আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ব্রিটেন কেন মুঈনুদ্দীনকে দেবে না?

মৃত্যুদণ্ড পাওয়া চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের জীবনযাপনে, বিশেষ করে তাঁর সামাজিক জীবনে আজ থেকে কী পরিবর্তন আসবে, সেটা জানতে আমাদের বিরাট আগ্রহ থাকবে। গত ১৯ জুন বিবিসি বলেছিল, চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের দ্বৈত পাসপোর্ট রয়েছে। ১৯৭৩ সালে তিনি ব্রিটেনে আশ্রয় নেন। বিবিসি আজও ফলাও করে প্রচার করেছে, ‘ব্রিটিশ মুসলিম নেতা’ মুঈনুদ্দীনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

ফাঁসির আদেশের কারণে ব্রিটেন হয়তো তাঁকে বাংলাদেশে পাঠাবে না।

কিন্তু তিনি কি সেখানকার মর্যাদাবান সামাজিক নেতা হয়েই থাকবেন? ব্রিটিশ পত্রিকায় কোনো ব্যক্তি (পাবলিক ফিগার) সম্পর্কে সামান্য কটাক্ষমূলক কিছু বের হলে হয় মিলিয়ন পাউন্ডের মানহানি মামলা, নচেত্ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সামাজিক প্রতিষ্ঠানের পদ ছেড়ে তাত্ক্ষণিক লোকচক্ষুর আড়ালে যেতে হয়।

চৌধুরী মুঈনুদ্দীন বেশ নামীদামি প্রভাবশালী ব্যক্তি। ১৯৮৯ সালে সালমান রুশদির ‘স্যাটানিক ভার্সেস’-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে তাঁকে প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের কাছে যেতে আমরা দেখি। ২০০৩ সালে প্রিন্স চার্লসের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাত্রত আলোকচিত্র আমরা দেখি। তিনি তখন ইসলামি ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক হিসেবে চার্লসের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।

এবারে তাঁর ক্ষেত্রে কী ঘটবে? মুঈনুদ্দীনের ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান ‘ডেইলি মেইল’কে বলেছিলেন, ‘ব্রিটেন প্রত্যর্পণের অনুরোধ রাখবে না। কারণ বাংলাদেশে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। ’

প্রশ্ন হলো, ব্রিটেনের সমাজ কেবল এ ধরনের একটি যুক্তির ওপর দাঁড়িয়ে দণ্ডিত একজন নাগরিককে সম্মানের আসনে রাখাটাকে নৈতিক মনে করে কি না? কোনো বিদেশি আদালতের মৃত্যুদণ্ডকে সভ্যতার অন্যতম সূতিকাগার দেশটি কীভাবে দেখে? কেবলই ক্ষমতাসীন সরকারের বা আমলাতন্ত্রের দ্বারা অগ্রাহ্য বা খাটো করাটাকে সে দেশের আইনসভা ও বিচার বিভাগ কি নিঃশর্তে মেনে নেয়?

৬৪ বছর বয়স্ক মুঈনুদ্দীন মুসলিম স্পিরিচুয়াল কেয়ার প্রভিশনের পরিচালক এবং একটি মাল্টি ফেইথ গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁর এখনকার পদপদবি জানি না। মুসলিম স্পিরিচুয়াল কেয়ার প্রভিশন নামের প্রতিষ্ঠানটি মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেনের একটি প্রকল্প।

ওই প্রকল্পটি ব্রিটিশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে পরিচালিত বলে সংগঠনটির ওয়েবসাইটেই উল্লেখ আছে।

চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বিষয়ে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি এর আগে বলেছিলেন, ‘মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধের কারণে তার প্রত্যর্পণ কঠিন হতে পারে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত কারও প্রত্যর্পণে প্রত্যেক দেশের একটি কর্তব্য আছে। ’ এই কর্তব্য সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের প্রতিক্রিয়া আমরা জানতে চাই। এটা গণমাধ্যমের কোনো প্রশ্নের জবাবে নয়, ব্রিটেনের ঐতিহ্যবাহী গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও তার নীতি নৈতিকতার নিক্তিতে ওজন দেওয়া অবস্থানের আলোকে আমরা জানতে চাই, ব্রিটিশ সরকার এখন কী বলবে? হাউস অব কমন্স এখন কী বলবে? বিচার বিভাগ কী বলবে? আদালতের দ্বারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে না হোক, তাদের সামনে প্রশ্নটি যাতে নিয়ে যাওয়া যায়, তেমন সব ব্যবস্থাই করতে হবে।

   

ব্রিটেনের বর্তমান স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জেরেমি হান্ট। তিনি কনজারভেটিভ দলীয় রাজনীতিক। ব্রিটিশ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছিলেন, ‘মুঈনুদ্দীন সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ বা ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের চাকরি করেন না। তবে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি পদত্যাগ করেন। ’ ‘ডেইলি মেইল’ গত ১৪ এপ্রিল মুঈনুদ্দীনের স্বেচ্ছা পদত্যাগের তথ্য দিল।

১৯ জুনের বিবিসি রিপোর্টে তাঁকে চ্যারিটি মুসলিম এইডের একজন ট্রাস্টি হিসেবে বলা হলো। সেখানে তাঁর পদত্যাগসংক্রান্ত কোনো তথ্য ছিল না। আজও বিবিসি তাঁর বর্তমান পদমর্যাদা বা ব্রিটিশ সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া উল্লেখ করেনি। এখন ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনই আমাদের কাছে তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করতে পারে।  

আমরা বুঝতে চাইছি, ব্রিটেনের সমাজ, ধর্ম ও মানবাধিকার-সংশ্লিষ্ট কর্মীরা কি আজকের পরও তাঁর এসব পদে থাকাটা বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নেবে কি না?

অ্যাডওয়ার্ড স্নোডেনের প্রত্যর্পণ বিতর্কে বিশ্ব নতুন করে দেখেছে প্রত্যর্পণ যথেষ্ট  জটিল বিষয়।

গত বছর বারাক ওবামা-ডেভিড ক্যামেরনের শীর্ষ বৈঠকে উভয় দেশের প্রত্যর্পণ চুক্তি বিরাট গুরুত্ব পেল। প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরনই তুলেছিলেন। কারণ ব্রিটিশরা মনে করে, এই ব্যবস্থা ব্রিটেনের জন্য বৈষম্যমূলক। যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে ক্যামেরন সরকার অসুস্থ এক মুসলিম জঙ্গি নেতাকে প্রত্যর্পণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু উচ্চ আদালত সে আবেদন নাকচ করে দিয়েছেন।

কিন্তু বাংলাদেশি মুঈনুদ্দীন শারীরিকভাবে একদম সুস্থ বলেই জানি।

১২৫৯ সালে মিসর তার প্রতিবেশী হিত্তিতেসের সঙ্গে বিশ্বের প্রথম প্রত্যর্পণ চুক্তি করেছিল। পরস্পরের কাছে অপরাধী ও রাজনৈতিক উদ্বাস্তুদের হস্তান্তর ছিল চুক্তির মূল কথা। আন্তর্জাতিক প্রত্যর্পণ বিশেষজ্ঞ ম্যাকন্যাবের মতে, আন্তর্জাতিক প্রত্যর্পণ আইনে ‘রাজনৈতিক অপরাধকে’ ব্যতিক্রম বিবেচনা করা হয়। প্রত্যর্পণে রক্ষণশীলতা এখনো একটি বৈশ্বিক প্রবণতা।

সোভিয়েত সংবিধান তার নাগরিকদের অন্য দেশে বিচারের জন্য পাঠানো নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। জার্মানিরও শক্তিশালী সাংবিধানিক রক্ষাকবচ আছে। যুক্তরাষ্ট্রে যৌন নিপীড়নের দায়ে ফেরার রোমান পোলানস্কিকে ফরাসিরা মার্কিনদের হাতে তুলে দিলই না। তবে ব্রিটেন সেদিক থেকে কিছুটা অনন্য। তারা তাদের আইনে নাগরিকদের জন্য এ রকম সুরক্ষা দেয়নি।

ইইউর সদস্য রাষ্ট্রগুলো চাইলে তাদের দোষী সাব্যস্ত অপরাধীদের নিজ দেশে দণ্ড খাটাতে পারে। এই বিধানও ব্রিটেন তার আইনে লিখে নেয়নি।

ধরা যাক, বাংলাদেশ ব্রিটেনের কাছে এখন চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে ফেরত দিতে অনুরোধ জানাল। তখন তারা সে অনুরোধ রক্ষা করতে পারে। যদি নেতিবাচক অবস্থান নেয়, তাহলে বিদ্যমান আন্তর্জাতিক আইন তারা তাদের অবস্থান অনুযায়ী ব্যাখ্যা করতে পারে।

এক্ষেত্রে সাধারণত আন্তর্জাতিক আইনের দুটি দোহাই দেওয়া হয়। প্রথমত, অনুরোধ পাওয়া রাষ্ট্র বলতে পারে, যে অভিযোগে দণ্ড দেওয়া হয়েছে তা ‘রাজনৈতিক অপরাধ’। দ্বিতীয়ত, অনুরোধ লাভকারী রাষ্ট্র বিশ্বাস করে, প্রত্যর্পণের অনুরোধ করার পেছনের প্রকৃত কারণ হলো রাজনৈতিক, অপরাধ-সম্পর্কিত নয়।

এর আগে ব্রিটেন মুঈনুদ্দীনকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ নাকচ করেছে বলে খবর বেরিয়েছে। তাদের কথিত যুক্তি হলো, ফাঁসি হওয়ার ঝুঁকি আছে এমন কাউকে তারা প্রত্যর্পণ করে না।

আসলে আমরা ব্রিটেনের আনুষ্ঠানিক সরকারি ব্যাখ্যা জানি না, কী কারণে তাঁকে প্রত্যর্পণ করা হবে না।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.