসতে শেখেনি। তাই যাই করিস অন্তত ওর মত ছেলের প্রতি ভরসা করে নিজের জীবন সঁপে দিসনা।

আমার হঠাত করে অসহ্য লাগতে থাকে। সবাই এমন করছে কেন আমার সাথে? আমি ভেবেছিলাম সবাই বুঝি ঘুমিয়ে আছে এত সকালে। কিন্ত বের হয়ে দেখি সবাই জেগে আছে এবং ব্যস্ত হয়ে ছুটাছুটি করছে। এত অল্পসময়ের মাঝেই পুরো বাড়ি উতসবের সাজে সাজানো হয়েছে। বাইরের ঘরে গায়ে হলুদের স্টেজ।

আমাকে মানতেই হলো সেটা খুবই সুন্দর হয়েছে দেখতে। চৈতি খালাতবো্নদের নিয়ে মেঝেতে আল্পনা করছিল। আমাকে দেখেই তারা খুশি হয়ে উঠে বলে,আপা দেখ রাত জেগে এইসব করেছি তোর বিয়ের জন্য। ছোটখালা আমাকে দেখে স্নেহের হাসি হেসে বলে পাগলী মেয়েটা একরাতেই চোখের কোলে কালি ফেলে দিয়েছে, এমন সুন্দর মুখটাতে কি মলিনতা মানায়?আমি আমার রুমে ফিরে আসি। এখন শুধু অপেক্ষা রনি আমাকে এই ঝামেলা থেকে উদ্ধার করবে।

দুপুর গড়িয়ে গেলেও তার ফোন না পেয়ে অস্থির হয়ে আমি তাকে ফোন করি, আমাকে অবাক করে দিয়ে সে বলে যে সে ভেবে দেখেছে আমার উচিত বাসার পছন্দ মত বিয়ে করা। কারন সে যেহেতু এখনো চাকরি করে না তাই আমাকে নিয়ে কোথায় রাখবে তার ঠিক নেই,আর আমায় নিয়ে পালিয়ে গেলে যদি আমার বাবা পুলিশে খবর দেয় তবে ঝামেলা হয়ে যাবে কারন দেশের আইন কানুন নাকি আজকাল খুব কড়া। এক মুহুর্তেই আমার বোঝা হয়ে যায় নওরিনের কথাই ঠিক ছিল। আমি এটাও বুঝতে পারি আমি আসলে রনিকে কখনোই ভালবাসিনি। একধরনের হতাশা আমায় ঘিরে ধরে কারন শেষ আশার আলোটুকুও নিভে গেল।

তবে কাওকে ভালবাসলে তাকে যখন মানুষ হারায় যত ভয়ংকর কষ্ট লাগার কথা তা আমি বুঝতে পারিনা নিজের মাঝে। শুধু একধরনের বি্স্বাদ বমি উদ্রেককারি অনুভুতি হয় এটা ভেবে যে এমন মানুষের সাথে মিশেছি যে সাধারন বন্ধুত্বের ও উপযুক্ত না। তখন ও রনি ফোনে বকবক করে চলছে,বলছে আমাকে আসলে সে অনেক ভালবাসে কিন্ত এই মুহুর্তে সে কিছু করতে পারছে না,আমাকে কে সে আসলে হারাতে চায় না,আমায় সে সারাজীবন মনে রাখবে ইত্যাদি। আমি ফোন রেখে দিই। এই এক মুহুর্ত যেন আমাকে অনেক বড় করে দেয়,জীবনের অনেক শিক্ষা দিয়ে দেয় নিমেষেই।

আমি আবার ও কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। হয়ত সবাই আমার দিকে চোখ রাখছিল। একটু পরেই বাবা আসে আমার রুমে। আমার মাথায় হাত দিয়ে বলে, মা রাগ করিস না। আমি চেষ্টা করেছিলাম বিয়েটা একবছর পরে দিতে কিন্ত ওরা শুনলোই না কিছু।

ছেলেটা অনেক ভাল। তাই প্রস্তাবটা যেতে দিতে পারলাম না। আমাদের সবার উপর বিশ্বাস রেখে তুই রাজি হয়ে যা। সত্যি বলতে বাবার অপরাধি করে রাখা মুখটার দিকে তাকিয়ে আমার খুব মায়া লাগছিল। আমি ঠিক করলাম স্রোতে গা ভাসিয়ে দেব অর্থাৎ মেনে নেব এই বিয়েটা।

মন থেকে মানতে পারি না পারি বাইরে আর আপত্তি দেখাবো না। সেই বিকেলে ঘরোয়া পরিবেশে সুন্দরভাবে আমার গায়ে হলুদ হয়ে যায়। সেদিন রাতে আকাশ ভেঙ্গে অঝোর বৃষ্টি ঝরছিল। আমি জানালার পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। চারিদিকে কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব।

ঘরের চারপাশ ঘন হয়ে আছে ফুলের গন্ধে। আমার প্রিয় ফুল রজনীগন্ধ্যা দিয়েই সাজানো হয়েছে ঘরটা। হ্যাঁ সেদিন ছিল আমার বিয়ের প্রথম রাত। সেদিন আমি সর্বস্বীকৃত ভাবে একজন পুরুষের জীবনসঙ্গিনী হয়েছিলাম। বড় একটা ঘর,তার এককোনে দুধ সাদা বিছানা,তার চারপাশ সাজানো শুধু রজনীগন্ধার মালা দিয়ে।

যার রুচিতে ঘরটা সাজানো হয়েছে সে প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য। আমি কখনো ভাবিনি যে যার সাথে পরিচয় নেই এমনকি যাকে একবার ও দেখিনি এমন কাওকে বিয়ে করতে হবে কিন্ত তাই হয়েছে। ভাবিনি বয়েসে বড় কারও সাথে সম্পর্ক করবো কিন্ত সাত বছরের বড় একজন আজ থেকে আমার সবচে কাছের জন বলে বিবেচিত হবে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যিই আমি তার চেহারা দেখিনি আগে,ছবিও না। আমাকে দেখার জন্য বলা হয়েছিল কিন্ত কেন জানিনা ইচ্ছা হয়নি।

বিয়ের আসরেও আমি তার দিকে ভাল করে তাকাইনি। শুধু বুঝতে পেরেছি বেশ লম্বা আর সুঠাম দেহের কেউ আমার পাশে ছিল। পাশাপাশি বসার সময় আমার মনে পড়ছিল আমার বান্ধবিদের বলা গল্পগুলো,যেখানে বড় বয়েসের পুরুষ তার কমবয়েসের বউদের মানসিক ও শারিরিক নির্যাতন করে। আর সেসব পেপার পত্রিকায় পড়া বধুর উপর পাশবিক নির্যাতনের কাহিনী। মনেপড়ছিল সেইসব উপন্যসের কাহিনী যেখানে কচি বধুর সাথে বয়ষ্ক পুরুষের মনের মিল হয় না কিন্ত তাও বউটা মনের কষ্ট চেপে সংসার করে যায়।

এই সব ভয় আমার মনকে বরফের মত জমিয়ে দিচ্ছিল। যদিও আমি বয়েসে কচি না,অসহায়ও না, রীতিমত শিক্ষিত আত্মবিশ্বাসী একজন নারী। তাও সেই বিয়ের আসরে আমি এক গ্রাম্য বালিকা বধুর মত ভয়ে সঙ্কুচিত হয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শেষ করে সন্ধ্যার মধ্যই আমি আমার নতুন ঠিকানায় পৌঁছে যাই। এখানে সবাই আমার সাথে সদয় ব্যবহার করছে,আমার সুবিধা অসুবিধার দিকে সবার সতর্ক নজর।

মনে হচ্ছে আমাকে তাদেরই একজন করে নিতে সকলের খুব আগ্রহ। নতুন বউ দেখতে আসা প্রতিবেশিরা সবাই বিদায় নিলে আমাকে বিয়ের পোশাক বদলে হালকা একটা শাড়ি পড়িয়ে দেয়া হয়। আমি সত্যিই খুব ক্লান্ত ছিলাম কিন্ত সমস্ত সাজ, মেকাপ তুলে ফ্রেশ হয়ে যখন রাতের খাবার খেতে টেবিলে বসলাম দেখি এই পরিবারের সকলেই এক টেবিলে বসেছে নতুন বউ এর সাথে খাবে বলে। এখানেই আমি বুঝতে পারি এই হাসিখুশি পরিবারটির সাথে মানিয়ে নিতে আমার তেমন কষ্ট হবেনা। তবে তখন আমার টেনশন আসলে পরিবার নিয়ে ছিল না বরং যে পুরুষটির হাতে আমার বাবা কন্যাদান করেছেন তাকে নিয়ে ছিল।

তাই আমি তেমন কিছুই খেতে পারছিলাম না। খাওয়া শেষ হলে বড়ভাবি আমাকে আমাদের ঘরে দিয়ে যায়। তখন থেকেই আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছি কারো আগমনের অপেক্ষায়। সভয়ে ভাবছি সে কি আজই সমস্ত অধিকার আদায় করে নেবে?যদি নেয় তবে?নিজেকে শক্ত করার চেষ্টা করছিলাম প্রানপনে। যাই হোক,ভাললাগুক বা না লাগুক আমাকে তো সব মেনে নিতেই হবে।

দরজার বাইরে পদশব্দ শুনে চিন্তার জগত থেকে ফিরে আসি বাস্তবে। আমার পেছনে দরজা বন্ধ হয় তবু আমি ফিরে তাকাই না। পদশব্দ আমার পেছনে এসে থেমে যায় একটা পুরুষালি ভরাট কিন্ত নরম কন্ঠে সে বলে উঠে,বৃষ্টি ভাললাগে?কন্ঠটা শুনে আবার বুকের মধ্য যেন রক্ত ছলকে উঠে। তার মুখটা দেখার অদম্য ইচ্ছা জাগে। আমি ঘুরে দাঁড়াই,সরাসরি তার মুখের দিকে তাকাই।

ব্যক্তিত্ব্পূর্ন একটা চেহারা,পুরুষালী শক্ত গঠন। ফিল্মের নায়কদের মত সুন্দর নয় তবে চেহারাতে অদ্ভুত একটা আকর্ষন আছে। সব মিলিয়ে তাকে সুন্দর বলা যায়। তবে সবচে সুন্দর তার দুটি চোখ। প্রথম দৃষ্টিতেই তার চোখের মায়া আমাকে মুগ্ধ করে দেয়।

তার চোখে আমার জন্য যে দরদ ছিল তা আমি এক নজরেই দেখে নিই। আমি মাথা নিচু করে নরম স্বরে উত্তর দিই হ্যাঁ ভাললাগে। সে বলে আমারো। সে আমাকে বিছানায় এসে বসার জন্য আমন্ত্রন জানায় এবং তার মুখেই প্রথম এই তাড়াহুড়া করে বিয়ে করার কারন জানতে পারি। সে তার দাদুর প্রিয় নাতি।

তার দাদুর দাবি বাইরে যাওয়ার আগে তাকে অবশ্যই বউ আনতে হবে। তার দাদুর ইচ্ছা যে নাতির বিয়ের জন্য গ্রামে বড় অনুষ্ঠান করে লোক খাওয়াবেন। দাদুর শরীর বেশি ভাল যাচ্ছে না। তিনি প্রতিদিন তার ছেলেদের এটা বলে বলে অস্থির করছেন। তার ইচ্ছা রাখতেই এত দ্রুত সব আয়োজন করা হয়েছে।

বিয়েটা যদিও ভালভাবেই শহরে দেয়া হয়েছে তবে গ্রামেও একটা বড় আয়োজন করা হবে। এখানের সবকিছু শেষে সবাই গ্রামে যাবে নতুন বউকে নিয়ে যেখানে দাদু তার মেজ ছেলের পরিবারের সাথে থাকেন। আমি লজ্জা পেয়ে যাই যখন সে বলে,আমি জানি এভাবে বিয়েটা তুমি মন থেকে একদম মেনে নিতে পারনি। আমার ও ইচ্ছা ছিলনা বাইরে যাওয়ার আগে এভাবে বিয়ে করার। পারলে আমাকে ক্ষমা করে দিও।

আমি যখন তোমার বিষয়টা চৈতির কাছে শুনলাম তখন আমার হাতে কোনো উপায় ছিলনা,দুই বাসাতেই বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। যদি পারতাম তবে তোমাকে কিছু সময় দেওয়ার জন্য হলেও একটু দেরি করতাম। আমি তার দিকে তাকাই বেশ অবাক হয়ে। তার চোখ দেখেই বুঝি সে কথাটা সত্যিকারের আন্তরিকতা নিয়েই বলছে। সব জানার পর আমি রাগ আর ধরে রাখতে পারিনা।

সব যেন অচিরেই ম্যাজিকের মত মিলিয়ে যেতে থাকে। সে জিগাসা করে ফুলের গন্ধ ভাল লাগছে কিনা, সে আমার পছন্দের ফুলের কথা জেনে নিয়েই ঘর সাজিয়েছে। আমার সব টেনশন আস্তে আস্তে দুরীভূত হতে থাকে,তার স্থান নেয় অল্প অল্প ভাললাগা। আমার আগের সব ধারনা এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। তার স্থান নেয় একটু একটু মুগ্ধতা।

সেরাতে কতক্ষন আমরা গল্প করেছিলাম জানিনা তবে সেরাতেই কিভাবে যেন জেনে গিয়েছিলাম যে সে অন্তর থেকে সৎ। তার মাঝে কোনো দুইনম্বরি নেই। সেরাতেই জেনেছিলাম সে যা বলছে বা করছে আন্তরিকতা নিয়েই করছে,নিছক আমাকে খুশি করার জন্য ছল করছে না। সেরাতে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ার পরে আধা ঘুমের মাঝে আমি বুঝতে পারি একটা হাত পরম যত্নে আমার গায়ে চাদর টেনে দিচ্ছে। সেদিন আকাশে আধখানি চাঁদ ছিল,বাতাসটা ছিল মিষ্টি।

আমার হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে সে বলে উঠে চলো বাইরে থেকে ঘুরে আসি। ওর হাত ধরে চুপি চুপি ঘর থেকে বের হয়ে আসি। বাড়ির পেছনে গাছের ছায়া ঢাকা ঘাট বাধানো পুকুর। আমরা দুজন সিঁড়ির উপরে এসে বসি। তখন মাঝ রাত।

চাঁদের ছায়া পুকুরের পানিতে প্রতিফলিত হচ্ছে। চারিদিকে কেমন যেন বুনো গন্ধ। হঠাত হঠাত রাতজাগা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছিল। বাতাসে যেন কোনো মায়ার পরশ ছিল সেদিন। সেই মায়ারজালে আবদ্ধ হয়ে চারিদিক যেন নিরব হয়ে ছিল।

হয়ত সেই মায়ার কারনেই আমরা দুজনও চুপ করেছিলাম একে অন্যের দিকে তাকিয়ে। সে রাত যেন আমাদের মধ্যে কিছু একটা করে দিয়েছিল। হয়ত কোনো রাতপরী আশির্বাদ করেছিল দুজনকে যেন আমরা একে অন্যের মাঝে অনন্ত সুখের সন্ধান পাই। প্রথম দিন থেকেই বুঝেছিলাম ধীরে ধীরে তার সাথে আমার একটা নাজুক বন্ধন গড়ে উঠছে। সেই রাত এই বন্ধনটাতে আরো অনেক কিছু যোগ করেছিল।

আমার বিয়ের ছয়দিন হয়ে গেছে। আমরা আগেরদিন বিকালে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছেছিলাম। এই গ্রামটা অনেক সুন্দর। তার চেয়ে সুন্দর এই বাড়িটা। এখানে সকলে এমন আচরন করছে যেন আমি কোনো দেশের রাজকন্যা,ভুল করে এই গ্রামে চলে এসেছি।

আজ সকাল থেকে আমি ওর সাথে এবাড়ি ওবাড়ি দাওয়াত খেয়ে বেড়াচ্ছি। একটা জিনিস একয়দিনে আমি বুঝে গেছি যে শাহেদকে সবাই খুব ভালবাসে আর তার সঙ্গি হওয়াতে সে ভালবাসার একটা ভাগ আমি এমনিতেই পেয়ে যাই। চারদিন গ্রামে থেকে আমরা শহরের বাসাতে ফিরে এসেছিলাম। গ্রামের স্মৃতিগুলো আমি কখনো ভুলতে পারবোনা। এখানেই আমি মানুষটার এক নতুন রূপ আবিষ্কার করেছি,দেখেছি তার বয়স যতই হোক তার মাঝে এখনো একটা শিশুসুলভ মন আছে।

গ্রামের পুকুরে মাছ ধরে,ছোট ভাইদের সাথে পাল্লা দিয়ে সাঁতার কেটে,গাছ থেকে ফল পেড়ে খেয়ে,ছোট ছেলেমেয়েদের সাথে ক্রিকেট খেলে সে একয়দিন খুব আনন্দে কাটিয়েছে। এমনকি ছোটভাইদের সাথে এ নিয়ে আলোচনা করতেও শুনেছি যে রাস্তার লোকদের কিভাবে ভুত সেজে ভয় দেখানো যায়। আমার শশুর এবং তার দুই ভায়ের পরিবার মিলে অনেক ছেলে মেয়ে। সবার সাথেই তার সমান খাতির। আর দাদু মনেহয় আমাকে খুব পছন্দ করেছেন।

আমার চেহারাতে নাকি তার মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পান। তিনি প্রতিদিন সকালে খাবার সময় আমাকে পাশে ডেকে নিতেন। আমি মানুষটার কাছে বসে তার ছেলেবেলার গল্প শুনতাম। আমার দাদুকে আমি কখনো দেখিনি তাই এই বৃদ্ধ লোকটা আমার মাঝে এক অসীম মমতার স্থান দখল করে নিয়েছে্ন সহজেই। গ্রাম থেকে ফেরার পরদিন দুপুরে শাহেদ হঠাত করে বলে মিতু ব্যাগ গোছাও,চার দিনের জন্য আমরা বেড়াতে যাচ্ছি।

আমি ভেবেছিলাম হয়ত কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর বাসায় যেতে হবে। সন্ধ্যায় বাসে উঠে গভীর রাতে যখন একটা হোটেলে থামলাম তখন আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম। তবে এ নিয়ে কোনো চিন্তা করার অবস্থা আমার ছিলনা। আমি এর আগে এতটা লং জার্নি কখনো করিনি তাছাড়া বিয়ের পর এত জায়গাতে ঘুরেছি যে শরিরটা এমনিতেই দুর্বল হয়ে আছে। এজন্যই হয়ত সারাটা রাস্তা আমার মাথা ঘুরছিল।

এক স্টপেজে থামার পর ওয়াসরুমে যেয়ে বমিও করলাম একবার এবং তারপরই কাহিল হয়ে পড়লাম সম্পুর্নভাবে। শাহেদ আমাকে যত্ন করে কিছু ঔষধ খেতে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে যেতে বলল। তখন থেকে সারাটা রাস্তা আমার আধো ঘুমে কেটেছে,বাস আমাদের নিয়ে কোথায় যাচ্ছে কিছুই বুঝিনি। এতই ক্লান্ত ছিলাম যে হোটেলের রুমে কাপড় না ছেড়েই শুয়ে পড়লাম। আমার তখন ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছিল একটু পরেই যখন শাহেদ আমাকে ডেকে বললো আবার বাসে উঠতে হবে।

সেই অন্ধকার ভোরে বাসে উঠে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ি। অসম্ভব ঝাঁকিতে যখন আমার ঘুম ভাঙ্গে তখন চারিদিকে ঝকঝকে আলো ফুটে গেছে। আমি চোখ মেলতেই শাহেদের হাসিমুখ চোখে পড়ে। সে নরম স্বরে জানতে চায় তোমার শরীর কি এখন ভাল লাগছে?আমার আসলেই বেশ ঝরঝরে লাগছিল। আমি ভীষন লজ্জা পেলাম যখন মনে পড়ল ওর সাথে বেড়াতে এসে সারাক্ষন মহিষের মত ঘুমিয়েছি।

বাসের জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাই, ওর কাছে জানতে চাই আর কতক্ষন লাগবে পৌঁছাতে। ও বলে প্রায় এসে গেছি। কিছুক্ষন বাদেই বাস থামে। বাস থেকে নেমে আমি অবাক হয়ে চারিদিকে তাকাই। পায়ের নিচে বালি,আসেপাশে ছোট ছোট খাবারের দোকান।

ব্যাগ নিয়ে নানা বয়েসের মানুষ বিভিন্ন জায়গাতে জটলা করছে। আর সামনে…সামনে বিশাল এক জলাধার,সেখানে একটা জাহাজ নোঙ্গর করা আছে। ওহ খোদা!এটা কি সমুদ্র?আমি আনন্দে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই। আমি কখনো সাগর দেখিনি। তবুও চিরকাল সাগর আমাকে টেনেছে।

বন্ধুরা যখন সাগরে যেত তাদের মুখে গল্প শুনতাম কিন্ত বাসা থেকে অনুমতি না পাওয়াতে কখনো তাদের সাথে যোগ দিতে পারিনি। ও আমার অবস্থা দেখে মৃদু হেসে বলে,মিতু এখন আমরা টেকনাফে। আমরা প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন এ যাচ্ছি। সেখানে সাগর পাড়ে একটা ঘরে আমরা দুজন থাকবো,সাগরের সুস্বাদু তাজা মাছ খাব,দ্বীপের মিষ্টি ডাবের পানি খাব আর সারাদিন সাগরপাড়ে খালি পায়ে হেটে বেড়াব। শুধু আমরা দুজন,শুধুই একে অন্যের কাছে থাকব।

সে আমার চোখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। আমি আনন্দে অবিভুত হয়ে যাই,খুশিতে আমার চোখে পানি চলে আসে। হাতমুখ ধুয়ে হাল্কা নাস্তা সেরে আমরা জাহাজে উঠি। জাহাজ ছেড়ে দিতেই আমরা সামনের খোলা অংশটাতে চলে আসি। ওর কাছে জানতে পারি এটা ঠিক সাগর নয়,এটা নাফ নদী।

এই নদী ধরে বেশ কিছু সময় গেলে তখন খোলা সাগর পাওয়া যাবে। সেখানে পানি অনেক পরিষ্কার,আকাশ ভাল থাকলে সাগরের রঙ হয় নীল। ওর কাছেই জানতে পারি কক্সবাজারের সাগরের পানিও এত নীল কখনো হয়না। কফির কাপ হাতে সাগর দেখতে দেখতে সময়টা যে কখন কেটে যায় বুঝতে পারিনা। জাহাজের পাশে উড়ে চলা গাংচিলগুলোর সাথে সাথে যেন আমিও উড়ে চলছিলাম।

এক সময় যাত্রা শেষ হয়। ওর হাত ধরে আমি পা রাখি স্বপ্নের দ্বীপে আর আমার জীবনের সবচেয়ে স্বপ্নময় সময়ে। আজ পুর্নিমা। চাঁদের উজ্জ্বল আলোতে সাগরের রূপ যে না দেখেছে তাকে ব্যাখ্যা করে বোঝানোর মত ভাষা আমার কাছে নেই। দ্বীপে পৌঁছানোর পর সারা দুপুর খালি সাগর দেখেছি।

সাগর এত নীল!এত সুন্দর!এত বিশাল!বিস্ময়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। প্রকৃতির এই পাগল করা সৌন্দর্য যার কল্পনায় প্রথম এসেছিল,যার হাতে সৃষ্টি হয়েছিল তার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা আপনাতেই নত হয়ে আসে। আমরা যে ঘরটাতে থাকছি সেটা হোটেলের এক কোনে। উপরে টিনের চাল দেয়া ঘরটা বেশ বড় আর নিরিবিলি,সেখান থেকে কয় এক পা হাটলে সাগর পাড়ে চলে আসা যায় সহজেই। রাতের খাওয়া সেরে আমরা সাগর পাড়ে হাটছিলাম।

ও হঠাত দাঁড়িয়ে পড়ে,আমাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সেই প্রথম তার দেহের স্পর্শ অনুভব করেছিলাম আমার সমস্ত দেহ দিয়ে। বিয়ের পর একসাথে থাকলেও এত কাছাকাছি হইনি একবারও। আমি মনেমনে স্বীকার করি সেটাই ছিল সঠিক মুহুর্ত। নিজের প্রেয়সিকে প্রথমবার কাছে টেনে নেয়ার জন্য আগের বা পরের কোনো মুহুর্তই এত উপযুক্ত হতো না।

আমরা অনেক অনেকক্ষন একে অন্যের সান্নির্ধ্য উপভোগ করি। এই আলিঙ্গনে আমাদের দেহ একে অপরের অনেক কাছে ছিল কিন্ত তার চেয়েও অনেক কাছে ছিল আমাদের মন। এমন একজন মানুষের সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল যে এক আলিঙ্গনেই একটা মেয়েকে নিজের করে নিতে পারে। আমরা যখন ঘরে ফিরলাম ও তখন টেবিলের উপরে রাখা মোমটা জ্বালিয়ে দিল। মোমের সে নরম আলোয় আমরা একে অন্যকে দেখি।

একে অপরের চোখের দিকে তাকিয়ে আমরা একে অপরকেই শুধু নয় নিজেরা নিজেদেরকে নতুন করে আবিষ্কার করি। ও যখন এগিয়ে এসে ওর ঠোঁট দিয়ে আমার ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় তখন আমার মনে হচ্ছিল যেন এই স্পর্শের জন্য আমি সেই সৃষ্টির শুরু থেকে অপেক্ষা করছি। সাগরের দুটো ঢেউ যেমন তীরে এসে একে অন্যের সাথে এমনভাবে মিশে যায় যে তাদের আর আলাদা করা যায় না,আমরাও একে অপরের সাথে তেমনি করে মিশে গিয়েছিলাম। সেই থেকে আমি নিমজ্জিত হচ্ছি তলহীন এক গভীর অনুভুতির সাগরে। সে থেকে আমার অনন্ত পতন শুরু।

আমরা যেন শুধু একে অপরের জন্যেই সৃষ্টি হয়েছি। আইনত কাওকে পাওয়াই কেবল পাওয়া নয়। এর চেয়ে অনেক গভীর,অনেক বেশি করে মানুষকে পাওয়া যায় মানুষের মনের অতলে। আমি আগে জানতাম না কিন্ত সে জানতো। সেই আমাকে সব শিখিয়েছে কিন্ত ঠোঁট দিয়ে একটা বাক্য উচ্চারন না করেই।

তার কাছে এসেই আমি বদলে গেলাম। আগে শুধু একজন তরুনী ছিলাম। সে মাত্র কয়দিনে আমাকে একজন সত্যিকারের নারীতে পরিনত করলো। এখন আমি বিশ্বাস করি ভালবাসার জন্য দেহের সৌন্দর্য নয় বরং সুন্দর একটা মন বেশি জরুরি। আরো জরুরি দুটি মনের একে অন্যকে বোঝা এবং একে অন্যের অনুভুতির কদর করা।

আমি সত্যি বদলে গেছি, না হলে ও যখন তার প্রথম জীবনের প্রেমিকার কথা জানা্লো,সেই মেয়েটির প্রতি লালন করা সেই সময়কার তীব্র অনুভুতির কথা জানালো আমার কেন একটুও ঈর্ষা হলোনা?সে যখন মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা বলছিল,একজন বেকার ও অন্য ধর্মের ছেলে হওয়ার কারনে তাকে ধরে রাখতে ব্যার্থতার কথা বলছিল তখন ওর প্রতি সহানুভুতিতে আমার মনটা আদ্র হয়ে উঠছিল। ওর অসহায় অবস্থাটা যেন আমি নিজের মধ্যে অনুভব করতে পারছিলাম। আমি ওকে রনির কথা জানালাম(খবর পেয়েছি সে আমাকে হারানোর বেদনা ভুলতে আমার বান্ধবী পিংকির সাথে এফেয়ার করেছে) সে হেসে বললো ভাগ্য ভাল যে রনি নিজে থেকেই সরে গেছে নইলে রাজকন্যাকে জয় করতে ঢাল তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধে নামতে হত। আমি নিজের মধ্যে আজকাল অদ্ভুত এক সুখ অনুভব করি। ওকে দেখেও বুঝতে পারি সেও একই অনুভুতিতে ডুবে আছে।

জানালায় টাঙ্গানো ঘন্টাটি আবার বেজে উঠে। আমি অতীত থেকে ফিরে আসি বাস্তবে। চাঁদের আলো ওর ঘুমন্ত মুখে এসে পড়েছে। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি,কি যে ভাল লাগছে ওকে দেখতে। হঠাত আমার চোখে পানি চলে আসে।

কাল থেকে এই মুখ আর আমি দেখতে পাবনা। কাল ওর ফ্লাইট। ও চলে যাবে বহু দুরে। আমাকে এখানে থাকতে হবে অন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।