আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি একজন সস্তা ও বাজারি পাঠক বলছি...

মাঝে মাঝে বৃষ্টি দেখে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে জাগে... ভেতর ভেতর যাই পুড়ে যাই, কেউ জানেনা আমার আগে...

গত কয়েক দিন ধরে হুমায়ূন আহমেদ এর 'সস্তা' এবং 'বাজারি' লেখালেখি নিয়ে 'সাহিত্য পণ্ডিত' এবং 'বোদ্ধাদের' তুমুল সমালোচনা দেখে যারপর নাই আপ্লুত। হুমায়ূন আহমেদ নাকি তরল সাহিত্য রচনা করেছেন, যার ফলে দেশে অজস্র তরল পাঠকের সৃষ্টি হয়েছে, সেই সব তরল পাঠক বিদগ্ধ সাহিত্যিকদের আগুন গরম সাহিত্য পাঠ করতে গেলে সেই সকল সুগভীর, আগুন-গরম, ক্ল্যাসিক এবং একই সাথে ধ্রুপদী সাহিত্যের তাপে নিমেষেই বাষ্পীভূত হয়ে মিলিয়ে যাবেন... এইবার আলোচনায় আসি, হুমায়ূন আহমেদ নিজে কখনোই কি দাবী করেছেন তিনি কালজয়ী কোন সাহিত্য রচনা করেছেন? করেছেন? না, করেন নি। তিনি বরং অকপটে তার সাহিত্য নিয়ে হাস্যরস করেছেন। প্রকাশ্যে বলেছেন, জ্বী জনাব, আমি বাজারী লেখা লিখছি, সস্তা উপন্যাস লিখছি। এই বাজারি লেখক বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদ এর কাঠপেন্সিল থেকে হুবহু তুলে দিচ্ছি- 'বাজারি লেখক- বিষয়টা আরও পরিস্কার করা দরকার।

তেল-সাবান- পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ বিক্রেতা টাইপ লেখক। এদের বই বাজারে পাওয়া যায় বলেও বাজারি। যাদের বই বাজারে পাওয়া যায় না, তাদের বাড়িতে কার্টুন ভর্তি থাকে, তারা মহান লেখক, মুক্তবুদ্ধি লেখক, কমিটেড লেখক, সত্যসন্ধানী লেখক। তাঁদের বেশিরভাগের ধারণা তাঁরা কালজয় করে ফেলেছেন। এঁরা বাজারি লেখকদের কঠিন আক্রমণ করতে ভালোবাসেন।

তাঁদের আক্রমণে শালীনতা থাকে। তাঁরা সরাসরি কখনো আমার নাম নেন না। তবে বুদ্ধিমান পাঠকরা বুঝে ফেলেন কাকে ধরা হচ্ছে। তাঁদের আক্রমনের নমুনা, 'অন্যপ্রকাশের সামনে জনৈক বাজারি লেখকের বইয়ের জন্য তরুণ-তরুণীর সমাবেশ দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে হয়। এরা সৎ সাহিত্য থেকে বঞ্চিত।

কষ্টকল্পিত উদ্ভট চরিত্রের গালগল্পে বিভ্রান্ত। বাজারি লেখক এবং তার প্রকাশকের অর্থ জোগান দেওয়া ছাড়া এই তরুণ-তরুণীরা আর কিছুই করছে না। ... কালজয়ি এইসব মহান লেখকের সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার দেখা হয়ে যায়। বেশিরভাগ দেখা হয় দেশের বাইরের বইমেলায়। আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তাঁরা বিচলিত বোধ করেন।

কেন করেন তা আমার কাছে স্পষ্ট না। এমন একজনের সাথে কথোপকথনের নমুনা- কালজয়ীঃ কেমন আছেন? আমিঃ জি ভালো। কালজয়ীঃ ইদানীং কিছু কি লিখছেন? আমিঃ একটা সস্তা প্রেমের উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছি। যতটা সস্তা হওয়া দরকার ততটা সস্তা হচ্ছে না বলে অস্বস্তিতে আছি। আপনার দোয়া চাই যেন আরেকটা সস্তা লেখা লিখতে পারি।

কালজয়ীঃ (গম্ভীর) আমিঃ আপনি কি মহান কোন লেখায় হাত দিয়েছেন? কালজয়ীঃ আপনার রসবোধ ভালো। আচ্ছা পড়ে কথা হবে'। ---------------------------- এইবার আসি বাংলা ভাষার তথাকথিত কালজয়ী লেখকদের প্রসঙ্গে। বিদগ্ধ সমালোচক পাঠকদের বিষয়ে পড়ে আসি। ।

বাংলাদেশের বাংলা ভাষার কালজয়ী কথাসাহিত্যিক কারা? উত্তরটা শুনতে আমি ব্যাক্তিগতভাবে খুবই আগ্রহী... কে কিংবা কারা কালজয়ী লেখক? জহির রায়হান? আখতারুজ্জামান ইলিয়াস? আহমদ শরিফ? শহিদুল জহির? রশিদ করিম? হাসান আজিজুল হক? আবদুল মান্নান সৈয়দ? হুমায়ূন আজাদ? সৈয়দ শামসুল হক? আহমদ ছফা? শহিদুল্লাহ কায়সার? ইমদাদুল হক মিলন? আমি জানি না, বিদগ্ধ পাঠকদের প্রিয় কোন কালজয়ী কথা সাহিত্যকের নাম বাদ পড়ে গেল কিনা? যদি বাদ পড়ে যেয়ে থাকে, তাহলে নিজ গুণে আমাকে ক্ষমা করবেন, এবং সেই নামটি আমাকে জানাবেন। এইবার গিলতে কিংবা হজম করতে কষ্ট হবে এমন একটা কথা বলব। উপরের লেখকদের মোটামুটি সকলেরই কম বেশি লেখা পড়ার সুযোগ আমার হয়েছে। কার লেখা কেমন সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার মতো দুঃসাহস আমার নেই। ব্যাক্তিগত মতামত আছে।

সেইসব মতামতও এখানে দিতে চাচ্ছি না। কেবল আহমদ ছফা এবং হুমায়ূন আজাদ নিয়ে দুইটা কথা বলতে চাই। এর কারণ, আজকাল যে সকল বিদগ্ধ পাঠক সস্তা এবং বাজারি লেখক হুমায়ূন আহমেদ কে গালি দেয়াকে ফরজ বলে ধরে নিচ্ছেন, না হলে বাংলা সাহিত্যের মানমর্যাদা সকলি ধুলোয় লুটাবে বলে হাপিত্যেশ করেন, সেই সকল পাঠকরা হুমায়ূন আজাদ এবং আহমদ ছফা'র দৃষ্টিতে হুমায়ূন আহমেদ কে পোর্টরে করার চেষ্টা করেন। হুমায়ূন আহমেদ সম্পর্কে আহমদ ছফা অমুক বলেছেন, হুমায়ূন আজাদ তমুক বলেছেন... এবং তেনারা যেহেতু বলেছেন, তাহলে হুমায়ূন আহমেদ আসলেই তাই। এক্সকিউজ মি, আপনি আমাকে বলেন, হুমায়ূন আজাদের কোন মহান সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি হুমায়ূন আহমেদকে মূল্যায়ন করার ক্ষমতা রাখেন? জাস্ট তার একটা বইয়ের নাম বলেন... ছোট মুখে একটা বড় কথা বলি, সমাজতত্ব, মনস্তত্ব, ভাষা, রাষ্ট্র, রাজনীতি, ধর্ম আর দর্শন এবং এসকল বিষয়ে গুরুগম্ভীর বিশ্লেষণ এবং সুকঠিন বিশেষজ্ঞ মতামত প্রদানই কালজয়ী সাহিত্যের কাজ? কালজয়ী সাহিত্যকদের কাজ? আহমদ ছফার কোন বই পড়ে আপনার মনে হয়েছে, তিনি বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী লেখক? কেন? 'তিনি যখন যাহা বলিবেন, হুমায়ূন আহমেদ তখনই তাহা' কেন? একটু ধৃষ্টতা দেখিয়ে বলি? আহমদ ছফাকে আমার কখনোই সেই মানের সাহিত্যিক মনে হয় নি, যিনি ঢালাওভাবে বাংলা সাহিত্যের যা কারো সম্পর্কে যখন তখন সুনির্দিষ্ট পরিচয়ের পৈতা ঝুলিয়ে দিতে পারেন।

আমি বরং মনে করি, তিনি যতটা না ভালো সাহিত্যিক ছিলেন, তারচেয়ে অনেক বেশি ভালো সংগঠক ছিলেন। কথাটা বিবেচনা করে দেখবেন হে বিদগ্ধ তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার সমালোচক পাঠক মহল। কি গেলেনতো ক্ষেপে? আমার চৌদ্দ গোষ্ঠী নিয়ে গালি গালাজ শুরু হয়ে গেল? সাহিত্যের কি বুঝি আমি? হুমায়ূন আহমেদ ছাড়া আর কি পড়েছি? জ্বী, আপনাদের উন্নাসিকতাটাই এখানে। আপনাদের কথা হচ্ছে, যেই পাঠক হুমায়ূনে বুঁদ হয়ে থাকে তার পক্ষে সত্যিকারের সাহিত্যের রস আস্বাদন করা অসম্ভব! তাইতো। এইবার বলেন সত্যিকারে ধ্রুপদী সাহিত্য কি? কে সেই ধ্রুপদী সাহিত্যিক? সুনীল, শীরসেন্দু, সমরেশ? সউমেন চন্দ, বিভূতিভূষণ, মানিক বন্দোপাধ্যায়, তারাশংকর? (লিখলে অসংখ্য নাম লেখা যাবে) এদের মধ্যে কাউকে পান যিনি আপনার দৃষ্টিতে ধ্রুপদী কালজয়ী কথা সাহিত্যিক? পাচ্ছেন না? নাকি পেয়েছেন? পেয়ে থাকলে শোকর আলহামদুলিল্লাহ।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমি অধম এদের সকলের লেখাই অল্পবিস্তর পড়েছি। তারপরও আমার মনে হয়েছে এবং হচ্ছে, হুমায়ূন আহমেদ বাংলা সাহিত্যের অসীম ক্ষমতাবান একজন লেখক। লেখার অপার্থিব ক্ষমতা নিয়ে তিনি জন্মেছিলেন, এবং সেই ক্ষমতার 'ক্ষমতা' তিনি দেখিয়েছেন। যিনি কালের আবর্তে হারিয়ে যাবেন না, কালজয়ী হয়েই থাকবেন। হারিয়ে যাবেন আপনি কিংবা আমার মতন বিদগ্ধ সমালোচক নাক সিটকানো 'কালজয়ী পাঠক কিংবা সমালোচকরা'।

আচ্ছা, আর আপনারা যারা উপরের কোথাও কালজয়ী কাউকে খুঁজেই পেলেন না তাঁদের জন্য আরও অপশন। আরনেস্ট হেমিংওয়ে, গুন্থার বাহনেমান, এরিখ মারিয়া রেমারক, পলওয়েলম্যান, চার্লস ডিকেন্স, মারকেজ, মার্ক টোয়েন, ষ্টেইনবেক... (আরও কিছু নাম লেখা যায়, ঢোল বেশি পেটানো হয়ে যাচ্ছে, এই পর্যায়ে এসে ফেটে গেলে সমস্যা) বিদগ্ধ সমালোচক মহান পাঠক মহল কি উপরের নামগুলো থেকে একটাও নাম খুঁজে পাচ্ছেন যাকে ধ্রুপদি কালজয়ী সাহিত্যিক মনে হয়? পাচ্ছেন? না পেয়ে থাকলে কিছু বলার নাই। বলতেই হচ্ছে, পাঠক হিসেবে আপনারা অতি উন্নত ভীন গ্রহের, সেখানে ফিরে যাওয়া ছাড়া আপনাদের সাহিত্য তৃষ্ণা মেটানোর আর কোন উপায় নেই, হে কালজয়ী পাঠক মহল। আর ধ্রুপদী কাউকে যদি ওখান থেকে পেয়ে থাকেন তাহলে অতি বিনয়ের সাথে বলছি, জনাব, উনাদের সকলেরই অল্পবিস্তর লেখা পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে... তারপরও পাঠক হিসেবে আমি অতি সস্তা, অতি বাজারি, কারণ বাজারি এবং সস্তা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বই বলে তারপরও আমি হাভাতের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ি। একই বই বারবার পড়ি।

তারপরও আমার অনুভুতির জগতকে এই সস্তা লেখকের বাজারি বই আচ্ছন্ন করে রেখছে... আপনাদের দুর্ভাগ্য, হুমায়ূন আহমেদ কে আপনারা আর কি কি বলে নাকচ করবেন? উপেক্ষা করবেন? গালিগালাজ করবেন? সেসব তিনি নিজের সম্পর্কে নিজেই বলে গেছেন। তিনি বলে গেছেন, তিনি পাঠ্যবই রচনা করেন নি। তার বইতে শিক্ষণীয় কিছু খুঁজতে মানা করে গেছেন। তিনি কারো মনোরঞ্জন করতে লেখেন নি। তিনি লিখেছেন নিজের আনন্দের জন্য।

আপনাদের কালজয়ী লেখকরা কালজয়ী, কারণ তেনাদের লেখায় মনস্তত্ত্ব, সমাজতত্ব, রাষ্ট্রতত্ত্ব, ধর্ম, দর্শন সর্বোপরি বিশেষ 'মেসেজ' থাকে, শিক্ষণীয় উপকরণ থাকে... তাইতো? এই সস্তা পাঠক মনে করেন, হুমায়ূন আহমেদ নামক বাজারি লেখকের লেখা সকলকে প্রভুত আনন্দ দিয়েছে, অনুভূতিকে ছুঁয়ে দিতে পেরেছে গভীরতম গভীরতায়। আনন্দ কিংবা কান্নায়। তিনি কারো মনরঞ্জনের জন্য সাহিত্য রচনা করেন নি। লিখেছেন নিজের আনন্দে। যেহেতু এতো কিছুর পরও আমি হুমায়ূন আহমেদ এর মাতাল পাঠক, সেহেতু আপনাদের মতন বিদগ্ধ বিশেষজ্ঞ পাঠকদের কাছে নিশ্চয়ই আমি একজন সস্তা পাঠক।

সেই বাজারি লেখকের বাজারি সাহিত্যের সস্তা পাঠক হিসেবে একটা সস্তা কথা বলি? - 'সাহিত্যের উদ্দেশ্য সকলকে আনন্দ দেওয়া, কারও মনোরঞ্জন করা নয়'। ** এবং 'কারও মনোরঞ্জন করাও সাহিত্যের কাজ নয়, কাউকে শিক্ষা দেওয়াও নয়। সাহিত্য ছেলের হাতের মোয়াও নয়, গুরু হাতের বেতও নয়'। ** আপনারা আসলে চাচ্ছেন, সাহিত্য রচিত হোক কেবল মাত্র আঁতেল এবং বোদ্ধা শ্রেণীর মনোরঞ্জনের জন্য, কিংবা জ্ঞানতাত্ত্বিক দর্শন চর্চা ও শিক্ষণীয় মেসেজ প্রদানের জন্য। এটি আসলে আধিপত্যবাদি হেজেমনিক প্রক্রিয়ায় একধনের ডিসকোর্স তৈরির চেষ্টা ছাড়া আর কিছু না।

বিঃদ্রঃ উপরের স্টার (**) চিহ্নিত উদ্ধৃতি দুটো আমার মতো সস্তা বাজারি পাঠকের নয়। উহা প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধ থেকে নেয়া। কিঞ্চিত আশংকায় আছি, আপনাদের বিদগ্ধ মননশীলতায় এখন প্রমথ চৌধুরীও না আবার 'সস্তা' হয়ে যান! সরি প্রমথ চৌধুরী, মাফ করবেন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.