আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একদিন ঈশা খাঁ'র বাড়ীতে- স্মৃতিচারণে মিষ্টি প্রেমের গল্প।

প্রত্যেক মানুষই কম বেশি কল্পনাবিলাসি। এমন একদিন ছিলো সেদিন আমি একটু বেশিই কল্পনাবিলাসি ছিলাম। আজ শুধু কল্পনা নয় স্বপ্ন দেখতেও ভয় পাই। আমি আবার স্বপ্ন দেখতে চাই........ আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। আমার বড় বোন সরকারী চাকুরী করতো।

তার পোষ্টিং হলো কিশোরগঞ্জ আমাকেও আপা তার সাথে নিয়ে গেলো। আর আমাদের বাবা মা রইলো রাজবাড়ীতে। কিশোরগঞ্জে আমরা যে বাসায় ভাড়া থাকতাম সে বাসার বাড়িওয়ালার মোট পাঁচটি মেয়ে ছিলো। সব চেয়ে যে মেয়েটি বড় ছিলো সে পড়তো ক্লাশ এইটে, আমার এক ক্লাশ উপরে। আমার উপরের ক্লাশে পড়তো বলে আমি তাকে আপনি বলে ডাকতাম না, তার নাম ধরে ডাকতাম।

তার নাম ছিলো লিপি। সেও আমাকে নাম ধরেই ডাকতো। আমাদের মধ্যে বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো। কিশোরগঞ্জে আমার সবার প্রথম বন্ধু বলতে সেই লিপি। আমি ক্লাশ শেষ করে যখন বাসায় ফিরতাম তখন আমার মন খুব ছটফট করতো রাজবাড়ীতে চলে আসার জন্যে আমার কিছুই ভাল লাগতো না।

তখন লিপি হয়তো আমাকে ডেকে ওর রুমে নিয়ে গিয়ে, স্কুলের বান্ধবিদের বিভিন্ন গল্প করতো। কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ীতে ঈশা খাঁর বাড়ী, বইতে পড়েছি ঈশা খাঁ বাংলার বার ভূইয়ার তেরো ভূইয়া। লিপি আমাকে জঙ্গলবাড়ীর ঈশা খাঁর সেই বাড়ীতে নিয়ে যাবে বলেছে। সেই পুরানো দিনের ঈশা খাঁর পড়া বাড়ী দেখতে যাবো ভাবতেই আমার ভাল লাগতো। আমরা যেখানে থাকতাম সেখান থেকে ঈশা খাঁর বাড়ী প্রায় পনেরো মাইল দূর।

আমরা দুই জনই ছোট মানুষ তাই বাসায় বল্লে আমাদের একা একা এতো দূর যেতে দেবেনা জানতাম। আমি আর লিপি তাই সিদ্ধান্ত নিলাম কাউকে না জানিয়ে আমরা দুইজন স্কুলের কথা বলে বাসে চড়ে সেখানে যাবো। কিন্তু আমাদের দুই জনকেইতো স্কুল ড্রেস পরে স্কুলেযেতে হয়, আর স্কুল ড্রেস পরে সেখানে গেলেতো অন্য সকলে বুঝে ফেলবে আমরা স্কুল পালিয়ে বেড়াতে এসেছি। তাই সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগলাম। সত্যি সত্যি একদিন সুযোগ চলে এলো।

সে দিন ছিলো ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী, স্কুলে মিলাদুন্নবীর অনুষ্ঠান হচ্ছে সে কথা বলে সুন্দর পোষাক পড়ে আমি আর লিপি অভিযানে বেরুলাম সকাল দশটার দিকে। জঙ্গল বাড়ির বাসে উঠে পরলাম দুইজন। কোথায় গিয়ে বাস থেকে নামতে হবে আমাদের দুই জনের কেউই জানিনা। ঘন্টা তিনেক বাস চলার পর বাসের সুপারভাইজার আমাদের জিজ্ঞাসা করলো আমরা কোথায় নামবো। আমরা জঙ্গল বাড়ী নামবো শুনে সুপারভাইজার প্রায় আৎকে উঠলো।

তোমরা জঙ্গলবাড়ী নামবে আগে বলনি কেন? জঙ্গলবাড়ী পার হয়ে এসেছি প্রায় ঘন্টা দুয়েক আগে। সুপারভাইজারের কথা শুনে আমাদের দুইজনেরই প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা। সুপারভাইজার আমাদের বাস থেকে নেমে কিশোরগঞ্জের বাসে উঠতে বল্লো। আমার মনের মধ্যে জিধ চেপে গেলো ঈশা খাঁর বাড়ী দেখতে এসেছি ঈশা খাঁর বাড়ী দেখেই যাবো, বাড়ী না দেখে ফিরবোনা। আমরা বাস থেকে নেমে একটা খাবার হোটেলে ঢুকে সিঙ্গারা আর চপ্‌ খেয়ে নিলাম।

আমার কাছে প্রায় পাচঁ’শ টাকা আছে। খাবার-দাবার বা বাস ভাড়ার কোন অসুবিধা নেই। আমি লিপির কাছে জানতে চাইলাম আমরা কি বাড়ি ফিরবো না ঈশা খাঁর বাড়ী দেখে যাবো? লিপি বল্লো তোমার যা ভাল মনে হয় তাই করো আমার কোন অসুবিধা নেই। তারো প্রায় দুই ঘন্টা পরে কিশোরগঞ্জের এক বাস এলো আমরা সেই বাসে চেপে জঙ্গলবাড়ী আসতে আসতে প্রায় বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে এলো। আমদের মনে সন্ধ্যার সে ভাবনা নেই।

সন্ধ্যার কাছাকাছি সময়ে আমরা জঙ্গল বাড়ীতে এসে পৌছালাম। সেখান থেকে একটা বিক্সায় সেই বহু প্রতিক্ষিত ঈশা খাঁর বাড়ীতে এসে পৌছালাম। বাড়ির হাল অবস্থা বলছি- আসেপাশের এলাকার লোক জন বাড়ীর জানালা দরজা এমন কি কিছু ইট পর্যন্ত খুলে নিয়েগেছে। বাড়ির পাশেই একটা বিশাল পুকুর। এক সময় সুন্দর ঘাট বাঁধানো ছিলো দেখেই বোঝা যায়।

আমি আর লিপি সেই ভাঙ্গাচুড়া ঘাটে গিয়ে বসলাম। লিপি দেখতে খুব ফর্শা আর সুন্দর ছিলো। বেলা ডুবে যাওয়ার শেষ আলোতে লিপির ছায়া পুকুরের পানিতে পরে কি যে সুন্দর লাগছিল তা আমি কাউকে কোন দিন বুঝাতে পারবোনা। আজ বাড়ীতে গেলে আমাদের কপালে কষ্ট আছে লিপির এই কথা শুনে আমি বাস্তবে ফিরে এলাম। লিপি উঠে এসে আমার হাত ধরে টেনে তুলে বল্ল চল বাসায় ফিরে যাই।

আমরা দুই জন হাত ধরা ধরি করে বাস স্ট্যান্ডে এসে দাড়াবার সাথে সাথেই বাস পেয়ে গেলাম। পরে জানতে পারলাম জঙ্গলবাড়ী থেকে কিশোরঞ্জে ফেরার এটাই নাকি শেষ বাস। আর একটু দেরি হলেই আমদের সেদিনকার মতো ঈশা খাঁর বাড়ীতে থেকে যে তে হতো। কিশোরগঞ্জ বাস স্টপেজে এসে বাসায় গেলে আজ কি হবে তা ভেবে হাত পা ঠন্ডা হয়ে গেলো। বাসায় যখন ফিরলাম তখন রাত সাড়ে সাতটা।

আমার ঘরে ঢুকে জানলাম লিপির মা আর আপা দুই জন মিলে কোন বাসায় যেনো বেড়াতে গেছে সেই দুপুরে তারা এখোনো ফেরেনি। আমি এক লাফে লিপির ঘরে ঢুকে লিপিকে বল্লাম দেখেছিস কতো বড় বাঁচা বেঁচে গেছি বাসায় কেউ নেই। আজ বাসায় থাকলে কি হতো বলতো? লিপি ভেংচি কেটে বল্ল ছাই হতো ভিতু কোথাকার। আমি আর লিপি এর পর থেকে বিকাল হলেই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতাম আবার সন্ধার আগেই বাসায় ফিরে আসতাম। সবচাইতে বেসি যেতাম শোলাকীয়া ঈদগাহ ময়দানে।

শোলকীয়া ঈদগা ময়দান বিশাল এক মাঠ বাংলাদেশের সবচাইতে বড় ঈদের জাতাম হয় সেখানে। মাঠের মধ্যে মধ্যে অনেক রকমের গাছগাছালিতে ভরা। এর মধ্যে আম গাছই সব চাইতে বেশি। এভাবেই প্রায় বছর কেটে গেলো। আমি ক্লাশ এইটে উঠার পর রাজবাড়ীতে চলে এলাম।

আমার আসার দিন লিপির সেকি কান্না আমি কোন দিনও ভুলবোনা আজ প্রায় তেইশ বছর পার হয়েছে লিপি হয়তো আমাকে ভুলেই গেছে হয়তো ভোলেনি আমি জানিনা কিন্তু লিপির সে দিনের কান্না আমার আজো চোখের সামনে ভাসে। মানুষের শরীরের কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ তার চোখের সামনে কেটে ফেল্লেও হয়তো এভাবে কাঁদবেনা। লিপির ছোট বোন শিরিন ক্লাশ ফাইভে পরতো সে আমার জ্যাকেটের পকেটে একটা কাগজ ভরে দিয়েছিলো কখন যে আমি তা বুঝতেই পারিনি, তাতে লেখা ছিলো ‘‘ভাইয়া তুমি ভালোনা’’। শিরিন আপু আজ তুমি কোথায় আছো জানিনা, কিন্তু আমি তোমাদের ভুলিনি, তুমি কি আমাকে মনেরেখেছো? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.