রাজধানীতে ফ্ল্যাট কেনাবেচার নামে সংঘবদ্ধ কয়েকটি চক্র হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এতে সরাসরি ক্ষতির শিকার হয়েছেন ৩০ সহস্রাধিক মানুষ। ঢাকায় চার শতাধিক ফ্ল্যাট ব্যবসায়ী এমন প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসেছেন বলে জানা গেছে। রাজধানীতে মাথা গোঁজার ঠাঁই করতে অনেকেই নিজের শেষ সম্বল প্রতারকদের হাতে তুলে দিয়ে এখন পথে বসেছেন। পেনশনের টাকায় ফ্ল্যাট কিনতে গিয়ে মুশতাক আহমদের চোখের পানিই এখন সম্বল হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রবাসী স্বামীর টাকায় রোকেয়া বেগম গোপনে ফ্ল্যাট কিনে স্বামীকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ৪০ লাখ টাকা নিয়ে ফ্ল্যাট বিক্রেতা লাপাত্তা হওয়ায় রোকেয়াকেই তার স্বামী বিতাড়িত করে সারপ্রাইজ (!) দিয়েছেন। গ্রামে পৈতৃক ভিটেখণ্ড বিক্রি করে ঢাকায় একটি ফ্ল্যাটের মালিক হতে চেয়েছিলেন হোটেল ব্যবসায়ী সুরুজ আলী খান। তার ভিটেও শেষ, হোটেল ব্যবসাও লাটে উঠেছে- এখন স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে দাঁড়ানোর জায়গাও পাচ্ছেন না। টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পর প্রতারকরা লাপাত্তা হয়ে গেছেন; তাদের কথিত ফ্ল্যাট, সাজানো অফিস, চুক্তিপত্র, দলিল সব কিছু রাতারাতি উবে গেছে।
গত কয়েক দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে ফ্ল্যাট কেনাবেচার নামে চলমান ভয়ঙ্কর প্রতারণার বিভিন্ন চিত্র বেরিয়ে এসেছে। অভিজাত এলাকায় নির্মাণাধীন অত্যাধুনিক অ্যাপার্টমেন্টকে পুঁজি করে, চটকদার সব বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে সহজ সরল মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার পথ বের করা হয়। সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলের বিজ্ঞাপনে অপেক্ষাকৃত কম দামে, বিশেষ কিস্তি সুবিধায় এমনকি ব্যাংক ঋণে ফ্ল্যাটের দাম পরিশোধের সুবর্ণ সুযোগের লোভ দেখানো হয়। আরএসএস নামক একটি রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানের এমডি এম এ সবুরের প্রতারণা স্টাইল ছিল বেশ অভিনব। ভুক্তভোগীরা জানান, মাত্র ২০-২৫ লাখ টাকায় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ফ্ল্যাটের চটকদার বিজ্ঞাপন দেয় এ প্রতিষ্ঠানটি। বিভিন্ন মোড়ে, দেয়ালে বিরাট বিরাট বিলবোর্ডে নিজের জমকালো ড্রেস আর পালকযুক্ত মুকুট পরিধানের ছবির প্রচারণা চালানো হয়। এসব বিলবোর্ডে লেখা হয় 'মাত্র ২০ লাখ টাকা জমা দিয়ে আপনিও হতে পারেন এ জমানার মহারাজা-মহারানী'। চটকদার, সস্তা দরের অবাস্তব বিজ্ঞাপন দেখে শত শত মানুষ হাজির হন প্রতারক এম এ সবুরের দফতরে। ফ্ল্যাটপ্রাপ্তির মাধ্যমে অনেকেই মহারাজা-মহারানী বনে যেতে চান। ধূর্ত সবুরও সুযোগ নেন পুরোপুরি। নিজ অফিসের রিসিট বা দলিলের মাধ্যমে চাহিদামাফিক টাকা হাতিয়ে নিয়ে সবাইকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষায় থাকার পরামর্শ দেন।
এ সুযোগেই সব অফিসে তালা ঝুলিয়ে পাততারি গুটিয়ে লাপাত্তা হন এম এ সবুর ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেতে ওই প্রতিষ্ঠানের এমডি এম এ সবুরের কাছে ২০ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ৬০ লাখ টাকা পর্যন্ত পরিশোধ করেছেন অনেকেই। কিন্তু ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়ার সময় ঘনিয়ে আসার আগমুহূর্তে পালিয়ে যান সবুর। তার ব্যবহৃত সব মোবাইল ফোন বন্ধ। শুধু তাই নয়, ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মাহমুদা আক্তার জলি ও মাহবুব হোসেনেরও কোনো পাত্তা পাচ্ছেন না প্রতারিতরা। ধূর্ত সবুরের নানাবিধ অপকৌশলের বেড়াজালে ধরাশায়ী হয়েছেন অনেকেই। বরিশালের জাতীয় পার্টির এমপি গোলাম কিবরিয়া টিপু, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের জিটিসিএল প্রজেক্টের পরিচালক সত্যনারায়ণ সাহা, ব্যবসায়ী শহীদুল্লাহ রইছ, মাসুদ রানা, মঞ্জুরুল হক, এ বি এম আনোয়ার হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, আনসার আলী, কাজী ফখরুল আলম, আবদুল খালেক, শফিকুল ইসলাম, আবুল বাশার, কামরুন্নাহার, জহির আহমেদ ও দিলরুবা খানমসহ শত শত গ্রাহকের অন্তত তিন শ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ওই প্রতারক চক্র। বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে প্রতারিত গ্রাহক এ বি এম আনোয়ার হোসেন অভিযোগ করেন, তিনি ২০১১ সালের মার্চে ১ হাজার ২০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট বুকিং দিয়েছিলেন ১০ লাখ টাকায়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাকি টাকা পরিশোধ করে ফ্ল্যাট বুঝে নেওয়ার কথা ছিল তার। একই অভিযোগ করলেন ব্যবসায়ী মাসুদ রানা। তিনি বলেন, ২০১১ সালে আমি ২১ লাখ টাকা দিয়েছি। এখনো ফ্ল্যাট বুঝে পাইনি, পাওয়ার কোনো লক্ষণও দেখতে পাচ্ছি না। বাড্ডায় এম এ সবুরের অন্য একটি প্রকল্পে প্লট বুকিং দিয়ে আরও পাঁচ শতাধিক গ্রাহক সীমাহীন বিপাকে পড়েছেন। লাখ লাখ টাকা আরএসএস ফান্ডে জমা দিয়ে প্রতারিত মো. বাবুল আহম্মেদ, এহিয়া নূর দীপু, রুবাইয়াত রহমান হেমা, আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী, মেহেরুন্নেছা ইসলাম নেহার, লিটন চন্দ্র দাস, ডা. শাহজাহান সাজু, মো. আমানুল্লাহ খান, ফরিদুজ্জামান, এন আলমসহ শত শত গ্রাহক এখন দিশাহারা। তাদের সমুদয় টাকা বুঝে নিয়ে ফ্ল্যাট দলিলও করে দিয়েছেন এম এ সবুর। কিন্তু বাস্তবে বুঝে পাননি কিছুই। মাসের পর মাস পার করে এখন এম এ সবুরের টিকিটিও খুঁজে পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। অবশেষে প্রতারিত গ্রাহকরা আলাদা একটি অ্যাসোসিয়েশন গঠন করে হন্যে হয়ে খুঁজছেন এম এ সবুরকে। প্রতারিতরা জানান, ২০১০ সাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নির্মাণাধীন ভবন দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এ কোম্পানি। প্রথম দিকে কয়েকজনকে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দিয়েছে। এর পর থেকেই প্রতারণা শুরু। টিঅ্যান্ডটির ওয়্যারলেস বিভাগের প্রধান সহকারী কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন বলেন, আমরা টাকা দেওয়ার পর মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় গ্রাহকদের নির্মাণাধীন বিল্ডিং দেখানো হয়। নির্মাণাধীন বিল্ডিংগুলো দেখে সরল মনে বিশ্বাস করে এম এ সবুরের হাতে লাখ লাখ টাকা তুলে দেওয়া হয়। তিনি আরও বলেন, আমার মতো কয়েক শ গ্রাহক তাকে টাকা দেন। কিন্তু চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও বিভিন্ন ধরনের ছলচাতুরী করা হচ্ছিল। এক পর্যায়ে উধাও হয়ে যান সবুর ও তার সাঙ্গাতরা। এসব ঘটনায় রাজধানীর বিভিন্ন থানায় অর্ধশতাধিক জিডি করা হলেও সেগুলো আইনগত ভিত্তি পায়নি এখনো। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের সূত্র ধরে বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১০ সালে মিরপুরের শেওড়াপাড়ার ৫৬৮ শামীম সরণিতে অফিস নেন আরএসএসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ সবুর। এ ছাড়া পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় তারই আপন ভাই মাহবুব এবং বোন মাহমুদা আক্তার জলিকে। তারা রংচংয়ের বিজ্ঞাপন প্রকাশ করে সহজ সরল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। নগরীতে লাগিয়ে দেওয়া হয় অসংখ্য বিলবোর্ড। তার অ্যাপার্টমেন্ট ফ্ল্যাটগুলোর নাম দেওয়া হয় 'প্রেসিডেন্ট প্যালেস'। সস্তা দরের এমন বিডবোর্ড দেখেও শিক্ষিত শ্রেণীর হাজারো মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতারক এই সবুরের বাড়ি মেহেরপুরে। বিভিন্ন সময় নাম পাল্টিয়ে তিনি ফ্ল্যাট বরাদ্দের নামে লোকজনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান। যেসব ফ্ল্যাটের কাগজপত্রে ঝামেলা আছে, সেসব ফ্ল্যাট কোনোরকমে ক্রেতাকে গছিয়ে দিয়ে টাকা নিয়ে সটকে পড়ার উদ্দেশ্যেই এত কম দামে বিক্রি হবে বলে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে ফ্ল্যাটের জমির মালিকের সঙ্গে গোপন একটা অাঁতাত থাকে এবং মূল প্রতারক লাপাত্তা হলে জমির মালিক এসে ফ্ল্যাট ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি তখন প্রতারক চক্রকে না চেনার ভান করে গ্রাহকদের ঠকানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। এসব ফ্ল্যাট ব্যবসায়ী রাজধানীর নির্মাণাধীন বিভিন্ন অ্যাপার্টমেন্টে একাধিক ফ্ল্যাট বুকিং দিয়ে পত্র-পত্রিকায় চটকদার বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেন। নিজেরা অ্যাপার্টমেন্টের মালিক সেজে একের পর এক ফ্ল্যাট বিক্রি ও বুকিংমানি হাতিয়ে নিতে শুরু করেন। একই ফ্ল্যাট চার-পাঁচ জনের কাছে বিক্রি করারও এন্তার নজির রয়েছে। কথিত ডেভেলপার কোম্পানিগুলোর অনেকেই বিরোধপূর্ণ জায়গাজমি সংগ্রহের দিকেই বেশি নজর দেয়।
রাজনৈতিক ও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এই ডেভেলপাররা যে কারোর জায়গা জবরদখল করে বিশালকায় অট্টালিকা গড়ে তোলে এবং তা বিক্রি করে দেয়। এ ক্ষেত্রে রাজউক কেবল সরকারি ফি আদায় করেই দায়িত্ব পালন সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। ক্রেতারা ঠকলেন কি না, অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রেতা কী কী শর্ত ভঙ্গ করলেন, কত দিনের মধ্যে ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়া বাধ্যতামূলক_ সেসব নিয়ে রাজউকের ভূমিকা না থাকায় ক্রেতা ভোগান্তি যেমন দূর হচ্ছে না, তেমনি থামানো যাচ্ছে না প্রতারণার দৌরাত্দ্য। রাজউক সূত্র জানায়, আরএসএস স্টাইলে চার শতাধিক প্রতিষ্ঠান রাজধানীজুড়ে প্লট বিক্রির প্রতারণা চালাচ্ছে। এরই মধ্যে রিহ্যাব পৃথক তদন্তে অভিযুক্ত দুই শতাধিক ফ্ল্যাট ব্যবসায়ীর লাইসেন্স বাতিল করেছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই তাদের প্রতারণা থামানো যাচ্ছে না।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।