গতকাল নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী শপথ নিয়েছেন। এর মাধ্যমে আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের সমঝোতার প্রয়াস কি শেষ হয়ে গেল? নির্বাচনটি কি সব দলের অংশগ্রহণে হবে? এ নিয়ে দুই শিক্ষাবিদের মতামত প্রকাশ করা হলো:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে সমঝোতা, তথা সব দলের অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন। আর এটি করা হলো এমন সময়ে, যখন সহকারী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। এর মাধ্যমে তিনি দেখাতে চেয়েছেন, সমঝোতার ব্যাপারে সরকার আন্তরিক।
প্রকৃতপক্ষে যদি সরকারের সদিচ্ছা থাকত, তাহলে দুই দলের মধ্যে অনেক আগেই আলোচনা হতো।
প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার টেলিফোন সংলাপ যাঁরা শুনেছেন, যাঁরা সরকারি দলের অন্যান্য নেতার বক্তৃতা-বিবৃতি লক্ষ করেছেন, তাঁরা স্বীকার করবেন, ক্ষমতাসীন দলটি বারবার তাদের প্রস্তাবিত সর্বদলীয় সরকারের ফর্মুলা বিরোধী দলের ওপর চাপাতে চাইছে। বিএনপির নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সম্পর্কে কোনো কিছুই তারা আমলে নিচ্ছে না। এ অবস্থায় সমঝোতা কীভাবে হবে?
সর্বশেষ গতকাল নির্বাচনকালীন সরকারটি যেভাবে করা হলো, তা গায়ের জোর ছাড়া কিছু নয়। এটি মহাজোট সরকারেরই আরেক রূপ। দুঃখ হয়, আমাদের নেতা-নেত্রীরা, বিশেষ করে যাঁরা ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরা সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট এবং মনের ভাষা বোঝেন না।
আজ প্রধানমন্ত্রী যেভাবে নির্বাচনকালীন সরকার করলেন, সেটি যদি ন্যায্য হয়ে থাকে, তাহলে ১৯৯৪ সালে কেন তাঁরা স্যার নিনিয়ানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন? স্যার নিনিয়ান তো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে (খালেদা জিয়া) রেখে দুই দলের সমসংখ্যক সদস্য নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের কথা বলেছিলেন।
সাধারণ মানুষ শান্তি চায়, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ চায়। কিন্তু সরকার যেভাবে নির্বাচন করতে চাইছে, তাতে শান্তি আসবে না। হরতাল কেন হচ্ছে? বিরোধী দল অযৌক্তিক কোনো দাবি করছে না। তারা নির্বাচন চায় এবং সেই নির্বাচনের জন্য একটি সুষ্ঠু পরিবেশ তথা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির কথা বলে আসছে।
যেহেতু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, সেহেতু নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরির দায়িত্বও তাদের।
সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে জনপ্রিয়তা যাচাই করা যেত, দলগুলো নিজেদের কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে যেতে পারত। তবে সরকারের এটাও জানা উচিত, ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। একটি জবরদস্তির নির্বাচন চাপিয়ে দিলে বিএনপি বাধ্য হবে রাজপথে আন্দোলন করতে। কেননা তারা সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করে সেই নির্বাচনে যেতে পারে না।
ফলে দেশে সংঘাত-সংঘর্ষ বাড়বে। মানুষের দুর্ভোগ চরমে উঠবে। এসবের দায়দায়িত্ব কিন্তু সরকারকেই নিতে হবে।
আমরা মনে করি, সরকারের উচিত ছিল অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করা, তাদের দাবিদাওয়া শোনা। বিএনপি আলোচনার দরজা বন্ধ করে দেয়নি।
প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণও খালেদা জিয়া প্রত্যাখ্যান করেননি। বলেছিলেন, হরতালের পর তিনি যেতে পারবেন। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
বিএনপির দাবি, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হবে, একজন নির্দলীয় ব্যক্তিকে সরকারপ্রধান করতে হবে। কিন্তু সরকার সেসব নিয়ে কোনো আলোচনাতেই রাজি হলো না।
দুই দলই তাদের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার টেবিলে বসতে পারত। তারপর কে কতটুকু ছাড় দিতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা হতে পারত। কিন্তু সরকার যখন বলে, সবকিছু সংবিধান অনুযায়ী হতে হবে, তখন তো আলোচনার সুযোগ থাকে না।
একদিকে সরকার বিএনপিকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে রাখছে, অন্যদিকে বলছে, ওরা ক্ষমতায় এলে দেশ মৌলবাদীদের হাতে চলে যাবে। এটি সরকারের চরম অসহিষ্ণুতা বলেই আমি মনে করি।
আদালতের রায়ে দুই মেয়াদের জন্য তত্ত্বাবধায়কব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সরকার সেটি একেবারে বাতিল করে দেওয়ায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
সরকারের এসব কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে, তারা সমস্যার সমাধান চাইছে না। সবার অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ একটি নির্বাচন হোক—সেটি তাদের কাম্য নয়। তারা চাইছে নিজেদের পছন্দমতো একটি নির্বাচন করে আবার ক্ষমতায় আসতে।
কিন্তু প্রধান বিরোধী দলটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থাকলে তো জনরায়ের প্রতিফলন ঘটবে না। সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন হয়ে যে দলই জিতুক না কেন, সেটি গ্রহণযোগ্য হতো। সরকারি দলের নেতারা বিরোধী দলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে এত কথা বলছেন। কিন্তু কাউকে তো শাস্তি দিতে পারেননি।
বিরোধী দলকে বাদ দিয়ে একটি নির্বাচন করলে তারাও নিশ্চয়ই বসে থাকবে না।
সাধ্যমতো আন্দোলন করবে। রাস্তায় সংঘাত হবে। তাতে আরও মানুষ মারা যাবে। দেশের সম্পদ নষ্ট হবে। দুই দলই যদি সমান শক্তি নিয়ে মাঠে নামে, কী অবস্থা তৈরি হবে, ভাবুন।
এসবই এড়ানো যেত আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাপারে একটা সমঝোতায় আসতে পারলে। আমার ধারণা, বিএনপি অনেকটাই ছাড় দিতে প্রস্তুত আছে; কিন্তু আওয়ামী লীগই কোনো ছাড় দিতে রাজি নয়।
অধ্যাপক সদরুল আমিন: সাবেক সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।