মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল!
কয়েকটি গণ-অভ্যুত্থান - ২
-------------------------- ডঃ রমিত আজাদ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর থেকে)
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মুক্তিকামী নিপীড়িত জনগণ রাজপথে নেমে আসে, সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক জনতার সন্মিলিত প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগে হটে যায় স্বৈরাচারী শাসক, শাসন ক্ষমতায় বসেন নিপীড়িত জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি, একেই বলে গণ-অভ্যুত্থান। মানবজাতির পথ চলার দীর্ঘ ইতিহাসে এই জাতীয় গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে বহুবার। এরকম কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গণ-অভ্যুত্থান স্থান পাবে আমার এই প্রবন্ধে। (পাঠকদের গঠনমূলক সমালোচনা আশা করছি)
মিশরের গণ-অভ্যুত্থান (১৯৫২)
পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতাগুলোর মধ্যে একটি হলো মিশরীয় সভ্যতা। স্কুলের সিলেবাসে মিশরীয় সভ্যতা পাঠ্য নেই এমন কোন দেশ বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
এই দেশের মমি ও পিরামিড মুর্ত অর্থেই কেবল দূর থেকে দেখা যায়না, বিমূর্ত অর্থেও তা সত্য। তাই দেশ জয়ের নেশাগ্রস্ত জুলিয়াস সিজার থেকে শুরু করে নেপোলিয়ন পর্যন্ত সকলেই অভিযান চালিয়েছিলো ঐ দেশে। সাম্রাজ্যবাদীদের দৃষ্টি সম্ভবত ঐ দেশ থেকে কখনোই সরে আসবে না।
এই দেশটি হযরত ইব্রাহিমের (আ.) এর পদধুলি দ্বারা পবিত্র হযেছে। এ দেশেই মুসা (আ.)-এর জন্ম।
এখানেই সংরক্ষিত আছে ফেরাউনের লাশ। যে নীল নদ মিশরীয় সভ্যতার প্রাণশক্তি সেই নীল নদের বুকে একটি বাক্সে ভাসতে ভাসতে ফেরাউনের প্রাসাদে আশ্রয় পেয়েছিলেন তার (ফেরাউনের) পরম শত্রু শিশু মুসা (আ। আবার এই নীল নদের পানি দ্বিখন্ডিত হয়ে প্রশস্ত রাস্তা তৈরি হওয়ার পর তা দিয়ে পার হয়ে গেলেন মুসা (আ। আর ফেরাউন মুসা নবীকে পাকড়াও করতে ওই পথ দিয়ে ধাওয়া করতে গিয়ে তার দলবল নিয়ে পানিতে ডুবে মুত্যুবরণ করে।
এরকম ইতিহসের একটি দেশ- যেখানে খোদাদ্রোহিতা ও আল্লাহর নির্দেশিত পুন্যতার পথের লড়াই ছিল সব সময়।
এ দেশে ইসলামের আগমনের আগ পর্যন্তু শত শত বছর ধরে ফারাহ রাজবংশ থেকে শুরু করে অনেক রাজবংশ শাসন করেছে। এমন কি মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বহু বিজিতরা বার বার এ দেশ দখল করেছে। কখনো রোমানরা এসেছে। কখনো গ্রিস থেকে এসে আলেকজান্ডার দখল করেছে । আলেকজান্ডারের নাম অনুসারেই বর্তমান আলেকজান্দ্রিয়ার নামকরণ হয়েছে।
পারস্য শাসকরাও দখল নিয়েছিল মিশরের, আবার ফ্রান্স থেকে নেপোলিয়ান আগমন করে ফরাসি উপনিবেশ বানিয়েছে। ব্রিটিশরাও নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল। মুসলিম শাসনামলে আবার কখনো আব্বাসী, ফাতেমী, গাজী সালাহ উদ্দীনের আয়ুবী বংশ ও উসমানীয় সাম্রাজ্যের শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, রহস্যময় সভ্যতার এ দেশটি বিশাল কয়েকটি অধ্যয়ে তিনহাজার বছর ধরে শাসিত হয়েছে কিং ফারাহদের দ্বারা। ফারাহ আমলের মূল বৈশিষ্ট ছিল দেব-দেবী ও পিরামিড সংস্কৃতি।
এরপর দিগবিজয়ী আলেকজান্ডার আগমন করেন মিশরে। এ সময়ে মিশরীয় সমাজে গ্রিক সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব পড়ে। কিন্তু আলেকজান্ডার ব্যাবিলনে মৃত্যুবরণ করলে তার জেনারেলরা হতাশ হয়ে। পড়ে এ অবস্থায় আলেকজান্ডারের ঘনিষ্ঠ অনুচর টলেমিকে শাসন ক্ষমতা দেয়া হয়। টলেমির শেষ বংশধর ছিলেন ক্লিওপেট্রা।
জুলিয়াস সিজার অভিযান চালালে মিশর চলে যায় রোমানদের হাতে। রোমানরা শুরুতে প্যগান থাকলেও পরে খ্রীস্টান ধর্ম গ্রহন করে। প্রথম শতাব্দিতে রোমানদের শাসানামলেই তারা খ্রীষ্টান ধর্মে দিক্ষীত হয়। আলেকজান্ডারের আগে বেশ কয়েকবার কিছু সময়ের জন্য মিশর চলে গিয়েছিল লিবিয়ান, নুবিয়ান ও আসিরিয়ানদের হাতে । মোদ্দা কথা নীল নদের পলি মাটিতে সমৃদ্ধ মিশরের জনপদ বহু বিদেশী শক্তিকে প্রলুব্ধ করেছে।
ফলে বার বার এ দেশ দখল হয়েছে।
দেশটির ধর্মবিশ্বাস পরিবর্তিত হয়েছে একাধিকবার সেই ফেরাউনের প্যাগানিজম থেকে শুরু করে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে প্রথম শতাব্দিতে তারা খ্রীষ্টান ধর্মে দিক্ষীত হয়। সপ্তম শতকে মিশর মূলতঃ রোমান প্রভাবে ছিলো। অবশেষে ৬৪০ খ্রিষ্টাব্দে আমর ইবনুল আস (রাঃ) এর নেতৃত্বে মাত্র চার হাজার মুজাহিদ বিশাল রোমক বাহিনীকে পরাজিত করে মিসরে ইসলামের দাওয়াত পেীছানোর পর থেকে এখনও পর্যন্ত মিসর মুসলিম সভ্যতার অন্যতম নির্দশন হিসেবে বিবেচিত। গাজী সালাউদ্দিন এর স্মৃতি বিজরিত মিসর থেকে জন্ম নিয়েছেন অসংখ্য মুসলিম বীর, আলেম,বিজ্ঞানী।
এর পর নবম শতাব্দী থেকে পর্যায়ক্রমে ফাতেমী, আব্বাসীয় ও তুর্কী মামলুক শাসন একাদশ শতাব্দী পর্যন্তু অব্যাহত থাকে। ফাতেমীরাই ৯৭০ খ্রিস্টাব্দে কায়রোতে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে । ফাতেমী খেলাফতের নিয়ন্ত্রণ মক্কা ও মদিনা পর্যন্তু বিস্তৃত ছিল। এর একশ’ বছর পর তখনকার মুসলিম বিশ্বের মহাবীর গাজী সালাহ উদ্দীন ১১৭১ খ্রিস্টাব্দে মিশর থেকে দামেস্ক পর্যন্তু দখল করে নেন। ১১৫০ খ্রিস্টাব্দে গাজী সালাউদ্দীন বংশের শেষ সুলতান প্রাসাদের মামলুক ভৃত্যের হাতে নিহত হলে একজন মাসলুক জেনারেল ক্ষমতা দখল করে নেন।
মধ্য এশিয়া থেকে আগত এই মামলূকরা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হিসাবে পরিচিত ছিল। নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্যে দিয়ে তারা ৩শ’ বছর মিশর শাসন করে। এর পর ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে মামলুকদের স্বদেশীয় তুরস্কের উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান সেলিম কায়রো দখল করে নেন এবং শেষ মামলুক সুলতানকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন। মামলুক সুলতানরা কায়রোতে চমৎকার সব মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এ ছাড়া তারা কায়রো ও দামেস্কের মধ্যে কবুতরের মাধ্যমে ডাক চলাচলের ব্যবস্থা করেছিলেন।
ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্তু অটোমান সুলতানদের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল মিশরে। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীতে সুলতানদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দেয়। এই সুযোগে মামলুকরা আবার মাথা চাড়া দিযে ওঠে। অষ্টদশ শতকে কায়রোর অটোমান গভর্নর নাম মাত্র গভর্নরে পরিণত হন। ক্ষমতা চলে যায় মামলুকদের হাতে।
এই পরিস্থিতিতে ফ্রান্সের নেপোলিয়ন দেশ জয়ের নেশায় অভিযান চালায় । তিনি দ্রুত মামলুকদের পরাভূত করে মিশরকে কবজা করে ফেলেন ১৭৯৮ সালে। এ পরিস্থিতিতে তুরস্ক মিশর অভিমুখে অভিযান চালালে তা ব্যর্থ করে দেন নেপোলিয়ন । ফলে মিশর ফ্রান্সের উপনিবেশে পরিণত হয় ।
কিন্তু নেপোলিয়ন বেশিদিন আগ্রহ ধরে রাখতে পারেননি।
তিনি মিশর ত্যাগ করেন। রেখে যান ফরাসি সৈন্য । এই সুযোগে মামলুকরা আবার অতীত অবস্থানে ফিরে যায় । ইতোমধ্যে ব্রিটেন তুরস্কের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ১৮০১ সালে মিশর আক্রমণ করে এবং ফরাসি সৈন্যদের বিতাড়িত করে। তারা মামলুকদের শায়েস্তা করতে কঠোর পন্থা অবলম্বন শুরু করে।
১৮০৫ সালে নবনিযুক্ত গভর্নর মোহম্মদ আলী পাশা মামলুক নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে একটি দুর্গে জড়ো করে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। তাদের সংখ্যা ছিল ৭ শ’ থেকে ৮ শ’ জন। আর সেই সঙ্গে শেষ হয়ে যায় মামলুকদের আধিপত্য। মোহাম্মাদ আলী পাশা তার সুযোগ্য জ্যেষ্ঠ পুত্র ইব্রাহিম পাশাকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষ শাসন ব্যবস্থা কয়েম করেন। এক পর্যায়ে উসমানীয় সুলতানকে উপেক্ষা করে মোহাম্মদ আলী পাশা নিজস্ব রাজ কায়েম করেন।
তার রাজ বংশের শেষ শাসক ছিলেন কিং ফারুক।
মোহম্মাদ আলীর পৌত্র ইসমাইলের সময় ফরাসি কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় ভূমধ্য ও লোহিত সাগর সংযোগকারী সুয়েজ খাল খনন করা হয়। ১৮৬৯ সালে খনন কাজ শেষ হয়। সুয়েজ খাল চালু হয়ে এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে নৌ দুরত্ব কমিয়ে দেয় অনেকখানি, যা ইউরোপিয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিকে তাদের এশিয়ার উপনিবেশগুলি থেকে সম্পদ লুট ও নিয়ন্ত্রন করা সহজ করে তোলে। এই খনন কাজের কারণে মিশরের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ে।
জনগণের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। এরই সুযোগ গ্রহণ করে ১৮৭৫ সালে ব্রিটেন বাধ্য করে মিশরের শেয়ার তার কাছে বিক্রয় করতে। এর ফলে ব্রিটেন মিশরের অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ লাভ করে। । ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মিসর সরাসরি বৃটিশ নিয়ন্ত্রনে চলে যায়।
তবে নামমাত্র সুলতানের পদ বজায় থাকে।
কার্যত, সরকারের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ব্রিটিশদের হাতে। মিশরীয় জনগণ এটা মেনে নিতে পারেনি। ফলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। এক পর্যায়ে আহমদ উরাবীর নেতৃত্বে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
এ সরকার পার্লামেন্টের মাধ্যমে বাজেট পেশ ও বাস্তবায়নের উদ্দ্যোগ নিলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে ১৮৮২ সালে সামরিক হস্তক্ষেপ করে এবং মিশরীয় সেনাবহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এ যুদ্ধে মিশরীয় সেনাবাহিনী পরাজিত হয় এবং ব্রিটেন ইসমাইলকে নামমাত্র রাষ্ট্র প্রধান করে ব্রিটিশ শাসন সূচনা করে।
কিন্তু ১৯০৬ সালে আবার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। পরিস্থিতি বেকায়দা দেখে একটা নির্বাচন দেয়া হয়। সে নির্বাচনে সাদ জগলুলের নেতৃত্বে গঠিত ওফাদা পার্টি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলে তাকে সরকার প্রধান করা হয়।
কিন্তু ব্রিটেনের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ১৯১৯ সালে সাদ জগলুলকে মাল্টাতে নির্বাসনে পাঠানো হয়। এর পরই শুরু হয়ে যায় বিদ্রোহ । এটা মিশরের ইতিহাসে ‘আধুনিক বিপ্লব’ হিসাবে বিবেচিত। পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠলে ব্রিটেন বাধ্য হয়ে ১৯২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মিশরের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। স্বাধীনতা ঘোষণা করার পরেও শুধু প্রভাবই নয় ব্রিটিশ সৈন্যও মিশরের মাটিতে থেকে যায়।
স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠিত সরকার নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি প্রবর্তন করে।
কিন্তু ব্রিটেনের পুতুল রাজা ফারুক রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার শুরু করলে আবার অস্থিরতা বৃদ্ধি পায়। জেনারেল মুহাম্মদ নগিব ও কর্নেল গামাল আব্দুল নাসেরের নেতৃত্বে গঠিত ‘ফ্রি অফিসার্স নামে একদল দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা মিসরের রাজতন্ত্র উচ্ছেদ এবং পুর্ন স্বাধিনতার জন্য সংগ্রামের প্রস্তুতি নেন। তাদের মুভমেন্ট কিং ফারুককে পার্লামেন্ট বাতিল করতে বাধ্য করে। কিং ফারুককে পাঠানো হয় নির্বাসনে।
এভাবে একদল দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় ব্যপক গণ-অভ্যুত্থানের তোড়ে ভেসে যায় দুর্নীতিপরায়ন সরকার মিশরের রাজতন্ত্র।
১৯৩৯ সালে শুরু হয় দ্বিতিয় মহাযুদ্ধ। মিসর দ্বিতিয় মহাযুদ্ধের কয়েকটি ভয়ংকর যুদ্ধের ক্ষেত্র। যুদ্ধের প্রয়োজনে বৃটিস সরকার মিসরের একটি সশস্ত্র বাহিনী গঠন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু এই সশন্ত্র বাহিনীর সদস্যরা অনেকেই হয়ে উঠেন জাতিয়তাবোধে উদ্ভুদ্ধ।
এর আগে ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইখওয়ান আল মুসলিমিন বা মুসলিম ব্রাদারহূড। ইসলামি আদর্শে জাতিয়তাবোধ ও স্বাধিনতার সংগ্রামে উদ্ভুদ্ধ তরুনরা জড়ো হয় ইখওয়ান আল মুসলিমিনে। এদিকে সেনাবাহিনীতে কর্মরত একদল অফিসার যারা নিজেদেরকে ফ্রি অফিসার্স নামে অভিহিত করতেন তারা মিসরের রাজতন্ত্র উচ্ছেদ এবং পুর্ন স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের প্রস্তুতি নেন। ১৯৫৩ সালে ফ্রি অফিসার রা জেনারেল মুহাম্মদ নগিবের নেতৃত্বে মিশরের পুর্ন স্বাধীনতা ঘোষনা করে এবং মিসরের শেষ রাজা ফারুককে নির্বাসন দেয়।
কেন এবং কি কারণে ঘটেছিলো এই গণ-অভ্যুত্থান?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দুটি বৃহৎ শক্তিই এই প্রচারণা চালাতে থাকে যে, দুর্নীতিপরায়ন ও বৃটিশের তাবেদার।
মিশরের রাজবংশীয় ও অভিজাত শ্রেণী বিলাসবহুল জীবন যাপন করছে আর তাদেরই সেবক ও রক্ষক সেনা কর্মকর্তারা যাপন করছে অতি সাধারণ বা প্রায় দরিদ্র জীবন। বিষয়টি জনগণ ও সৈনিকরা আগে থেকেই অনুধাবন করছিলো, তার উপর দুই বৃহৎ শক্তির এই প্রচারনা জনমনে ব্যপক প্রভাব ফেলে।
আরেকটি বড় কারণ ছিলো ১৯৪৮ সালের মিশর-ইজরায়েল যুদ্ধে মিশরের পরাজয়। প্তি মুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সৈনিক ও সেনা কর্মকর্তারা মাতৃভূমী রক্ষার জন্য প্রাণপন যুদ্ধ করে যাওয়ার পরও অসম্মানজনক পরাজয় তাদের মনে গভীর ছাপ ফেলে। ফ্রী অফিসার-রা ভাবতে শুরু করেন যে, বাদশাহ্ ফারুক ও তার সভার দুর্নীতিই এই পরাজয়ের মূল কারণ ছিলো।
১৯৪৮ সালের মে মাসে রাজা প্রথম ফারুক মিশরীয় বাহিনীকে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে ফিলিস্তিনে প্রেরণ করেন, যে বাহিনীতে ৬ষ্ঠ পদাতিক ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন কর্নেল গামাল আবদুল নাসের। নাসের এই যুদ্ধে মিশরীয় বাহিনীর অপ্রস্তুত অবস্থার কথা লিখেছিলেন। নাসেরের নেতৃত্বাধীন বাহিনী ফালুযা পকেট নামক একটি এলাকা অধিকারে আনতে সক্ষম হয়। অধিকারের পরপরই ঐ বছরের আগস্ট মাসে ইসরায়েলি বাহিনী নাসেরের বাহিনীকে ঘিরে ফেলে। (পরে ইসরায়েল ঐ এলাকার দখল লাভ করেছিল ঠিকই কিন্তু সেটি হয়েছিল আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে, নাসের পুরো সময়ে কখনই ইসরায়েলের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি।
)
এই সকল অসন্তোষ থেকে একদল দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তা ভাবতে শুরু করলেন যে, সৈনিক হিসাবে তাদের দায়িত্ব দেশ ও জাতির সেবা করা কোন ব্যক্তিবিশেষ বা রাজ পরিবারের সেবা করা নয়। তাই দেশপ্রেম ও জাতিয়তাবাদী চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে তারা গঠন করে গুপ্ত সংগঠন ফ্রী অফিসারস্। এর নেতৃত্বে ছিলেন জেনারেল নাগিব ও কর্নেল নাসের। তরুণ কর্নেল নাসেরের চারদিকে ভীড় জমাতে থাকে সমমনা সেনা কর্মকর্তারা। আবার নাগিবের মত একজন জেনারেলের উপস্থিতি আরও অধিক সেনা কর্মকর্তাদের আকৃষ্ট করে।
এদিকে দেশেও ব্যপক অরাজকতা শুরু হলে ফ্রী অফিসাররা ১৯৫২ সালের ৫ই আগস্ট একটি অভ্যুত্থানের দুর্নীতিপরায়ন ও বৃটিশের তাবেদার কিং ফারুককে ক্ষমতাচ্যুত করার পরিকল্পনা করেন। ইতিমধ্যে জেনারেল নাগিব গোপন সুত্রে খবর পেয়ে ১৯শে জুলাই ফ্রী অফিসারদের জানিয়ে দেন যে, কিং ফারুক এই সংস্কারপন্থী বিদ্রোহী অফিসারদের তালিকা পেয়ে গেছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই সংবাদ পেয়ে অভ্যুত্থানকারী নেতারা অভ্যুত্থানের তারিখ এগিয়ে আনার সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। এবং তারা ফ্রী অফিসারদের একজন সদস্য খালেদ মহিউদ্দিনের বাসায় অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন এবং ২২শে জুলাই এই তারিখ নির্ধারন করেন।
তারা ২২শে জুলাই রাতে অভ্যুত্থান শুরু করেন।
এসময় খালেদ মহিউদ্দিন নিজ বাসভবনে ছিলেন ও আনোয়ার সাদাত (পরবর্তিতে মিশরের রাষ্ট্রপতি) সিনেমা দেখতে যান। ইতিমধ্যে জামাল আবদুল নাসের মুসলিম ব্রাদারহুড ও মিশরের ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট ফর ন্যাশনাল লিবারেশন-এর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করতে শুরু করেন তাদের রাজনৈতিক সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে। ২৩শে জুলাই সকালে নাসের এবং আবদুল হাকিম খালেদ মহিউদ্দিনের বাসভবন ত্যাগ করেন বেসামরিক পোষাকে। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো কিং-কে সমর্থনকারী কমান্ডারদেরকে ব্যারাকে পৌছানোর আগেই গ্রেফতার করা । তা নইলে তারা ব্যরাকে পৌঁছে সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে।
তারা কায়রোর এল-কোবা ব্রীজের কাছে পৌছালে ইউসুফ সাদিকের নেতৃত্বাধীন একটি আর্টিলারি ইউনিটের সাথে দেখা হয়। তারা সেনা সদরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে রয়ালিস্ট কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করার জন্য ঐদিকেই এগুচ্ছিলো। কিছুক্ষণ পর তারা সেনা সদরে অবস্থানকারী সেনা প্রধান ও অন্যান্য রয়ালিস্ট অফোসারদের গ্রেফতার করে। সকাল ছয়টার দিকে ফ্রী অফিসারদের এয়ারফোর্স ইউনিটের বিমান কায়রোর আকাশে চক্কর দিতে শুরু করে।
সকাল ৭ টা ৩০ মিনিটে, মিশরের জনগণ জাতীয় রেডিও মারফত শুনতে পেলো একটি কন্ঠস্বর, যেখানে বলা হচ্ছিলো যে, জেনারেল নাগিবের নেতৃত্বে বিপ্লব সাধিত হয়েছে।
এই বিপ্লব মিশরের জনগণকে দুর্নীতিপরায়ন সরকার আর বিদেশী প্রভাব মুক্ত করার বিপ্লব। সমগ্র মিশরের জনগণ বিপ্লবের ঘোষণাকারী যার কন্ঠস্বর শুনছিলেন তিনি ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক ফ্রী অফিসার আনোয়ার সাদাত। এই আনোয়ার সাদাতই পরবর্তিকালে মিশরের রাষ্ট্রপতি হন। এই অভ্যুত্থান বা বিপ্লবে একশত জনের কম অফিসার অফিসার অংশগ্রহন করেন। এবং প্রায় সবাইই ছিলেন জুনিয়র অফিসার।
কিছুক্ষণ পর মিশরের উল্লসিত লক্ষ লক্ষ জনগণ রাজপথে নেমে আসে। দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাদের ইনিশিয়েট করা এই অভ্যুত্থান রূপ নেয় গন-অভ্যুত্থানে। এরপর, জনতার রোষ সামাল দেবে সেই শক্তি আছে কোন বাদশাহের?
বিপ্লবের ঘোষণায় সাদাত বলেছিলেন:
সম্প্রতি মিশর এক সংকটময় সময়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে যা হলো ঘুষ, দুর্নিতি, অপকর্ম, এবং অস্থিতিশীলতা। এই সব কিছু সেনাবাহিনীতে ব্যপক প্রভাব ফেলে। একদল দেশপ্রেমহীন মানুষের ঘুষ-দুর্নীতির কারণে আমরা ১৯৪৮ সালের যুদ্ধে ইজরায়েলের কাছে পরাজিত হয়েছি।
যুদ্ধ পরবর্তিকালে অপকর্মকারীরা একে অপরকে সহযোগীতা করেছে এবং বিশ্বাসঘাতকরা আর্মি কমান্ড করতে শুরু করেছে। তারা এমন একজনকে প্রধান করেছে যিনি হয় অজ্ঞ অথবা দুর্নীতিপরায়ন। এভাবে মিশর এমন একটা বিন্দুতে উপনীত হয়েছে যে, তাকে রক্ষা করার মতো কোন সেনাবাহিনী নেই। এই কারণে আমরা সেই দায়িত্ব নিজ কাধে তুলে নিলাম যে, সেনাবাহিনীকে বিশুদ্ধ করবো ও কমান্ডের দায়িত্ব এমন ব্যক্তিদের দেবো যারা দক্ষ, সচ্চরিত্র, দেশপ্রেমিক ও যাদের বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে। আমরা নিশ্চিত যে প্রতিটি মিশরীয় আমাদের স্বাগত জানাবে।
আমরা যে সকল সেনা কমান্ডারদের গ্রেফতার করবো তাদের প্রতি রুক্ষ হবোনা, তবে তাদেরকে স্ব স্ব পদ থেকে অব্যহতি দেয়া হবে। আমি মিশরের জনগণকে এই নিশ্চয়তা দিতে চাই যে, আজ মিশরের সেনাবাহিনী যেকোন ব্যক্তি স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে সাংবিধানিকভাবে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় সক্ষম। আমি মিশরের জনগণকে অনুরোধ করবো যে, ধ্বংস ও সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী কোন বিশ্বাসঘাতককে বাড়ীতে আশ্রয় দেবেন না। কারণ এটা মিশরের জন্য মঙ্গলজনক হবেনা। সেনাবাহিনী ও পুলিশ জনগণের দায়িত্ব গ্রহন করবে।
আমি বিদেশী ভাইদের তাদের জান-মালের নিরাপত্তার আশ্বাস দিচ্ছি। মহান আল্লাহ্ই সকল সাফল্যের অভিভাবক।
(চলবে)
সূত্রঃ আমার পঠিত কিছু বই ও ইন্টারনেটে প্রাপ্ত কিছু আর্টিকেল, সকল লেখকের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।