আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উদ্ধত হাসি চুপসে দিল ‘ফাঁসি’

মুক্তিযুদ্ধের সময়ে চট্টগ্রামে হিন্দু ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-সমর্থক নিধনে অংশ নেয়া এবং নির্যাতন কেন্দ্র চালানোর অপরাধে রায়ে তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে সাকা চৌধুরীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় আদালত।
দণ্ড ঘোষণার পর হেসে দিয়ে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, “উই আর সারপ্রাইজড। ”
এরপরই চেয়ারের দুই হাতলে দুই হাত রেখে পেছনে হেলান দেন তিনি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মাথাটা ছেড়ে দেন বাম কাঁধ। এ সময় এক দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায় তাকে।


ফাঁসির রায়ে হাসি উবে যায় সামনে আসনে বসে থাকা তার স্বজনদেরও।
সাকার স্ত্রী ফারহাত কাদের চৌধুরী, মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরী, বড় ছেলের বউসহ আরো দুইজন নারী ওই সারিতে বসা ছিলেন। রায় শুনে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাকার বড় ছেলে ফাইয়াজ কাদের চৌধুরীকে গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। মলিন মুখে সাকা চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে গেলেও নিচু স্বরেই কথা বলছিলেন তারা।
প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে সাকার স্ত্রী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি এতক্ষণ ধরে রায়টি মেলাচ্ছিলাম।

পুরোটাই এক এবং অভিন্ন। ”
তিনি হাতে থাকা বাঁধাই করা একটি বই দেখিয়ে বলেন, “এটাই রায়। আমরা কাল অনলাইনে পেয়েছিলাম। ”
এ সময় জামায়াত নেতাদের আইনজীবী তাজুল ইসলাম এসে সাকার স্ত্রীর কাছে গিয়ে ‘নির্বাক’ সাকা চৌধুরীকে রায়ের প্রতিক্রিয়া জানানোর অনুরোধ করতে বলেন।
পরোক্ষণেই মেয়ে ফারজিন কাদের চৌধুরী তার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “বাবা, দাঁড়াও।

দাঁড়িয়ে তুমি তোমার রি-অ্যাকশন বলো। ”
জবাবে সাকা বলেন, “বলছিতো মা। আর কত বলমু?” স্ত্রীও তাকে একই অনুরোধ জানালে তিনি হাতে ইশারা করে তাদের কথা বলতে নিষেধ করেন।
এক পর্যায়ে সবার অনুরোধে তিনি বলেন, “এই রায় মিনিস্ট্রি থেকে বের হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ দিলাম।


১ টা ২০ মিনিটের দিকে সাকা চৌধুরীকে কাঠগড়া থেকে নামিয়ে আনেন পুলিশ সদস্যরা। ১৩-১৫ জনের মতো পুলিশ পুরো সময় ওই কাঠগড়া ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। দণ্ড ঘোষণার কিছুক্ষণ আগে সেখানে ৬ জন নারী পুলিশকে আনা হয়। সাকার পরিবারের নারী সংখ্যা ছিল সাত জন।
নারী পুলিশ সদস্যদের আনার পর তাদের নিয়েও হাসি ঠাট্টা করতে দেখা যায় সাকা পরিবারের নারী সদস্যরা।

সাকার মেয়েকে বলতে শোনা যায়, “আমাদেরকে সামলাতে হবে তো, তাই এদেরকে আনা হয়েছে। ”
রায় শেষ হওয়ার পর সাকাকে নিচে এনে ট্রাইবুনালের হাজতখানায় রাখা হয়। ৩টা ৪০ মিনিটের দিকে তাকে প্রিজনভ্যানে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
এর আগে সকাল ১০টার দিকে তাকে ট্রাইবুনালে আনা হয়। ১০টা ৪১ মিনিটের দিকে তাকে কাঠগড়ায় আনা হয়।

কয়েক মিনিট পরই বিচারকরা এজলাসে আসেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই রায় পড়া শুরু হয়।
রায় পড়া শুরুর সময়ই সাকা চৌধুরীর স্বজনরা উপরে আসতে থাকেন। তবে সাকার ছেলে হুম্মামকে নিচে দাঁড় করিয়ে রাখে নিরাপত্তা কর্মকর্তারা। এক পর্যায়ে এসবি কর্মকর্তারা তাকে উপরে নিয়ে আসেন।

তখন সাকা চৌধুরী কাঠগড়ায় বসে ছিলেন। ছেলেকে নিয়ে আসার পর তিনি এসবি কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানান।
১০টা ৫৩ মিনিটের দিকে রায়ের এক পর্যায়ে বলা হয়, হি ওয়াজ ইলেকটেড এমপি ফর ফাইফ টাইমস। এ সময় সাকা বলে উঠেন, ফাইফ, ফাইভ? নো, সিক্স টাইমস।
পরে এগারোটার দিকে আবার ফাইভ টাইমস বলা হলে তিনি একইভাবে প্রতিবাদ জানান।

তখন তার আইনজীবী ব্যারিস্টার ফখরুলও দাঁড়িয়ে এ বিষয়ে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
তখন ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানও বলেন, সিক্স টাইমস। এরপর থেকে রায়ে সিক্স টাইমসই বলা হচ্ছিল।
রায়ের শেষের দিকে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানের অংশেও একবার সিক্স টাইমস বলা হয়, তখন সাকা বলেন, বদলানোর দরকার কী? যা লিখছেন তাই থাকুক।
১১টার পরে রায়ে ১৯৭৩ সালের আইনের কথা বলা হলে সাকা বলেন, কিসের ৭৩ সালের আইন।

এটা ২০০৯ সালে হইছে। সেটাতে ভুতাপেক্ষা কার্যকর দেয়া হয় নাই।
পরে সাকা বলেন, প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ আমার পক্ষে রায় দেয়। এবার তিন জনের রায় শুনতে এসেছি।
১১ টা ২৫ মিনিটের দিকে রায়ের এক পর্যায়ে নতুন চন্দ্রকে ‘জনপ্রিয়’ বলার পর সাকা বলেন, হ্যাঁ, জনপ্রিয়।

তবে মদ বেচতো। তার ছেলে সাক্ষী দিয়ে গেছে, তার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো ছিল। একগাদা ফটোও দেয়া হয়েছে।
স্বাধীনতার পর নতুনচন্দ্র বিষয়ে দায়ের হওয়া মামলা সম্পর্কে রায়ে বলা হলে তিনি বলেন, ওই মামলায় কী বলছে? ওই কেসে কি বলা হয়েছে সাকা মেরেছে? বারবার কেন ওই কেসের কথা বলেন?
১১ টা ২৭ মিনিটের দিকে সাকা তার মাথার উপরের ফ্যানটি চালু করতে বলেন। ওই সময় অবশ্য ট্রাইব্যুনালের সব ফ্যানই বন্ধ ছিলো।


রায়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের কথা উল্লেখ করা হলে তিনি বলেন, হ, সহিহ হাদিস।
সাকার তার বিরুদ্ধে অভিযোগে নিজের অবস্থান প্রমাণ করতে পারেননি- এমন একটি কথা বলা হলে তিনি বলেন, “১২শ সাক্ষীর মধ্যে ৫ জনকে আনতে বলছস। টেস্টিফাই করবে কেমনে?”
রায়ে আইয়ূববিরোধী আন্দোলনসহ পাকিস্তান আমলের বিভিন্ন আন্দোলনের একটি প্রসঙ্গ এলে তিনি বলেন, এখানেও ফজলুল কাদের চৌধুরী ছেলে ছিল। আইয়ূব বিরোধী আন্দোলনে কোনটা ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে সেটা বের করো।
পরে তিনি বলেন, নতুন চন্দ্র কোন জায়গা থেকে দেখছে? সে জায়গায়তো ঘরই নেই।


১১টা ৩৬ মিনিটের দিকে কাঠগড়া সংলগ্ন সামনের সোফায় বসা স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন সাকা চৌধুরী। এ সময় তাদের উভয়কে হাসতে দেখা যায়। ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের কথা বলা হলে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মারা গেছে। তার মধ্যে ২০ লাখ আমি মারছি বলে দিলেইতো হয়। ”
পৌনে বারোটার দিকে আইনজীবীদের সারি থেকে উঠে আসেন জামায়াত নেতাদের আইনজীবী তাজুল ইসলাম।

তিনি সাকার কাঠগড়া এবং তার স্ত্রী-স্বজনদের সোফার মাঝ দিয়ে বের হয়ে যান। বের হওয়ার সময় উভয় দিকে কথা বলেন তিনি।
এ সময় তাজুল বলেন, ওয়ার্ড বাই ওয়ার্ড মিলে যাচ্ছে। তখন সাকা বলেন, পুরো রায়ই অনলাইনে এসেছে। এখন আর পড়ার দরকার কী? চলেন বাড়ি যাই।


বেলা ১১টা ৪৮ মিনিটে হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে সালাউদ্দিন কাদের বলেন, “এগুলো পড়ার দরকার নাই, এগুলো তো গত দুই দিন ধরে অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। ”
এ সময় কয়েক মুহূর্তের জন্য বিচারক রায় পড়া বন্ধ রাখেন। মিনিট খানেক পর আবার রায় পড়া শুরু করেন তিনি।
এর আগে হাসতে হাসতে নিচু কণ্ঠে সালাউদ্দিন কাদের বলেন, “যেটা পড়া হয়নি সেটা পড়েন, পড়ে চলেন বাড়ি যাই। ”
পরে সাকা আবার বলেন, জাতিসংঘে পর্যন্ত বইল্লা আসছে, “দেশীয় আইনে বিচার হবে।

এখন আন্তর্জাতিক আইনের কথা বলতেছে। কুলাইতে পারতেছে না। ”
১২টার দিকে তিনি বলেন, “রায়ে এমন সব পাড়ার নাম বলতেছে, আমার জীবনেও যাই নাই। নির্বাচনের ভোট চাইতেও যাই নাই। জানিতো হিন্দুরা ভোট দিবে না, যাইয়া লাভ কী?”
পরে আবার বলেন, “তারা বলছে, সাক্ষী ৫ জন।

এখন বলছে, সাক্ষী আনতে পারি নাই। ”
এতক্ষণ নিজে নিজে কথা বলে চলা সাকার সঙ্গে এক সাংবাদিক কথা বলতে যান। সাকা ওই সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করেন, কোন পত্রিকায় কাজ করেন? তিনি জবাব দেয়ার পর সাকা বলেন, “ডেক্স নিউজ! আপনার সঙ্গে কথা বলে কী লাভ? দিল্লিস্টার কই? তাকে আসতে বলেন। ”
রায়ে লুটের একটি বর্ণনা আসলে সাকা বলেন, “দেখেন দেখেন কী বলে? ধানের কলও চুরি করছি। আহারে এত অভাবি ছিলাম।


সাড়ে ১২ টার দিকে বলেন, বলেন ফাঁসির আদেশ হইছে আর কত? ‘গিল্টি, নট গিল্টি’ পড়া শুরু হলে সাকা বলেন, “দিয়ে দাও ফাঁসি তাড়াতাড়ি। ”
এ সময় সাকার স্ত্রী বলে উঠেন, “১ দাও, ৩টায় দাও আর ৯টায় দাও, ফাঁসিতো দিবাই। ”
আর সাকা বলেন, “সাঈদী সাহেবের মতো একটা লোককে ফাঁসি দিয়া দেয়। আর আমিতো বড় গুনাহগার। কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিছে কসাই মোল্লা হিসাবে।

আর আমাকেতো দিতে হবে ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে হিসাবে, উত্তরাধিকার সূত্রে। আমি কোন সংগঠনের সদস্য ছিলাম না। আমার দোষ হইলো, আমি ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে। ”
রায়ের শেষে দিকে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বলেন, উই অবজার্ভ। তখন সাকা বলেন, আই অ্যাম অ্যলসো অবজার্ভ।

এ সময় সাকার স্ত্রী বলেন, উই অলসো অবজার্ভ।

সোর্স: http://bangla.bdnews24.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.