গনজাগরনের মাধ্যেমে পরিবর্তন সম্ভব....মানুষের চিন্তার পরিবর্তন করাটা জরুরি ....বুদ্ধিবৃত্তিক পুনরজাগরনে বিশ্বাসী কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধ বসতি ও মন্দিরে হামলার ঘটনার এক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও আতঙ্ক কাটেনি সেখানকার বৌদ্ধপল্লীতে। অনেকে এখনও নিজের বাড়িতে থাকার সাহস পাচ্ছেন না। খাঁখাঁ করছে মন্দিরগুলো। পূজো দিতেও আসার সাহস পাচ্ছেন না তারা। প্রবারণা পূর্ণিমার মহোত্সবের দিনও মন্দিরে আসার সাহস পাননি বৌদ্ধ ও রাখাইনরা।
ওড়েনি ফানুস। ভাসানো হয়নি নদীতে নৌকা।
সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, এখানকার বৌদ্ধরা এখনও স্বাভাবিক জীবনযাপন শুরু করতে পারেননি। অজানা ভয় তাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। সরকারের আশ্বাসের পরও কেন এত ভয়—এ প্রশ্নের জবাব জানতে বৌদ্ধ ও রাখাইনদের অনেকের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের।
বেশিরভাগই কোনো জবাব না দিয়ে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান। আবার অনেকে সাহস করে জানিয়েছেন তাদের ভয়ের কারণ। তারা বললেন, প্রশাসন ও সরকারের ওপর তারা ভরসা রাখতে পারছেন না। কারণ ২৯ সেপ্টেম্বর বৌদ্ধমন্দিরে সহিংসতার সময় তারা প্রশাসনের কাছে বার বার সহযোগিতা চেয়েও পাননি। শুধু তাই-ই নয়, ওইদিন বৌদ্ধ বসতি ও মন্দিরে হামলার ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছিল সরকারি দলের লোকেরাই।
তারা জানান, স্থানীয় মণ্ডলপাড়ার ছেলেরাই মন্দিরে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং লুটপাট করে। আর এ মণ্ডলপাড়াতেই বাড়ি আওয়ামী লীগ নেতা ও উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজল এবং মহাজোট থেকে গতবারের সংসদ সদস্য প্রার্থী সাইমুম সরওয়ার কমলের। পুরো ফতেখাঁরকুল ইউনিয়ন (আক্রান্ত বৌদ্ধ বসতিগুলো এ ইউনিয়নে) নিয়ন্ত্রণ করেন এ দুই ভাই।
বৌদ্ধ ও রাখাইন সম্প্রদায়ের দাবি—ঘটনার দিন আওয়ামী লীগের এ দুই নেতা তাদের পাশে এসে দাঁড়ালে মন্দির ও বৌদ্ধদের বাড়িগুলো রক্ষা পেত। তারা এও জানালেন, এ দুই ভাইয়ের এলাকায় এত বেশি প্রভাব রয়েছে যে, তাদের নিষেধ উপেক্ষা করার মতো দুঃসাহস ওই এলাকায় কারও নেই।
বাইরের লোকজন গাড়িতে এসে মন্দিরে আগুন দিয়েছে—এমন অভিযোগের জবাবে তারা বলেন, বাইরের অনেক লোক এসেছে এটা ঠিক। কিন্তু তারা এসেছে মণ্ডলপাড়ার ছেলেরা প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল শুরু করার পর। তাছাড়া এলাকার লোক না থাকলে বাইরের লোকের সাহস হবে না এখানে এসে মন্দিরে আগুন এবং লুটপাট চালানোর।
যারা এ লুটপাট ও মন্দিরে আগুন দিয়েছে, তাদের চেনেন কিনা জানতে চাইলে তারা বলেন, কারা এ কাজ করেছে, তা এখানকার লোকজনের মুখে মুখে। এখানকার লোকজন তো তাদের দেখেছে।
পত্রিকায় তাদের ছবি ও নাম ছাপা হয়েছে। কিন্তু তাদের তো পুলিশ গ্রেফতার করছে না! এরপর স্থানীয় বৌদ্ধরা এ প্রতিবেদকের হাতে বেশ কয়েকটি আলোকচিত্র তুলে দেন। ওই ছবির একটিতে দেখা যায়, শ্রীকুলের সাদা চিং বৌদ্ধমন্দিরে হানা দিয়ে বুদ্ধের মূর্তি ভাঙছে বাংলাবাজার দক্ষিণ নয়াপাড়ার মৃত মুছা খলিলের ছেলে স্থানীয় যুবলীগ নেতা সালামত উল্লাহ ও পশ্চিম মুক্তারকুলের মৃত জাফর আলমের ছেলে ছাত্রলীগ নেতা মো. মোর্শেদসহ আরও ক’জন। আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, মণ্ডলপাড়ার ছাত্রলীগ নেতা জাহেদুল ইসলাম জাহেদ একই পাড়ার ছেলে রামু কলেজ ছাত্রলীগ নেতা কাইছার হামিদ ও ছাত্রলীগ নেতা রিদুয়ান আহমেদের নেতৃত্বে মন্দিরে ব্যাপক লুটপাট চালানো হচ্ছে।
এ আলোকচিত্রগুলো প্রশাসনকে দিয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তারা বলেন, এতে কী লাভ হবে।
প্রশাসন তো জানে কারা এ কাজ করেছে। এ ঘটনার অন্যতম হোতা এখন পুলিশের সঙ্গে থাকে। তাছাড়া শিয়ালের হাতে মুরগি পাহারার দায়িত্ব দিতে চাই না আমরা।
৩০ অক্টোবর প্রবারণা পূর্ণিমার দিন সন্ধ্যায় সরেজমিন পরিদর্শনে দেখা যায়, উ-মংরি বৌদ্ধবিহার (লাল চিং মন্দির) ও সাদা চিং মন্দির পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখানে এবার প্রবারণা পূর্ণিমা হয়নি।
পুড়ে যাওয়া মন্দিরে অল্পসংখ্যক পূজারি এসে ফুল, মোমবাতি আর আগরবাতি জ্বালিয়ে পূজো দিয়ে চলে যাচ্ছেন। অথচ প্রতিবছর এখানে প্রবারণা পূর্ণিমার দিন মহোত্সব হতো। হাজার হাজার লোক জড়ো হতো। ফানুস ওড়ানো হতো। ছোটরা ফাটাত আতশবাজি।
রাতভর চলত গান-বাজনা। বসতো মেলা।
মন্দিরে পূজো দিতে আসা দিপ্য বড়ুয়া এ প্রতিবেদককে জানান, বৌদ্ধদের মধ্যে এখনও আতঙ্ক কাটেনি। তাই তারা মন্দিরে আসার সাহস পাচ্ছেন না। তাছাড়া পূজো দেয়ার মতো তাদের মানসিক অবস্থাও নেই।
তিনি জানান, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের প্রবারণা পূর্ণিমায় ফানুস ওড়ানোর জন্য অনুরোধও করা হয়েছিল; কিন্তু সে অনুরোধ রক্ষা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ভাইয়েরা অন্নহীন, বস্ত্রহীন, বসতহীন। তাদের ছাড়া তো আমরা উত্সব করতে পারি না।
মন্দির চত্বরে গিয়ে দেখা যায় মুর মন্দির পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কাঠের পিলারগুলো পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে।
শুধু মন্দিরই পোড়েনি, আগুনের লেলিহান শিখায় চারপাশের নারিকেল-সুপারি গাছগুলোও মরে গেছে। পুড়ে যাওয়া কিছু গাছ এরই মধ্যে মন্দির কমিটি কেটে ফেলেছে। এখন মন্দিরের সামনে বিশাল ব্যানারে লেখা রয়েছে—‘শুধু গৌতম বুদ্ধই নন, পুড়েছে মানবতা, পুড়েছি আমরা’।
লাল চিং মন্দিরে গিয়েও দেখা গেল একই চিত্র। মন্দির পাহারা দিচ্ছে পুলিশ।
পোড়া মন্দিরের বাইরে বসে আছেন অনুব্রত বড়ুয়া ও সুশীল বড়ুয়া। মন্দিরের কাছেই তাদের বাড়ি। তারা জানান, বড়ুয়ার ছেলে কোরআন শরিফের ওপর দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছে—এমন প্রচারণা সন্ধ্যা থেকেই চলছিল। এ নিয়ে মণ্ডলপাড়ার যুবকদের বেশ সক্রিয় দেখা যায়। আগে থেকেই আঁচ করা যাচ্ছিল যে, একটা গণ্ডগোল হতে পারে।
বিষয়টি স্থানীয় উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজলকে জানানো হয়। উত্তেজনা বেড়ে গেলে বিষয়টি প্রশাসনকেও জানানো হয়। কিন্তু প্রশাসন কোনো সহযোগিতা করেনি। উপজেলা চেয়ারম্যানের ভূমিকা কি ছিল—এমন প্রশ্নের জবাবে তারা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, তিনি সমাবেশ করে যুবকদের মন্দিরে হামলা না করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলেগুলো কোনো কথাই শোনেনি।
স্থানীয় সংসদ সদস্যের ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্দিরের সামনে সমবেত পূজারিরা জানান, তিনি এসে বিক্ষুব্ধ যুবকদের থামানোর চেষ্টা করেন। এসময় তারা এমপির কোনো কথা শুনবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন। সংসদ সদস্যের বক্তব্যের এক পর্যায়ে যুবকরা হৈচৈ শুরু করে দেয় এবং তাকে লক্ষ্য করে জুতা ছুঁড়তে থাকে। পরে এমপি সাহেব তার গাড়িতে করে চলে যান। রাত ১১টার দিকে এ মন্দিরে হামলা চালানো হয় বলে স্থানীয়রা জানান।
উসাই-ছেন রাখাইন বড় ক্যাং মন্দিরে গিয়ে দেখা যায় এ মন্দির পোড়ানো না হলেও ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে। মন্দির কমিটির সহ-সভাপতি উথোইচিং রাখাইন জানান, স্থানীয় যুবক শ্রেণীর লোকজন এ হামলা ও লুটপাট চালায়। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অভিযুক্তরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ালেও প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তিনি জানান, যুবকরা ভাঙচুরের চেয়েও লুটপাটে বেশি ব্যস্ত ছিল। এ মন্দির থেকে এক কেজি ওজনের স্বর্ণের বুদ্ধমূর্তি, বুদ্ধের কষ্টিপাথর মূর্তি একটি, রুপার তৈরি বুদ্ধমূর্তি ৬০টি, পিতলের বুদ্ধমূর্তি ৩টি, রুপার ফুলের টপ ৩০টি, বুদ্ধ ধাতুদন্ত একটি, অরহ বুদ্ধ ধাতু (চুল) ও দানবাক্স লুট করা হয়।
ভাঙচুর করা হয় ৩টি বুদ্ধমূর্তি, বারান্দা ফুলের গ্রিল, মন্দিরের প্রধান সিঁড়ি, দরজা-জানালা, কাঠের বেড়া, মন্দিরের সীমানা, ১১টি বুদ্ধ আসন, স্টিলের আলমারি, কাঠের আলমারি, প্রাচীনকালের ১১টি দেয়াল ঘড়ি, ৫টি টেবিল, ১০ সেট টিফিন ক্যারিয়ার, টেলিভিশন ইত্যাদি।
মন্দিরের সামনে কথা হয় মংমং রাখাইন ও লুংকন রাখাইনের সঙ্গে। তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, প্রশাসন ও স্থানীয় সরকারি দলের নেতাকর্মীরা সহযোগিতা করলে এ সহিংসতা ঘটত না। তারা আমাদের কোনো সহযোগিতা করেনি। সাদা চিং ও লাল চিং মন্দিরে হামলার এক ঘণ্টা পর এ মন্দিরে হামলা হয়।
কিন্তু প্রশাসনের কেউ এ মন্দির রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। আর এখন মায়াকান্না কাঁদছেন। তারা আরও জানান, মন্দির থেকে আধ কিলোমিটার দূরে রামু থানা। অথচ পুলিশ এসেছে রাত ৩টার পর। তারা জানান, মাত্র ৪ কিলোমিটার দূরে আর্মি ক্যাম্প রয়েছে।
প্রশাসন আর্মির কাছেও সহযোগিতা চায়নি।
রামু উত্তর মিঠাছড়ি প্রজ্ঞামিত্র বনবিহারের সাধারণ সম্পাদক নীতিশ বড়ুয়া জানান, উত্তেজিত জনতা ১২টি মন্দির পুড়িয়ে দিয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে আরও ৬টি মন্দির। ভস্মীভূত মন্দিরগুলো হচ্ছে—পশ্চিম মেরংলোয়া গ্রামের কেন্দ্রীয় সীমাবিহার, উত্তর শ্রীকুল গ্রামের সাদা চিং ও লাল চিং, অপর্ণাচরণ বৌদ্ধবিহার, উত্তর মিঠাছড়ি গ্রামের প্রজ্ঞামিত্র বনবিহার, সীমা ঘর, লাল চিং, বিমুক্তি ভাবনা বিদর্শন কেন্দ্র, উখিয়ারঘোনা গ্রামের তেজবনবিহার ও লট উখিয়ারঘোনা গ্রামের আর্য বংশ বৌদ্ধবিহার। ভাঙচুর করা হয়েছে চেরাংঘাটা বড় ক্যাং ও উত্তর ফতেখাঁরকুল গ্রামের বিবেকারাম বৌদ্ধবিহার।
পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে ২৭টি বসত ও দোকানঘর। ভস্মীভূত বসতঘর ও দোকান মালিকরা হলেন অতিন্দ্র বড়ুয়া, ফকির ড্রাইভার, জুনু বড়ুয়া, অতিমোহন বড়ুয়া, তাফুরু বড়ুয়া, অঞ্জলী বড়ুয়া, জুনু বড়ুয়া (২), ফুরুক বড়ুয়া, তোফান বড়ুয়া, নিকাশ বড়ুয়া, শশীবালা বড়ুয়া, জুনু বড়ুয়া, আব্বুলু বড়ুয়া, নিরঞ্জন বড়ুয়া প্রমুখ।
হামলায় নেতৃত্বে ছিলেন যারা : স্থানীয়রা জানান, ওইদিনের পুরো সহিংসতার ঘটনায় নেতৃত্ব দেন কক্সবাজার জেলা মত্স্যজীবী লীগ নেতা আনছারুল হক ভুট্টো, রামু প্রেস ক্লাব সভাপতি ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নুরুল ইসলাম সেলিম, ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেন, যুবলীগ নেতা সালামত উল্লাহ, ছাত্রলীগ নেতা মো. মোর্শেদ, জাহেদুল ইসলাম জাহেদ, রামু কলেজ ছাত্রলীগ নেতা কাইছার হামিদ ও রিদুয়ান আহমেদ। এদের সবাই উপজেলা চেয়ারম্যান কাজলের অনুসারী বলে স্থানীয়রা জানান।
সহিংসতার কারণ : স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপকালে এ সহিংসতার জন্য তারা ৪টি কারণ জানিয়েছেন।
প্রথমত, ফতেখাঁরকুল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর ভরাডুবি; দ্বিতীয়ত, মণ্ডলপাড়ার চেয়ে বড়ুয়াপাড়ার ছেলেরা শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে যাওয়া; তৃতীয়ত, স্থানীয় সংসদ সদস্যের ওপর দোষ চাপিয়ে তাকে এলাকাছাড়া করে পুরো সংসদীয় আসন আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে আনা। এছাড়াও পদ্মা সেতু দুর্নীতি, হলমার্ক কেলেঙ্কারি, রেলওয়ের ঘুষ কেলেঙ্কারি থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্নখাতে নেয়াও এ সহিংসতার অন্যতম কারণ বলে অনেকে জানিয়েছেন। জানা যায়, ফতেখাঁরকুল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ফরিদুল আলম বিপুল ভোটে হেরে যান। নির্বাচিত হন বিএনপি নেতা সিরাজুল ইসলাম ভুট্টো। এর জন্য সংখ্যালঘুদের দায়ী করে আসছিল স্থানীয় আওয়ামী লীগ।
হামলার সূত্রপাত : রামুর হাইটুপী গ্রামের উত্তম কুমার বড়ুয়া নামের এক যুবকের ফেসবুকে পবিত্র কোরআন শরিফ অবমাননার ছবি দেখা যায়। রামু ফকিরা বাজারের ‘ফারুক কম্পিউটার’ নামের একটি দোকানে উত্তম বড়ুয়ার ফেসবুকে পবিত্র কোরআন অবমাননাকর ছবিটি দেখেন চট্টগ্রাম পলিটেকনিক কলেজের ছাত্র ও ছাত্রলীগ কর্মী মুক্তাদির। এরপর ওই ছবি দেখার জন্য ভিড় জমে যায়। একপর্যায়ে শত শত কপি প্রিন্ট করে প্রচার করা হয় সর্বত্র। মুহূর্তের মধ্যে গোটা রামু ছড়িয়ে পড়ে ‘বড়ুয়ার পোড়া কোরআন শরিফের ওপর থিয়য়াই ফটু তুইল্লে’ (বড়ুয়ার ছেলে কোরআন শরিফের ওপর দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছে)।
এ ধরনের প্রচারণার মাধ্যমে ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করা হয়। এমনি পরিস্থিতিতে রাত ৯টার দিকে রামু বাজার ও মণ্ডলপাড়ার লোকজন বিক্ষোভ মিছিল বের করে। মিছিলে নেতৃত্ব দেন জেলা ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেন, উপজেলা যুবলীগ নেতা সাব্বির হোসেনের ভাই হাফেজ আহমদ। মিছিলটি রামু চৌমুহনী স্টেশন থেকে শুরু হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে চৌমুহনী চত্বরে সমাবেশে মিলিত হয়। ওই সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, কক্সবাজার জেলা মত্স্যজীবী লীগ নেতা আনছারুল হক ভুট্টো, রামু প্রেস ক্লাব সভাপতি ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নুরুল ইসলাম সেলিম।
রাত ১১টার দিকে লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে চৌমুহনী স্টেশনসহ আশপাশের বৌদ্ধ পল্লী এলাকায়। ৪০-৫০টি মোটরসাইকেল নিয়ে মহড়া দেয় কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের আজাদ। এ সময় মিছিল নিয়ে আসা লোকজন ‘বড়ুয়াদের গালে গালে, জুতা মারো তালে তালে’ এ ধরনের স্লোগান দিতে থাকে। রাত ১২টার দিকে রামু চৌমুহনী স্টেশনে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার জন্য চেষ্টা চালান রামু উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজল, রামু থানার ওসি একে নজিবুল ইসলাম, রামু উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল আলমসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সচেতন নেতারা। ইউএনওর টেলিফোন পেয়ে ১২টার পর ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন, রামু-কক্সবাজার আসনের বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য লুত্ফুর রহমান কাজল।
তিনিও উত্তেজিত জনতাকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান। তার বক্তব্যের একপর্যায়ে উত্তেজিত জনতা হৈচৈ শুুরু করে এবং তাকে লক্ষ্য করে জুতা ছুড়তে থাকে। এমনি পরিস্থিতিতে তিনি ওইস্থান ত্যাগ করে কক্সবাজারে চলে আসেন। এরপর আওয়ামী লীগ নেতারা বক্তব্য দিতে থাকেন। এরই মধ্যে চেরাংঘাটা ও হাইটুপির বৌদ্ধবসতি ভাংচুর শুরু হয়ে যায়।
রাত সাড়ে ১২টা পার হতেই উত্তেজিত জনতা প্রথম দক্ষিণ শ্রীকুল গ্রামের কাঠের তৈরি লাল চিং মন্দিরে প্রথম অগ্নিসংযোগ করে। কাঠের হওয়ায় মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো মন্দিরে। রাত ১টার কাছাকাছি হতেই অগ্নিসংযোগ করা হয় লাল চিং মন্দিরের পাশাপাশি সাদা চিং ও মৈত্রী বিহারের অপর্ণাচরণ বিহারে। রাত দেড়টার দিকে অগ্নিসংযোগ করা হয় পশ্চিম মেরংলোয়া বড়ুয়া পাড়ার বাড়ি ঘরে। এখানে অগ্নিসংযোগ করা হলে এক সঙ্গে পুড়ে যায় ১২টি বসতঘর।
এ সময় এসব বাড়ির লোকজন প্রাণভয়ে পালিয়ে যায়। ফলে বাড়ির কোনো মালামাল তারা রক্ষা করতে পারেনি। এসব বাড়ি যখন দাউ দাউ করে জ্বলছিল তখনই ২০০ গজ পশ্চিমে আরও দুটি বাড়ি ও দোকান ঘরে অগ্নিসংযোগ করা হয়। পর্যায়ক্রমে রামু কেন্দ্রীয় সীমাবিহারসহ বেশ কয়েকটি মন্দিরে অগ্নিসংযোগ করার খবর আসতে থাকে।
মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে : স্মরণকালের ভয়াবহ এ সহিংসতার ঘটনা এক মাস পেরিয়ে গেলেও আসল হোতারা এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে গেছে।
এমনকি ঘটনার মূল রহস্যও উদ্ঘাটিত হয়নি। এ ঘটনা তদন্তে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি ও তাদের রিপোর্ট নিয়ে খোদ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যেও দেখা দিয়েছে চরম অসন্তোষ।
সহিংস ঘটনার পর থেকে এ পর্যন্ত রামুতে দু’শতাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হলেও ঘটনায় সরাসরি জড়িত এমন কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। উল্টো অনেক নিরীহ লোকজনকে আটকের অভিযোগ রয়েছে। রামু প্রেস ক্লাব সভাপতি ও ছাত্রলীগের সাবেক নেতা নুরুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বে সেদিন হামলার ঘটনা ঘটলেও পুলিশ তার কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেনি।
উল্টো তাকে থানায় ওসির সঙ্গে বসে গল্প করতে অনেকে দেখেছেন।
এদিকে রামুর সহিংস ঘটনায় গঠিত ৪ সদস্যের তদন্ত কমিটি গত ১৮ অক্টোবর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। কমিটির প্রধান হচ্ছেন চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মো. নুরুল ইসলাম। অন্যদের মধ্যে রয়েছেন বান্দরবানের পুলিশ সুপার কামরুল আহসান, কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আবদুর রউফ ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বাবুল আকতার। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, তদন্ত কমিটি তাদের প্রতিবেদনে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে নেপথ্য কারণসহ কারা এ ঘটনায় জড়িত, তা উল্লেখ করেছে।
ঘটনার সঙ্গে জড়িত ২০৫ জনের নাম প্রতিবেদনে রয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে বিভিন্ন বিষয়ে ২২টি সুপারিশ করা হলেও দায়িত্বে অবহেলার জন্য অভিযুক্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে এর কোনো সুপারিশ নেই। সূত্র জানিয়েছে, কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে তদন্ত কমিটির সদস্যরাই দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন। রামুর ঘটনায় সরকারি কর্মকর্তাদের দায়ী করা হবে কি-না, এ বিষয়ে তাদের কোনো সুপারিশ থাকবে কি-না, তা নিয়ে কমিটির সদস্যদের মধ্যে চলে দীর্ঘ তর্কবিতর্ক। অবশেষে কোনো রকম সুপারিশ না করে ‘রামুর ঘটনায় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ কয়েকজন কর্মকর্তা যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেননি’ এমন সাদামাটা মন্তব্য করেই রিপোর্ট জমা দেয়া হয়েছে।
রামুর সীমাবিহারের সহকারী পরিচালক প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু সাংবাদিকদের বলেন, ‘অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বহাল রেখে তদন্ত লোক দেখানো বলে মনে হচ্ছে। ’ তিনি আরও বলেন, ‘রামুর ঘটনা নিয়ে এর আগে পুলিশের আইজি হাইকোর্টে যে রিপোর্ট দিয়েছেন, তা আমরা প্রত্যাখ্যান করেছি। আমরা চাই নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে এই ঘটনায় অভিযুক্ত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হোক। ’ সরকারি তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশেরও দাবি জানিয়েছেন এই বৌদ্ধ নেতা।
তদন্ত কমিটি রামুর ঘটনায় জড়িত হিসেবে ২০৫ জনকে চিহ্নিত করে রিপোর্ট দিয়েছে।
জানা গেছে এর অধিকাংশই বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মী। আওয়ামী লীগেরও কয়েকজন নেতাকর্মীর নাম রাখা হয়েছে তালিকায়।
বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য লুত্ফুর রহমান কাজলের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে বলা হয়েছে, তিনি রামুর ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ পায়নি তদন্ত কমিটি। তবে স্থানীয় এমপি হিসেবে কাজল সহিংসতা দমনে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন বলে তদন্ত রিপোর্টে তাকে দায়ী করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংসদ সদস্য কাজল প্রতিবাদ সমাবেশে বক্তব্য দিয়ে তড়িঘড়ি রামু ত্যাগ করেছেন।
কিন্তু এ প্রতিবেদনে উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজলের সম্পৃক্ততা কিংবা দায়িত্বে অবহেলার ব্যাপারে কিছুই বলা হয়নি।
স্থানীয় সংসদ সদস্যের বক্তব্য : স্থানীয় সংসদ সদস্য লুত্ফুর রহমান কাজল আমার দেশ-কে জানান, রামুর ইউএনও দেবীচন্দ আমাকে টেলিফোনে জানান, রামুতে কোরআন অবমাননা নিয়ে উত্তেজিত জনতা মিছিল-সমাবেশ করছে। তিনি আমাকে রামুর চৌমুহনী আসতে অনুরোধ করেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের অনুরোধে আমি রাত সাড়ে ১১টার দিকে রামুর উদ্দেশে রওনা দিই। রামু সদরে পৌঁছে দেখি, বিক্ষুব্ধ লোকদের সমাবেশে উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজল বক্তব্য দিচ্ছেন।
স্থানীয় রামু থানার ওসি নজিবুল, আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম, ইউএনও দেবীচন্দও কিছুক্ষণ পর উপস্থিত হন। আমরা উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম। আমি বক্তব্য দিতে গেলে কিছু যুবক আমার বক্তব্য শুনবে না বলে হৈচৈ শুরু করে দেয়। তারা উপজেলা চেয়ারম্যানের বক্তব্য শুনবেন বলে জানান। একপর্যায়ে আমাকে লক্ষ্য করে তারা জুতা ছুড়ে মারে।
আমি বক্তব্যদানে বিরত থাকি। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতাদের একজন কোরআন অবমাননাকর ছবির প্রিন্ট উঁচিয়ে জনতাকে আরও উত্তেজিত করে তোলে। উত্তেজনা থামানোর জন্য আমি ইউএনও এবং অন্যদের আলেম ডেকে এনে উত্তেজনা থামানোর পরামর্শ দিই। নিজেও একজন আলেমের সঙ্গে কথা বলি। একপর্যায়ে রামু উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নুসরাত জাহান মুন্নী আমাকে এসে জানান শ্রী কুলের বৌদ্ধমন্দিরে আগুন দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
এর পরপরই উপজেলা চেয়ারম্যানকে দেখলাম লোকজন নিয়ে মন্দিরের দিকে রওনা হতে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে নিরাপত্তাজনিত কারণে আমি কক্সবাজার শহরের দিকে রওনা হই। গাড়িতে উঠে আমি ইউএনওকে ১৪৪ ধারা জারির পরামর্শ দিই। এসপিকে টেলিফোন করে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনেরও অনুরোধ জানাই।
তিনি বলেন, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই আমরা বাংলাদেশী ভাই।
এটাই আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। এটা আমাদের গর্বও। অতীতে কখনও মুসলমানদের সঙ্গে বৌদ্ধদের কোনো সংঘাত হয়নি। কিন্তু বর্তমান মহাজোট সরকার আমাদের ওপর আজ এক কলঙ্কতিলক লাগিয়ে দিয়েছে। এরআগে হাটহাজারীতেও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মহেশখালীতে হিন্দুমন্দির ভাংচুর হয়েছে। কিন্তু কখনও বিএনপি সরকারের আমলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হয় এমন ধিক্কারজনক ঘটনা ঘটেনি। রামুর ঘটনাটিও সরকারি দলের কিছুসংখ্যক নেতাকর্মী সংঘটিত করেছে বলে আমার ধারণা।
উপজেলা চেয়ারম্যান কাজলের বক্তব্য : উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান সোহেল সরওয়ার কাজল আমার দেশ-কে বলেন, ওইদিনের ঘটনা ঘটিয়েছে উচ্ছৃঙ্খল কিছু যুবক। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আমরা প্রাণপণ চেষ্টা করি কিন্তু প্রশাসনের যথাযথ সহযোগিতা না পাওয়ায় সেটি সম্ভব হয়নি।
হামলা ও লুটপাটে জড়িতদের অধিকাংশই আপনার দলের এমনকি অনেকে আপনার পাড়ার—এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, আপনি তাদের নাম বলুন। ভাংচুরের ছবি দেখে জড়িতদের নাম বললে তিনি বলেন, নাম ঠিকই আছে, তবে তারা আমাদের দলের কেউ নয়। এ ছেলেগুলো বখাটে, মাদকাসক্ত ও ইয়াবা ব্যবসা করে। এদের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। সহিংসতার মূল হোতা নুরুল ইসলাম সেলিমকে প্রায় আপনার সঙ্গে দেখা যায়, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সহিংসতার সঙ্গে নুরুল ইসলাম জড়িত নয়।
সে ওইদিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আমাদের সহযোগিতা করেছিল। সে ষড়যন্ত্রের শিকার। রামু প্রেস ক্লাবের গ্রুপিংয়ের কারণে তার নাম জড়ানো হচ্ছে। তিনি বৌদ্ধদের আপসহীন ভূমিকার সমালোচনা করে বলেন, ওইদিন ভোর ৫টা পর্যন্ত তাদের কারও চেহারা দেখা না গেলেও এখন যাচ্ছে তাই বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।