আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কয়েকটি গণ-অভ্যুত্থান - ৪ (খ)

মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল!

কয়েকটি গণ-অভ্যুত্থান - ৪ (খ)
--------------------------- ডঃ রমিত আজাদ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর থেকে)

সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলঃ
ফার্দিনান্দ মার্কোস দেখলেন যে, তৃতীয়বারের মতো আর রাষ্ট্রপতি থাকার সুযোগ তার নেই, যেহেতু চলমান সংবিধান সেই অনুমতি দেয়না, তাই ক্ষমতায় টিকে থাকার ভিন্ন পথ খুঁজলেন প্রথমতঃ তার নিজেরই সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতার দোহাই দিয়ে তিনি দেশব্যাপি সামরিক শাসন জারি করলেন। এখানে তাকে সহযোগীতা করলেন তার আজ্ঞাবহ কিছু উর্ধ্বঃতন সামরিক কর্মকর্তা, কেননা মার্কোসের অনুগ্রহে তারা অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও ঐ সকল পদ পেয়েছিলেন ও বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। এই সামরিক কর্মকর্তাদের পাশাপাশি একই কারণে মার্কোসের সাহায্যে এগিয়ে এলেন কিছু বেসামরিক আমলা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা। আবার চলমান সংবিধান যেহেতু তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পথে একটি বাধা সেহেতু ধুরন্ধর মার্কোস ১৯৩৫ সালের সংবিধান বাতিল করে, তার সুবিধামতো নতুন একটি সংবিধান চালু করেন, যেটি মুলতঃ ছিলো মার্কোসেরই লেখা। এই সামরিক শাসন ও তারই রচিত নয়া সংবিধান-এর রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার বদৌলতে তিনি আরো চৌদ্দ বছর ক্ষমতা টিকিয়ে রাখলেন।

এখানে উল্লেখ্য যে, আধুনিক বিশ্বের রাজনীতিতে কেবলমাত্র দেশের অভ্যন্তরে কিছু আজ্ঞাবহ লোক দিয়ে ক্ষমতায় টিকে থাকা মুশকিল। বর্হিবিশ্বের সমর্থনও দরকার। এক্ষেত্রে মার্কোসের ফরেইন মাস্টার হিসাবে আবির্ভুত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই সময়ের আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতায় কম্যুনিজম ও ক্যাপিটালিজমের ঠান্ডা লড়াই-কে অস্বীকার করার কোন উপায় ছিলো না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকাপোক্তভাবে মার্কোসের ডিক্টেটরশীপকে সমর্থন করেছিলো এই কারণে যে, মার্কোস মার্কিন প্রভুদের কাছে শপথ করেছিলেন যে, ফিলিপাইন থেকে তিনি কম্যুনিস্ট আইডিওলজিকে হটিয়ে দেবেন এবং ফিলিপাইনে মার্কিন সেনা ও নৌ ঘাটি গুলোকে অব্যহত ব্যবহার করতে দেবেন।


দেশে বাক স্বাধীনতা না থাকলে ও সামরিক শাসনের চাপ থাকলে যেকোন প্রকার দুর্নীতি করাই খুব স হজ হয়ে যায়। মার্কোসের তখন পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিলো সামরিক বাহীনি ও জাতীয় অর্থ-থবিলের উপর। সুতরাং অর্থলোভী মার্কোস নির্বিঘ্নে সরকারী থবিল থেকে অর্থ আত্মসাৎ করতে থাকে ও তার সিংহাসনকে নিষ্কন্টক করার সৈন্যদের নির্বিচারে হত্যার নির্দেশ দেয়। এর ফলে একদিকে ফিলিপাইনের অর্থনীতিতে ধ্বস নামে আরেকদিকে ফিলিপাইন জেনেটিক ফান্ড হারাতে থাকে। অর্থনাশ ও জীবননাশ দুটোই ফিলিপাইনের সর্বনাশ ডেকে আনে।



পাশাপাশি মার্কোস শুরু করে ব্যক্তি অর্চনা (personality cult)। তিনি সরকারী অফিসের পাশাপাশি সকল স্টোর, হোটেল, বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়, ইত্যাদি পাবলিক প্লেসে তার ছবি টানানো বাধ্যতামুলক করে দেন। অন্যথায় ঐ প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হতো। মিডিয়াগুলোও ঘন ঘন রাষ্ট্রপতি মার্কোসের 'বন্দনা' করতো নানাবিধ ঘোষণা ও সংবাদ প্রচারের মধ্য দিয়ে। এমনকি দেশব্যাপী বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডগুলোও প্রতিস্থাপিত করা হয় মার্কোসের সরকারের সাফল্য ও প্রশংসাবাণী দিয়ে।

এমনকি মার্কোস বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ করে দেন, এবং সেগুলোর হয় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ নেন অথবা সেগুলো তার আজ্ঞাবহদের দিয়ে দেন।

মার্কোস বিরোধীতা ও বেনগিনো এ্যাকুইনো:
এত কিছুর পরেও কিছু দেশপ্রেমিক মার্কোসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে থাকে। তারা মুলতঃ ছিলেন দেশের খ্যাতিমান ব্যাক্তিত্ব। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কারারুদ্ধ সিনেটর বেনগিনো এ্যাকুইনো (Benigno "Ninoy" Aquino Jr)। মার্কোস এ্যাকুইনো-কে বামপন্থী বলে অভিযুক্ত করেছিলেন।

এদিকে মার্কোস বিরোধী অবস্থানের কারণে ফিলিপাইনে এ্যাকুইনো-র জনপ্রিয়তা দি দিন বাড়তে থাকে। অবশেষে মার্কোস তাকে বাধ্য করেন ফিলিপাইন ছাড়তে। এ্যাকুইনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসিত হন। তারপরেও ১৯৮৩ সালে এ্যাকুইনো ঘোষণা দেন যে, মার্কোস সরকারকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তিনি ফিলিপাইনে ফিরে আসবেন।

এদিকে সামরিক বাহিনীর মোহমুক্ত জুনিয়র অফিসাররা চুপিচুপি তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করেন।

এর ফলে গঠিত হয় সেনা সংগঠন Reform the Armed Forces Movement (RAM) এবং Young Officers Union (YOU). এগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ফিলিপাইন মিলিটারী এ্যাকাডেমীর ১৯৭১ ব্যাচ। Lt. Col. Gringo Honasan, Lt. Col. Victor Batac, and Lt. Col. Eduardo Kapunan। আবার তারা গুরু হিসাবে পেয়ে যান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী Juan Ponce Enrile-কে।

বেনগিনো এ্যাকুইনো হত্যাকান্ডঃ
মিলিটারি ও প্রো-মার্কোস গ্রুপগুলোর হুমকী সত্বেও এ্যকুইনো দেশে আসতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। মৃত্যুর হুমকী সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন 'মরার জন্যই ফিলিপিনো হয়ে জন্মেছি'।


১৯৮৩ সালের ২১শে আগস্ট তিন বৎসরের নির্বাসনের পর এ্যাকুইনো ফিলিপাইনে ফিরে আসেন। কিন্তু ম্যানিলা এয়ারপোর্টে বিমান থেকে অবতরনের পরপরই তার মাথা লক্ষ্য করে গুলো করা হয়। তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। এই হত্যাকান্ড সকল ফিলিপিনোকেই ভীষণভাবে আহত করে। এটা জনগণকে এতোই নাড়া দিয়েছিলো যে, মার্কোস প্রশাসনের ভীত কেঁপে ওঠে।

জনগণের মধ্যে সরকার বিরোধী মনোভাব এভাবে তৈরী হয় যে, এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে অর্থনীতির উপর। ফিলিপাইনের নড়বড়ে অর্থনীতি আরো নড়বড়ে হয়ে পড়ে। এদিকে মার্কোসের শারীরিক অসুস্থতার কারণে তার সরকারও দুর্বল হতে শুরু করে। তার উপর ১৯৮৪ সালে এ্যাকুইনোর হত্যা তদন্তকারী কমিশন রিপোর্ট দেয় যে, এই হত্যাকান্ডের সাথেসরকার ও মিলিটারি জড়িত। এই রিপোর্ট ছিলো মার্কোস সরকারের উপর আরেকটি বড় আঘাত।



নির্বাচনের ডাকঃ
জনগণের অসন্তোষ ও দাবীর প্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চাপে ১৯৮৫ সালের ৩রা নভেম্বর মার্কোস ফিলিপাইনে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘোষণা করেন। এদিকে বিরোধী দলের নেতৃত্ব দিতে থাকেন এ্যাকুইনোর বিধবা স্ত্রী কোরাজন এ্যাকুইনো।

১৯৮৬ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সরকারী ইলেকশন কমিশনার দুর্নীতিপরায়ণ অজনপ্রিয় ফার্দিনান্দ মার্কোসকেই বিজয়ী ঘোষণা করে। দেশের জন গণ এই ফলাফলে বিস্মিত হয় এবং কারো বোঝার আর বাকী থাকেনা যে, নির্বাচনে ব্যাপক কারচূপী হয়েছে।

তাছাড়া নির্বাচনের সময় প্রচুর ভায়োলেন্সেও হয়েছিলো। এই ঘটনায় গণ-অভ্যুত্থান আসন্ন হয়ে পড়ে। এই গণ-অভ্যুত্থানের নাম দেয়া হয়েছিলো People Power Revolution। ফিলিপাইনের ধর্মীয় সংগঠন ক্যাথলিক বিশপ কনফারেন্স নির্বাচনের ভুয়া ফলাফলে সরকারকে দোষারোপ করে। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটেও নির্বাচনের ফলাফলকে দোষারোপ করে একটি বিল পাশ করা হয়।

খোদ মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রিগান-ও নির্বাচনের ফলাফলের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন।

মার্কোস পন্থীরা তাকে বিজয়ী ঘোষণা করলেও জনগণ তা মেনে নেয়নি। এবং প্রবল জনপ্রিয় এ্যাকুইনোর বিধবা স্ত্রীর ডাকে তারা মার্কোসের আজ্ঞাবহদের মিডিয়া, ব্যাংক, বীমা সহ সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে অসহযোগীতা শুরু করে। ফলে ঐ সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এবং শেয়ার মার্কেটে তাদের দর পড়তে থাকে।



নির্বাচনে কারচূপী ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশপ্রেমিক সামরিক কর্মকর্তাদের সংগঠন Reform the Armed Forces Movement মার্কোসের বিরুদ্ধে ক্যু করার পরিকল্পনা গ্রহন করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী একটি গ্রুপ মালাকানাং প্রাসাদ (রাষ্ট্রপতির বাসভবন) আক্রমণ করবে। অন্যান্য গ্রুপ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা (এয়ারপোর্ট, রেডিও-টিভি স্টেশন, সামরিক ঘাঁটি, ইত্যাদি) দখলে নেবে। পাশাপাশি মার্কোস পন্থী অফিসাররা যাতে কাউন্টার এ্যাটাক না করতে পারে সেজন্যও কিছু অফিসার তৎপর থাকবে। Lt. Col. Gregorio Honasan-এর নেতৃত্বে রাষ্ট্রপতির বাসভবন আক্রমণ করার কথা ছিলো।

এদিকে মার্কোস এই পরিকল্পনার কথা জেনে যান ও নেতাদের গ্রেফতার করেন। মুক্ত থাকা তাদের সহকর্মী অফিসাররা সেনাবাহিনীর ডেপুটি চীফ Lt. Gen Fidel Ramos-এর কাছে তাদের মুক্তির দাবী করেন। রামোস বিদ্রোহী অফিসারদের পক্ষ সমর্থন করে পদত্যাগ করেন। এদিকে অত্যন্ত প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা Cardinal Archbishop of Manila Jaime Sin ও বিদ্রোহী অফিসারদের সমর্থন করেন। ২২শে ফেব্রুয়ারী বিকালে জেনারেল রামোস ও বিদ্রোহী অফিসারদের অন্যতম নেতা এনরাইল প্রেস কনফারেন্স করেন।

মার্কোসও আবার এই দুজনকে আত্মসমর্পন করতে বলেন।

এদিকে Cardinal Sin ফিলিপিনো জনগণকে Radio Veritas মারফৎ বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তাদের সমর্থন করার ডাক দেন। তিনি সকলকে Epifanio de los Santos Avenue ()-এ সমবেত হওয়ার ডাক দেন। অনেকেই ভীত ছিলো যে সরকারী বাহিনী কি করে! কিন্তু ভীতি সত্তেও বিপুল সংখ্যক নান ও পাদ্রীরা সেখানে জমায়েত হতে শুরু করেন। মার্কোস বিরোধী এই প্রচারণায় রেডিও ভেরিতাস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালণ করে।

ফিলিপাইন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি Francisco Nemenzo বলেছিলেন রেডিও ভেরিতাসের সাহায্য ছাড়া লক্ষ লক্ষ মানুষকে অল্প সময়ের মধ্যে মোবিলাইজ করা সম্ভব নাও হতে পারতো। রেডোও ভেরিতাসও আমাদের umbilical cord হিসাবে কাজ করেছিলো।

(চলবে)

(কি ঘটেছিলো পরবর্তি কয়েকদিন? কি করেছিলেন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তারা? কি করেছিলো দেশের জনগণ? কি ঘটেছিলো উদ্ধত অদেশপ্রেমিক, স্বৈরাচারী ফার্দিনান্দ মার্কোসের ভাগ্যে? পরবর্তি অধ্যায়ে তা জানতে পারবেন।

কয়েকটি গণ-অভ্যুত্থান - ৪ (ক) নিচের লিংকে পাবেন
Click This Link

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.