আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইজতেমা সমাচারঃ ইজতেমা কি এবং কেন?

গনজাগরনের মাধ্যেমে পরিবর্তন সম্ভব....মানুষের চিন্তার পরিবর্তন করাটা জরুরি ....বুদ্ধিবৃত্তিক পুনরজাগরনে বিশ্বাসী কিছুদিনের মধ্যেই ঢাকার টঙ্গীতে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ইজতিমা। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দিক থেকে ইজতিমা নিয়ে অনেক কথা এসেছে। আর ইজতিমার সময়ই কথাগুলো বেশি আসে। বিশেষ করে অনেকেই এর বিরুদ্ধে নানান কথা লিখেছেন। আমি গত বেশ কয়েক বছর ধরে ইজতিমায় যাই।

দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতেও যুক্ত আছি কম-বেশি। সেজন্য ভাবলাম এবিষয়ে যতটুকু জানা আছে তা লিখে ফেলি। অনেকের কাজে আসতে পারে। ইজতিমা কী? “ইজতিমা” অর্থ সম্মেলন (একত্রিত হওয়া) বলা যেতে পারে। সাধারণভাবে অনেক মানুষকে কোন একটা উপলক্ষে সমবেত করার নামই ইজতিমা।

তাবলীগে অনুসৃত অনেক কাজের মধ্যে ইজতিমাও একটি। ইজতিমা শুধু বাংলাদেশেই হয় তা নয়। বরং দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে ঐ অঞ্চলের ইজতিমা হয়। কোথাও পুরো দেশের হয়। কোথাও কয়েকটি দেশ মিলে হয়।

কখনও কোন দেশের একটা প্রদেশ বা অঞ্চলেরও ইজতিমা হতে পারে। বাংলাদেশে মূল ইজতিমা ছাড়াও বিভিন্ন জেলায় বা কয়েকটি জেলা মিলে ইজতিমা আগেও হয়েছে এবং এখনও প্রয়োজনুসারে বিভিন্ন জায়গায় হয়। এগুলো কখনও মিডিয়াতে না আসার কারণে অনেকেই জানতে পারেন না। ইজতিমাগুলোর কিছু কিছু নিয়মিতভাবে প্রত্যেক বছর হয়। নিয়মিত ইজতিমাগুলোর ক্ষেত্রে কোন কোনটার স্থান নির্দিষ্ট থাকে।

কোনটার স্থান প্রত্যেক বছর ঠিক করা হয়। আমার জানামতে ভারতে ইজতিমা একেক বছর একেক প্রদেশে হয়ে থাকে। আবার সেখানে শুধু কোন কোন প্রদেশেরও ইজতিমা হয়ে থাকে। বিশ্ব ইজতিমা? সাধারণত, ইজতিমা যেখানে হয়, সে অনুসারেই পরিচিত হয়। যেমন রাজশাহী অঞ্চলের ইজতিমা হলে তাকে বলা হবে- ‘রাজশাহী ইজতিমা’।

আমার জানামতে তাবলীগের মুরুব্বীরা আমাদের পরিচিত ইজতিমাকে ‘টঙ্গী ইজতিমা’ বলে থাকেন। “বিশ্ব ইজতিমা” নামটা তাবলীগ জামায়াতের পক্ষ থেকে দেওয়া না, মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত হয়ে গেছে। তাবলীগের কাজটা তদানীন্তন অবিভক্ত ভারতে শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। তবে খুব স্বাভাবিকভাবে বর্তমান ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশেই এর কাজটা বেশি।

এজন্য এখানে ইজতিমাগুলোও অপেক্ষাকৃত বড় হয়। অন্যান্য দেশে তাবলীগের জন্য বিশেষভাবে এই তিনটি দেশে আসতে অনুরোধ করা হয়। ভারত এবং পাকিস্তানেও ইজতিমাতে বিদেশী মেহমানরা আসেন। তবে সম্ভবত বাংলাদেশের ইজতিমাতে আসা বিদেশী মেহমানদের জন্য সবচেয়ে সহজ। এজন্যই এখানে আসতে বিদেশী মেহমানদের বেশি উৎসাহিত করা হয় আর বেশি বেশি বিদেশী মেহমান আসেনও।

তাই বলে একে “হজ্জ্বের পরে বিশ্বের মুসলিমদের সবচেয়ে বড় সম্মেলন” বলে হজ্জ্বের সাথে তুলনা করাটা কখনও ঠিক হবে না এবং তাবলীগের কাজের সচেতন সাথীরাও এটা অপছন্দ করেন। ইজতিমার উদ্দেশ্য। সহজভাবে বললে, টঙ্গীর এবং অন্যান্য সমস্ত ইজতিমারও উদ্দেশ্য বেশি বেশি মানুষকে কিছু সময়ের জন্য জামাআতে বের করা। এই যুগে শুধু কয়েকটা বয়ান শুনে মানুষ ইসলাম মানা শুরু করবে, এত বেশি আশা করা ঠিক হবে না। কিন্তু জামাআতে যেয়ে কেউ যখন একনাগাড়ে একটা বড় সময় দ্বীনি পরিবেশে থাকে তখন ইসলাম মানা তার জন্য অনেক সহজ হয়ে আসে।

এজন্য শুধু ইজতিমা না, প্রায় সবক্ষেত্রেই দাওয়াত ও তাবলীগের কাজে মানুষকে জামাআতে বের করার চেষ্টা করা হয়। ইজতিমা করা হলে, একে উপলক্ষ করে অনেকের জন্যই জামাআতে বের হওয়া সহজ হয়। এজন্য ইজতিমাতে বিশেষভাবে ঈমান সংক্রান্ত কথা বলে, নবী-রাসূল আলাইহিস সালাম এবং সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.)-দের ঘটনা বলে জামাআতে বের হওয়ার তাকীদই বেশি দেওয়া হয়। দেখা যায় যে সারা বছর মিলে যে পরিমাণ জামাআত বের হয়, এই এক ইজতিমা থেকেই তার প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি জামাআত বের হয়। ইজতিমা কি বিদয়াত? এটা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলে থাকেন।

কুরআন ও হাদীস ইসলামী দাওয়াতের মৌলিক নীতিমালা এবং এর বিধানসমূহকে নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু কোন সুনির্দিষ্ট অবকাঠামো, কর্ম-পদ্ধতি নির্ধারণ করে দেয় নি। অর্থাৎ এসব নীতি ও বিধানের মধ্য থেকে দাওয়াতের মেহনতের কাঠামো ও কর্মপদ্ধতি স্থান-কাল-পরিবেশ ভেদে বিভিন্ন হতে পারে। তাবলীগ ছাড়া অন্যান্য ইসলামী আন্দোলন বা প্রচেষ্টার দিকে তাকালেও এমন কিছু নিয়ম-কানুন, নিয়মিত/অনিয়মিত কর্মকান্ড চোখে পড়বে। যদি কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী কিছু না করা হয় তাহলে এসব অনুষ্ঠান করতে কোন সমস্যা থাকার কথা না।

তবে যখন মানুষ একটা অনুষ্ঠানকে ইবাদাত মনে করে শরীয়াতের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলবে, তখন সেটা বিদয়াত হয়ে যাবে। ইজতিমাকে শরীয়াতের অংশ করে ইবাদাত বানিয়ে ফেলা হয়নি। তবে তাবলীগের কাজের কাঠামোতে এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধায় সবাইকে এখানে অংশগ্রহণ করতে বলা হয়। সেসময় প্রায়ই ইজতিমার “সওয়াবের” কথা চলে আসে। ইজতিমার ভিতরে, বিশেষ করে বিশাল জামায়াতের সাথে, যেসব আমলগুলো করা হয়, সেগুলোর সওয়াবের কারণেই ইজতিমার সওয়াবের কথা বলা হয়।

তাছাড়া আলাদাভাবে ইজতিমার কোন সওয়াব নাই। কেউ যদি বলে বা মনে করে যে, ইজতিমায় আসলে সব গুনাহ মাফ হয়ে যাবে, তিনবার ইজতিমায় গেলে একবার হজ্জ্বের সওয়াব হয়, ইত্যাদি ইত্যাদি, তাহলে নিঃসন্দেহে এসব ভুল কথা। সবাইকে এসব থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করতে হবে। আর একটা কথা বলি, কোন একটা কাজের ব্যাপ্তি সমাজের একদম সাধারণ মানুষের পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে গেলে, এমন কিছু সমস্যার মুকাবেলা করতেই হয়। একটা মজার ব্যাপার হল, আমি তাবলীগের কাজে যুক্ত কারও কাছ থেকে এসব কথা খুব কম শুনেছি।

যা শুনেছি তাতে এগুলো সংশোধনের ব্যাপারে সতর্ক করার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু বেশি শুনেছি ঐসব ভাইয়ের কাছে, যারা ইজতিমা নিয়ে অভিযোগ করে থাকেন। অবশ্য হতে পারে এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সমস্ত অকল্যাণ থেকে হিফাজত করুন। মোটকথা ইজতিমা বিশেষ উদ্দেশ্যে করা একটি অনুষ্ঠান মাত্র।

প্রয়োজনে যার মধ্যে পরিবর্তন আসতে পারে। যেমন আগে পুরো বাংলাদেশের ইজতিমা একসাথে হত। এখন স্থান-সংকুলান না হওয়ার কারণে দুই বারে করা হচ্ছে। ইবাদাতের ক্ষেত্রে, এমনকি প্রতিষ্ঠিত বিদয়াতগুলোর ক্ষেত্রেও এমনটা নিতান্তই অস্বাভাবিক। কাদের জন্য এই ইজতিমা? সাধারণভাবে ইজতিমা সবার জন্যই।

যে কেউ এখানে আসতে পারেন। তবে ইজতিমাতে মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পর দেখা গেল, অনেকেই শুধু ইজতিমা দেখতে আসে। কত মানুষ, কতবড় প্যান্ডেল, এসব দেখাই তাদের উদ্দেশ্য। তখন মুরুব্বীদের থেকে নির্দেশনা দেওয়া হল যে, যাদের ইজতিমায় আসার দাওয়াত দেওয়া হয়, তাদেরকে যেন আসার আগে অন্তত তিন দিন জামাআতে সময় দেওয়ানোর পর নিয়ে আসা হয়। যেন তাঁরা একটা দ্বীনি মনোভাব নিয়ে ইজতিমায় আসেন আর ইজতিমার সময়টা সঠিকভাবে ব্যবহার করেন।

তবে জামাতে সময় না দিয়েই যদি কেউ চলে আসেন বা একান্ত দেখার উদ্দেশ্যেও যদি কেউ আসেন, তাকে নিষেধ করা হয় না। ময়দানে নিজ এলাকার মসজিদ যেখানে আছে সেখানে গেলে সবাইকেই হাসিমুখে জায়গা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ইজতিমাতে যারা আসেন, তাদের মধ্যে কিছু ভাগ করা যেতে পারে। এক) যারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসেন, পুরো সময় মাঠেই থাকেন, বয়ান শুনেন, অন্যান্য আমলে শরীক হন। এদের অনেকেই আবার ইজতিমা থেকে জামাতে বের হয়ে যান।

দুই) যারা ইজতিমাতে পুরো সময় থাকেন না। কিছু বয়ান শুনেন। আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকেন। এদের বেশিরভাগই কাছাকাছি এলাকার মানুষ। তিন) যারা শুধু জুময়ার নামায এবং আখেরি মুনাজাতে শরীক হন, বয়ান বা অন্যান্য সময় খুব একটা থাকেন না।

সাধারণত, এই শেষের প্রকারের মানুষেরাই ইজতিমা সম্পর্কে সঠিক ধারণা রাখেন না। বিভিন্ন ভুল ধারণা এদের মধ্যেই বেশি থাকে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল- এই ধরণের মানুষের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। আর বিভিন্ন মিডিয়াগুলোতে এদের সংখ্যা আর মন্তব্যই ফলাও করে প্রচার করা হয়। ইজতিমাতে কী হয়? ইজতিমার মূল আমল হল বয়ান।

প্রতিদিন ফজর এবং মাগরীবের পর লম্বা সময় নিয়ে বয়ান হয়। যোহর এবং আসরের পরেও ছোট বয়ান হয়। সকাল সাড়ে দশটার দিকে বিশেষ শ্রেণী বা পেশার মানুষ যেমন ছাত্র, শিক্ষক, পেশাজীবি, আলীমদের নিয়ে আলাদা আলাদা মজমা করে বয়ান হয়। এসময় অন্যরা তালীমের মধ্যে থাকেন। বয়ান সাধারণত ভারত এবং পাকিস্তানের আলীম এবং মুরুব্বীরা করে থাকেন।

তখন বয়ান উর্দুতে হয়। বাংলাতে অনুবাদ হয়। তবে বাংলাদেশের কেউ বয়ান করলে সরাসরি বাংলাতেই করেন। বিদেশি মেহমানদের জন্য এসব বয়ান তাদের ভাষায় অনুবাদ করে দেওয়া হয়। উনাদের জন্য সরাসরি আলাদা বয়ানও হয়।

আগে যেমন বলেছিলাম, বয়ানের মূল উদ্দেশ্য থাকে মানুষের মধ্যে ঈমানী চেতনা এবং উম্মাতের ফিকির তৈরি করে তাদেরকে জামাতে বের হওয়ার জন্য উদবুদ্ধ করা। তবে এক্ষেত্রেও শুধু বয়ানের দ্বারাই সবাই তৈরি হয়ে যায় না। বরং পুরো ইজতিমাটাই জামাতে বের হওয়ার ও বের করার একটা মেহনত। বয়ান যার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ মাত্র, পুরোটা নয়। সাথীরাও নিজেদেরকে আল্লাহর রাস্তায় বের হওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে থাকেন।

এভাবে পুরো পরিবেশের চেষ্টার ফলেই মানুষ জামাতে বের হয়। শনিবার আসরের পর বিয়ে পড়ানো হয় যা ইজতিমার অন্যতম আকর্ষণ(!)। প্রথমে উর্দু বয়ান ও আরবি খুতবা হয়। এরপর পাত্র এবং পাত্রীর পিতা/ওয়ালী জোড়ায় জোড়ায় লাইন ধরে যান এবং একে একে সবার সামনে বিয়ে পড়ানো হতে থাকে। প্রত্যেক বছর এভাবে অনেক বিয়ে পড়ানো হয়।

ইসলাম যে সহজ এবং অনাড়ম্বর বিয়ের শিক্ষা দেয়, তার একটা দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করে মানুষকে ইসলামী পদ্ধতিতে বিয়েতে উৎসাহিত করাই এর উদ্দেশ্য। তাছাড়া এমন না, যে মানুষকে বিশেষভাবে ইজতিমায় বিয়ে করার জন্য ডাকা হয়। ইজতিমাতে মানুষ সাধারণত নিজ এলাকার মসজিদ অনুসারে এক একটা জামাত গঠন করে মাঠে থাকে এবং নিজেদের খাওয়া-দাওয়া, বিছানা-পত্র, সামিয়ানা ইত্যাদি নিজেরাই ব্যবস্থা করে। ইজতিমার মাঠের এলাকা বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল অনুসারে ভাগ করে দেওয়া আছে। সবাই সে অনুসারেই মাঠে থাকেন।

আর চেনার সুবিধার জন্য পুরো মাঠে পূর্ব-পশ্চিম এবং উত্তর-দক্ষিণ বরাবর খুঁটিতে নাম্বার দেওয়া আছে, অনেকটা x,y স্থানাঙ্ক বা কো-অর্ডিনেটের মত। খুঁটি নাম্বার জানা থাকলে সহজেই যেকোন জায়গা খুঁজে বের করে ফেলা যায়। আর তাছাড়াও মাঠকে অনেকগুলো “খিরতা”-তে ভাগ করা আছে। যেখানে এক বা একাধিক জেলা থাকে। এসব খিরতা ম্যাপ থেকে দেখে নেওয়া যায়।

ইজতিমার বিভিন্ন জায়গাতে ম্যাপ টাঙানো থাকে। এছাড়াও লিফলেট আকারেও অনেকে ইজতিমার ময়দানে ম্যাপ বিতরণ করে। জনদুর্ভোগ? ইজতিমার ব্যাপারে অনেকেই অভিযোগ করে থাকেন, এতে সাধারণ মানুষজন যাতায়াত এবং অন্যান্য দিক থেকে দুর্ভোগের শিকার হয়ে থাকেন। ইজতিমা টঙ্গীর মাঠে ষাটের দশকে শুরু হয়। সেসময় এই মাঠ মূল ঢাকা শহর থেকে বেশ দূরেই ছিল।

আবার যানবাহনের হিসাবে মোটামুটি অনেক দূরেও ছিল না। সুবিধাজনক একটা অবস্থানে ছিল আর কি। আর তখন ইজতিমায় আসা মানুষের সংখ্যাও খুব বেশি ছিল না। চারপাশে মানুষের বসতিও ছিল না তেমন একটা। এখন অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ঢাকা ইজতিমার মাঠের একেবারে কাছে চলে এসেছে। চারপাশে তৈরি হয়েছে বসতি। আরও তৈরি হচ্ছে। এজন্য ইজতিমার সময় তাদের বেশ অসুবিধাই হয়। তবে মাঠের অবকাঠামো তৈরি হয়ে যাওয়া, বিদেশি মেহমানদের সুবিধার জন্য ঢাকার কাছাকাছি আর কোন উপযুক্ত জায়গা না থাকা ইত্যাদি কারণে এই কষ্টটুকু সহ্য করা ছাড়া ইজতিমা আয়োজন করার উপায় আপাতত নাই মনে হয়।

আল হামদু লিল্লাহ, যারা কষ্ট করছেন, তাদের অধিকাংশেরই এই ব্যাপারে কোন অভিযোগ করতে শুনি নি। আর দুই ভাগ হয়ে যাওয়ার পরে এই কষ্ট অনেকটাই কমে গিয়েছে। একবার ইজতিমায় গিয়ে একবার একটা প্রয়োজনে মাঠের বাইরে গিয়েছিলাম। বাইরে উত্তরার আবাসিক এলাকায় জায়গায় জায়গায় মাইক লাগানো হয়েছে। সেগুলোতে শব্দ শোনা যায় ঠিকই, কিন্তু কী বলা হচ্ছে তা বোঝা বেশ কঠিন।

খুবই মনোযোগ দিয়ে শুনলে হয়ত কিছু বোঝা যেতে পারে। অথচ সেসব জায়গাতে মনোযোগ দিয়ে শোনার কেউ নাই। দোয়ার সময় বহুদূর পর্যন্ত এমন মাইক লাগানো হয় শুনেছি। তাবলীগের কাজের সাথে আমার অভিজ্ঞতা যা বলে, তাতে মাঠের বাইরের এই মাইকগুলো ইজতিমা কর্তৃপক্ষের কাজ হতে পারে না। কারণ অমনোযোগী অবস্থায় যেনতেন ভাবে দ্বীনের কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াটা এই কাজের নিয়ম না।

আর মূল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে হলে মাইকের আওয়াজও অনেক ভাল শোনা যেত, যেহেতু মূল মাইক্রোফোনের সাথে সংযুক্ত থাকত। এজন্য ধরে নেওয়া যায়, এটা কোন উৎসাহী লোকের কাজ। আবার একবার শুনলাম গত ইজতিমার বয়ান নাকি কোন এক টিভি চ্যানেলেও প্রচার করেছে। এক নাম্বার কথা হল, আমি বেশ কয়েকবার মঞ্চের কাছাকাছি বসে দেখেছি, কেউ বক্তাদের বা অন্যদেরও ছবি তুলতে গেলে আশে-পাশের সবাই বেশ কড়াভাবেই নিষেধ করে থাকেন। সেখানে সরাসরি বা ভিডিও ধারণ করে প্রচার করার প্রশ্নই আসে না।

তবে উপরের মাইক লাগানোর মত করে যদি কোন চ্যানেল কথা প্রচার করে তাহলে করতেও পারে। আর এর পরের কথা হল, আমার দেখা মতে তাবলীগের কাজের লোকজন টিভি খুবই অপছন্দ করেন। যারা পারেন, তারা বাসা থেকে টিভি সরিয়েই ফেলেন। আর অন্যান্য মিডিয়া ব্যাপারেও উনারা উৎসাহী না। এমনকি পোস্টার পর্যন্ত তারা ব্যবহার করেন না।

তাঁরা সরাসরি সুন্নাত অনুসারে মানুষের কাছে গিয়ে দাওয়াত দেওয়ার মানসিকতাতেই অভ্যস্ত। আজকাল অবশ্য কিছু “বিশ্ব ইজতিমা”-এর পোস্টার দেখা যাচ্ছে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে- এগুলো অন্য একটা মাহফিল/সম্মেলনের, যেখানে ইজতিমা শব্দটার প্রতি মানুষের আগ্রহকে ব্যবহার করার চেষ্টা করা হচ্ছে মাত্র। সুতরাং কোন টিভি চ্যানেলের প্রচারের দোষ উনাদের ঘাড়ে চাপানো উচিত নয়। আখেরী মুনাজাত কি বিদয়াত? এই মন্তব্য একজনকে করতে দেখেছি যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এভাবে মুনাজাত করে কিছু শেষ করার দলীল নাই।

এটা ঠিক। তবে যেটা আমাদের কাছে আখেরী মুনাজাত হিসেবে পরিচিত সেটা আসলে ইজতিমা শেষ উপলক্ষে করা হয় না। বরং ইজতিমা থেকে অনেক জামাত দেশের বিভিন্ন এলাকায় সফরের জন্য রওয়ানা হয়। এর জামাতগুলো রওয়ানা হওয়ার সময় তাদের উদ্দেশ্য হিদায়াত(নির্দেশনা)মূলক একটা বয়ান হয়। তারপর এই সমস্ত জামাআতের জন্য পাশাপাশি সমস্ত উম্মতের জন্যও দুয়া করা হয়।

আর এই দুয়া বা মুনাজাতের মাধ্যমেই ইজতিমা শেষ হয়। দুয়ার পর জামাতগুলো তাদের গন্তব্য জেনে তার উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও কোথাও কোন জামাত পাঠালে এভাবেই তাদেরকে হিদায়াত বা নির্দেশনা ও তাঁর দুয়া দিয়ে বিদায় দিতেন। কেউ আবার এজন্য ইজতিমার বিরুদ্ধে বলেন যে, এখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা দোয়াতে শরিক হতে আসেন। যাদের অনেকের অনেক কাজই ইসলাম-বিরোধী।

আসলে কোন একটা জায়গাতে অনেক লোক একসাথে হলে আরো অনেকেই সেখানে আসে। কে কীজন্য আসছে সেটা অন্যদের জানা নাই। যে যেই নিয়্যাতে আসবে, আল্লাহ তায়ালা তার ব্যাপারে তেমনই ফায়সালা করবেন। কিন্তু এখানে আসতে কাউকে বাধা দেওয়া হয় না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি কাফির কিন্তু তার নিজের গোত্রের কাছে সম্মানিত, এমন লোকদের সাথে ভাল ব্যবহার করেননি? অনেকে ইজতিমার একসাথে খাওয়া-দাওয়া করা, থাকা ইত্যাদিকে পিকনিকের সাথে তুলনা করতে চান।

আপনি যদি কাউকে পছন্দ নাও করেন, দয়া করে এভাবে খোঁটা দেবেন না। শরীরে আঘাত লাগলেও মানুষ ভুলে যায়। কিন্তু মনে আঘাত পেলে সহজে ভুলে না। ইজতিমার মাঠে মানুষের স্রোতের মধ্যে একবেলা টয়লেটে যাওয়া এবং অযুর অভিজ্ঞতা থাকলে যে কারও মাথা থেকে এমন পিকনিকের ইচ্ছা স্রেফ উবে যাবে। অনেকে বলেন, আচ্ছা এত লোক যে ইজতিমায় আসে, তারা চাইলেই কি অমুক ভাল কাজটা সবাই মিলে করে ফেলতে পারত না? কিংবা দ্বীন কায়েম করে ফেলতে পারত না? কিংবা ইজতিমাটা ফিলিস্তিনে করে ইসরাইলের হাত থেকে তাদের মুক্ত করে ফেলতে পারত না, এমন প্রশ্নও অনেকে করে থাকেন।

আসলে এই যে এত মানুষ, আসলেই কি তারা সংখ্যায় অনেক বেশি? একটু আগে ইজতিমায় আসা যে কয়েক ধরণের মানুষের কথা বললাম, তার মধ্যে জুময়া আর দুয়াতে শরীক হতে আসা মানুষের সংখ্যাই বেশি, যেই সংখ্যাটা মিডিয়াতে আসে। আসলে মাঠে ইজতিমায় পুরো সময় অবস্থান করে বয়ান শোনা মানুষের সংখ্যা অত বেশি নয়। আবার কমও নয় একেবারে। আর যারা মাঠে থাকেন, তাদের সবাই-ই তাবলীগের মুরুব্বীদের একটা কথা শুনলে যেকোন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, এমন নয়। প্রকৃত দ্বীনদার মুসলিমের সংখ্যা আল্লাহ তায়ালাই ভাল জানেন।

আমিও নিজের ব্যাপারে সন্দিহান। আর আল্লাহ তায়াল সংখ্যার দিকে তাকানও না, এর মুখাপেক্ষীও তিনি না। তাঁর ওয়াদা মুসলিমদের ঈমান এবং আমলের সাথে। অনেক কিছু লেখা হয়ে গেল। যারা স্রেফ বিরোধিতার খাতিরেই বিরোধিতা করেন, তাদের জন্য লেখাটা না।

কিন্তু অনেক ভাই আছেন, যাঁরা সত্যিই কুরআন-সুন্নাহের বিপরীত কিছু হচ্ছে এই আশঙ্কা থেকেই ইজতিমা নিয়ে বলেন। হয়ত তাঁদের জন্য লেখাটা সহায়ক হবে। চেষ্টা করেছি যা জানি তা লিখতে। তবে সবচেয়ে ভাল হয়, যদি আপনারা নিজে এসে দেখেন ইজতিমা কী। পুরো সময় অথবা অন্তত একদিন।

আশা করি অনেক কিছুরই উত্তর পেয়ে যাবেন। আল্লাহ তায়ালা আমাকে, পাঠকদেরকে এবং পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে সিরাতাল মুসতাকীমের হিদায়াত দান করুন। প্রথম থেকে শুরু করে সমস্ত মুসলিমের গুনাহকে মাফ করে দিন। সমস্ত মুসলিমদের জন্য দুনিয়া এবং আখিরাতে মঙ্গলের ফায়সালা করুন। জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচান।

আমীন ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।