মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ঢাকা মহানগরের একটি আসনের সংসদ সদস্য কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, 'আমার তো পার্লামেন্টে যাওয়া ছাড়া কোনো কাজ নেই।' আমি তখন সেখানে উপস্থিত ছিলাম। জবাবে নেত্রী বলেছিলেন, জনগণের জন্য কাজ করতে চাইলে কাজ খুঁজে বের করেও করা যায়। কথাটা শুনে আমি বেশ অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। মাঝেমধ্যেই বিষয়টা নিয়ে ভাবতাম। প্রধানমন্ত্রীর সেই কথাটা আজ বার বার কানে প্রতিধ্বনি হয়ে এক মধুর অনুভূতির জন্ম দিচ্ছে। কথা রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। বহুল প্রতীক্ষিত টাঙ্গাইলের নাগরপুরবাসীর স্বপ্নের 'ধলেশ্বরী সেতু' উপহার দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছেন ইচ্ছা থাকলে কাজ করা যায়।
আমার জন্মস্থান টাঙ্গাইলের অন্তর্গত নাগরপুর উপজেলায়। কৈশোর থেকেই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় নাগরপুরের মানুষের প্রাণের দাবি ধলেশ্বরী সেতুর বিষয়টি সম্পর্কে অবগত ছিলাম। টাঙ্গাইল শহর থেকে নাগরপুর ধলেশ্বরী নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন, সম্পূর্ণভাবে অনুন্নত ও অবহেলিত একটি জনপদ। এ অবহেলিত জনপদের সাড়ে তিন লাখ মানুষের দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি ধলেশ্বরী নদীর ওপর সেতু নির্মাণ। ৫১৫ মিটারের একটি সেতুর জন্য মানুষের আকুতি স্বচক্ষে দেখেছি। জরাজীর্ণ রাস্তাঘাট ও মাঝনদীতে মাঝেমধ্যেই ফেরি বিকল হয়ে যাওয়ায় পথেই গর্ভবতী মহিলার সন্তান প্রসবের ঘটনাও নেহাত কম নয়। ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে নাগরপুর যাওয়ার সময় নদীর পাড়ে আমার অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা এখনো মাঝেমধ্যে মনে পড়ে। ১৯৯৭ সাল থেকে রাজনৈতিকভাবে নাগরপুরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করি। দেখলাম একটি সেতুর জন্য নাগরপুরের মানুষের সে কী হাহাকার! যেন বৃষ্টির ফোঁটার জন্য তাকিয়ে আছে চাতক পাখি। তখন থেকেই নাগরপুরের মানুষের স্বপ্নের এ সেতুর বিষয়টি নিয়ে প্রায়ই ভাবতাম। এলাকার মানুষের কাছে শুনতাম- বিগত প্রতিটি সরকারই এ সেতু বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেছে। কিন্তু তা শুধু প্রতিশ্রুতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পরে নাগরপুরে কখনই আওয়ামী লীগ বিজয়ী হতে পারেনি। ধলেশ্বরী সেতুর বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সরকারের সময় উচ্চ পর্যায়ে আলোচনাও কম হয়নি। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময় ব্যক্তিগত উদ্যোগে নাগরপুরের বর্তমান সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার আবদুল বাতেন ভাইকে সঙ্গে নিয়ে বেশ কয়েকবার সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলীর শরণাপন্ন হয়েছিলাম। কিন্তু, সেতু বাস্তবায়নের দ্বার কখনো উন্মোচিত হয়নি।
নেত্রীর সেই উক্তি শোনার কয়েক দিনের মধ্যেই আমি বুঝে ফেলি নাগরপুরে আমার করণীয় কী। এলাকার সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে গড়ে তুললাম 'ধলেশ্বরী সেতু বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ'। বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে দাবি জোরদারের জন্য সচেষ্ট হলাম। ধীরে ধীরে মানুষের মনের মধ্যে থাকা প্রাণের দাবিটি জোরদার হয়ে উঠল। তৎকালীন মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে আমাদের এ দাবি ও ধলেশ্বরী সেতু বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ গঠনের বিষয়টি অবহিত করি। তিনি আমাকে যথেষ্ট উৎসাহ দেন এবং এটি নিয়ে আন্দোলন জোরদার করার পরামর্শও দিলেন। ২০০৬ সালের শেষ দিকে নাগরপুরের মানুষের মুখে মুখে দাবির বিষয়টি আরও জোরালো হয়ে উঠলে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের টনক নড়ে উঠল। বিএনপি সব সময়ই দুটি বিষয়ে বেশ পারদর্শী। একটা ফিতা কাটার রাজনীতি, আরেকটি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন। খোঁজ নিলে দেখা যায় যে বিএনপি যেসব প্রকল্পের ফিতা কেটে উন্নয়নের কথা বলে তার বেশির ভাগই বিগত সরকারের সময় শুরু করা। ২৭ ডিসেম্বর, ২০০৫ সালে চারদলীয় জোট সরকারের নাগরপুর থেকে নির্বাচিত তৎকালীন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী গৌতম চক্রবর্তী তড়িঘড়ি করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে দিয়ে ধলেশ্বরী নদীর ওপর সেতু নির্মাণে ভুয়া ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ন্যক্কারজনক ঘটনার জ্বলন্ত এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিনই টাঙ্গাইলের বিভিন্ন পত্রিকার সংবাদকর্মীরা আমাকে মোবাইল করে মতামত জানতে চান। তাদের কাছে আমার স্পষ্ট বক্তব্য ছিল- সরকারের শেষ সময়ে এ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন জনগণকে ধোঁকা দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দেওয়ার অপচেষ্টা ছাড়া কিছুই নয়।
সেতু নির্মাণের আগে যে বিষয়গুলো গুরুত্ব্বপূর্ণ এর মধ্যে প্রাক্কলন ব্যয় নির্ধারণ, নদীশাসন, মাটির গুণাবলি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা ছাড়াই ভিত্তিপ্রস্তরটি স্থাপন করা হয়। নাগরপুরের জনগণ সহজ-সরল হলেও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর এ চাতুরতার বিষয়টি স্পষ্টই উপলব্ধি করতে পেরেছিল, যার ফলে সেদিন রাতেই কয়েক শ প্রতিবাদী মানুষ ভিত্তিপ্রস্তরের নামফলক তুলে ফেলে। প্রতারণার বিষয়টি বুঝতে পেরে প্রতিবাদী জনগণ ও ঢাকায় বসবাসরত নাগরপুরবাসীসহ নাগরপুরের বিভিন্ন সংগঠন এ ভিত্তিফলক উন্মোচন প্রত্যাখ্যান করে। ধলেশ্বরী সেতু বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে আমার কাছে পরবর্তী কর্মসূচি জানতে চায় নাগরপুরবাসী। আমরা ধলেশ্বরী সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে নাগরপুর এবং ঢাকায় একাধিক সভা-সমাবেশ করে অবিলম্বে সেতুর কাজ শুরু করার আহ্বান জানাই। পরবর্তীতে ছয়-সাত মাস অতিবাহিত হলে প্রতারণার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিষয়টি তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে অবহিত করি। তিনি সেখানে উপস্থিত আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মরহুম আবদুল জলিলকে এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দেন। পরে রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ধলেশ্বরী সেতু বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ২০০৬ সালের ২৫ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সেতু বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণের আলটিমেটাম দেওয়া হয়। দাবি না মানলে মানববন্ধনসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাওয়ের মতো কঠিন কর্মসূচিও দেওয়া হয়। কিন্তু সবই তৎকালীন সরকারের এক কান দিয়ে ঢুকে অন্য কান দিয়ে বের হয়ে যায়।
আলটিমেটামের সময় শেষ হলেও তৎকালীন সরকার কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় আমরা প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মুক্তাঙ্গনে মানববন্ধন করি। মানববন্ধনে আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব উপস্থিত ছিলেন। ঢাকায় বসবাসরত কয়েক হাজার মানুষ ব্যানার-পোস্টার নিয়ে হাতে হাত ধরে মানববন্ধন রচনা করে নাগরপুরের জনগণের সঙ্গে তৎকালীন জোট সরকারের প্রতারণার প্রতিবাদ জানিয়েছিল। মানববন্ধন কর্মসূচিতে আবদুল জলিল প্রতারণার তীব্র নিন্দা জানান ও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে জননেত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে ধলেশ্বরী সেতু বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেন। পরে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৭ অক্টোবর ধলেশ্বরী নদীতে নৌকামিছিলের আয়োজন করা হয়। সেদিন নাগরপুরের প্রতিবাদী মানুষ শত শত নৌকা নিয়ে এ মিছিলে শামিল হয়। নৌকামিছিল শেষে নদীর তীরে বিশাল সমাবেশের আয়োজন করি। সমাবেশে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফজলুর রহমান ফারুকসহ জেলা ও থানার প্রায় সব নেতা উপস্থিত ছিলেন। এসবেও কোনো কাজ না হওয়ায় অবশেষে বাধ্য হয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি দিলাম। কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দেয়। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ হয় প্রতিবাদী মানুষের সঙ্গে। অনেকেই আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।
এভাবেই একটা ভিত্তিপ্রস্তর দিয়ে মেয়াদ শেষ করে চলে গেল বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। ক্ষমতায় এলো আওয়ামী লীগ। সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিলাম নাগরপুরবাসীর প্রাণের দাবি ধলেশ্বরী সেতুর কথা। তিনি প্রতিশ্রুতি রাখলেন। একনেকে অনুমোদন হলো প্রকল্পটি। অবশেষে ২০১০ সালের গোড়ার দিকে শুরু হয় ধলেশ্বরী সেতুর নির্মাণকাজ। আজ নাগরপুরবাসীর সেই স্বপ্নের সেতু উদ্বোধন করবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। সেই শুভক্ষণের প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে নাগরপুরের সর্বস্তরের মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর আগমন আর স্বপ্নের সেতু বাস্তবায়নকে ঘিরে নাগরপুর এখন পোস্টার আর ব্যানারের শহরে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি রেখেছে। নাগরপুরবাসী আজ কৃতজ্ঞ জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি। সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে সেতুর দুই পার প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে ব্যানার আর পোস্টারে ছেয়ে গেছে। পোস্টারে লেখা 'হে মহান নেত্রী নাগরপুরবাসী তোমার প্রতীক্ষায়'। এ সেতু বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রমাণিত হলো, আওয়ামী লীগ সরকার শুধু প্রতিশ্রুতিই দেয় না, প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নও করে। নাগরপুরের জনগণ আজীবন এটা স্মরণ রাখবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনাকে ধন্যবাদ। হে মহান নেত্রী তোমাকে ধন্যবাদ।
লেখক: সহ-সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং আহ্বায়ক, ধলেশ্বরী সেতু বাস্তবায়ন সংগ্রাম পরিষদ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।