আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

উপন্যাস

আমি একজন সফল আর্কিটেক্ট হতে চাই

তোমার সিমান্তে আমি মোঃ শিলন রেজা কয়দিন থেকে মনের মধ্যে সবসময় একরকম অস্থিরতা বিরাজ করছে। অতীতের পাওয়া উষ্ণ সেইসব সৃতি গুলো তাড়া করছে করছে আমাকে সদা। সেগুলোকে ফিরে আবার ফিরে পাওয়ার ইচ্ছে প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। মাঝে মাঝে এলোমেলো বাতাস আমাকে উদাসিন করে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেদিনের সময়টাতে। এদিকে বাসার অভিভাবক গুলো বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।

একটু পরপর এসে আমাকে আমার মতের ব্যাপারে জিজ্ঞাসায় ফেলতেছে। বড় আপু তো ওইদিন বলেই ফেললো, কীরে আমাদের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ে করবি না ঠিক আছে, কিন্তু তোর পছন্দের মেয়েটির নাম টাই নাহলে বল, দেখি আমি বাবা কে ম্যানেজ করতে পারি কিনা? আমি বললাম, কি বলছ আপু? তুই তো জানিস আম্মা মারা যাবার পর বাসাটা কেমন খালি খালি লাগছিলো। পাঁচ বছর আগেই তোর বিয়ের কথা চলছিলো। যাতে বাসার খালি খালি ভাব টা দূর হয়। আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে তখন বাধা দিয়েছিলাম, বাবা কে বলেছিলাম, না বাবা, ওর বিএসসি টা শেষ হউক।

তা নাহলে বিয়ের পর নানা ঝামেলায় পড়ার পাঠ চুকে যাবে। বাবা সেদিন কি মনে করে যেন আমার কথাটা মেনে নিয়েছিল। তাই আজ নিজে থেকে দায়িত্ব নিয়ে তোর বিয়ের ব্যাপারে কথা বলেছি। আপা কথা গুলো বলে থামলো। আমি বললাম, প্লিজ আপা আমার এখন ভাল লাগছে না।

আমি এখন বিয়ে করবো না। আপা বলল, কেন করবি না? এখন তো তোর বিএসসি শেষ, ভালো একটা জব করতেছিস, এখন সমস্যা কি? তোর কোন পছন্দ থাকলে আমাদের বল। আমরা তো না করতেছি না। তাছাড়া বাবার শরীর আগের থেকে অনেক দুরবল হয়ে গেছে এইটা তো বুঝিস। তাকে দেখার তো একজন আপন লোক চাই।

আমি এইভাবে এসে বারবার দেখলে আমার সংসার দেখবে কে? আমি কোন কথা না বলে নীরব থাকলাম। মরিয়ম আবারো বলল, কীরে আলি তুই কি এখন চুপ করেই থাকবি? আপা প্লিজ আমাকে কয়েকটা দিন সময় দাও। আমি খুব ক্লান্ত। -কয়েকটা দিন মানে কতদিন? মরিয়ম বলল। -ইয়ে মানে দুমাস মত আর কি।

আমি বললাম। আপার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। -কয়েকটা দিন যে দুইমাস হতে পারে তা জানতাম না তো। আপা কিছুটা বিস্ময় ভাবে বলল। -ইয়ে মানে ঢাকাতে যায় আগে পরের বার এসে তোমাদের কথা আমি মানবো।

যা বলবে তাই করবো। আপা এবার আরও অবাক হয়ে বলল, এইতো মাত্র তিন দিন হলো তুই বাড়ি এসেছিস। এরমধ্যে ঢাকাতে যাবি আবার! তুই না বললি, এবার মাস খানেক থাকবো। -থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আর থাকতে পারবো না। একজন কে আমায় খুজে বের করতেই হবে যে করে হউক।

দৃঢ়তার সাথে জবাব দিল আলি। -কাকে খুঁজবি? আর কেনই বা খুঁজবি? আমি তো কিছুই বুঝতেছি না। মরিয়ম বলল। -আমি আগে তাকে খুজে পায় পড়ে তোমাকে সব বলব। আলি বলে থামল।

-তার মানে তোর কি পছন্দের কেউ ছিল। যাকে খুঁজবি। আপার প্রশ্ন। -জানিনা। তবে মনে হচ্ছে আমার জীবনের একটা বড় অংশ জুড়ে তার অবস্থান।

যা আগে কখন বুঝিনি। তাকে আমার খুব প্রয়োজন। আপা প্লিজ তুমি বাবা এবং ফুফুকে ম্যানেজ করো দুইমাসের জন্য। মরিয়ম দাড়িয়ে কিছুটা ভাবল। কিন্তু কিছু বলল না।

আচ্ছা দেখছি বলে আলির ঘর থেকে চলে গেলো। মরিয়ম আপা চলে যাবার পর, আলি তার পুরানো ডায়রি গুলো ঘাটতে লাগলো এই ভেবে যে কোথাও মালিহার বাসার ঠিকানা আছে কিনা দেখার জন্য। মালিহা, পুরো নাম ফাইরুজ মালিহা চৌধুরী, বাড়ি বরিশাল, মোবাইল নং ০১৭৪২৯১৯৩৯২। নাম্বার টা টানা পাঁচ বছর থেকে বন্ধ। আর তেমন কোন ইনফরম্যাশন নেই।

মেয়েটা আলি কে বড্ড ভালোবাসতো। সারাক্ষণ জ্বালাতন করতো। আলি তার প্রতি খুব বিরক্ত ছিল। প্রতি ঘণ্টাতে মালিহা আলির কাছে ফোন করতো। এখন অবশ্য আলি মালিহার সেই জ্বালাতন গুলো কে খুব মিস করে।

আলি এখন খুব ভালো করে বুঝতে পেরেছে যে মালিহার মত এত গভীর ভাবে কেউ ওকে ভালবাসতে পারেনা। মাথার মধ্যে এই ভাবনা গুলো গিজগিজ করতেছে। আলি প্রতিজ্ঞ হয় যখন মালিহার একপাক্ষিক ভালবাসা তাকে অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ভাবে যেভাবেই হউক মালিহা কে তার খুজে বের করতে হবেই। কিন্তু কিভাবে এই চিন্তা তার মাথা ব্যাথার কারন হয়ে দাড়ায়।

মালিহার শেষের দিন গুলোর কান্না আহাজারি গুলো আলিকে তার হৃদপিণ্ডে চাবুক দিয়ে আঘাত করে প্রচণ্ড বক্র ভাবে। মাঝে মাঝে মালিহা বলতো, শোন আমাকে এখন এভাবে অবহেলা করতেছো তো, একদিন এমন দিন আসবে যখন আমাকে পাওয়ার জন্য তুমি পাগল প্রায় হয়ে যাবে। কিন্তু সেদিন হয়তো আমি তোমার পাশে থাকবো না আর আমাকে খুজতে খুজতে তুমি হয়রান হবে। সত্যিই তো আজ আমি মালিহা কে কত উন্মুখ হয়ে গেছে। তার ভালবাসা এখন আমাকে সারাদিন ভাবায়।

মনের গহীনে তার জন্য এত সুপ্ত ভালবাসা আগা অনুভব করতে পারিনি কখনও। অনেকগুলো পুরনো ডায়েরি ঘাটা হলো কোথাও মালিহার সন্ধান মিলল না। আলি একটা ডায়েরি লেখার আসক্তি আছে সে প্রতিমাসেই নতুন নতুন ডায়েরি লেখে এবং প্রতিমাসে তার জিবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলোর আদ্যপ্রান্ত সে লিপিবদ্ধ করে। মালিহা তো তার জীবনের বড় একটা ঘটনা সে তাকে নিয়েও লিখেছে এইটা মনে আসছে কিন্তু কোন ডায়েরিতে লিখেছে এইটা সথিক জানা নাই। এইজন্য সবগুলো ঘাটতে লাগলো।

সবগুলো ডায়েরির মধ্যে খোজ করার পর বুঝলাম এখানে দুইটা ডায়েরি নাই। যার একটা প্রাইমেট মেডিক্যাল কোচিং সেন্টার থেকে দেওয়া। যে ডায়েরিটা আলি ভীষণ পছন্দ করতো। মেডিক্যাল কোচিং করার সময় প্রাইমেট কর্তৃপক্ষ সবাই কে একটা করে সুন্দর ডায়েরি দিয়েছিলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলো নোট করার জন্য। কিন্তু আলি অই ডায়েরি টা তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নোট করার কাজে ব্যবহার করতো।

কিন্তু শেষে চাকরি তে যোগদানের পর পুরনো ডায়েরি গুলোকে আর যত্ন নেইনি। কিন্তু এখন সে ভাবছিল আমার মনে হয় অই ডায়েরি টায় আমি মালিহার বিষয়ে কিছু লিখেছি। আলি সব সময় কোন ব্যক্তির বিষয়ে লেখার আগে তার পুরো নাম ঠিকানা দিয়ে শুরু করে। এমন কি কোন স্কুলে পড়েছে তাও সে লিখে রাখতো। এইজন্যই ডায়েরি টাকে তার খজার জন্য মন উতালা হয়ে উঠলো।

অনেকক্ষণ একমনে ভাবলো। মনে পড়লো পুরানো সব কাগজ-পত্র তো জহুরী মহল্লার যে বাসাতে ভাড়া থাকতো সেখানে ফেলে এসেছিলো। তখন ভেবেছিলো ওইগুলো তার প্রয়োজনীয় না। এজন্য সে তাচ্ছিল্য ভাবে ফেলে রেখেছিলো। নেবার প্রয়োজন মনে করেছিল না।

আলির মনে এবার ভাবনা আসলো দুই বছর হয়ে গেলো ওখান থেকে চলে এসেছি। জানিনা আমার মেসের যেসব পোলারা থাকতো তারা আছে কিনা? আমার মনে শুধু এই দ্রিড়তা ভর করলো, আমার অই ডায়েরি টা প্রয়োজন, যেভাবে হউক আমার ওটা ম্যানেজ করতেই হবে। সেইদিন রাতেই আলি ঢাকাতে চলে আসলো আপা মরিয়ম কে ম্যানেজ করে। প্রথম দুইদিন আলি নিজের ফ্ল্যাটে প্রতিটি টেবিল এবং র্যা ক চেক করলো। এই ফ্ল্যাটে আলি একাই থাকে।

চাকরি পাওয়ার পর কোম্পানি থেকে ফ্ল্যাট টা আলি কে দিয়েছে। সে নিজের বাসার আরও অন্যান্য ডায়েরি, নোটবুক গুলো খুটে খুটে দেখলো এর মধ্যেও কোথাও মালিহার ঠিকানা আছে কিনা। আলির কোন কিছুই মনে আসলো না। শুধু এইটুকু জানে মালিহার বাড়ি হচ্ছে বরিশাল। এর বেশি কিছু না।

তবে আলি জানে যে মালিহা নিজের ঠিকানা তার ডায়েরিতে লিখে দিয়েছিলো। তখন বারবার আলি কে বলতো যে বরিশালে যাবার জন্য। কিন্তু আলি মালিহা কে সহ্য করতে পারত না। কিন্তু এখন টাকে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে গেছে। সব ডায়েরি গুলো দেখলো না, কোথাও নেই মালিহার ঠিকানা এবং সেই ডায়েরি গুলোর মধ্যে অই ডায়েরিটা নেই! এভাবে রাত ২ টা পর্যন্ত সব আলমারি, টেবিল, র্যা ক তন্নতন্ন করে খুজলো কোথাও সেই ডায়েরি নেই।

এবার ভাবল আগের ম্যাচে একসাথে থাকা বড় ভাই মইনুলের কাছে ফোন দেই। মইনুল ভাইয়ের নাম্বার ফোনে ছিল কিন্তু প্রায় ২ বছর হয়ে গেলো একবারও ফোন করা হয়নি। আসলে আসার সময় একটা বিষয় নিয়ে মইনুল ভাইয়ের সাথে আলির মন কষাকষি হয়েছিলো। এই থেকে আর ফোন দেওয়া হয়নি। তো আজকে ফোন দেওয়া হলো, কিন্তু “দুঃখিত, আপনার ডায়েল কৃত নাম্বার টিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

অনুগ্রহ করে কিছুক্ষন করে আবার চেষ্টা করুন। ধন্যবাদ। “ মানে ফোন বন্ধ আছে। এভাবে অই রাতে প্রায় আমি আরও ২০-২৫ বার ফোন দিলাম একই রকম উত্তর। মানে বন্ধ আছে।

আলি সিদ্ধান্ত নিলো সকাল বেলা জহুরী মহল্লা টার সেই ফ্ল্যাটে যাবে। খোজ নিয়ে দেখবে কোন ধরনের কুল কিনারা পায় কিনা। কারণ এখন আলির মনে পরছে আসার সময় মইনুল ভাই বলেছিল এই ডায়েরি গুলো নিয়ে যাও। আলি বলে ছিল এই গুলো আপনি রেখে দিন। এখন আলির সেই গুলো ফিরে পেতে চাই।

পরদিন সকাল দশটার দিকে আলি গেলো জহুরী মহল্লার সেই সুপরিচিত ফ্ল্যাটে। যেখানে জীবনের অনেক গুলো মধুর সময় কাটিয়েছে এই মেস বাসাতে। মনে পড়ে এই মেসে মাঝে মাঝেই মালিহা চলে আসতো। তাঁর সকল রুম মেট দের সাথে গল্প করতো। তাঁর এলোমেলো বই খাতা গুলো সুন্দর করে গুছিয়ে রাখতো।

যেদিন আসতো সেদিন পলাশ ফুল নিয়ে আসতো অনেক করে। রুমে ছিটিয়ে দিতো। যার ঘ্রাণে পুরো ঘর সুবাসিত হতো। আলির মেসের সব মেম্বারের সাথে তাঁর ভালো খাতির। এমন কি বাড়িওয়ালা পর্যন্ত জানতো মালিহা হচ্ছে আলির ভালবাসার মানুষ।

কিন্তু আলি এইগুলো একদম সহ্য করতে পারতো না। অনেক ভাবে অপমান করতো মালিহা কে। এই জন্য মেসের অন্যান্য মেম্বার পর্যন্ত আলির ওপর রাগ করতো। আলি মালিহা কে খুব মেরে ছিল একদিন। কিন্তু মালিহা বলতো, ভালবাসার মানুশের হাতে মার খাওয়ার নাকি অনেক মজা।

মেসের প্রতিটি সদস্য মালিহার দিক নিয়ে আলি কে বোঝাতো। কিন্তু আলি মানতো না। এই জন্যই মেস ছেড়ে চলে আসে আলি। আলি গিয়ে কলিং বেল বাজালো। একটা অপরিচিত মুখ যেন ভেসে আসলো আলির সামনে দরজা খোলার সাথে সাথে।

-কে, কাকে চাচ্ছেন? ভিতরের ছেলেটা বলল। -আলি বলল, এখানে মইনুল, শামিম, তুহিন, মিজান বলে অনেক গুলো ছেলে থাকতো না। তাঁরা কি আছেন? -ছেলেটা আলির মুখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বলল, আসেন ভিতরে আসেন। -আপনাকে অনেক ক্লান্ত লাগছে মনে হচ্ছে। দাঁড়ান আপনার জন্য পানি আনি।

বলে একগ্লাস পানি এনে আলির দিকে এগিয়ে দিলো। পানিটা খেয়ে নিন, তারপরে আপনার কথা শুনি। - আসলে আলি খুব ক্লান্ত ছিল, কারণ মনের মধ্যে মালিহার চিন্তা বুদ করে রেখেছে। আলি খুব অবাক হলো। ঢাকা শহর বাসির দেখছি সৌজন্যতা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

আলি কিছু না বলে পানিটা ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। -ছেলেটা বলল, ভাইয়া একটু বসেন, আমি আসছি। এই বলে সামান্য সময়ের জন্য ভিতরের দিকের রুমে গেলো। এবার আলি রুমের মধ্যে একটু পর্যবেক্ষণ করতেই প্রথমে ভাবল সে ভুল বাসাতে এসেছে। কারণ রুম গুলোর অনেক পরিবর্তন হয়েছে।

সবগুলো কেমন ছিমছাম। আলিরা যখন এখানে থাকতো সবসময় কেমন উৎসব উৎসব থাকতো। এখন যে নিরবতা সেই গুলো কে গ্রাস করেছে। তাঁর মনে এইটা বারবার আসলো হয়তো ভুল বাসাতে এসেছে। পরে ছেলেটা এসে আমাকে আশ্বস্ত করলো যে আমি ঠিক বাসাতেই এসেছি।

-ছেলেটি এসে বলল, ভাইয়া আসলে আমি এখানে থাকিনা। ভর্তি পরিক্ষা দেবার জন্য দুইদিন আগে এসেছি। এটা আমার খালার বাসা। তবে আপনার ইনফরম্যাশন অনুযায়ী এইটাই আপনার অনুসন্ধিৎসু বাসা। এইটা আমি হলফ করে বলতে পারি।

আমি বুঝলাম মইনুল ভাইয়েরা মেস ছেড়ে চলে গেছে এবং এখন এই ফ্ল্যাট টা ফ্যামিলি ফ্ল্যাট হয়ে গেছে। আমার মাথা ধরেছিল এবং কানের মধ্যে বুম ধরে আসছিলো। হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলাম মনে হলো। তারপরেও জিজ্ঞাসা করলাম, -তোমার খালারা কতদিন আগে এই বাসাতে উঠেছে কিছু জানো? -ছেলেটি বলল, ভাইয়া সামান্য অপেক্ষা করুন, খালামনি আসছে উনাকে জিজ্ঞাসা করলে হয়তো উনি আপনাকে অনেক ইনফরম্যাশন দিতে পারবে। আনটি টাইপের ভদ্র মহিলা টা এসে আমাকে বলল, আমরা তো প্রায় দুইবছর হয়ে গেলো এই ফ্ল্যাটে উঠেছি।

আগের ছেলে গুলো কোথায় আছে তাতো বলতে পারবো না। মহিলাটি সিলেটী বলে উনার অধিকাংশ ভাষায় আমার বোধগম্য হলো না। তবে এইটুকু বুঝতে পারলাম উনি বলল, আমরা এসে বাসা খালিই পেয়েছিলাম। কারণ আমরা সেই মাসের ৫ তারিখে উথেছিলাম তো তাই। -এবার ছেলেটি আমার সমস্যা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিল বোধই।

আপনি বরং বাড়িওয়ালার কাছে যান। উনি কোন তথ্য দিতে পারে কিনা দেখেন। -পরামর্শ টা খুব ভালো লাগলো আলির। আলি জানে বাড়িওয়ালা পাচতলাতে থাকতো। এবং উনার সাথে আলির একটা ভালো ভাব আছে।

নামাজ পড়তে যেতো একসাথে। ইফতারে আলি কে মইনুল কে দাওয়াত দিতো। সোজা পাঁচতলাতে গিয়ে কলিং বেল বাজালে বাড়িওয়ালাই খুলল এবং আলি কে একবারেই চিনে ফেলল। কিছুক্ষন কুশল বিনিময় করে উনি আগমন সম্পরকে জানতে চাইলো। -আলি তাঁর প্রয়োজনের কারণ টা বলল।

-বাড়িওয়ালা ওকে বস্তে বলে ভিতরে গেলো এবং একটা বড় নোটবুক এনে আলির সামনে রাখল। এই খানে সবার নাম ঠিকানা লিখে রাখেন। কবে উঠেছে, কবে গেছে সব ইনফরম্যাশন নোট করে রাখেন। মোবাইল নাম্বার সহ। এবং কেউ চলে গেলে সে কোথাও বর্তমানে আছে সেটাও মাঝে মাঝে কয়েকজনার লেখা আছে।

-নোটবুক থেকে আমাদের সাথে যারা মেসে ওই ফ্ল্যাটে থাকতাম সবার নাম ও মোবাইল নং আমি একটা কাগজে লিখে নিলাম। শেষে চাচা কে বিদায় জানিয়ে চলে আসলাম। নিজের ফ্ল্যাটে এসে একের পর এক নাম্বারে ফোন দিতে লাগলো আলি, কিন্তু একি সব নাম্বার গুলোই বন্ধ দেখাচ্ছে। রাগে ক্ষবে নিজের দামি হ্যান্ড সেট টা বেডের উপর জরে একটা আছাড় দিলো। তারপর খানিক ক্ষণ ব্যাল্কনিতে রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকলো চোখ বুজে।

চোখ ফেটে কান্না আসছিলো। কিছু বুঝতে পারছিলো না। একটা কথা মনে বারবার আঘাত করছিলো তাহলো মালিহা কে ঠিক একই ভাবে কাঁদিয়েছিল। এজন্যই আজকে কষ্টটা এত বেশি লাগছে। কিছুক্ষণ ভাবনার মাঝে ডুবে থেকে হটাত মনে পড়লো মইনুল ভাইয়ের কথা, ওহ মইনুল ভাই তো সাভার ইপিজেডে চাকরি করতো।

সেখানে গেলেই তো হয়! হয়তো মইনুল ভাইকে ওখানে পাওয়া যাবে। পরেরদিন সাভারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো শ্যামলি বৈশাখী বাসের কাউন্টার থেকে। বাস যখন আমিন বাজারের কাছে তখন পকেটে ফোনের ভাইব্রেশন টের পেলাম। মোবাইল টি নিয়ে দেখলাম স্ক্রিনে লেখা কাবেরি আপু। কাবেরি আপু হচ্ছে আলির বড় বোন মরিয়মের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু।

কাবেরির গ্রামের বাড়ি মেহেরপুর জেলাতেই। পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে এখন পুলিশ প্রশাসনে আছেন। বিসিএস পরিক্ষা দিয়ে প্রথমে সিভিল পুলিশ থেকে র্যাড়বের অপারেশন কমান্ডার হিসাবে দায়িত্বরত আছেন। ফোন রিসিভ করতেই প্রশ্ন, আলি তুই কোথায় আছিস? বাড়ি থেকে কাউকে না বলে নাকি ঢাকা চলে এসেছিস। তোরা ছেলেরা একটু বড় হলেই বাবা-মা এবং বড় ভাইবোনের আদেশ অমান্য করতে ব্যস্ত।

কেন না বলে এসেছিস? -এড়িয়ে গিয়ে বললাম, না মানে আমার একটু কাজ ছিল তো তাই। -মিথ্যা বলছিস কেন? আমি তোর অফিসে গিয়েছিলাম তোর খোঁজে তাঁরা বলল, তুই নাকি দুইমাসের ছুটি নিয়েছিস। ছুটি যদি নিলি তো বাসাতে না কাটিয়ে আবার ঢাকাতে ফিরে আসলি কেন? আর এখন আমাকে কাজ বুঝাচ্ছিস। কি কাজ তোর? -তুমি বুঝবে না। -আমি জানতাম তুই এমন কোথায় বলবি।

কি কাজ বল আমাকে। আমি জানতে চাই। শোন একটা কথা বলি আমি কোন না কোন ভাবে তোর এই কাজে উপকারে আস্তে পারি। কি বল। কাবেরি আপু জোর করতে লাগলো।

-তুমি আমার কি উপকার করবে। আমার কোন মানুষের উপকার দরকার নাই। তবুও বলি আমি একজনার খোঁজে যাচ্ছি। -কার খোঁজে, বউ খুজছিস নাকি বন্ধু? কাবেরি আপু একটু হেসে হেসে বলল। -মনে করো দুটোই।

তুমি হাসছ। তুমি নাকি আমার উপকারে আসবে। আমি জানি তো তোমার দৌড় কতখানি। আলি একটু রাগান্বিত ভাবে বলল। -আচ্ছা বল, কোথায় যাচ্ছিস? দেখি আমি তোর কোন ভাবে উপকার করতে পারি কিনা।

এবার কিছুটা আগ্রহ নিয়ে বলল কাবেরি আপু। -সাভার ইপিজেড। আলি বলল। -কেন? আবার প্রশ্ন করলো কাবেরি আপু। -একজনার খোঁজে।

মানে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মেসমেট। ওকে আমার খুব প্রয়োজন। -তুই একটা গাধা! -কেন? -তুই জানিস ইপিজেডের মধ্যে বাইরের লোক প্রবেশ করা নিষেধ। কোন মতেই প্রবেশ করতে দেবে না। কাবেরি আপা বলল।

-তাহলে কি হবে। আলি কিছুটা শঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করলো। -এবার কাবেরি আপু একটা সুযোগ নিয়ে বলল, একটা পথ অবশ্য আছে, তবে আমাকে পুরো কাহিনীটা শেয়ার করতে হবে। তাহলে আমি ব্যবস্থা করতে পারি। -এবার আলি কিছুক্ষণ ভেবে বলল, ঠিক আছে তুমি সাভারে আসো আমি থাকবো।

তোমাকে সব বলব। কিন্তু আমারও একটা শর্ত তুমি আপু কে বলতে পারবে না। প্রমিজ। -প্রমিজ। শোন আমি নবীনগর আছি।

তুই আয় আমিও চলে আসছি। কাবেরি বলল। তারপর কাবেরি আপু আসলে আমাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে বসলো। হ্যা এবার বল কারণ কি এতোসব ঘটনার? -আমি বলতে শুরু করলাম। না মানে বাসায় থেকে বিয়ের জন্য খুব চাপাচাপি করছে।

বাবা এবং আপু বলেছে আমার কোন পছন্দের কেউ থাকলেও নাকি মেনে নেবে। আসলে বর্তমানে আমার কেউ পছন্দের নেই তবে বছর পাঁচ ছয় আগে আমাকে ফাইরুজ মালিহা বলে একটা মেয়ে খুব পছন্দ করতো। আমার জন্য সে অনেক কিছু করেছে। আমাকে খুবই ভালোবাসতো। তোমাকে মাঝে বলেছিলাম না।

সেই মালিহা কে আমার খুব মনে পড়ছে। টাকে এই মুহূর্তে জানা আমার কর্তব্য। -কাবেরি আপু এতক্ষন চুপ করে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। আমার কথা শেষ হতেই বলে উঠলো, তুই কি মনে করিস ছয় বছর আগে তোকে ভালোবাসতো বলে এখনো তোর জন্য মোমবাতি জালিয়ে তোর পথ চেয়ে বসে আছে? -হ্যা হ্যা ঠিক এইটা জানার জন্যই তো তাঁকে আমার খুঁজে বের করতে হবে। তুমি আমাকে একটু হেল্প করো প্লিজ আপু।

আলি অনুনয় নিয়ে এই কথা গুলো বলল। -আমি দেখছি কী করা যায়? এখন এইটা তো বল সে কোথায় থাকে? আবারো প্রশ্ন করলো কাবেরি আপু। -ইয়ে মানে সেইটা আমি এখনো জানিনা। তবে এইটুকু জানি মালিহার গ্রামের বাড়ি বরিশালে। আলি বলে থামল।

-তুই আসলেই একটা বড় গাধা! জানিস না মানে কি? তাহলে তাঁকে খুঁজবি কি করে? কাবেরি বলল। -আলি এবার জড়তা ঝেড়ে ফেলে বলল, সেজন্যই তো এখানে আসা। -মানে কি? তাহলে সে কি গার্মেন্টসে কাজ করে? বলে কাবেরি হাস্তে লাগলো। -দেখ আপু প্লিজ ফান করো না। আমি কাল সারারাত ঘুমাতে পারিনি।

তাঁকে আমার খুজতেই হবে। সে গার্মেন্টসে কাজ করবে কেন? আলি বলল। আমি এখানে এসেছি মইনুল ভাইয়ের খোঁজে। -কিছুই বুঝতেছি না। একটু খোলাসা করে বল দেখি।

-মানে খুব সোজা, মালিহার টোটাল ঠিকানাটা আমার একটা ডায়েরিতে আছে। আলি বলে থামল। -কাবেরি আপু এবার উচ্ছাসিত হয়ে বলল, তাহলে তো হয়েই গেলো। চল সেই ঠিকানায় গিয়ে খোজ করি। -ইয়ে মানে সেই ডায়েরিটা তো এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই।

যখন আমি মইনুল ভাইয়ের কাছ থেকে চলে আসি তখন ভুলে ডায়েরিটা রেখে আসি। তখন ভেবেছিলাম ওইটা আমার প্রয়োজন হবে না। কারণ তখন আমি মালিহা কে দেখতে পারতাম না। ওই ডায়েরিটা মালিহা আমাকে আমার বার্থডে তে দিয়েছিলো। আসলে সেই সময় আমি মালিহা কে একেবারে দেখে সহ্য করতে পারতাম না।

সেইটা তো তুমি জানো। কারণ তোমাকে আমি মাঝে মাঝে এইগুলো বলতাম। এইজন্য তখন মালিহার দেওয়া ডায়েরিটা আমি মইনুল ভাইয়ের খাটের নিচে ছুরে ফেলেছিলাম। মইনুল ভাই আবার সেইটা খুব জত্ন করে রেখে দিয়েছিলো জানি। আমাকে অনেকবার দিতে গেলেও আমি নেয়নি।

যে ডায়েরিতে মালিহার নিজের লেখা ঠিকানা ছিল। -এবার কাবেরি আপু সত্যি সত্যি খুবই রেগে গেলো, তুই কি মনে করিস যে তোর সেই মইনুল ভাই এখনো যত্ন করে তোকে দেবার জন্য ডায়েরি টা রেখে দিয়েছে? তুই নিজেকে কি ভাবিস আল্লাহই ভালো জানে। -তুমি সবসময় নেগেটিভ চিন্তা করো কেন? আলি বলল, আমি অতকিছু জানিনা তবে মালিহা কে আমার খুঁজে বের করা লাগবেই। তুমি জাননা আপু ওর প্রতি ভালবাসা আমার প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে বাড়ছে। আপু প্লিজ তুমি শুধু ইপিজেডের ভিতরে ঢুকে মইনুল ভাইয়ের সম্পর্কে ইনফরম্যাশন নিতে সাহায্য করো।

-আচ্ছা ঠিক আছে ঠিক আছে। চল দেখি কি করা যায়। কাবেরি আপু বলল। ওখান থেকে সিএনজি করে সাভার ইপিজেডে গেলাম। প্রথমে ঢুকতে দিচ্ছিল না।

পরে আপু নিজের পরিচয় দেবার পর আর বাধা দিলো না। প্রথমে আমরা প্রবেশ করে জিএম স্যারের চেম্বারে গেলে উনি বসতে বলল। জানতে চাইলো কি ব্যাপারে এসেছি। -আসলে আমরা একজনার সম্পর্কে দেখা করতে এসেছি। বলতে পারেন ইনফরম্যাশন নিতে এসেছি।

আলি বলল। -জী বলুন, কার সম্পর্কে জানতে চান। উনি বললেন। -আমি আবার বললাম, মইনুল হোসেন বলে কি কেউ আপনার গার্মেন্টসে চাকরি করে? উনার সাথে দেখা করবো। -উনি এবার বলল, মইনুল বলে তো প্রায় শখানেক প্রার্থী আছে।

আপনি কাকে চাচ্ছেন? কিভাবে বুঝবো। কোন সেক্টরে কাজ করে সেটা কি জানা আছে? -আমি বললাম, জী বায়িং সেক্টরে। উনি অ্যাকাউন্ট স্যার কে ডেকে আমাদের সমস্যাটা বলল, এবং এটাও বলে দিলো যে উনারা প্রশাসনের লোক আপনি ভালো করে খুঁজে তাঁর সাথে ওদের দেখা করিয়ে দ্যান। -অ্যাকাউন্ট স্যার এবার খাতা বের করে অনেকক্ষণ খুঁজে খুঁজে বের করলো, হ্যা বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালী বাড়ি একজনার এই মইনুল আছে। এখানে অবশ্য উনার ছবি আছে দেখেন ছবিতে চিনতে পারেন কিনা? -এবার আমিও আমার ব্যাগে থাকা ডায়েরিটা নিয়ে মইনুলের একটা ছবি বের করে ওই ছবির সাথে মিলিয়ে দেখলাম ঠিক আছে কিনা।

-এবার কাবেরি আপু একটু দেখে বলল, হ্যা হ্যা মিলে গেছে। এই মইনুলই সেই মইনুল। -এবার উনি বললেন, কিন্তু ব্যাপার কি বলুন তো। আপনার প্রশাসনের লোক যেহেতু, তাহলে কি উনার কোন পুলিশি ঝামেলা হয়েছে? -আমি এবার বললাম, না না কোন সমস্যা নই। আসলে বিষয়টা আমার ব্যক্তিগত।

সরি আপনাদের অনেক কষ্ট দিলাম। -জিএম স্যার এবার বলল, না না ঠিক আছে। কোন ব্যাপার না। -এবার অ্যাকাউন্ট স্যার বলল, কিন্তু এবার একটা দুঃসংবাদ আছে! উনি তো ছয় মাস আগে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। -চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন! আমার মাথা ঘুরতে লাগলো।

এইটুকু বলে আমি যেন আর কিছু বলতে পারলাম না। -কাবেরি আপু আমার সমস্যা টা বুঝতে পারলো। আচ্ছা উনি এখন কোথায় কোন চাকরি কুরছেন কি না কিছু জানেন? -অ্যাকাউন্ট স্যার বলল, কোথায় কোন চাকরি করছেন কিনা তাতো কিছু জানান নি। তবে মাস খানেক আগে একবার আমার সাথে উনার দেখা হয়েছিলো। উনি জানিয়েছিলেন বিদেশে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

উনার নাকি ডিভি তে লটারি লাগছে। পরে আর কিছু জানান নি। -আপু বলল, আচ্ছা এখানে উনার পুরো ঠিকানা লেখা আছে না? এইটা আমাদের দেন। -হ্যা হ্যা আছে তো। উনার ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপিও আছে।

যেখানে স্পষ্ট লেখা আছে মইনুলের ঠিকানা লেখা আছে। উনি ওখান থেকে পেজটা ফটোকপি করে দিলো। কাবেরি আপুর মুখের দিকে তাকালাম। পুরো ঘেমে গেছে। বুঝলাম আমার সমস্যা টাকে আমলে নিয়েছে।

তবে আপুর এনার্জি লেবেল খুব লো। -আপু অনেক থ্যাংকস তোমাকে। তুমি না থাকলে এই ঠিকানাও পেতাম না। আমি বললাম। -দেখ আলি, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এতোগুলো বাধা অতিক্রম করে মালিহা কে কি খুঁজে পাবি? আপু বলল।

-তুমি চিন্তা করো না। আমি সব বাধা ঠিকই পার করে মালিহার কাছে পোঁছাবো। আমার সব কিছু ম্যানেজ করায় লাগবে। আপু কে বিদায় জানিয়ে বাসাতে ফিরে আসলাম। রাতে ঘুমানোর সময় ভাবলাম, আগামি কালই পটুয়াখালীর উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।

হটাতই মইনুল ভাইয়ের ডিভি লটারির কথা মনে পড়লো। কোন একটা আশাংকার জন্য আর থাকতে পারলাম না। তখনি ব্যাগ এবং কিছু টাকা নিয়ে সদরঘাটের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। সদরঘাটে এসে একটা ভিআইপি কামরা ভাড়া করলাম। কারণ গত কয়েকদিন ধরে ঘুমানো হয়নি।

লঞ্চের মধ্যে অন্তত যেন একটু আরাম করে ঘুমানো যায়। তাহলে ক্লান্তিটা একটু দূর হবে। রাত ৯:১৫ তে লঞ্চ ছেড়ে যাবে বরিশালের উদ্দেশ্যে। পটুয়াখালী পোছাতে ভোর ৪:০০ নাগাত বাজবে। নিজের কামরাতে বসে ছিলাম।

ব্যাগে ল্যাপটপ, মোবাইল, আর কিছু টাকা ছিল। ল্যাপটপ টা বের করে কিছুক্ষণ টেপাটেপি করলাম। কিন্তু ভালো লাগছিলো না। মনের মধ্যে অজানা শংকা এসে ভোর করতেছিল। বুকটা মাঝে মাঝেই ধকধক করে উঠছিল।

ল্যাপটপ টা বন্ধ করে ব্যাগে ভরে রাখলাম। মনের মধ্যে এবার ভোর করলো মালিহার সাথে অতীতের সৃতি গুলো। মেয়েটা কত দুষ্টু এবং চঞ্চল প্রকৃতির ছিল। কত গভীর ভাবে আমাকে ভালোবাসতো। কত সুন্দর সুন্দর কথা বলতো কত স্বপ্ন দেখাতো।

কত উষ্ণ আলিঙ্গন এবং চুম্বনে ভরিয়ে দিতো আমাকে। আমার কোন বাধায় সে মানতে চাইতো না। ওর নাম নিয়ে আমার সাথে বন্ধুরা কত মজা করতো। হায়রে সেদিন গুলো তে আমি মালিহার এতো গভীর ভালবাসার কোন দামই দেইনি। বন্ধুদের মজা করাটাকে আমার সম্মান হানি ভেবে মালিহা কে কত কথাই না শুনিয়েছি।

কত ভাবে যে গালাগালি করেছি। আজ শুধু সেইদিন গুলির কথা মনে পড়ছে,। ফিরে পেতে ইচ্ছে করছে সেই চঞ্চলা মেয়েটিকে আমার জীবনে। সেদিনের উষ্ণ আলিঙ্গন কে আজ কতনা অনুভব করতেছি। মনে পরে সপ্তাহের প্রতি বৃহস্পতি ও শুক্রবার সে জার্নি করতো আমার জন্য।

প্রতি শুক্রবার সারাদিন আমার সাথে কাটানোর জন্য সেই বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্রি হোস্টেল থেকে ছুতে আসতো ঢাকাতে। সারাদিন আমার সাথে ঘুরত জোর করে আমাকে নিয়ে যেতো ঢাকার বিভিন্ন জায়গাতে। আমাকে কত রকম খাবার খাওয়াতো। খুব মনে পড়ছে মালিহার সাথে আমার আকস্মিক পরিচয় এবং বন্ধুত্বের কথা। প্রথম দিন কার কথা।

আমি তখন ঢাকা সিটি কলেজে ইন্টার মিদিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হওয়ায় অনেক রাত জেগে পড়াশোনা করতে হত। এইটা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। শোভন, রাশেদ আর আমি একই গ্রামের হওয়ায় হোস্টেল সুপার আমাদের তিনজন কে একই রুমে থাকার ব্যবস্থা করেছিল। সেই সময় আমার ক্লাস মেট শোভন আমাদের গ্রামের অনেক মেয়ে, ঊর্মি, মিতা, রুমি, রিতা, তৃষ্ণা এই ধরনের অনেক মেয়ের সাথেই ফোনে কথা বলতো।

আমি কারো সাথে তেমন কোন কথা বলতাম না। -হটাত একদিন একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে আমার ফোনে ফোন আসলো। প্রথমে অপরিচিত নাম্বার দেখে রিসিভ করলাম না। পরে আরও পরপর দুবার ফোন দিলো। তৃতীয় বারের বেলায় আমি রিসিভ করতেই, ওপাশ থেকে সুমিষ্ট কণ্ঠে একটা মেয়ে বলে উঠলো, জুবায়ের তুই কি টেস্ট পেপার কিনে ফেলেছিস? -আমি কিছুই বলতে পারছিলাম না।

আরও কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বুঝলাম মেয়েটা ভুল করে ফোন দিয়েছে। এইজন্য আমি কিছু না বলেই কেটে দিলাম। -আবার ফোন দিয়ে বলল, কিরে মোর কথা কি তোর কানে ঢোহে না। টেস্ট পেপার ক্যানছো? বরিশালের ভাষাতে আরও কিছু বলল, যার বেশির ভাগ আমি বুঝতে পারলাম না। প্রথমে ঢাকা তে এসেছি অনেক ভাষায় আমি বুঝিনি।

-তাই শুধু বললাম, টেস্ট পেপার! কিসের টেস্ট পেপার? আমিতো কিছুই বুঝতেছি না। -আবারো সেই বরিশালের ভাষায় বলল, ফাজলামো হরো, মোর লগে মশকরা হরো। মোর লগে মশকরা হরলে কিন্তু ভালা অইবো না কয়ে দিলাম। -এবার তো আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, বরং কিছুটা ভড়কে গেলাম। শোনেন আমি আপনার এই সব হিন্দি কথার আগামাথা কিছুই বুঝলাম না।

দয়া করে শুদ্ধ বাংলায় বললে খুশি হতাম। -কিরে খুব বেশি শুদ্ধ বলা শিখেছিস মনে হচ্ছে? মেয়েটা বলল। -এবার আর আমি কথা বাড়াতে চাইলাম না। শোনেন আপনি মনে হয় ভুল করতেছেন। আমি জুবায়ের না।

আমি আলি রহমান। আপনি জানেন আমি ঢাকা থেকে বলছি? -মেয়েটা এবার হতভম্ব হয়ে গেলো, ওহঃ তাহলে সরি। কিছু মনে করেন না। আসলে আমি... -আমি টাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, জী জী বুঝতে পেরেছি। আপনি ভুল করে কল দিয়েছেন।

ঠিক আছে নাম্বার টা চেক করে আবার ফোন দ্যান। আরও কিছু কথা বলে আমিই কেটে দিলাম। পরের দিন আবার সেই নাম্বার থেকে ফোন আসলো। এবার সে একটু ভুমিকা নিয়েই শুরু করলো, এভাবে বলতে লাগলো যে, আমি ফাইরুজ মালিহা চৌধুরী। বরিশাল রয়েল কলেজ থেকে এবার বানিজ্য বিভাগ থেকে এইচএসসি পরিক্ষা দেবো।

গত দিন আসলে আমি জুবায়ের কে টেস্ট পেপার কিনতে দিয়ে ছিলাম, সেই টা আনার জন্য ফোন দিতে গিয়ে আপনার কাছে চলে গেছিলো। কিছু মনে করেন না। -আমি বললাম, আপনি এবার এইচএসসি পরিক্ষা দিবেন? আবারো প্রশ্ন টা করে ফেললাম বোকার মত। -হ্যা তাই। -তাহলে তো আপনি আমার দুই বছরের সিনিয়র।

আমি নিউ ফার্স্ট ইয়ার। -সমস্যা নাই। বন্ধুদের মাঝে আবার ছোট বড় আছে নাকি? আমি কি তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে পারি? ওর কথার স্বরটা ছিল খুব মিষ্টি। আর বলার স্টাইল টা ছিল আরও মহনীয়। সারাক্ষণ শুনতে ইচ্ছে করতো।

তাছাড়া সেই মুহূর্তে আমার কোন মেয়ে বন্ধু ছিল না। আমার রুম মেট রা সারাদিন তাদের মোবাইল ফ্রেন্ড দের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলল। যা আমার মাঝেও ইচ্ছে হতো, ইশ আমারও যদি অমন একটা বন্ধু থাকতো? আমিও তাঁর সাথে আমার হাসি-কান্না এবং সুখ-দুঃখ কে শেয়ার করতে পারতাম। আজকে সেই সুযোগ আমাকে হাত ছানি দিচ্ছে দেখে আমি না করলাম না। আমি এক কথাই রাজি হলাম।

তারপর থেকেই শুরু হলো তাঁর সাথে আমার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলা। জীবনের এমন কোন বিষয় ছিল না যে সে আমার কাছ থেকে শুনে নি। আমার পরিবার, গ্রাম, ভাইবোন, আমার ভাললাগা, আমার পছন্দের বিষয় সব গুলো সে শুনেছে। তাঁর জীবনেরও প্রত্যেক টা খুঁটিনাটি বিষয় সে আমার কাছে বলতো। সারাক্ষণ কল দিয়ে শুরু হতো তাঁর মুখে কথার ফুল ঝুরি।

শেষই হতে চাইতো না তাঁর কথা গুলো। মালিহাই বেশি কথা বলতো। আমি কথা বলতে কিছুটা ইতস্ত বোধ করতাম। আমি তেমন ভাবে প্রসঙ্গ টেনে এনে কথা বলতে পারতাম না। এই জন্য মালিহা আমার রুম মেট দের কাছে আমার নামে কমপ্লেন দিতো কেন কথা বলি না ভালো করে।

আমার বন্ধুরা বলতো, আলি আসলে এই ধরনের। বেশি কথা বলে না। তাছাড়া ও আগে কোন মেয়েদের সাথে কথা বলেনি তো তাই। তুমি একটু শিখাইয়া নিও। এর মাঝেই মালিহার পরিক্ষা শুরু হয়ে গেলো।

তখন ও একটু কম কম কথা বলতো। আমি নিজে থেকেই বলেছিলাম ভালো করে পরিক্ষা দেন আগে। কথা পরেও বলা যাবে। আমার সাথে কথা বলাতে আপনার যেন পরীক্ষার কোন ক্ষতি না হয়। তাহলে কিন্তু আমি ভীষণ রাগ করবো।

-মালিহা মাঝে মাঝেই বলতো আমি যেন তাঁকে তুমি করে বলি। -আমি তাঁকে শর্ত দিয়ে ছিলাম যদি আপনি আপনার এইচএসসি পরীক্ষাতে A+ করতে পারেন তাহলে আমি আপনার কথা মত আপনাকে তুমি করে বলবো। -প্রমিজ করো। আমাকে তুমি করে বলবে? মালিহা বলল। আমি প্রমিজ করেছিলাম।

ওর পরীক্ষা চলা সময় টাতে আমি নিজে থেকেই কথা কমিয়ে দিলাম। বেশি বেশি কল দিলে আমি কথা সংক্ষেপ করতাম। এভাবে এক দিন দুইদিন করে সপ্তাহ পার হয়ে মাস পেরিয়ে যাচ্ছিলো। ওর পরীক্ষার আপডেট আমাকে জানাতো। এতো কিছু ভাবনার মাঝে আমি ডুবে ছিলাম।

হটাত আমার কামরাতে খটখট করে আওয়াজ হতে লাগলো। আমি বুঝলাম কেউ আমার কামরার কাছে কড়া নাড়ছে। ভাবলাম হয়তো, কন্ট্রাক্টর টিকিত চেক করতে এসেছে। এই বলে দরজা খুললাম। -দরজা খুলতেই আনুমানিক চল্লিশ বছর বয়স্ক এক মহিলা আমাকে কি যেন একটা বিষয়ে অনুরধ করতে লাগলো আমি বুঝতে না পেরে উনাকে ভিতরে আস্তে বললাম।

-মহিলার সাথে আরও দুইটা ছেলে মেয়ে ছিল তারাও আসলো। ভিতরে আসার সাথে সাথেই আমার কাছে হাতজোড় করে বলতে লাগলেন, বাবা তুমি একমাত্র আমায় উপকার করতে পারো। -আপনার সমস্যা কি আমাকে খুলে বলেন আমি অবশ্যই আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করবো। আমি ভেবেছিলাম কিছু টাকা পয়সা হয়তো চাইবে। -না মানে আমার বাচ্চা টা একটু অসুস্থ তো তাই।

যদি আপনার কামরাতে ওকে একটু রাখতে দিতেন তাহলে ওর অসুবিধা হতো না। ওর কিছুদিন আগেই অপারেশন কড়া হয়েছে তো তাই। তাছাড়া আজকেই আমাদের বরিশাল যেতে হবে, সব গুলো সিট বুক হয়ে গেছে। যদি আপনি একটু দয়া করেন তাহলে আমাদের জন্য খুব উপকার হতো। -আমি এবার বাচ্চাটার দিকে একবার তাকালাম।

কিছুটা পীড়িত মনে হল। ঠিক আছে সমস্যা নায় আমার কামরাতে তো দুইটা খাট আছে আপনারা একটাতে আসেন আমার কোন সমস্যা নায়। -এবার দেখালাম উনারা ওই খাট টাতে এসে বসলো এবং ছেলেটিকে শুইয়ে দিলো। আমি আবার মালিহার সাথে আমার অতীত জীবনে ফিরে গেলাম। পরীক্ষার মাঝে আমাদের কথা গুলো তাঁর পরীক্ষা কেদ্রিক ছিল।

কেমন হল এই পরীক্ষা টা কেমন হয়েছে ওই পরীক্ষা টা ইত্যাদি ইত্যাদি। যেদিন টায় মালিহার পরীক্ষার শেষ হল সেদিন আমার সাথে মালিহা একটানা সাড়ে চার ঘণ্টা কথা বলেছিল। -।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.