আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পুলিশ বাহিনীর ভালমন্দ দিক: ১

জীবন একখান বাঁশবাগান। খালি বাঁশ আর বাঁশ। ফেসবুকে আমি: facebook.com/bamboo.baash জিমেইলে আমি: bashbamboo@gmail.com

আপনারা যাঁরা পুলিশ সার্ভিসে যোগদানে আগ্রহী,তাঁরা এই সার্ভিসের বিভিন্ন দিক নিয়ে আগ্রহী হবেন-এটাই স্বাভাবিক। চলুন শুরুতেই এর অনুজ্জ্বল দিকগুলো দেখা যাকঃ ১) ভাবমূর্তি সংকট(Image crisis): পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন অসৎ পুলিশের কর্মকান্ড আমরা মোটামুটি প্রতিদিনই দেখতে পাই। “পুলিশ” নাম শুনলেই সাধারণ জনগণের সামনে যে মূর্তিটি ভেসে ওঠে তা কিন্তু মোটেই সুখকর নয়।

কাজেই,পুলিশ সার্ভিসে যোগদান করামাত্র আপনাকে আপনার সার্ভিসের কুলাঙ্গারদের কৃতকর্মের দায়ভার বহন করতে হবে,এটা মোটামুটি নিশ্চিত থাকুন। ইউনিফর্ম চাকুরির এটি একটি খারাপ দিকঃ অন্যান্য চাকুরিতে কোন ব্যক্তি অপকর্ম করলে তার দায় বর্তায় ওই ব্যক্তির উপর,কিন্তু ইউনিফর্মধারী কেউ সেই একই অপকর্ম করলে তার দায় পড়ে গোটা সার্ভিসের উপরেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে,ইউনিফর্ম পরে আপনি যখন কোন ভালো কাজ করবেন তখন কিন্তু কেউ পুরো সার্ভিসকে বাহবা দেবেনা। এর জন্যে আসলে কাউকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। বিগত ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানি শাসন এবং স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসন- মোটামুটি গত আড়াইশ বৎসর ধরে এই পুলিশ বাহিনী ব্যবহৃত হয়েছে সাধারণ মানুষকে দমিয়ে রাখতে।

আড়াইশ বছর ধরে যে ট্রেডিশন গড়ে উঠেছে তা রাতারাতি দূর হবে এমনটি আশা করা অনুচিত। আপনি যত ভালো মানুষই হয়ে থাকেননা কেন,পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করার পর মানুষ আপনাকে বাঁকা চোখে দেখবে-এটি শুরুতেই জেনে নিন। ২) কর্কশ কাজের পরিবেশ(Harsh working environment): পুলিশের চাকুরিতে আপনার দিন শুরু হবে খুনের সংবাদ নিয়ে,লাঞ্চ করবেন রায়টের মাঠে, বৈকালিক নাস্তার সময় শুনবেন ধর্ষণের মামলার কথা,ডিনারের সময় ডাকাতির খবর আর রাত ৪টায় ঘুম ভাংবে থানার ডিউটি অফিসারের ফোনের শব্দে-“ ওমুক জায়গায় সশস্ত্র দস্যুরা ৫ জনকে হত্যা করে মালামাল লুট করেছে-শিগগির আসুন”। সমাজের অন্ধকার দিকটার সাথে আপনার পরিচয় হবে ওতপ্রোতভাবে। মনে রাখবেন,এটি কোন হোয়াইট কলার চাকুরি নয় যে আপনি ৯টা-৫টা স্যূট টাই পরে অফিসে গেলেন এবং ফিরে এসে পরিবারের সাথে সময় কাটালেন।

আপনার কাজের সামান্য বিচ্যুতিতে টলে উঠতে পারে সরকারের আসন,হতে পারে ভয়াবহ প্রাণহানি। এই কর্কশ পরিবেশের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন কিনা পেশা পছন্দক্রমে পুলিশ রাখার আগে বার বার ভেবে দেখুন। ৩)ব্যক্তিগত সময়ের অভাব(Lack of personal time): আমার কাছে পুলিশের চাকুরির এটি সবচাইতে কঠিন দিক বলে মনে হয়। পুলিশিং একটি ২৪/৭ চাকুরি-এর যুদ্ধকাল বা শান্তিকাল বলে কিছু নেই-Cops are always in the line of fire.এমনও হবে যখন আপনি নিজের(?) বা নিজের অতি নিকটাত্মীয়ের বিয়েতে যোগ দিতে পারবেননা, খুব কাছের কেউ মারা গেলেও শেষ দেখাটি দেখতে পারবেননা। সারাদিন ব্যস্ততার পর অফিস থেকে এসে সবেমাত্র নিজের ছোট ছেলে বা মেয়েটিকে কোলে নিয়েছেন,এমন সময় দায়িত্বের আহবানে সাড়া দিতে আপনাকে ছুটে যেতে হবে দূর- দুরান্তের কোন অপরাধের ঘটনাস্থলে।

দিন নেই,রাত নেই,ঈদ নেই,পহেলা বৈশাখ নেই,বিশ্বকাপ নেই-পুরোটা সময় আপনি থাকবেন দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে। কদিন আগে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সারাদেশ যখন আনন্দে মেতে উঠছে- পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের তখন ছুটতে হয়েছে ভেন্যু নিরাপত্তায়। হরতালের সময় পুরো অফিসপাড়ায় যখন ছুটির আমেজ,আপনার তখন রায়ট গিয়ার পরে মিছিলের সাথে থাকতে হবে। বোমার শব্দে বা গুলী’র শব্দে যখন সবাই জান-মাল বাঁচাতে ছোটাছুটি ব্যস্ত তখন পুলিশ বোমা বিস্ফোরনস্থলে বা গুলী’র স্থানে জানের মায়া ত্যাগ করে ডিউটি’র খাতিরে । আর এরকমটি একদিন নয়,দুদিন নয়,মাসের পর মাস,বছরের পর বছর চলবে-যতদিন আপনি অবসরে না যান।

কাজেই,নিজেকে ভালোভাবে প্রশ্ন করুন এই জীবন আপনি চান কি-না। ৪)সীমিত সম্পদ এবং জনবল(Limited resources and manpower): সারদাতে “ট্রেনিং অফ ট্রেইনারস” নামের একটি ওয়ার্কশপে প্রশিক্ষন দিতে এফবিআই (FBI)এবং আমেরিকার বিভিন্ন স্টেটের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসাররা এসেছিলেন। এদের একজন,সিয়াটল পুলিশ ডিপার্টমেন্টের শেরিফ জনাব স্টিভেনস ভদ্রলোক খুব মজার একটা কথা বলেছিলেন -“ দেখো, বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর সদস্য হিসেবে তোমাদের খুব গর্বিত হওয়া উচিত। যেরকম ভয়াবহ চাপ এবং সীমাবদ্ধ রিসোর্স নিয়ে তোমরা কাজ করছ-আমাদেরকে এরকম পরিবেশে কাজ করতে হলে তোমাদের সিকিভাগ সার্ভিসও আমরা দিতে পারতাম কিনা সন্দেহ”। এটি একটি নির্মম সত্য-যেসব সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে বাংলাদেশের পুলিশকে কাজ করতে হয় তা প্রায় কল্পনাতীত।

উদাহরণ হিসেবে পুলিশ- পিপল রেশিওর দিকে তাকানো যেতে পারে। বাংলাদেশে প্রায় ১২০০ জন মানুষের জন্যে রয়েছে মাত্র একজন পুলিশ,যেখানে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে প্রায় ৭০০ জনের জন্যে একজন পুলিশ বরাদ্দ। অর্থাৎ,য দি ভারতের মানেও আমরা পৌঁছতে চাই,সেক্ষেত্রেও পুলিশের জনবল প্রায় দ্বিগুণ করতে হবে। অসৎ পুলিশ অফিসারদের বিত্ত-বৈভবের কথা আমরা পত্রিকায় প্রায়ই দেখতে পাই,কিন্তু এটা খন্ডিত চিত্রমাত্র। কখনো সুযোগ হলে এলাকার পুলিশ ব্যারাকগুলো একবার ঘুরে দেখতে পারেন,দেখবেন কি অমানবিক অবস্থায় সাধারণ পুলিশ সদস্যরা জীবনযাপন করে।

গরীব দেশ,যা সম্পদ আছে তাতে এর চাইতে বেশি দেবার সামর্থ্যও নেই। দেড় লাখ সদস্যবিশিষ্ট এই বাহিনীতে বিসিএস অফিসার মাত্র দুহাজার,বাকিরা সবাই কন্সটেবল থেকে ইন্সপেক্টর পর্যন্ত পদে নিয়োজিত। পুলিশ বাহিনীতে দুর্নীতিবাজদের অস্তিত্ব এবং কোনও কোনও ক্ষেত্রে প্রতিপত্তির কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু জনগণকে একটা মোটামুটি মানের সার্ভিস দিতেও যে অবকাঠামোগত সহায়তা প্রয়োজন,আমাদের এই গরীব দেশ প্রায়শঃই তা সরবরাহ করতে পেরে ওঠেনা। কর্তব্য করতে গিয়ে হাজারটা বাধার সম্মুক্ষীন হবেন এবং লড়াইটা অধিকাংশ সময়ে একাই করতে হবে- পুলিশ প্রথম পছন্দ দেবার আগে এটি অবশ্যই মাথায় রাখুন।

৫)কঠোর শারীরিক প্রশিক্ষণ(Rigorous Physical Training): পুলিশ বাহিনী'র সদস্য হিসেবে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হবার পর এক বৎসর (এ.এস.পি ও সাব-ইন্সপেক্টর) আপনাকে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমী,সারদায় মৌলিক প্রশিক্ষণ; /ছয় মাস (সার্জেন্ট ও কনস্টবল-দের) আপনাকে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমী,সারদা, খুলনা, টাঙ্গাইল,নোয়াখালি বা রংপুর নিতে হবে। “সারদার ঘোড়াও দুর্নীতি করে,পয়সা দিলেই সব ঠিক” জাতীয় আজগুবি কথাবার্তায় কান না দিয়ে মনে রাখবেন, এই প্রশিক্ষণটি যথেষ্ট কঠিন। ঘোড়ায় চড়া,এগারো ফিট উঁচু দেয়াল লাফিয়ে পার হওয়া(surmounting wall) ইত্যাদির জন্যে এখানে শারীরিকভাবে আপনাকে তৈরি করে নেয়া হবে। এই তৈরি করার পদ্ধতিটি যথেষ্ট কষ্টসাধ্য,ভোর চারটায় উঠে আপনাকে দৌড়াতে হবে পিটি গ্রাউন্ডে,দৈনিক মোটামুটি পাঁচ কিলোমিটার পথ দৌড়ে পার হতে হবে। এছাড়া প্যারেড,অবস্টাকলস,মার্শাল আর্ট,ফায়ারিং ইত্যাদি তো আছেই।

আপনি যদি মনে করেন আউটডোর ট্রেনিং আপনার জন্যে নয়-তাহলে পুলিশে না আসাই ভালো। ৬)প্রতিকুল সামাজিক পরিবেশ(Adverse social environment): একটি সমাজে পুলিশ বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য মোটামুটি এরকমঃ সমাজের শতকরা নব্বই ভাগ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আইন মেনে চলবে;মাত্র দশ ভাগ মানুষ হবে বিপথগামী এবং পুলিশ তাদেরকে নিয়ন্ত্রন ও দমন করবে। হলিউডের Righteous Kill সিনেমাটিতে পুলিশ অফিসারের চরিত্রে অভিনয়কারী রবার্ট ডি নিরোর একটি সংলাপ এখানে প্রনিধানযোগ্য-“Our job is to protect 90 percent people of the society from the rest 10 percent”. বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর দিকে আমরা যদি তাকাই-আসলেই কি নব্বইভাগ মানুষ আইন মেনে চলে,বা চলার মত পরিবেশ এখানে রয়েছে?একটি ছোট উদাহরণ এখানে টানা যেতে পারে। রাস্তায় দুটি প্রাইভেট গাড়ির মধ্যে ছোটখাটো ধাক্কা লাগলে যার দোষে ধাক্কা লেগেছে সে কি বের হয়ে এসে ক্ষমা চায় আমাদের দেশে? বরং দুই পক্ষ গাড়ি থামিয়ে রাস্তায় নামে এবং কার পরিচিত কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি রয়েছে তা নিয়ে গলাবাজি শুরু করে দেয়। সাবেক আইপিএস অফিসার নটরাজনের ভাষায়, একটি দেশের পুলিশ বাহিনী সেদেশের মানুষের চমৎকার একটি প্রতিচ্ছবি হিসেবে কাজ করে।

যেদেশের মানুষ যেরকম,সেদেশের পুলিশ বাহিনীও ওরকমই হয়-তারা কেউ আকাশ থেকে আসেনা। এরকম একটি দেশে পুলিশের চাকুরি করা খুবই কঠিন কাজ। আপনি ন্যায়,অন্যায় যা-ই করুন না কেন আপনার শতকরা পঞ্চাশভাগ ক্লায়েন্ট সবসময় আপনার উপর অসন্তুষ্ট থাকবে। আপনার কাজ যদি আপনি ঠিকভাবে করেন তাহলে অন্যায়কারী পক্ষের লোকেরা আপনার কুৎসা গাইবে,আর অন্যায়ভাবে করলে হবে তার উল্টোটা। যে কোন ক্ষেত্রেই পুলিশ হচ্ছে সবার প্রিয় “ভিলেইন”।

জওহরলাল নেহরু তাঁর একটি পার্লামেন্টারি ভাষণে বলেছিলেন-“একটি জঙ্গী মিছিলে যে লোকটি ইঁট দিয়ে পুলিশের মাথা ফাটালো সে হয়ে যায় নায়ক,মিডিয়াতে তাকে নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়ে যায়। কিন্তু যে গরীব কন্সটেবলটি তার কর্তব্য করতে গিয়ে আহত হল-তার খোঁজ কাকপক্ষীতেও নেয়না”। এর মানে এই নয় যে পুলিশের লোকেরা অন্যায় করেনা। বাকি সব সার্ভিসের মতই এখানেও দুষ্টলোক আছে যারা ক্ষমতার চরম অপব্যবহার করে। কিন্তু যারা এরকম নয়,তাদের পক্ষেও আপনি কাউকেই পাবেননা।

পুলিশ সার্জেন্ট দশটাকা ঘুষ খেলে যতটা শোরগোল হয়,স্যুট-টাই পরা বড় বড় হোয়াইট কলার অপরাধীরা কলমের খোঁচায় দশ কোটি টাকা আত্মসাৎ করলে তার সিকিভাগও হয়না। বরং কোনও কোনও ক্ষেত্রে এই হোয়াইট কলার অপরাধীরাই আপনার দিকে আঙ্গুল তুলে বলবে-“পুলিশ খারাপ,বাংলাদেশে পুলিশের কোনও দরকার নেই”। এরকম পরিস্থিতিতে আপনার একমাত্র জবাব হতে পারে কবিগুরুর দু-চরণঃ “আমি শুনে হাসি,আঁখিজলে ভাসি,এই ছিলো মোর ঘটে, তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ,আমি আজ চোর বটে!” পুলিশ হিসেবে পেশা পছন্দ করার আগে বা পুলিশ হিসেবে যোগ দেবার পরে উপরের দুলাইন ভালোভাবে মুখস্ত করে নিন, মোটামুটি নিয়মিতই আপনাকে এটি ব্যবহার করতে হবে! ### পরবর্তী খন্ডে পুলিশ বাহিনী'র ভালো ও উজ্জ্বল দিকগুলো আলোচনা করা হইবে । । (চলবে).....


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.