আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঝলসানো মুনির থেকে একটি নিউজ আইটেম



লেখাটা লিখতে একটু দেরী করে ফেললাম। যেদিন আগুনে ঝলসে গিয়েছিল, সেদিন লিখলে বেশ ভালো হত। ঘটনাটা বেশ টাটকা ছিল। আবেগ, নীতিকথা, তত্ত্বকথা সব কিছু ঢেলে দারুণ মুখরোচক একটা কলাম লেখা যেত। কাজটা অবশ্য সেদিন অনেকেই করেছিলেন।

দু’কলম অনেকেই লিখেছিলেন। সঙ্গে ছিল, সি এন জি তে বসা ঝলসানো পুত্রকে কোলে নিয়ে পিতার ছবি। তবে বেশী প্রাধান্য পেয়েছে মৃত্যু গুলো। কোন দল করত, কি পোস্টে ছিল এসব বিস্তারিত। কিছু এলেবেলে লোকও মরেছে, তাঁদের নাম ও দেয়া হয়েছে।

কিছু আগুনে ঝলসেছে। ‘ব্যাটারা তো মরে নি, মরলে তখন দেখা যাবে’। তখন তাঁর জন্য বরাদ্দ হবে ‘কি অপরাধ এই কিশোরের’ এ জাতীয় কিছু শিরোনাম। তবে ঘটনাটা আরও মার্কেট পেত যদি রাজনীতিতে একটা শান্ত ভাব থাকতো। একে তো সরকারের শেষ সময়, তার ওপর আবার বিরোধী দলের ‘দাবী আদায়’ টাইপ মুড।

‘জ্বালাও পোড়াও’ টাইপ ঘটনার ছড়াছড়ি। এসব কাভার করবে, না এই ‘গরীব সিএনজি’ চালকের পুত্রের শরীর ঝলসানো নিয়ে রিপোর্ট করবে? তারপরও মেডিকেল কলেজ প্রতিনিধি রা রিপোর্ট জমা দিয়েছেন। দু একটা পত্রিকায় সেসব ছাপাও হয়েছে। লাশ একেবারে না থাকলে তখন এসব ‘ঝলসানো’ রিপোর্ট গুলকেও অনেক বেশী ‘হট কেক’ করা হত। বিভিন্ন আঙ্গিকে রিপোর্ট হত।

‘চিকিৎসা কেমন চলছে’, ‘ডাক্তারের কোন গাফিলতি পাওয়া গেল কি না’ কিংবা ‘মানবাধিকার সংস্থার লম্ফ ঝম্ফ’ প্রতিটি নিয়েই একাধিক লেখালেখি হত। এমন কিছুই হোল না বা বলা চলে ‘হতে পারলো না’। এখন সবাই ব্যস্ত সামনে কি কর্মসূচী আসছে, সেসব নিয়ে। ‘গণ কারফিউ’ ‘লাগাতার হরতাল’ আসতে পারে। অন্যদিকে ‘গ্রেফতার’ স্ট্র্যাটেজি।

সঙ্গে থাকছে ‘সর্বদলীয়’ হচ্ছে, না ‘নির্দলীয়’ হচ্ছে, তাঁর সাসপেন্স। ভারতে সবাই গিয়ে কি নিয়ে আলোচনা করছে? এরশাদ সাহেব কেন চুপ করে আছেন? মউদুদ সাহেবের কেন ‘হার্ট অ্যাটাক’ কিসের সংকেত? এতো সব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মাঝে ঝলসানো মনির কে নিয়ে খুব বেশী রিপোর্টিং আশা করা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যায়। গল্পটায় যদিও ইমোশান আছে, ট্র্যাজিডি আছে। কিছুটা নতুনত্ব ও আছে। তারপরও শুধু ‘ভুল সময়ে’ ঘটনা ঘটায়, গল্পটা হিট করলো না।

যাই হোক, অবশেষে মনির মরল। সুযোগটা এবার নেয়া যায়। এবার কিছু মায়াকান্না টাইপ লেখালেখি শুরু করা যেতে পারে। ‘একটি তরতাজা প্রাণ ঝরে গেল’ ‘কার দোষ?’ এধরনের লেখা তো হবেই। এছাড়াও থাকবে ‘হরতাল’ এর ব্যবচ্ছেদ করা টাইপ কিছু লেখালেখি।

‘এতগুলো হরতাল দেয়ার পরেও কোন দলই সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারেনি, অতএব হরতাল দেয়া আর না দেয়া সমান কথা’। সুশীলদের তো আবার একটু দল প্রীতি আছে। যে যেই দলের প্রতি অনুরক্ত, শো দলের দিকে হেলেই বলবেন। আওয়ামী সুশীল রা এখন যেমন বলবেন বিপক্ষে, জাতীয়তাবাদী রা বলবেন স্বপক্ষে। সেসব পড়তে চাইলে পড়তে পারেন, যদি যুক্তিগুলো এখনো মুখস্থ না হয়ে থাকে।

এই ছেলেটাকে নিয়ে কি করা যায়। লেখার বিষয় হিসেবে খারাপ না। তবে সময়টা খুব সুবিধার না। এধরনের বিষয় নিয়ে লিখলে, পেছনের পাতা কিংবা ভেতরের পাতা। একমাত্র ভরসা, খবরটা টাটকা।

কেবলই মরেছে। দলগুলো ব্যাপারটা একেবারে ভাবে নি, তা বোধ হয় না। কিন্তু উপায় নেই। ছেলেটার বয়স কম, নিজ দলের কর্মী কেউ ই দাবী করতে পারছে না। পারা গেলে দু দলই সুযোগ নিত।

একজন নিজের দলের দাবী করে সংবাদ সম্মেলন করত। আর অন্যজন বলত ‘সরকারী দল কাজটা করেছে’। ‘ইমোশান’ তৈরি করার জন্য লাশটা নিজের দলের কর্মী দাবী করে আরও খান দুয়েক হরতাল ঠুকে দেয়া যেত। লীগের এক নেতার ‘কোপানো হত্যা’ উপলক্ষ্যে একটা হরতাল এসেছে। মুনির ব্যাটা কোন বাসে হেল্পার গিরি করলেও হত, এই ইস্যু তুলে হরতালটাকে, ‘টু ইন ওয়ান’ বানিয়ে দেয়া যেত।

কোনটাই করা যাচ্ছে না। মৃত্যুটাও কারো কোন কাজে দিচ্ছে না দেখে এই মৃত্যু নিয়ে কেউই খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছে না। ঝলসে যাওয়ার ব্যাপারটা পুরনো হলেও ‘মৃত্যু’ টা টাটকা। এখনো একরাশ ‘ইমোশান’ ঢেলে আবেগে গদ গদ করুণ দুএকটা কলাম প্রতিটি পত্রিকা ই রাখবে। ফলে এ নিয়ে লিখলে আশা করা যায় ছাপাবে।

কিন্তু লিখি কি নিয়ে? ৯৫% বার্ন এর চিকিৎসা নিয়ে? নাকি গান পাউডার নিয়ে? কিভাবে এতো সহজলভ্য হচ্ছে এসব জিনিস? না ছেলেটাকে নিয়েই লেখা উচিৎ? কিন্তু ওকে নিয়ে লিখবই বা কি? ছেলেটার পুরো নাম কি? কি করতো? কোন ক্লাসে পড়ত? কিংবা আদৌ পড়াশোনা করত কি না? বাবা রমজান আলীর একটি সন্তান আগেই মারা গিয়েছে। এবার দ্বিতীয়জনও গেল। আর বার্ন ওয়ার্ডে কাতরাচ্ছে। এছাড়া ওর সম্পর্কে আর কোন তথ্যই তো জানি না। হারাধনের শেষ জনের নাম কি? ওর মায়ের নাম কি? এসব তথ্য জোগাড় করা কি জরুরী? কে জানতে যায় ওসব কথা।

গরীব দের সম্পর্কে এতো তথ্য জানতে কেউই আগ্রহী না। ওসব ছাড়াই কলাম লিখে ফেলা যাবে। এখন চাই একটা দারুণ ক্যাপশান। সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে একটা ছবি। তবে নতুন।

আগে কোথাও ছাপা হয় নি এমন একটা দিতে হবে। ব্যান্ডেজ জড়ানো ছবিটা আগেই ছাপা হয়েছে। ভালো ইম্প্যাক্ট দিবে না। ক্রন্দন রত ফ্যামিলির একটা ছবি? এরকম ছবি কি তোলা হয়েছে? না হলে, এখনই রিপোর্টার পাঠিয়ে জোগাড় করা উচিৎ। তাই না? নইলে কলাম টা দৃষ্টি নন্দন হবে না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.