প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর ফোনালাপের পর বিশিষ্ট নাগরিক, ‘সুশীল সমাজ’, মিডিয়া সৃষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার, এক কথায় মধ্যবিত্তের স্বস্তির নিঃশ্বাসে অবাক লাগছে। কী এমন ঘটনা ঘটেছে, যার কারণে আমাদের মনে হলো রাজনৈতিক সঙ্কট কেটে গেছে? শেখ হাসিনা ফোন করেছেন, খালেদা ধরতে চাননি, পরে ধরেছেন, এতে বিশিষ্ট সুশীল সমাজ উল্লাস প্রকাশ করছে। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিরোধীদলীয় নেত্রীকে ফোন করেছেন, সেটি সংবাদ হবেই। কিন্তু লক্ষ্য করেছেন কিনা জানি না। অধিকাংশ পত্রিকার প্রতিবেদনের ধরনটা এ রকম যে, যা তা কথা, খালেদা জিয়া ফোন ধরেছেন।
আরও আছে, তাদের কথোপকথনের কিছু কিছু অংশ বিভিন্ন পত্রিকা ছেপেছে। পত্রিকাগুলো তার প্রতিবেদন এমনভাবে ছেপেছে যাতে এ ধারণা জন্মে যে, খালেদা সব সময় যৌক্তিক ভালো কথা বলছেন, আর হাসিনা অযথা প্যাঁচাল পাড়ছেন।
প্রথম কথা, যে বিষয়টি ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ আমলে নেয়নি, তা হলো, প্রথম থেকেই তোয়াজ করার বিষয়টি। নির্বাচন হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী সংসদের অধিবেশন ডাকা হয়েছে।
কেউ যদি আসতে না চায়, তা তাদের ইচ্ছা। কিন্তু আমাদের বিশিষ্ট সুশীল সমাজ ও মিডিয়া কর্তারা শোরগোল তুললেন এ বলে যে, কেন খালেদা ও জামায়াত আসছে না সংসদে, তা বিবেচনা করে সরকারের উচিত তাদের সংসদে নিয়ে আসা। সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে শুরু করে স্পীকার বিরোধীদলীয় সদস্যদের বার বার বলেছেন সংসদে আসতে। তাঁরা নানা অজুহাতে আসেননি। এ কথা কেউ বলেননি, মিডিয়াতে কলাম লেখক বা কথকরা যে, সংসদে আসার অর্থ হচ্ছে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করা।
সংসদে না আসা মানে ওই এলাকার জনগণের ম্যান্ডেট অবজ্ঞা করা। এ বিষয়ে বিশেষ আইন পাস করা এখন সময়ের দাবি। কেউ যদি নির্বাচিত হয়ে তাঁর এলাকার মানুষকে বঞ্চিত করেন একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত, তাহলে তাঁর সদস্যপদ বাতিল হবে। ৯০ দিনের সময় আরও কমিয়ে আনা বাঞ্ছনীয়। ভবিষ্যতে প্রয়োজনে সংসদ বর্জনের কথা ভেবে হয়ত ১৪ দল এমন আইন করেনি।
এখানে উল্লেখ্য, সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন না করে তারা রাষ্ট্রের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন নির্লজ্জের মতো। এই নির্লজ্জতাকে সবাই আন্দোলন হিসেবে দেখেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে এক ধরনের পাকিস্তানী মানসিকতা লুকিয়ে আছে।
আজ থেকে একযুগ আগে ১৯৭১ সালে যারা পাকিস্তানের নীতিনির্ধারক এবং রাজনীতিতে প্রভাবশালী ছিলেন বা নিছক পাকিস্তানী, তাদের সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম পাকিস্তানী মানস বোঝার জন্য। তাদের দাবি, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর ভুট্টোর দাবিগুলো না মানার কারণেই ১৯৭১ হয়েছে।
সংবিধান বা সংসদ সম্পর্কে যে দাবি করেছিলেন ভুট্টো, সেগুলো মানা উচিত ছিল। উত্তরে আমি বলেছি, ১৯৭০ সালে নির্বাচন হয়েছিল। এলএফও মেনে সবাই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। সাংবিধানিক নিয়ম অনুসারে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধানই প্রধানমন্ত্রী হবেন। এখানে কিছু মানা না মানার প্রশ্ন আসছে কেন? অন্য কথা বাদ, সংখ্যাগরিষ্ঠ যে ম্যান্ডেট দেবে তাই তো মানতে বাধ্য সবাই।
সেটি যদি না হয়, তাহলে তো কোন সুস্থ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থা গড়া যাবে না। এ কথার তাঁরা উত্তর দেননি। শুধু বলেছেন, ভুট্টোও তো পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছেন। মূল বিষয়টি ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা ম্যান্ডেট কোন বিষয় নয়, পশ্চিম পাকিস্তানীরা যা বলছে, তা মানতে হবে।
এখানেও বিষয়টা তাই দাঁড়াচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বা জনগণের ম্যান্ডেট কোন বিষয় নয়, বিএনপি-জামায়াত বা তাদের নেতা খালেদা জিয়া যা বলবেন তাই মানতে হবে।
এ ধারণাটা আমাদের মিডিয়াও ব্যাপকভাবে সৃষ্টি করেছে। গত ২৭ বছর বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টিরা বা দক্ষিণপন্থীরা ক্ষমতায় ছিল। তারা আমলাতন্ত্র, ব্যবসা-বাণিজ্যে যাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তারা এখনও ক্ষমতাশালী। মিডিয়ার অধিকাংশ মালিক তাদের। বর্তমান সরকার যাদের টিভি লাইসেন্স দিয়েছে, তাঁরা আবার তা বিক্রি করেছেন ওই দক্ষিণপন্থীদের কাছে।
ফলে কোন বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা মিডিয়া সৃষ্টি না করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে সূক্ষ্মভাবে। শাহরিয়ার কবির একটি প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘প্রচার মাধ্যমের সহযোগিতা ছাড়া সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্য সামাজিক উন্মাদনা সৃষ্টি সম্ভব নয়। ’
বর্তমানে এ ধারণা সৃষ্টি করা হয়েছে এবং আওয়ামী লীগের দুর্বল নেতৃত্বের কারণে যা রোধ করা যায়নি, তা হলো, বর্তমানে ইস্যু একটিই, তা হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু আসলেই কি তাই? তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু হলে দুইপক্ষই একটি সমঝোতায় পৌঁছত। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ নিশ্চয়ই জানেন, একটি বড় দল নির্বাচনে না এলে নির্বাচন গুরুত্ব হারায়।
কিন্তু সংখ্যালঘিষ্ট বিরোধী দল যা বলবে তা মানতে হবে- ব্যাপারটি যদি এমনই দাঁড়ায়, তাহলে সংখ্যাগরিষ্ঠ বা ম্যান্ডেটের প্রশ্নটিও গুরুত্ব হারায়।
তত্ত্বাবধায়কের প্রশ্ন যখন প্রথম উঠেছিল তখন বিএনপিই না বলেছিল, পরে জনচাপে তা মানতে বাধ্য হয়। ধরে নিলাম, এ সরকার নিরপেক্ষ নয়। প্রশ্ন, তত্ত্বাবধায়ক কি নিরপেক্ষ? তত্ত্বাবধায়কের অধীনে যে সব নির্বাচন হয়েছে তাতে কোন না কোনভাবে একপক্ষীয় ঝোঁক দেখা গেছে। আর আমাদের মনসিকতাও আশ্চর্য।
আমরা জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকার চাই। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের সময় যারা একসময় জনপ্রতিনিধিদের অধীনস্থ ছিল তাদের অধীনে নির্বাচন চাই। একেবারে চাকরবাকরের খাসলত। ঔপনিবেশিক শাসন গেছে বটে কিন্তু ঔপনিবেশিক হীনম্মন্যতা যায়নি। হ্যাঁ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার একসময় আমরাও চেয়েছি।
কারণ নির্বাচন নামক প্রতিষ্ঠানটি প্রথম নষ্ট করেন বিএনপির স্রষ্টা জিয়াউর রহমান। ৩০ মে ১৯৭৭ সালে পাকিস্তানী জেনারেল আইয়ুব খানের মতো বাংলাদেশের জেনারেল জিয়াউর রহমান নিজেকে বৈধতা দেয়ার জন্য গণভোট করেন। রেজিস্ট্রিকৃত ভোটারদের মধ্যে ৮৮.০৫% ভোট প্রদান করে এবং ৯৯.৮৮ ভাগ ভোট হ্যাঁ সূচক হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার সময় ১৯৭৩ সালে সাধারণ নির্বাচনে রেজেস্ট্রিকৃত ভোটারের মধ্যে ভোটপ্রদান করে ৫৫.৬২%, আর ১৯৭০ সালে ৫৫.০৯ ভাগ। বোঝা যায়, জিয়ার আগ্রহে উৎসাহী আমলা ও সুযোগসন্ধানী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কী করেছিলেন।
জেনারেল জিয়াও নাকি বুঝতে পারেননি আমলারা এত উৎসাহ ভরে ভোটের কারচুপি করবে। কারচুপি করার অলিখিত নির্দেশ ছিল। কিন্তু এতটা কারচুপি করার নয়। নির্বাচনে কারচুপি সেই থেকে শুরু হলো।
জেনারেল এরশাদ নির্বাচন প্রক্রিয়াকে যে পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে আর প্রক্রিয়া বলে কিছু ছিল না।
১৯৮৮ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মাইদুল ইসলামকে বিজয়ী ঘোষণা করলে, মামলা হয় এবং নির্বাচন বাতিল করে বিচারক যে রায় দেন, তা প্রণিধানযোগ্য- ‘প্রকৃতপক্ষে কোন নির্বাচন হয়নি...ভোটাররা ভোট দিতে পারেনি...বাদী-বিবাদী উভয়ে ভোটকেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মারার প্রতিযোগিতা করেছে- ভোটারের চেয়ে ব্যালট বেশি- রিটার্নিং অফিসার খেয়াল খুশিমতো ভোটের সংখ্যা বসিয়ে মাইদুল ইসলামকে বিজয়ী ঘোষণা করেছেন... এরূপ কার্যকলাপ দেশে চলতে থাকলে দানবীয় শক্তির কাছে ভাল মানুষকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। ’
১৯৯০ সালে এ কারণে তিনটি রাজনৈতিক জোট একত্রে এ প্রক্রিয়ার অবসান চেয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চিন্তাটা তখনই এসেছে। এর পরও নির্বাচন হয়েছে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে। কিন্তু খালেদা জিয়ার আমলে এরশাদের প্রক্রিয়া গ্রহণ করে অনুষ্ঠিত হয় বিখ্যাত মাগুরা নির্বাচন।
যিনি এই নির্বাচন পরিচালনা করেছিলেন সেই বিচারপতি রউফকে আমরা নির্বাচন নিয়ে পরে বড় বড় কথা বলতে শুনেছি। এই হচ্ছে আমাদের কপাল।
মাগুরা নির্বাচনের এবং খালেদা জিয়ার আমলে জাতীয় নির্বাচনে যা তা অবস্থার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রচলনের দাবি ওঠে। খালেদা জিয়া মানতে চাননি প্রথমে, পরে জনচাপে পড়ে তা মানতে বাধ্য হন।
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার শুরুতেই যখন পঞ্চদশ সংশোধনীর কথা ওঠে তখন সংসদীয় কমিটি এক আলোচনাসভা করেছিল।
সেখানে টিআইবির চেয়ারম্যান হাফিজুদ্দিন ছাড়া সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপক্ষে মত দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ জিতবে কী হারবে, সে থেকেও চিন্তা ছিল পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বিচারপতি খায়রুল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ বলে রায় দিয়েছেন। সুপ্রীমকোর্টও তা বহাল রেখেছে।
১৪ দলের সরকারের বিরুদ্ধে অনেক যুক্তিসঙ্গত অভিযোগ থাকতে পারে, আছেও, কিন্তু গত পাঁচ বছরে যত নির্বাচন হয়েছে, তাতে সবদল অংশগ্রহণ করেছে।
বিএনপিও নির্বাচন নিয়ে বড় ধরনের কোন প্রশ্ন উঠায় নি এবং অধিকাংশ নির্বাচনে বিএনপি জিতেছে। সেই সরকার, সেই নির্বাচন কমিশন তো এখনও আছে। তাহলে এর অধীনে নির্বাচন হতে পারে না কেন? সর্বোচ্চ আদালতের রায় কেন মানতে অনীহা বিএনপির? মৌলিক এসব প্রশ্নের উত্তর বিএনপির কোন নেতা দেবেন না। সে জন্য বলেছিলাম, তত্ত্বাবধায়ক ইস্যু মূল ইস্যু নয়। মূল ইস্যু যুদ্ধাপরাধ বিচার ও জামায়াত।
দেশের শত্রু জামায়াতকে শক্তিশালী করেছে বিএনপি। পাকিস্তানী জারজ মনোবৃত্তি থেকে এই দৃষ্টভঙ্গির সৃষ্টি। জামায়াতকে বৈধ করতে খালেদা জিয়া তাদের ক্ষমতায়ও বসিয়েছেন কিন্তু নৈতিক বৈধতা জামায়াত পায়নি। যুদ্ধাপরাধ বিচার জামায়াতের আদর্শিক ও সাংগঠনিক ভিত্তিতে বড় ধরনের আঘাত করেছে। জামায়াত না থাকলে বিএনপিরও আদর্শিক ও সাংগঠনিক ভিত্তি বড় ধরনের অভিঘাত হানবে।
এত দিন একটি মিথের সৃষ্টি করা হয়েছে যে, বিএনপি-জামায়াতের আদর্শ ভিন্ন। বিএনপি মুক্তিযোদ্ধাদের দল। সুশীল সমাজ যাদের মনের ভেতর জামায়াত ও হিন্দু মহাসভার বসবাস তারা সরাসরি নিজেদের জামায়াত বলতে লজ্জা পায় দেখে বিএনপি সমর্থন করে। এই মায়া বা মোহ বা ইল্যুশন যত শীঘ্র আমরা ত্যাগ করতে পারব, তত দ্রুত রাজনীতি আমাদের কাছে স্বচ্ছ হয়ে উঠবে।
জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যে ছিলেন এ কারণে যে, বাধ্য হয়ে তিনি যুদ্ধ করেছিলেন।
পাকিস্তানে বড় হয়ে ওঠা জিয়া কখনও মানসিকভাবে বাঙালী ছিলেন না। বাঙালী হলে তিনি বঙ্গবন্ধু পরিবারকে হত্যা শুধু নয়, তাঁর আদর্শ, নামও মুছে ফেলতে চাইবেন কিভাবে? সাবেক সচিব বোরহানউদ্দিন আহমদ দুঃখ করে লিখেছিলেন- জিয়া “কোন দিন শেখ মুজিবকে ক্ষমা করেন নাই। সুযোগমতো সব সময়ই কালিমা লেপনের প্রয়াস পেয়েছেন। বঙ্গভবনে একটি অখ্যাত অন্ধকার সব সময়ই কালিমা লেপনের প্রয়াস পেয়েছেন। বঙ্গভবনে একটি অখ্যাত অন্ধকার কামরায় জাতির পিতার ছবি সরিয়ে জাতীয় স্মৃতি থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর দেহাবশেষ সুদূর টুঙ্গিপাড়ায় সমাহিত করা হয় তড়িঘড়ি করে তাঁর জন্মস্থানে, জাতীয় স্মৃতি ভবনে নয়। তিনি বাকশালকে বৈদেশিক সাহায্য হিসেবে অভিযুক্ত করেন এবং নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ আক্রমণ করেন।
১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল সংসদের উদ্বোধনী অধিবেশনে তিনি শেখ মুজিবকে মওলানা ভাসানী এবং মশিউর রহমানের সমতুল্য হিসেবে উল্লেখ করেন, যাঁরা কোনদিন নির্বাচনে জয়ী হন নাই। তাঁর নামের পূর্বে জাতির পিতা কিংবা জনপ্রিয় ‘বঙ্গবন্ধুর’ খেতাব অথবা প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী বলে সম্বোধন না করে জনাব শেখ মুজিবুর রহমান বলেন। ” পাকিস্তানীদের মতো একটা জাতক্রোধ ছিল তাঁর বঙ্গবন্ধুর প্রতি; কারণ তিনি পাকিস্তান ভেঙ্গেছিলেন।
এ কারণেই তিনি বঙ্গবন্ধুর হত্যায় সায় দিয়েছেন ও বঙ্গবন্ধু কর্তৃক নিষিদ্ধ বাঙালী বিরোধী পাকিস্তানী দলগুলোকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। শুনেছি এবং দেখেছিও, আদর্শিক ছাড়া তাঁর আরেকটি ক্রোধ ছিল তাঁর বঙ্গবন্ধুর প্রতি। তিনি যখন যুদ্ধে বাধা এবং তাঁর বন্ধুরা তাঁদের স্ত্রী-পরিবার সরিয়ে এনেছেন তখন একমাত্র তাঁর স্ত্রীই ঢাকা ছেড়ে যেতে অস্বীকার করেছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা জেনারেল যিনি মারা গেছেন, সম্প্রতি তিনি এ কথা আমাদের অনেককে বলেছেন। এটি জিয়ার কাছে ছিল এক ধরনের ব্যক্তিগত বিট্রেয়ালের মতো।
স্ত্রীকে তিনি পরিত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রী প্রথমে সিলেটের ফরিদ গাজীর কাছে গিয়েছিলেন মীমাংসার জন্য। ফরিদ গাজী জিয়াকে ডেকে পাঠিয়ে ভর্ৎসনাও করেছিলেন। জিয়া রাজি হননি। পরে শেখ হাসিনা তাঁর পিতার কাছে নিয়ে যান জিয়া-পত্মীকে এবং বিষয়টি মীমাংসার জন্য অনুরোধ করেন।
বঙ্গবন্ধু জিয়াকে ডেকে হুকুম দেন স্ত্রীকে গ্রহণের জন্য। জিয়া মানতে বাধ্য হন। এই যে মানতে বাধ্য হওয়া, এ থেকে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে তাঁর প্রবল ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
অন্যদিকে, জিয়া-পত্মী কখনও ভুলতে পারেননি যে, তাঁর বর্তমান রবরবার মূল কারণ শেখ হাসিনা। এটি তাঁর কাছে অপমান স্বরূপ ও ভারস্বরূপ।
সুতরাং মন থেকে তিনি এটি গ্রহণ করতে পারেন না। মানুষ তো ফেরেশতা নয়, মানুষই। প্রকৃতির সহজাত প্রবৃত্তির দাস। রাজনীতি যিনি করেন তিনিও মানুষ। সুতরাং রাজনীতির মধ্যে ব্যক্তিমানস থাকেই।
এটি সব রাজনীতিবিদের জন্যই প্রযোজ্য।
২০০১ সালে খালেদা নিজামীকে ক্ষমতায় আনার পরই দুই দলের আদর্শিক ঐক্যটি জোরদার হয়। খাঁটি একজন মুক্তিযোদ্ধা কখনই জামায়াতের সঙ্গে রাজনীতি করবে না। করলে তাকে হারামজাদা বলাই শ্রেয়। আদর্শিক মিল না থাকলে জামায়াতও অন্য দলকে গ্রহণ করে না, করেনি।
জামায়াতের পিতা মওদুদীরপুত্র এই বাংলাদেশে এসে জামায়াতকে জারজ বলে গেছেন। জামায়াত কোন জবাব দিতে পারেনি। কারণ, বিষয়টি এত সত্য যে, জবাবের কিছু নেই। আদর্শিক ঐক্য না থাকলে, বিএনপি জামায়াতকে সামর্থন করে কিভাবে? যুদ্ধাপরাধ বিচারের ঘোর বিরোধিতা করে কিভাবে? আমরা যখন কোন আলোচনা করি, বিশেষ করে সুশীলরা তারা তখন ইচ্ছে করেই এ বিষয়গুলো ভুলে থাকে। জামায়াত যদি হীনবল হয়ে যায়, তাহলে বিএনপিও হীনবল হয়ে যাবে।
সুতরাং জামায়াত-বিএনপি এখন একই দল। বিএনপি না থাকলে জামায়াতও থাকবে না। সুতরাং এই আদর্শিক ঐক্য উড়িয়ে দেয়া যায় না।
২০০১-০৬ সালে খালেদা-নিজামী যে নিপীড়ন চালিয়েছিল, বাঙালী জনগোষ্ঠী বিশেষ করে হিন্দু ও আওয়ামী সমর্থকদের প্রতি, তা আমরা ভুলেছি কিন্তু বিএনপি ভোলেনি। বিএনপি নেতারা সুপরিকল্পিতভাবে ওই নিপীড়ন চালিয়েছিল, যাতে ভবিষ্যতে পাকিস্তান মানস বিরোধিতা এ দেশে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে।
আইএসআই এবং মৌলবাদীদের কর্তৃত্ব যেন থাকে তাহলে পাকিস্তানের সঙ্গে আবার আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং ভারতের দুইপ্রান্তে দুটি পাকিস্তান থাকলে হিন্দুদের দফারফা করা যাবে। এর সঙ্গে টাকার প্রশ্নও জড়িত। ২০০১-০৬ সালে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেরও সায় ছিল। ওই সময় তারা যে টাকা এনেছিল, তা এখনও শেষ করতে পারেনি। এই টাকা গত তিন বছরে তারা ব্যয় করেছে যুদ্ধাপরাধ বিচার বন্ধে।
লন্ডনে নির্মূল কমিটি ও অন্যদের চেষ্টায় লর্ড এভাবেরি থেকে শুরু করে জেরোমি করবিনÑ অনেকে যুদ্ধাপরাধ বিচার সমর্থন করেছিলেন। এক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন শাহরিয়ার কবির, ল-নের আনসার আহমদউল্লাহ প্রমুখ।
শাহরিয়ারই কয়েক দিন আগে জানালেন, সেই এভাবেরি, করবিনÑ এঁরাই এখন ব্রিটিশ সংসদে যুদ্ধাপরাধ বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে প্রস্তাব আনছেন। আমাদের এখানেও মিডিয়া যে প্রকারান্তরে এতদিন যুদ্ধাপরাধীদের মতামত বিভিন্নভাবে প্রচার করেছে তাও এই টাকা। ট্রাইব্যুনাল পর্যন্ত পৌঁছেছে সেই টাকা।
বিশ্বে যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রশ্নে দ্বিমত একমাত্র রাধা বিনোদ পাল টোকিও ট্রাইব্যুনালে করেছিলেন। আর আমাদের এখানে সুপ্রীমকোর্টে দ্বিমত হয়েছে। পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে এটি হয়নি।
জামায়াত-বিএনপির সেই পরিকল্পনা এখনও আছে। তার প্রমাণ রামু-রাউজানে বৌদ্ধ-হিন্দুদের ওপর আক্রমণ।
এ কারণে এখনও অনেক টাকা আসছে। খালেদা জিয়ার কাছে তাঁর দুই ছেলের বাণিজ্য এবং তাঁর নিজের জন্য একটি চেয়ার এ দুটিই বিবেচ্য।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত গিয়েছিল এ কারণে যে, তাদের মনে ক্ষীণ আশা ছিল, তারা জিততে পারে ২০০১ সালের মতো। কারণ তিন উদ্দিনের বিশেষ পক্ষপাত ছিল জামায়াত ও বিএনপির প্রতি। নির্বাচনে না গেলে দল রাখাও কঠিন হতো।
যে কোন কারণেই হোক সে আশা পূর্ণ হয়নি। আওয়ামী লীগ জেতার পর যে ধরনের প্রতিহিংসামূলক আচরণ করা উচিত ছিল, আওয়ামী লীগ তা পারেনি বা করেনি। ১৯৭১ সালেও একই ব্যাপার ঘটেছিল। বিএনপি-জামায়াতকে সাধারণে ভয় এবং সমীহ, এমনকি প্রবল প্রতাপশালী মিডিয়াও তার কারণ। কারণ, তারা প্রতিহিংসাপরায়ণ ও প্রতিরোধপরায়ণ।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগকে প্রতিহিংসায় বাধা দিয়েছে ছদ্মবেশী বিএনপি-জামায়াতী সুশীল সমাজ। ২০০১-০২ সালে যারা ছিল প্রায় নিশ্চুপ। এখানে লক্ষণীয়, বিএনপি-জামায়াত প্রতিশোধপরায়ণ হলে বা হরতালে দেদার ধ্বংস করলেও তা গণতন্ত্রের জন্য সহায়ক, ১৪ দল করলে নয়। মিডিয়া ২০০১-০২ সালে হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে যেতে বাধ্য হয় যখন তা তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে চলে যেতে থাকে। এর পর মিডিয়া সোচ্চার হয়ে ওঠে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।