সময়টা সত্তর দশকের। ভিয়েতনাম যুদ্ধে গেরিলারা তখন বনে-জঙ্গলে থেকে লড়ে চলছিল। মার্কিন সেনারা তাদের সহজে পাকড়াও করতে ব্যর্থ হয়ে ভয়ঙ্কর ‘অপারেশন এজেন্ট অরেঞ্জ’ শুরু করল। এই অপারেশনে তারা হার্বিসাইড কেমিক্যাল ব্যবহার করে হাজার হাজার গেরিলা যোদ্ধাদের হত্যা করল। আজও ভুক্তভোগী ভিয়েতনামিরা ওই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে, এমনকি তাদের পরবর্তী প্রজন্মও।
মার্কিন সৈন্যদের হার্বিসাইড কেমিক্যালের যোগানদাতা কোম্পানিটি ছিল মনসান্টো। যারা এখন কেমিক্যাল নয়, শস্যবীজের ব্যবসা করে। ভয়ঙ্কর জিএম (জেনেটিক্যালি মোডিফাইড) শস্য। মনসান্টো প্রথমে বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে জিএম খাদ্য বিক্রি করতে গেলে প্রতিবন্ধকতার শিকার হয়।
এরপর GATT চুক্তির দোহাই দিয়ে তারা WTO’র কাছে এ নিয়ে নালিশও করে।
পরে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হস্তক্ষেপে ইউরোপীয় দেশগুলো জিএম খাদ্য আমদানিতে সম্মত হলেও শর্ত হিসেবে উল্লেখ করে যে, পণ্যের ওপর ‘জিএম খাদ্য’ সিল লেখা থাকবে। মনসান্টো এতে আর পরে রাজি হয়নি।
নিজেদের ‘কলঙ্কিত’ নাম দিয়ে তারা যখন ব্যবসায় সফল হচ্ছিল না, তখন কৌশলে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়, ইউএসএইড’র ABSPII প্রজেক্ট, ভারতের মাহাইকোসহ (মহারাষ্ট্র হাইব্রিড কোম্পানি) অসংখ্য সাংবাদিক, গবেষককে তারা ‘ডোনেশন’ দেয়া শুরু করল।
এদের মাধ্যমে তারা জিএম শস্যের গবেষণা, উৎপাদন আর বাণিজ্যের প্রসারও ঘটালো। বাংলাদেশের কৃষি গবেষণার সর্বোচ্চ সংস্থা ‘BARI(Bangladesh Agricultural Research Institute)’ বর্তমানে তাদের অনেক গবেষণা এই কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়, মাহাইকো আর IBSP IIএর সহায়তায় করছে।
অনেকেই এই সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয় যে এরা আসলে মনসান্টোর অংশীদারি প্রতিষ্ঠান।
মনসান্টো বাংলাদেশে বেগুনের মাধ্যমে প্রবেশের চেষ্টা করলেও তাদের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু ধান। এছাড়া রয়েছে স্থানীয় জাতের বীজের প্যাটেন্ট ধ্বংস করে সকল কৃষি বীজে নিজস্ব প্যাটেন্ট তৈরি করা।
উবিনিগের গবেষণা মতে, ‘BARI’ সংগ্রহশালায় প্রায় ১৫,০০০ জাতের স্থানীয় ধান বীজের সংগ্রহ ছিল। স্থানীয় জাতের বেগুন বীজের সংগ্রহ ছিল ২৩৮টি।
এর মধ্যে ‘BARI’ প্রায় ৭,৫০০ জাতের ধান বীজ আর নয়নতারা, উত্তরা, যশোরির মত উচ্চ ফলনশীল অনেক জাতের বেগুন ‘IRRI’ আর ‘ABSP II’ কে হস্তান্তর করে দিয়েছে।
এ সংস্থাগুলো এখন সহজেই এই বীজগুলো ‘মোডিফাই’ করে নিজেদের প্যাটেন্ট নিয়ে নেবে। প্রশ্ন হলো, ‘BARI’ কিভাবে জনগণের প্রতিষ্ঠান হয়ে, কৃষকের প্রতিষ্ঠান হয়ে আমাদের সবজি বীজ ওদের হাতে তুলে দিল? কিভাবে আমাদের বীজের মেধাস্বত্ব ধ্বংস করে দিল? এ অধিকার তাদের কে দিল? ভয়ঙ্কর এই দেশদ্রোহী কাজটি করার জন্য ‘BAR’র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিচার দাবি জানাতে হবে। আন্দোলন করতে হবে এখনই।
মাহাইকো আর ‘ABSP II’র মাধ্যমে মনসান্টো বাজার হিসেবে বাংলাদেশ, ভারত আর ফিলিপাইনে জিএম শস্য বিটি বেগুনের চাষ করার প্রজেক্ট নিয়েছিল।
ভারত সরকার ২০০৯ সালে জিএম শস্যের অনুমোদন দিলেও পরিবেশবাদীদের আন্দোলনের মুখে এটি নিয়ে ব্যাপক মতামত বিশ্লেষণ করে। পরে ২০১০ সালে এই অনুমোদন বাতিল করে দেয়।
ফিলিপাইনে স্থানীয় মেয়র এটি জানতে পেরে নিজ হাতে জিএম শস্য গাছ উপড়ে ফেলে, এর আমাদানি নিষিদ্ধ করে (ফিলিপাইনের সংবিধান মোতাবেক স্বাস্থ্যহানিকর কোনো জিনিস উৎপাদন নিষিদ্ধ)। কিন্তু বাংলাদশে খুব চাতুরতার সঙ্গে সরকার বিটি বেগুনের বীজ আমদানির অনুমোদন দিয়েছে।
কীটনাশকের ব্যবহার না লাগা আর অতি উৎপাদনের দোহাই দিয়ে বলা হচ্ছে, এই শস্য পোকামাকড় খায় না।
যে শস্য পোকামাকড় খায় না, সে শস্য কি করে মানুষ খাবে? জিএম শস্যের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, এটি নারী-পুরুষ উভয়ের প্রজনন ক্ষমতা আস্তে আস্তে হ্রাস করে দেয়, লিভার ধ্বংস করে। এছাড়া এলার্জির অন্যতম উপাদান এটি। এর কারণে শরীরে কোনো অ্যান্টিবায়েটিক কাজ করবে না, অথচ ইনফেকশনের জন্য অ্যান্টিবায়েটিক আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
পবিত্র কুরআনে পষ্টভাবে (সূরা নিসা, আয়াত-১১৯) জিএম খাদ্যকে শরীরের ক্ষতির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, বিনে পয়সায় প্রদানের কথা বলে এটি ধ্বংস করে দিবে আমাদের কৃষিজাত পণ্য আর বীজের পুরো মেধাস্বত্ব।
বিবিএস’র তথ্যমতে, বর্তমানে বছরে ৩,৩৯,৭৯৫ টন বেগুন উৎপাদন করা হয়, যা দেশের সবজি আবাদি এলাকার মোট ২৫.৪ ভাগ। সুতরাং প্রশ্ন হলো, পর্যাপ্ত আবাদ আর নিজস্ব উচ্চ ফলনশীল বীজ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার কার স্বার্থে বিটি বেগুন চাষের অনুমোদন দিয়েছে?
(খন্দকার রাক্বীব
গবেষক -এর লিখা হুবহু আরটিএনএন থেকে সংগ্রহীত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।