আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য

নির্বাচন-বিবাদ চিরতরে শেষ করার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের দেশের জন্য এটা এখন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাঁচ বছর পর পর, নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলেই শুরু হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা, নির্বাচন বর্জনের হুমকি, হরতাল, ককটেল, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি। সহিংসতা যেন নিয়ম হয়ে উঠেছে। রাজনীতির এই অভিশপ্ত অধ্যায় আর কত দিন চলবে? তারপর আছে নির্বাচনে পরাজিত পক্ষের সংসদ বর্জনের ধারা।


এই সবকিছুর জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরস্পরের প্রতি অসহিষ্ণুতা ও অনাস্থা অনেকাংশে দায়ী। দেশের প্রধান এই দুটি দল ‘মাইনাস টু’-এর ঘোর বিরোধী, কিন্তু ‘মাইনাস ওয়ান’-এ প্রবল আগ্রহী। ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার পেছনে এই ‘মাইনাস ওয়ান’ ফর্মুলা কাজ করে থাকতে পারে। আবার পাঁচ বছর ধরে রাজনীতিতে বিএনপিকে মাইনাসের খাতায় ফেলে রাখার অবিরাম চেষ্টা বেশ লক্ষণীয়।
এত কিছুর পরও এটা অস্বীকার করা যায় না যে এই দুই দলের রাজনৈতিক প্রজ্ঞাই সব সংকটের অবসান ঘটাতে পারে।

অতীতে বেশ কয়েকবার এ রকম হয়েছে। সর্বনাশের শেষ প্রান্ত থেকে দেশকে ফিরিয়ে এনেছে এই দুই দলের সমঝোতা ও ঐকমত্য।
যেমন আমরা পঁচাত্তর-পরবর্তী ভয়ংকর দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে পারি। একসময় মনে হয়েছিল, সামরিক শাসনের জগদ্দল পাথর বোধ হয় আর সরানো যাবে না। কিন্তু সামরিক শাসনের মধ্যেও ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল।

বিএনপি ২০৭ ও আওয়ামী লীগ ৩৯ আসন পেয়েছিল। একধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া জেনারেল জিয়ার সামরিক সরকারের অধীনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনে যাওয়ার কোনো কারণ ছিল না। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনও হয়েছিল এরশাদের সামরিক শাসনের মধ্যে। আওয়ামী লীগ নির্বাচন করলেও বিএনপি করেনি। কিন্তু সেই নির্বাচন নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পথ খুলে দিয়েছিল।


১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে। প্রশ্ন ওঠে, রাষ্ট্রপতিপদ্ধতির সরকার পরিবর্তন করে সংসদীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হবে কি না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকারীদের বিচারের আইনগত বাধা (ইনডেমনিটি) বাতিল করা হবে কি না। অনেক দর-কষাকষির পর সংসদে দুই দলের সম্মতিতে সেই হত্যাকাণ্ডের বিচারের আইনগত সুযোগ সংসদে অনুমোদন করা হয়। একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনী পাস হয়।

দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র আবার ফিরে আসে। এটা ছিল দুই দলের আরেকটি ঐতিহাসিক সমঝোতা।
১৯৯৬ সালে প্রবর্তিত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। এর আগে ১৯৯১ সালের নির্বাচনও ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। পর পর তিন মেয়াদে এই ব্যবস্থা বেশ কাজে দেয়।

অন্তত নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে মতবিরোধ বা সংঘাতের অবসান হয়। সবাই ধরে নিয়েছিল, রাজনৈতিক গোলযোগের একটা উপলক্ষ অন্তত দূর হলো। কিন্তু ২০০৭ সালে দেখা গেল, তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা নিয়েও নানা সমস্যা।
এখন তো মাথাব্যথার জন্য মাথা কাটা হয়েছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাই বাতিল! ফলে নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে আবার সংঘাত শুরু হয়েছে।
এখন দুই দলের অন্তত তিনটি অভিন্ন সিদ্ধান্তে আসতে হবে।

প্রথমত, নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা। এটা নির্দলীয় হবে, নাকি সর্বদলীয় সরকার হবে, নাকি যেমন বর্তমান সংবিধানে আছে ঠিক সে রকমই হবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিএনপি নির্দলীয় ছাড়া মানবে না। আওয়ামী লীগ নির্বাচিত ছাড়া মানবে না। এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয় করে কোনো সিদ্ধান্তে আসতে না পারলে সামনে ঘোর দুর্দিন।

সেটা হবে খুব দুঃখজনক। যে দেশ এত দিন এত সংকটের সমাধান করে এগিয়ে গেছে, সে এখানে এসে আটকে যাবে, তা হতে পারে না। এমন একটা সমাধান বের করতে হবে, যেন শুধু এবারের জন্যই নয়, ভবিষ্যতেও নির্বাচন নিয়ে যেন আর কোনো বিবাদে জড়িয়ে পড়তে না হয়।
সোজা কথা, আমরা চাই, প্রতি পাঁচ বছর পর একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন হবে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি চার বছর পর নভেম্বরের প্রথম সোমবারের পরবর্তী মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

এর কোনো নড়চড় নেই। বাংলাদেশেও সে রকম একটা ফর্মুলা বের করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের পর বিরোধী দল নির্বিচারে সংসদ বর্জন করবে না। কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ হিসেবে ওয়াকআউট এক জিনিস, আর লাগাতার বর্জন সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হিসেবে ওয়াকআউট চলতে পারে, কিন্তু একটানা বর্জন গ্রহণযোগ্য নয়।


তৃতীয়ত, দুই দল অন্তত আগামী ১৫ বছরের জন্য ঘন ঘন হরতাল ও সহিংস রাজনীতি থেকে বিরত থাকবে। মাঠে বা মিলনায়তনের ভেতর সভা-সমাবেশ করুক, কালেভদ্রে রাস্তায় মিছিল করলেও আপত্তি নেই। কিন্তু মানুষ যেন বলতে পারে, এবার দেশে শান্তি এল!
এখন প্রশ্ন হলো, যেখানে ফোন করা নিয়েই এত কাণ্ড, সেখানে এত বড় তিনটি সিদ্ধান্ত কে কীভাবে নেবে?
উত্তর জানা নেই। কিন্তু আমাদের একান্ত চাহিদাটা আমরা কেন স্পষ্ট করে বলব না?
আরেকটি প্রশ্ন হলো, শুধু দুই দল কেন, অন্যান্য দলের ঐকমত্য দরকার নেই? নিশ্চয়ই আছে। তবে দুই প্রধান দল এসব বিষয়ে এক হতে পারলে অন্য দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে।

তা ছাড়া দুই দলের সঙ্গে তো ৩০টি দল জোট বেঁধেই আছে। তাই সমস্যা কম।
সবার আগে দরকার সব দলের অংশগ্রহণে বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। এটা নিশ্চিত করা গেলে অন্য সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে কমে আসবে। ভারত যে এত বড় গণতন্ত্রের দেশ, সেখানে কি বন্ধ্ (হরতাল) কম হয়? গত ৩ অক্টোবর ভারতের মন্ত্রিপরিষদ তেলেঙ্গানার জনগণের আলাদা রাজ্য গঠনের দাবি মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে মধ্যপ্রদেশে মহাগোলযোগ শুরু হয়।

বিদ্যুৎ খাতের ৩০ হাজার শ্রমিক সবকিছু বন্ধ করে দেয়। ব্যাংক, এমনকি পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। তেলেঙ্গানায় ক্ষমতাসীন কংগ্রেসের ভোট বেশি। তাই ও রকম সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকতে পারে। ফলে পুরো দক্ষিণ ভারতে বিদ্যুৎ গ্রিড বিকল হয়ে পড়ার হুমকি সৃষ্টি হয়।

কিন্তু তাই বলে ভারতে আগামী বছর মে মাসে নির্বাচন হবে কি হবে না, এ প্রশ্ন তো কেউ তুলছে না। সেখানে জনগণের দাবিতে আন্দোলন হয়, নির্বাচন বর্জনের জন্য নয়।
ইন্দোনেশিয়ায় বেশুমার দুর্নীতি হয়। কিন্তু তাদের দুর্নীতি দমন কমিশন, কেপিকে, এত শক্ত যে কেউ পার পায় না। এই নখদন্তসজ্জিত কেপিকে গত ২ অক্টোবর ইন্দোনেশিয়ার সাংবিধানিক আদালতের প্রধান বিচারপতি আকিল মোখতারকে দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার করে।

তাঁর কাছ থেকে নগদ দুই লাখ ৬০ হাজার ডলার আটক করা হয়। তাঁর সঙ্গে আরও পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গুরুতর অভিযোগের তদন্ত চলছে। এই মামলায় সন্দেহ করা হচ্ছে যে পশ্চিম জাভার ব্যান্টেন প্রদেশের একটি জেলার নির্বাচনী ফলাফল উল্টে দেওয়ার জন্য স্থানীয় রাজনীতিকেরা প্রধান বিচারপতিকে ঘুষ দিয়েছিলেন। এসব ঘটনায় সেখানে তোলপাড় চলছে (দেখুন, দি ইকোনমিস্ট, ১২ অক্টোবর, ২০১৩, পৃষ্ঠা ৩২)।

ইন্দোনেশিয়ায় ঘুষ আর গণতন্ত্র একসঙ্গে চলছে, আবার ঘুষের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক বিধিব্যবস্থাও খুব জোরদার। আর আমাদের দেশে ঘুষটা বেশি চলে, গণতন্ত্র আর দুর্নীতি দমন কমিশন চলে কম। না হলে হল-মার্ক কেলেঙ্কারি ধরা পড়ার পরও কেন ফাইল চাপা পড়ে যাচ্ছে। পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংক কেন সরে গেল?
তাই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রথম কাজ হওয়া উচিত নির্বাচন নিয়ে হট্টগোল সৃষ্টির পথ বন্ধ করার জন্য প্রতি পাঁচ বছর অন্তর নির্বাচনের একটি পূর্বনির্ধারিত তারিখ ঠিক করে দেওয়া। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন যেন হয়, সে ব্যবস্থা করা।

সরকারের ওপর রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের উদ্দেশ্যে লাগাতার সংসদ বর্জন বন্ধ করা। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা, পরস্পরের প্রতি আস্থার সংকট কাটিয়ে ওঠা। এই তিনটি কাজ করতে পারলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। দু-চারটা হরতাল হলেও, ৬০ থেকে ৭০ ঘণ্টার হরতালের দিন শেষ হয়ে যাবে। কারণ, মানুষই সেটা সহ্য করবে না।


আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com

সোর্স: http://www.prothom-alo.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.