মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল!
কয়েকটি গণ-অভ্যুত্থান - ১
-------------------------- ডঃ রমিত আজাদ
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মুক্তিকামী নিপীড়িত জনগণ রাজপথে নেমে আসে, সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক জনতার সন্মিলিত প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগে হটে যায় স্বৈরাচারী শাসক, শাসন ক্ষমতায় বসেন নিপীড়িত জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি, একেই বলে গণ-অভ্যুত্থান। মানবজাতির পথ চলার দীর্ঘ ইতিহাসে এই জাতীয় গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে বহুবার। এরকম কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গণ-অভ্যুত্থান স্থান পাবে আমার এই প্রবন্ধে। (পাঠকদের গঠনমূলক সমালোচনা আশা করছি)
ইরাকের গণ-অভ্যুত্থান
১৯৫৮ সালের ১৪ই জুলাই ইরাকে সংঘটিত হয় একটি গণবিপ্লব বা ক্যু দে'তাত। এই বিপ্লবের ফলে ১৯২১ সালে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের তত্বাবধায়ন ও অভিভাবকত্বে বাদশাহ্ দ্বিতীয় ফয়সাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হাসেমীয় রাজতন্ত্রের উৎখাত হয়।
অভ্যুত্থানের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিলো ব্রিটিশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী শৃঙ্খল থেকে ইরাক-কে মুক্ত করা। পশ্চিমা শক্তিগুলো ইরাকের জাতীয় রাজনীতি, সংস্কার, আঞ্চলিক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক নীতি থেকে শুরু করে সবগুলো সেক্টরেই আধিপত্য করতো। ইঙ্গ-মার্কিন এই উপস্থিতি ও নিয়ন্ত্রনে ইরাকের সাধারণ জনগণের মধ্যে ছিলো ব্যাপক অসন্তোষ। ইরাকের তৎকালীন রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা হাসেমাইট রাজবংশ ইরাককে ঐ সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের হাত থেকে মুক্ত করতে পারেনি বরং তাদেরই তাবেদারী করতো ।
ইরাকের সেনা বাহিনীতে ইতিপূর্বেই দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাদের একটি গোপন দল জেনারেল আব্দ-আল-করিম-কাসিম-এর নেতৃত্বে কাজ করে আসছিলো।
১৯৫৮ সালের ১৪ই জুলাই, এই দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা-রা, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পুতুল রাজতন্ত্র-কে উৎখাৎ করতে সমর্থ হয়। এই অভ্যুত্থানে বাদশাহ্ দ্বিতীয় ফয়সাল, ক্রাউন প্রিন্স আব্দ-আল-ইলাহ, এবং নুরি-আল-সাইদ নিহত হয়।
ইরাকের এই মুক্ত সেনা কর্মকর্তারা (free officers) মিশরের মুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের কার্যকলাপ দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলো। মিশরের মুক্ত সেনা কর্মকর্তারা ১৯৫২ সালে মিশরীয় রাজতন্ত্রকে উৎক্ষাত করেছিলো। সেখান থেকেই মডেল নিয়ে তাদের অনুকরণেই ইরাকী মুক্ত সেনা কর্মকর্তারা কাজ করেছিলো।
তাদের নেতা জেনারেল কাসিম মিশরে যেই জেনারেশনটি বিপ্লব সাধন করে রাজতন্ত্রকে উৎক্ষাত করেছিলো তাদেরই সমসাময়িক ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ইজরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মিশরীয় সেনা কর্মকর্তারা অনুধাবন করতে সমর্থ হন যে, দেশ ও জাতির প্রতি তাদের কি দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। তারা বুঝতে পারেন যে, বর্তমান দুর্নীতিপরায়ন শাসকচক্র জাতিকে দুর্বল করে রেখেছে ও জনগণকে দুঃখ-দুর্দশায় নিপতিত করেছে। দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা হিসাবে তাদের দায়িত্ব কোন ব্যক্তিবিশেষ বা রাজপরিবারের সেবা নয় বরং দেশ ও জাতির সেবা করা। তাই তারা জামাল আবদুল নাসেরের নেতৃত্বে রাজতন্ত্রকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ক্ষমতা গ্রহন করে ও একটি দুর্নীতিমুক্ত সরকার গঠন করার প্রয়াস চালায়।
ফলে পুরো আরব বিশ্বে জামাল আবদুল নাসের ও তার বিপ্লব একটি রোল মডেল হিসাবে গৃহিত হয়। ইরাকী অফিসারগণ এই ঘটনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইরাকে আরব জাতীয়তাবাদী সমর্থকদের উপস্থিতি ক্রমবর্ধমান হতে থাকে। আরব জাতীয়তাবাদীরা চাইছিলো ইরাক থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের প্রভাব মুছে ফেলতে। এই ধরণের সেন্টিমেন্ট গড়ে ওঠার পিছনে মূল কারণ ছিলো দুটি, ক) শিক্ষা পদ্ধতিতে রাজনীতিকরণ, খ) একটি শিক্ষিত ও দৃঢ়চেতা ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণী।
আরব জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলার জন্য বিদ্যালয়গুলো সূতিকাগার হিসাবে কাজ করে। জাতীয়তাবাদী চেতনা সৃষ্টিকারী শিক্ষা ব্যবস্থায় নির্মাতা হিসাবে অবদান রাখেন সামী শওকাত ও ফাধিল-আল-জামাল নামে দুজন শিক্ষক। তাঁরা দুজন ছিলেন প্যালেস্টাইন ও ইরাক থেকে পালিয়ে আসা দুজন রিফুজী। এন্টি-বৃটিশ ও এন্টি-ফ্রেঞ্চ মনোভাব প্রদর্শন করার জন্য তারা নির্বাসিত হন। তাদের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা ইরাকি ছাত্র-ছাত্রীদের জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্ধুদ্ধ করতে সমর্থ হয়।
আন্দোলনের দুজন নেতা কর্নেল আব্দুল সালাম আরিফ এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল করিম কাসিম যথাক্রমে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ২০ ও ১৯ ব্রিগেড। কর্নেল আরিফ কর্নেল আব্দ আল লতিফ আল দাররাজি-র সহযোগিতায় ২০ ব্রিগেডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বাগদাদ অভিমুখে মার্চ করেন। এসময় জেনারেল কাসিম ১৯ ব্রিগেড নিয়ে জালাওলায় তৈরী ছিলেন।
১৪ ই জুলাই ১৯৫৮-এ খুব ভোরে কর্নেল আরিফ বাগদাদ রেডিও স্টেশন নিয়ন্ত্রনে নেন, অল্পক্ষণ পরে সেটাই ইরাকের হেডকোয়ার্টার-এ পরিণত হয়। সেখান থেকে বিপ্লবের ঘোষণা দেয়া হয়।
আরিফ সাম্রাজ্যবাদের নিন্দা করেন এবং পুরাতন শাসন ব্যবস্থা উৎখাত করে ইরাককে রিপাবলিক ঘোষণা করেন। তিনি তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি কাউন্সিল ঘোষণা করেন যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে । এবং তিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হবার প্রতিশ্রুতি দেন।
১৯৫৮ সালের ইরাকের এই বিপ্লবটিতে দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তারা মূল ভূমিকা পালন করলেও তারা মূলতঃ জনগণের আশা-আকাঙ্খারই প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। ইরাক তেলসমৃদ্ধ একটি রাষ্ট্র।
সেইসময়ে ইরাকের তেলক্ষেত্রসমূহ সম্পূর্ণভাবে মার্কিন, ব্রিটিশ ও অন্যান্য দেশের কোম্পানির মালিকানায় ছিল। যেটা ইরাকের জনগণের জন্য কোনক্রমেই মঙ্গলজনক ছিলনা। তদুপরী, মধ্যপ্রাচ্যের কোনো কোনো দেশে তেল আছে কিন্তু জল নেই। আবার কারও কারও জল আছে কিন্তু তেল নেই। ইরাক হলো একমাত্র দেশ যার উভয় সম্পদই বিপুল পরিমাণে আছে, এবং সঙ্গে আছে কৃষির একটি ভালো ভিত্তি।
ফলে ১৪ ই জুলাই ১৯৫৮-এ বাগদাদ রেডিও স্টেশন থেকে বিপ্লবের ঘোষণা আসার সাথে সাথেই আপামর জনসাধারণ পথে নেমে আসে, এবং বিপ্লবের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে।
সাম্রাজ্যবাদের পদলেহনকারী দুর্নীতিপরায়ন পুতুল সরকারের উৎখাত জনগণকে স্বপ্ন দেখাতে শুরু করে নতুন একটি সৎ, নিষ্ঠাবান ও সর্বপোরি জনপ্রতিনিধিত্বকারী দেশপ্রেমিক সরকারের। যারা দক্ষ হাতে গড়ে তুলবে এমন একটি দেশ যা বিদেশী শক্তির ক্রীড়ানক হয়ে থাকবে না বরং রূপ নেবে একটি সত্যিকারের জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।