আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা এখনো থমথমে পাবনা

সাম্প্রদায়িক হামলার নারকীয় কাণ্ডে পাবনা এখন থমথমে। হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা হয়েছে, গঠন হয়েছে তদন্ত কমিটি। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে প্রশাসনের অনুদানও প্রদান করা হয়েছে। বনগ্রাম হিন্দুপাড়াসহ আশপাশ এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ। র্যাবসহ পুলিশের টহল বেড়েছে এলাকায়।

প্রশাসনিক অন্যান্য সংস্থার নজরদারিও বেড়েছে ব্যাপক। কিন্তু আতঙ্কিত মানুষজনকে নিজ নিজ বাড়িঘরে ফেরত আনা কঠিন হয়ে পড়েছে। রামুর স্টাইলে গুজব ছড়িয়ে সাঁথিয়ার বনগ্রামে হিন্দু পরিবারগুলোর বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মন্দির ভাঙচুরের নির্মমতা চালানো হয়েছে। ঘটনার ভয়াবহতা আর অজানা শঙ্কায় হিন্দু পরিবারগুলোর অনেক সদস্য এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। যারা এখনো ভিটেমাটির মায়া ছাড়তে পারেননি তারাও আশ্রয় নিয়েছেন আশপাশের মহল্লায় অন্য কোনো বাড়িঘরে।

বনগ্রামের হিন্দু পাড়াটিতে যেন ভুতুড়ে পরিবেশ নেমে এসেছে। সবার চোখে-মুখে সীমাহীন আতঙ্ক, কিন্তু কারও মুখ থেকে কোনো রকম শব্দ বেরোয় না। মাত্র কয়েক মুহূর্তের ভয়ানক থাবায় সাজানো সংসার, বাড়িঘর, আসবাবপত্র, আরাধনার মন্দিরঘর পর্যন্ত তছনছ হয়ে গেল।

ফেসবুকে পবিত্র কোরআন শরিফ ও মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কটূক্তির গুজব ছড়িয়ে পাবনার বনগ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মন্দির ভাঙচুরের ঘটনায় তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে প্রশাসন। প্রশাসন ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের কঠোর অবস্থানের কারণে ওই এলাকায় ভীতিকর অবস্থা কাটতে শুরু করেছে।

গতকাল দুপুর ১২টার দিকে বনগ্রাম বাজারে সর্বদলীয় বৈঠক থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে নির্ভয়ে বাড়ি ফিরে এসে স্বাভাবিক জীবনযাপনের আহ্বান জানানো হয়েছে। কথিত কটূক্তিকারী রাজিব সাহার বাবা বাবলু সাহা বাদী হয়ে আতাইকুলা থানায় একটি মামলা করেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাল, টিন ও নগদ টাকা অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়েছে। ঘটনার পর পরই ভয় ও অজানা আতঙ্কে বেশকিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। ঘটনার পর থেকেই নিখোঁজ রাজিব সাহার এখনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।

এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর এখনো পুলিশি নিরাপত্তায় রয়েছে। এ ঘটনায় রেজাউল করিম নামে এক ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। পাবনা জেলা প্রশাসক কাজী আশরাফ উদ্দিন জানান, এ ঘটনায় শনিবার রাতেই অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মুন্সি মুনিরুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির অপর দুজন সদস্য হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মুস্তাইন ও ম্যাজিস্ট্রেট মাহফুজুল আলম মাসুম।

গতকাল দুপুরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বৈঠকে রাজশাহী অ্যাডিশনাল ডিআইজি খোরশেদ হোসেন, পাবনা জেলা প্রশাসক কাজী আশরাফ উদ্দিন, পুলিশ সুপার মিরাজ উদ্দিন আহম্মেদ, পাবনা র্যাব-১২ কমান্ডার মেজর মঈন উদ্দিন, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট রণেশ মৈত্র, পাবনা জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি গণেশ ঘোষ, সাঁথিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন, আতাইকুলা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি কোরবান আলী বিশ্বাস, উপজেলা বিএনপির সভাপতি মাহবুব মোর্শেদ জ্যোতিসহ প্রশাসন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

পাবনার আতাইকুলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেজাউল করিম জানান, এ ঘটনায় কথিত কটূক্তিকারী রাজিবের বাবা বাবলু সাহা বাদী হয়ে ২০ জনের নাম উল্লেখ করে আরও অজ্ঞাত ২০০-৩০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। এদিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে দুই বান্ডিল টিন, ৩০ কেজি চাল ও নগদ ৫ হাজার করে টাকা প্রদান করা হয়েছে। এ ঘটনার পর পরই ওই গ্রাম থেকে বেশকিছু হিন্দু পরিবার নিরাপদ স্থানে চলে গেছে। বিশেষ করে বাড়ির যুবক ছেলে মেয়েদের নিয়ে রাতেই অনেক পরিবার অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।

এদিকে গতকাল হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ পাবনা জেলা সভাপতি চন্দন কুমার চক্রবর্তী ও জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি গণেষ ঘোষের নেতৃত্বে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। পরে তারা শহরে ঘটনার বিচার দাবি করে একটি মানববন্ধন করে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, শনিবার বেলা ১১টার দিকে ক্ষেতুপাড়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগের আহ্বায়ক জাকির হোসেন, ছাত্রলীগ নেতা কাওসার হাবিব সুইট, কালাম মুহুরির ছেলে জামায়াত কর্মী মানিক হোসেন, মতির ছেলে বিএনপি কর্মী খোকনসহ ১০-১২ জন যুবক প্রথমে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার একটি প্রিন্ট কপি বের করে বনগ্রাম বাজারে ছড়িয়ে দেয়। পরে বাবলু সাহার মুদিদোকানে গিয়ে তার ছেলে রাজিবের খোঁজ করে। পরে তাকে না পেয়ে দোকানে ভাঙচুর ও লুটপাট করে।

একপর্যায়ে এ খবর ছড়িয়ে পড়লে হাজার হাজার লোক একত্রিত হয়ে হিন্দু অধ্যুষিত সাহাপাড়ায় হামলা চালিয়ে বাড়িঘর ভাঙচুর, অগি্নসংযোগ ও লুটপাট করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানায়, শনিবার বনগ্রাম বাজারে হাটবার হওয়ায় এমনিতেই অনেক লোকের সমাগম ছিল সেখানে। তাদের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকে পুঁজি করে একটি মহল স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা চালায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাহাপাড়ার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, আমরা জামায়াত-বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগকে দোষারোপ করি না। যুগ যুগ ধরে আমরা এখানে সহাবস্থানে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছি।

হঠাৎ করে একটি গুজব রটিয়ে যারা এ কাজ করেছে আমরা তাদের বিচার দাবি করি। এ ব্যাপারে পাবনার পুলিশ সুপার মেরাজ উদ্দিন আহমেদ জানান, বর্তমানে এলাকার পরিবেশ শান্ত রয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে ভয় ও আতঙ্কে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন পরিবারসহ অন্যত্র চলে যাওয়ার বিষয়ে তিনি কোনো প্রকার মন্তব্য করেননি। প্রসঙ্গত, শনিবার ফেসবুকে পবিত্র কোরআন শরিফ ও মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কটূক্তির গুজব ছড়িয়ে বনগ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ৩৫টি বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মন্দির ভাঙচুর করা হয়।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.