আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

“বঙ্গবন্ধু” শেখ মুজিবুর রহমান এবং ঘানার “মুক্তিদাতা” ডঃ কওমে ন’ক্রুমাহ (“Bangabandhu” Sheikh Mujibur Rahman and “Osagayefo” Kwame Nkrumah.

প্রবাসী দেশ বিদেশ সম্পর্কে জানার আগ্রহ বরাবরই আমার একটু বেশী। সময়,সুযোগ , সামর্থ্য একসাথে হলেই বেরিয়ে পড়ি। পাশাপাশি বিদেশ ঘুরে আসা বন্ধুদেরও জিজ্ঞেস করি কেমন দেখলে, কি দেখলে ইত্যাদি । বন্ধুবর যখন পশ্চিম আফ্রিকার ছোট দেশ ঘানা থেকে ঘুরে এল তাকে প্রশ্ন করেছিলাম সে দেশ সম্পর্কে। আফ্রিকা মহাদেশের কোন দেশে এখনো যাওয়া হয় নি আমার ।

বন্ধু একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক এবং রাজনৈতিক মতাদর্শে বি,এন,পি’র সমর্থক। স্বাধীন ঘানার স্থপতি ন’ক্রুমা সম্পর্কে তার মন্তব্যের সুত্র ধরেই আজকের লেখা। বংগবন্ধু এবং বাংলাদেশের পতাকা পশ্চিম আফ্রিকার ছোট দেশ ঘানা। আয়তন ২ লক্ষ ৩৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার লোক সংখ্যা ২কোটী ৪০ লক্ষ জন। ভৌগলিক অবস্থানে এদেশের পশ্চিমে আইভরি কোস্ট, উত্তরে বুরকিনা ফাসো, পুর্বে টোগো এবং দক্ষিনে গিনি উপসাগর।

প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর দেশ ঘানা। উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীর উপনিবেশবাদের যুগে ঘানা ছিল আফ্রিকার “গোল্ড কোস্ট” হিসেবে পরিচিত। সোনা, পেট্রোলিয়াম,প্রাকৃতিক গ্যাস উল্লেখযোগ্য খনিজ পদার্থ , অন্যতম শীর্ষ কোকো উৎপাদনকারী দেশ। এশিয়া আফ্রিকার অনান্য অনেক দেশের মতই বৃটিশদের উপনিবেশ ছিল ১৯৫৭ সাল অবধি। ঘানার স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা ছিলেন ডঃ কওমে নক্রুমা।

ন'ক্রুমাহ এবং ঘানার পতাকা পড়া শুনা করেন আমেরিকার পেনসিল্ভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং লন্ডনের স্কুল অফ ইকোনোমিক্সে। ১৯৪৮ সালে দেশে ফিরে বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার হন। ১৯৫০ সালে বৃটিশদের বিরুদ্ধে অসহযোগ,ধর্মঘট এবং বেসামরিক অগ্রাহ্য আন্দোলন করে কারারুদ্ধ হন । ১৯৫১ সালে ন’ক্রুমাহ কারা রুদ্ধ থাকা অবস্থায় তার দল Convention People’s Party নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। ১৯৫২ সালে দেশ বৃটিশদের অধীনে স্বায়ত্বশাসনকালে “গোল্ড কোস্ট” দেশের প্রধানমন্ত্রী হন।

১৯৫৭ সালে ঘানা স্বাধীনতা লাভ করলে তিনি ঘানার প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন। তিনি “Osagayefo” উপাধিতে ভূষিত হন, ঘানার ভাষার এ শব্দের অর্থ হল মুক্তিদাতা বা ত্রানকর্তা। ১৯৬০ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ঘানা প্রজাতন্ত্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৬৩ সালে অর্গানাইজেশান অফ আফ্রিকান ইউনিটি’ (OAU )গঠিত হয়। ন’ক্রুমা ছিলেন সমগ্র আফ্রিকার একত্রীকরনের স্বপ্নদ্রস্টা এবং ঘানা ছিল OAU এর অন্যতম প্রতিষ্ঠা সদস্য দেশ।

১৯৬৩ সালে তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক “লেনিন শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে ঘানায় একদলীয় শাসন ব্যাবস্থা স্থাপন করেন এবং তিনি হন আজীবন প্রেসিডেন্ট। ১৯৬৬ সালে ভিয়েতনাম এবং চীনে রাস্ট্রীয় সফরে থাকা সময়ে সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। আমেরিকার সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি বা সি আই এর কেস অফিসার John Stockwell, এবং অন্যান্য সুত্র অনুযায়ী বৃটেন, ফ্রান্স এবং সি আই এ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। তিনি পার্শবর্তী দেশ গিনিতে আশ্রয় নেন।

সে দেশের প্রেসিডেন্ট আহমেদ সেকতুরে তাকে “ অতিথি প্রেসিডেন্ট বা সহ-প্রেসিডেন্ট হিসাবে আশ্রয় দেন। ১৯৭২ সালে রোমানিয়ায় ক্যান্সারে চিকিৎসাধীনকালে মারা যান। তাকে তার গ্রামের বাড়ী ন’ক্রুফুল এ সমাধিস্থ করা হয়। এরপর ঘানায় চলে সামরিক অভ্যুত্থান এবং পালটা অভ্যুত্থান এর পালা। ঘানার অর্থনৈতিক অবস্থা ক্রমশঃসংগীনতর হতে থাকে।

১৯৮১ সালে বিমান বাহিনীর অফিসার রাউলিং ক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন এবং সংবিধান স্থগিত করেন। ১৯৯২ সালে বহুদলীয় গনতন্ত্র এবং নতুন সংবিধান চালু হয় । ১৯৯২ এবং ১৯৯৬ সালে রাউলিং এর প্রতিষ্ঠিত দল National democratic party নির্বাচনে জয়ী হয়, রাউলিং হন প্রেসিডেন্ট। ২০০০ সালে বিবিসি ওয়ার্লড সার্ভিস শ্রোতাদের ভোটে নক্রুমা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ আফ্রিকান নির্বাচিত হন। ন’ক্রুমা আখ্যায়িত হন স্বাধীনতার বীর বা"Hero of Independence।

২০০৯ সালে National democratic party দলের নেতা ঘানার রাস্ট্রপতি জন আটা মিলস নক্রুমা’র ১০০ তম জন্মদিনে নক্রুমাহ'র জন্মদিন ২১ সেপ্টেম্বরকে ঘোষনা করেন প্রতিষ্ঠাতা’র দিন বা Founder's Day হিসাবে। ২১ সেপ্টেম্বর হয় সরকারী ছুটির দিন। ন’ক্রুমাহ’র দেহাবশেষ তার গ্রামের সমাধি থেকে এনে রাজধানী আক্রার জাতীয় সমাধিসৌধে স্থাপন করা হয় দেশটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে । ন’ক্রুমা’র নিবর্তনমুলক ব্যাবস্থা সমুহ- তিনি বিরোধীদের প্রতি ছিলেন নির্মম এবং অসহিস্নু। ১৯৫৫ সালে তিনি ট্রেড ইউনিয়ন এক্ট চালু করে ধর্মঘট নিষিদ্ধ করেন।

১৯৫৫ সালে সোনার খনি শ্রমিকেরা ধর্মঘট করলে তিনি Preventive Detention Act প্রবর্তন করেন। এই আইনে যে কাউকে বিনা বিচারে যতদিন খুশী আটক রাখা যেত। ১৯৬৪ সালে রেলকর্মচারীরা ধর্মঘট করলে তিনি একই আইনে তাদের কারা রুদ্ধ করেন। ১৯৬৪ সালের পর থেকে তিনি হয়ে ওঠেন ঘানার একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরসাশক। তিনি নিজস্ব “ জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনী এবং প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট গঠন করেন যারা হয়ে ওঠে সাশনের হাতিয়ার।

নিয়মিত সেনাবাহিনী এবং পুলিসবাহিনী থাকে উপেক্ষিত। ন’ক্রুমাহ’র জনকল্যানমুলক ব্যাবস্থা সমুহ- ঘানা ছিল অর্থনৈতিক দিয়ে অগ্রসরমান দেশ। নক্রুমা আধা সমাজতান্ত্রিক মার্ক্সবাদী অর্থনীতি চালু করেন। সমস্ত নাগরিকের জন্য বিনামুল্যে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ব্যাবস্থা চালু করেন। তার সাশনের গোড়ার দিকে কৃষি এবং খনিজ উৎপাদন বৃদ্ধি পায়।

সে সময় ঘানার অর্থনীতি ছিল দক্ষিন কোরিয়ার সমতুল্য। ভোল্টা নদীর উপর বাধ দিয়ে নির্মান করেন পৃথিবীর বৃহত্তম ওসাকাম্বো জল বিদ্যুৎ প্রকল্প যা সেচের জল যুগিয়ে খাদ্য উৎপাদন বাড়ায় এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশকে করে স্বয়ং সম্পুর্ন। উপসং হার- ঘানার ওসাগায়েফে কওমে নক্রুমা, এবং বাংলাদেশের বংগবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, দেশ দুটো , দেশের স্বাধীনতার স্থপতি এবং পরবর্তী রাজনীতিতে কি অদ্ভুত মিল? প্রধানমন্ত্রী- প্রেসিডেন্ট- একদলীয় শাসন, বিরোধীদের উপর নীপিড়ন, বিশেষ ক্ষমতা আইন, ,সি,আই,এ এবং উপনিবেশবাদী শক্তির মদদে সামরিক অভুত্থান, সামরিক নেতার রাজনৈতিক দলগঠন(বি,এন,পি/ National Democratic party) , বহুদলীয় গনতন্ত্র স্থাপন, সামরিক নেতার নির্বাচন( জিয়াউর রহহমান/ রাউলিং), হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাংগালী / আফ্রিকান হিসেবে বংগবন্ধু এবং ন’ক্রুমার স্বীকৃতি লাভ, লেনিন পুরস্কার /জোলিও কুরি পুরস্কার, আমেরিকা রাশিয়ার স্নায়ুযুদ্ধের শিকার ইত্যাদি। বংগবন্ধু এবং ন’ক্রুমাহ’র অমিল হল- ঘানার সামরিক নেতার প্রতিষ্ঠীত রাজনৈতিক দল National Democratic party নক্রুমাকে স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তার জন্ম দিন ২১ সেপ্টেম্বরকে প্রতিষ্ঠাতা্র জন্মদিন হিসাবে সরকারী ছুটির দিন ঘোষনা করেছে। তার গ্রামের সমাধি থেকে দেহাবশেষ এনে জাতীয় সমাধিসৌধে স্থাপন করে ন’ক্রুমাকে জাতীয় বীরের মর্য্যাদা দিয়েছে।

আমার চিকিৎসক বন্ধুর আক্ষেপ ছিল আমরা কবে শেখ মুজিবকে , ন’ক্রুমাহ’র মত মুল্যায়ন করব। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.