'সদিচ্ছা' ও 'ছাড় দেওয়ার মানসিকতা' নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো 'গঠনমূলক' সংলাপ শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফারনান্দেজ তারানকো। তার ভাষায়, পরিস্থিতির ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। এ জন্য ঢাকা সফর এক দিন বাড়িয়েছেন তিনি। গতকাল বিকালে তারানকো এ বক্তব্য দেওয়ার তিন ঘণ্টা আগেই বৈঠকে বসেছিলেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির চারজন করে সিনিয়র নেতা। দুই ঘণ্টার বেশি সময় তারা আলোচনা করেছেন। তারানকোর বক্তব্য, জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি-মুনের আমন্ত্রণে সংলাপ চালিয়ে যেতে উভয় দল সম্মত হয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, তারানকো আজ রাতে চলে যাওয়ার পর সংলাপে মধ্যস্থতা করবেন ঢাকাস্থ জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী নিল ওয়াকার।
অস্কার ফারনান্দেজ তারানকোর সমঝোতা মিশনের গতকাল ছিল শেষ দিন। কথা ছিল বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে রাতে ফিরে যাবেন নিউইয়র্ক। এর আগে বিকালে করবেন সংবাদ সম্মেলন। কিন্তু বিকালে খবর আসে তারানকো আরও এক দিন ঢাকায় থাকবেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকও পিছিয়ে আজ নির্ধারণ করা হয়। বাতিল করা হয় সংবাদ সম্মেলন। অবশ্য সকাল থেকেই অনির্ধারিত নানান বৈঠক শুরু করেন তারানকো। হোটেল থেকে বেরিয়েছেন সকাল ১০টায়। আলোচনা করেছেন দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের কূটনৈতিক মিশনের দায়িত্বে থাকা দুই নেতাসহ আরও কয়েকজন রাজনীতিকের সঙ্গে। পরে দুপুরে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। যখন তারানকোর উপস্থিতিতে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী নিল ওয়াকারের গুলশানের বাসভবনে বৈঠকে বসেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আট নেতা। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে চার সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন সিনিয়র নেতা ও মন্ত্রী আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ এবং প্রধানমন্ত্রীর পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ড. আবদুল মঈন খান ও ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরী। শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বৈঠকের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তারানকোর মধ্যস্থতায় বৈঠক হয়েছে। কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে, উভয় দল একমত হয়েছে কিনা জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। তবে রাতে দলের পক্ষ থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতারা হরতাল-অবরোধের নামে নৈরাজ্য বোমাবাজি, সন্ত্রাস বন্ধের জন্য বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। অন্যদিকে বিএনপি তাদের আটককৃত নেতাদের মুক্তি দাবি করে। এর জবাবে আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড বন্ধ করলেই আটককৃতদের মুক্তি এবং আলোচনা অর্থবহ হবে। বিএনপি রাতে বিবৃতি দিয়ে বৈঠকের কথা জানিয়ে বলেছে, 'বৈঠকে উভয় পক্ষ সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচনকালীন সরকার বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখার বিষয়ে একমত পোষণ করে। আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিরাজমান অনিশ্চয়তা নিষ্পত্তির লক্ষ্যে জাতিসংঘ মহাসচিবের এ উদ্যোগের জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে তাকে ধন্যবাদও জানানো হয়েছে।' পূর্ব নির্ধারিত সংবাদ সম্মেলন বাতিল করলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের সংলাপের পর হোটেলে ফিরে যাওয়ার আগে সংক্ষিপ্ত লিখিত বিবৃতি পাঠ করেন তারানকো। তিনি বলেন, আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। আমি আমার সফরের সময় এক দিন বাড়িয়েছি, কারণ পরিস্থিতির ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিবের আমন্ত্রণে উভয় দলের প্রতিনিধিরা একত্রে বসেছেন এবং সংলাপ করেছেন। একসঙ্গে বসার এই সিদ্ধান্তকে আমি অভিনন্দন জানাই এবং এ সুযোগ লুফে নিতে চাই। এটি রাজনীতিকদের দৃঢ় নেতৃত্ব, দায়িত্ববোধ ও সাহসিকতার প্রতিফলন এবং সেই সঙ্গে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি একটি জবাব। চলমান উদ্বেগ কমাতে এবং আত্দবিশ্বাস বাড়াতে উভয় পক্ষ সদিচ্ছা, ছাড় দেওয়ার মানসিকতা ও গঠনমূলকভাবে একসঙ্গে সংলাপ চালিয়ে নিতে সম্মত হয়েছে।'
দুপুরে সংলাপের পর সন্ধ্যায় দীর্ঘ আলোচনা করেছেন বিএনপির নেতারা। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংলাপে অংশ নেওয়া চার নেতা দুই ঘণ্টার বেশি সময় বৈঠক করেন। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, বিবৃতিই বিএনপির অবস্থান। তবে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের জন্য একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির জন্য প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। জাতিসংঘের ঢাকাস্থ আবাসিক সমন্বয়কারীর মধ্যস্থতায় আরও বৈঠক হবে। জানতে চাইলে খন্দকার মোশাররফ বলেছেন, এখনো অগ্রগতির বিষয়ে বলার সময় হয়নি। রাজনৈতিক সূত্রগুলোর তথ্য মতে, গতকালের বৈঠকের মূল এজেন্ডা ছিল দুই দল সংলাপ করবে কি না, সে সিদ্ধান্ত নেওয়া। পরে দুই দল এ বিষয়ে একমত হয় যে, নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা করবে। তবে আলোচনায় মূল বিষয় আসে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার থাকা না থাকা। সূত্রের দাবি, প্রাথমিক আলোচনায় নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর বিষয়ে কিছুটা নমনীয় হয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে বলেছে, তা হতে হবে সংবিধানের মধ্যেই। অপর এক সূত্র জানায়, আলোচনায় সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এ কে খন্দকারকে নির্বাচনকালীন সরকারপ্রধান করার বিষয় উত্থাপন করেন আওয়ামী লীগের এক নেতা। এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তবে বৈঠকে উপস্থিত একটি সূত্র জানিয়েছে, 'যা আলোচনা হয়েছে তার সবই প্রাথমিক। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো উভয় দলই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রয়োজনে কিছুটা সরে আশার ইঙ্গিত দিয়েছে।'
জাতিসংঘ মিশন বাড়ল এক দিন : ৬ ডিসেম্বর সফর শুরু করা তারানকোর গতকাল রাত ৯টায় এমিরেটসের একটি ফ্লাইটে ঢাকা ত্যাগ করার কথা ছিল। কিন্তু দুপুরে ঢাকার জাতিসংঘ কার্যালয় থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়, সফর আরও এক দিন বাড়ানো হয়েছে। সে হিসাবে আজ রাতে ঢাকা ত্যাগ করবেন তারানকো। সফর দীর্ঘায়িত করার বিষয়ে তারানকো বলেছেন, 'সফরের সময় এক দিন বাড়িয়েছি। কারণ পরিস্থিতির ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। এ সুযোগ আমি লুফে নিতে চাই।' জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, 'মিশনে একটি ইতিবাচক ফলের আশা করছেন তারানকো। সেটি নিশ্চিত করেই তিনি ঢাকা ত্যাগ করতে চাচ্ছেন।'
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক আজ : গতকাল বিকাল ৪টায় নির্ধারিত ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তারানকোর বৈঠক। কিন্তু সেটি পিছিয়ে আজ সকাল সাড়ে ১০টায় নির্ধারণ করা হয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সফরের শুরুতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন তারানকো। আজ দ্বিতীয় দফায় সাক্ষাৎ হবে। তারানকো ইতোমধ্যে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দুই দফা বৈঠক করেছেন।
সংলাপ নিয়ে দিনভর বিভ্রান্তি : সৈয়দ আশরাফ ও মির্জা ফখরুল বারিধারার একটি বাসায় বৈঠকে বসেছেন বলে গতকাল দিনভর ছিল বিভ্রান্তি। তারানকোর ব্যবহৃত গাড়ি ইউএনডিপির এক কর্মকর্তার বাসভবনে এক ঘণ্টার বেশি সময় অবস্থান করায় এ বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
খবর পেয়ে সেখানে সাংবাদিকরা ভিড় করেন। এক সময় বেরিয়ে যায় ইউএনডিপির গাড়ি দুটি। দিনভর টিভি ক্যামেরার দৃষ্টি বারিধারার ওই বাড়ির দিকে থাকলেও সন্ধ্যায় জানা যায়, বৈঠক হয়েছে গুলশানে জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারী নিল ওয়াকারের বাসভবনে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।