চীন বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বুঝেশুনে এগোয়। সে ক্ষেত্রে আরেকটি দেশের ‘সমন্বিত জাতীয় শক্তি’ বিচার করে থাকে। এর মধ্যে সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিও রয়েছে। এসব বিষয় মাথায় রেখে দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ব্রুনেই ও ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী এলাকা ও ভূখণ্ড নিয়ে টক্কর দিচ্ছে তারা।
নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে চীনের রয়েছে দীর্ঘদিনের সীমান্তবিরোধ।
যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সঙ্গে ভারতের খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এই দুই দেশের সঙ্গে আবার চীনের রয়েছে বিরোধ। একটি দ্বীপের মালিকানা নিয়ে জাপানের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে চীনের। আবার প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নেপথ্য শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ চীন। এই বহুমুখী দ্বন্দ্বের মধ্যে ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তানকে পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিতে চীনের সহযোগিতার বিষয়টি রয়েছে।
এভাবে চীন তার প্রয়োজনে আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে নরম-গরম সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তি বাড়াতে বরাবরই সচেষ্ট চীন। ভারত আবার কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে রয়েছে। সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের দিক দিয়েও চীনের চেয়ে পিছিয়ে ভারত। শুধু তা-ই নয়, সাইবার, ইলেকট্রনিক ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভারত এখনো চীনের ওপর নির্ভরশীল।
আর ভারতের এসব দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে চীন। সীমান্তবর্তী এলাকা বাহুবল ঝেড়ে ভারতের ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে চীন। খেয়ালখুশিমতো চীন কখনো দুই দেশের সীমান্তবর্তী লাদাখ, কখনো দেপসাং, কখনো-বা সেনাঘাঁটি দৌলত বেগ ওলদি নিয়ে ভারতকে পীড়ন করে যাচ্ছে। সীমান্তবর্তী এসব এলাকা নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীনের চলছে ইঁদুর-বিড়াল খেলা।
পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্রের দিক দিয়ে পাকিস্তানকে শক্তিশালী করে তুলতে সহায়তা করছে চীন।
আর এভাবে চীন ভারতকে কূটনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরে চীন বিপুল অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছে। কিন্তু ভারতের অরুণাচল প্রদেশ ও জম্মু কাশ্মীরের বিভিন্ন প্রকল্পে আন্তর্জাতিক সহায়তার বিরোধিতা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নিয়েও চীন বারবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তবে ভারত এসব ব্যাপারে বরাবরই নমনীয়।
যেমন, পাকিস্তানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিতে চীনের সহযোগিতার ব্যাপারে ভারত কখনই তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। ভারতের এমন নীরবতায় থেমে থাকেনি চীন।
ভারতের সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ রেখা কখনো সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করছে না চীন। সম্প্রতি চীন দাবি করেছে, ভারতের অরুণাচল প্রদেশ দক্ষিণ তিব্বতের অংশ। ২০০৫ সালে চীনের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাও ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যে বৈঠক করেন, সেখানে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে অনেক বিষয়ে মতৈক্য হয়।
বৈঠকে দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো সুনির্দিষ্ট ও সহজে নির্ধারণযোগ্য করা নিয়ে আলোচনা হয়। জনগণের স্বার্থে সীমান্ত এলাকাগুলোর নিরাপত্তা রক্ষার ব্যাপারেও জোর দেওয়া হয়। এর আগে ১৮৯৯ সালে সীমান্তবর্তী লাদাখ এলাকা কারাকোরাম পর্বত থেকে তিব্বতের কাছাকাছি অবস্থিত সিন্ধু নদ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়। ১৮৯৯ সালের আলোচনা ও নীতিমালা অনুসারে ভারতের জম্মু কাশ্মীরের সীমান্তবর্তী দেপসাং এলাকা ভারতের অংশ বলে নির্ধারণ করা হয়। ১৬৪২ সালে লাদাখ-তিব্বত সীমান্ত নিয়ে যে আলোচনা হয়, তা মেনে চলার ব্যাপারে একমত পোষণ করে ভারত।
পরে ১৮৪২ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের মহারাজা ও তিব্বতের তত্কালীন দালাই লামা এ ব্যাপারে আবার একমত পোষণ করেন। পরে চীনের সম্রাট এই চুক্তি অনুমোদন করে।
কিন্তু ১৯৮৬ সালে ভারতের অরুণাচল প্রদেশের সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ রেখায় চীন অনাহূতের মতো ঢুকে পড়ে। ওই সময় সীমান্তরেখায় বিপুলসংখ্যক সেনা মোতায়েন করে চীন। চীনের সরকারপ্রধান দেং জিয়াও পিং বলেন, চীন ভারতকে শিক্ষা দেবে।
তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন রাজীব গান্ধী। চীন সীমান্তে ঢোকার ১৯ দিন পর ভারতের সেনাপ্রধান বিষয়টি মন্ত্রিসভায় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করার অনুরোধ জানান। এটি নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক বলেও তিনি মন্তব্য করেন। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে কোনো আলোচনা করেননি। তিনি নিজে সরাসরি সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেন।
ওই বছর ৫ মে হঠাত্ করে সীমান্তবর্তী বিতর্কিত দেপসাং এলাকা থেকে চীন ও ভারত তাদের সেনাদের সরিয়ে নেওয়ার সমঝোতায় পৌঁছায়। এতে ভারতে জনমনে প্রশ্ন দেখা দেয়, ভারত কি তাহলে চীনকে তার এলাকায় প্রবেশের সুযোগ করে দিল? ভারত কি তাহলে নিজ এলাকায় দখল প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ?
আসলে চীনের জানা আছে যে, ভারত অর্থনৈতিকভাবে মন্দার মধ্যে রয়েছে। সেনাবাহিনীর আধুনিকায়নের দিক দিয়েও পিছিয়ে আছে ভারত। চীন মনে করে, সীমান্ত এলাকায় অনুপ্রবেশ করলে ভারতকে তারা চাপে রাখতে পারে। এভাবে ভারতকে যতটা বিচলতি করে রাখা যায়, ততই তাদের লাভ।
চীনের সঙ্গে টেক্কা দিতে হলে ভারতকে তাদের সম্পর্ক ও নীতি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। ভারতকে তাদের সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন করতে হবে ও সেনাশক্তি বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে সীমান্তবর্তী দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এটি সম্ভব হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভিয়েতনাম ও আসিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমে।
চীনের ওপর নির্ভরশীলতাও কমাতে হবে ভারতকে।
সাইবার ও জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চীনের ওপর ভারত এখনো নির্ভরশীল। এসব নির্ভরশীলতাকেও ব্যবহার করে ভারতকে চাপে রাখছে চীন।
ইন্ডিয়া টুডে অবলম্বনে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।