জালিয়াতি করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। জাল দলিল দাখিল করে, ভুয়া এলসি খুলে কিংবা ভুয়া সঞ্চয়পত্র ও এফডিআর বন্ধক রেখে ব্যাংক খালি করার মহোৎসবে নেমেছে সিন্ডিকেটটি। সরকারি-বেসরকারি কোনো ব্যাংকেই নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ঋণ অনুমোদন দেওয়ায় ব্যাংক খালি করার ঘটনা ঘটছেই। কাগজপত্র যাচাই-বাছাই এবং নিয়মিত তদারকি না করা- সর্বোপরি ব্যাংক কর্মকর্তাদের গাফিলতির কারণে জনগণের গচ্ছিত টাকা এভাবে লুটপাট হচ্ছে বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও শিল্পোদ্যোক্তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে অবিশ্বাস। লেনদেনের সম্পর্কে ধরছে ফাটল। ফলে বিপাকে পড়েছেন প্রকৃত উদ্যোক্তারা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসব ঘটনার জেরে প্রকৃত ঋণগ্রহীতা বা উদ্যোক্তাদের প্রতারক সন্দেহের তালিকায়ও রাখছে ব্যাংকগুলো। এ ধরনের ঘটনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল মনিটরিংকেই দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, এ ধরনের প্রতারণা ঠেকাতে না পারলে শীঘ্রই ব্যাংকিং খাতে বিপর্যয় নেমে আসবে। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকিং খাতে অভিনব কায়দায় প্রতি বছরই লুটপাট চলছে। আর সেই লুটের টাকা ব্যাংকের খাতায় মন্দ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়ে একসময় অবলোপনের খাতায় চলে যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাত থেকে নামে-বেনামে লুটপাট হওয়া ঋণ আদায় করতে না পেরে ব্যাংকগুলো অবলোপন করেছে। এভাবে গত চার দশকে ব্যাংকিং খাত থেকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি লুটপাট হয়েছে। কিন্তু লুটপাটকারীরা থেকে গেছে শাস্তির বাইরে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত চার দশকে এভাবে ব্যাংকিং খাত থেকে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। আর এর সিংগভাগই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের টাকা। এ ছাড়া প্রায় সব বেসরকারি ব্যাংকেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ হলমার্ক ও বিসমিল্লাহ গ্রুপের ঋণ জালিয়াতি এর প্রকৃত উদাহরণ, যার মাধ্যমে প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা ব্যাংক খাত থেকে বেরিয়ে গেছে। অথচ এর জামানতস্বরূপ যে কাগজপত্র জমা দেওয়া হয়েছে তার প্রায় সবই ভুয়া। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মাহফুজুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে ব্যাংক ঋণ নেওয়ার অভিযোগের তদন্ত করা হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যাংকগুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ নজরদারি শক্তিশালী করতে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তারা সৎ ও নিষ্ঠাবান না হলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে, যা ব্যাংক খাতের সুনাম নষ্ট করবে বলে মনে করেন তিনি। একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নৈতিকতা না থাকলে সব ক্ষেত্রেই জালিয়াতি ঢুকে পড়ে, যা ব্যাংক খাতেও ঢুকেছে। এ ছাড়া এ ধরনের জালিয়াতি ঠেকাতে হলে মূল কাজটা বাংলাদেশ ব্যাংককেই করতে হবে। তার মতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতেই এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। কেননা সেখানে জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে।
সূত্র জানায়, এই প্রতারক চক্র কখনো কখনো ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে ব্যাংক ঋণ নিয়ে যায়। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশেও ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটছে। এ ক্ষেত্রে বন্ধকি সম্পত্তি অতিমূল্যায়িত করে, ভুয়া এলসি খুলে কিংবা জাল সঞ্চয়পত্র ও এফডিআর বন্ধক রাখার মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে বিপুল পরিমাণ ঋণখেলাপি সৃষ্টি হয়েছে। ভুয়া দলিল, ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার পর তা পরিশোধ করছে না গ্রাহক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যাংককে দেওয়া কাগজপত্রের ঠিকানা অনুযায়ী গ্রাহকের খোঁজও পাচ্ছে না ব্যাংক। আবার খোঁজ পেলেও আইনি জটিলতায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। কারও কারও বিরুদ্ধে অর্থ ঋণ আদালতে মামলা করলেও তা ঝুলে থাকছে বছরের পর বছর। কিন্তু এর কোনো সমাধান হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়ে পাঁচ বছর পর ওইসব ঋণ 'মন্দ ঋণে' পরিণত করছে। ফলে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ ব্যাংকের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। আর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে।
জানা গেছে, ২০০৩ সালে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ অবলোপনের নিয়ম চালু হয়। ওই সময় ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। আর ব্যাংকিং খাতে মোট বকেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭৯ হাজার কোটি টাকা। মোট ঋণের ৩১ দশমিক ৯০ শতাংশই ছিল খেলাপি। এর মধ্যে মন্দ হিসেবে শ্রেণীবিন্যাসিত হওয়ার পর পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে এমন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা। ওই ১৩ হাজার কোটি টাকা মন্দ খেলাপি ঋণের মধ্যে ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রায় ৬ হাজার ৫০০ কোটি, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রায় ৩ হাজার কোটি এবং বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর প্রায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর পাঁচ বছর মেয়াদি মন্দ খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মোট ঋণের প্রায় ১৯ থেকে ২০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে কোনো ব্যাংকই অবলোপনের পর আর ওই খেলাপি ঋণ আদায়ের চেষ্টা করে না বলে মনে করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।