আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সমান্তরাল জীবনের অপ্রতিরোধ্য স্পৃহা

আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।

শিশিরের স্পর্শহীন নিষ্প্রাণ সবুজ ঘাস , অসহনীয় ট্রাফিক জ্যাম , পাবলিক বাসে শরীরের এখানে সেখানে সেক্স ডিপ্রাইভড পারভার্টদের হাতের ভারসাটাইল কারুকাজ , সাধারণ নাগরিকদের জন্য রাষ্ট্রের অপরিসীম উপহার আমলাতান্ত্রিকতার জঞ্জাল সব সামলাবার পর যখন সেই অনিবার্য নিয়তি সামনে এসে উপস্থিত হলো ধূলাবালিতে ময়লা হয়ে যাওয়া আটপৌরে শাড়ীর কোনা দিয়ে চোখ মুছতে হবে মনে করে ছোট এক প্যাচ বানাচ্ছিলো অসহায় সেই নারী । বহু কষ্টে একে ওকে ধরে কোনভাবে মৃতদেহটির দিকে এক দৃষ্টিতে বেশ কিছু সময় তাকিয়ে থাকতে চেয়েছিলো । তার জন্য , তাদের মতো বঞ্চিত হতে হতে শখ – আহ্লাদ সব মিনিমাইজ করে করে নিজেকে কয়েদীর পর্যায়ে নামিয়ে ফেলাদের জন্য অভিশাপই উপরওয়ালাদের দান । অনেকদিন ভেবেছে এই বিষয়টি নিয়ে ।

বিশেষ কোন কূল – কিনারা পায়নি । প্রায় প্রতিবারই মনে হয়েছে স্যাডিস্ট হয়ে যাবে । এক ধরণের ঈর্ষাজাত এক অক্ষম ক্রোধ । বেশীক্ষণ টেকেনা এই ধরণের জিঘাংসা । অনেক মানুষ আছে শেষ পর্যন্ত মেনে নেয় ।

নিজেকে ভাসিয়ে দেয় নষ্ট সময়ের ভেলায় । ঠিকভাবে ভাসতেও পারেনা আবার ডোবার অধিকার থেকেও তারা বঞ্চিত । এমনই সবকিছু মেনে নেওয়া , আটপৌরে পোশাকের এক নারীর সামনে প্রিয়জনের বহুল প্রতীক্ষিত লাশ এসে উপস্থিত হলো । আহা আহা , প্রিয়জনের লাশ তাও বহুল প্রতীক্ষিত । মুখে ঘৃণার থুতু , মনের ভিতরে বিষাক্ত সাপের মতো অবিরাম খেলা করে যাওয়া ধ্বংসাত্বক অনুভূতিসমূহকে সে এই মুহূর্তে জায়গা দিলো ।

লাশ এনে দেওয়ার জন্য হাদিয়া চাওয়া নোংরা , কুতকুতে চোখের মানুষটাকে গোটা পঞ্চাশেক টাকা দিয়ে বিদায় করে দিয়ে সামনে শান্ত-সমাহিত , আজীবনের জন্য বোবা হয়ে যাওয়া মুখটির সাথে চাওয়া – পাওয়া , বঞ্চনা – প্রাপ্তির হিসাবে মেলাতে বসলো । না , তখনো শাড়ীর কোনা চোখে চেপে ধরেনি । আজকে অনেক প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে সে । কোনভাবেই সেগুলোকে হারাতে দেবেনা । মৃদু আকাঙ্খা হিসাবে জীবিতই যখন তাকে পেলোনা অন্তত শেষবারের মতো এই পাশা খেলায় নিজের দৌড় সে পরখ করতে চায় ।

কেবল মুখমন্ডল দেখতে পাচ্ছে । বাকি শরীর সাদা কাপড়ে ঢেকে রাখা । কেন ঢেকে রাখা তা বিলক্ষণ জানে । আপাতত সেই পরীক্ষায় যেতে চায়না । ভালো করে বহুদিনের চেনা মুখখানা দেখে নিতে চায় তৃষ্ণার্তের মতো ।

ঠিক যেন টেনটেলাস । চারপাশে সমুদ্র দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকবার পরেও যাকে আজীবন পিপাসার্ত থাকতে হয়েছিলো । ভালো করে মানুষটার দিকে তাকিয়ে দেখে মৃতদেহের শার্টের পকেটে সাদা কাগজ ঝুলে রয়েছে । কৌতুহুলবোধ করলো । একটু ঝুঁকে সেটা দেখতে গেলে চোখের কোন দিয়ে দেখলো সামনে দাঁড়ানো পুলিশের সেই খচ্চরটা তার ঝুঁকে যাওয়া শরীরের বিশেষ জায়গায় চোখ রাখতে সচেষ্ট ।

এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে এখন । সংবেদনশীলতা থাকলে নারীর স্তনের মাঝে স্পষ্টভাবে চিত্রিত যৌনতাকে অতিক্রম করে তার জীবনের অপরিসীম সঞ্চয় কিংবা অদ্বিতীয় সম্পদ হৃদয়ের মর্মস্পর্শী ছবি দেখতে পাওয়া যায় । এসব সূক্ষ্ণ অনুভূতি এসব খানকির ছেলেরা বোঝেনা । যারা বোঝে , বুঝতো তাদেরই একজনের লাশের সামনে সে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে । মানুষটা মৃত , আর কোনদিন কোন স্পর্শ কিংবা স্মৃতি সে রেখে যাবেনা ।

কিন্তু প্রতিদিন এনে দেবে বিষাদের সেই গাঢ় হাহাকার যার জন্য পীড়িত মানুষ দুঃখী হতেও ভীত হয়না , জাগিয়ে যাবে দাঁতে দাঁত চেপে জীবন চালিয়ে যাওয়ার অদম্য স্পৃহা , অথচ জাগিয়ে তোলার কারিগর খোদ নিজেই এখন অস্তিত্বহীন । অস্তিত্বহীন ? এমনটা মনে হতে নিজের উপরেই রাগ হলো । প্রবলভাবে অস্তিত্বসম্পন্ন বলেই তো এই মুহূর্তে তার নিস্পলক , সাড়াহীন শরীরের দিকে ঝুঁকে আছে । হাত বাড়িয়ে সেই সাদা টুকরো কাগজটি তুললো । স্পষ্ট অক্ষরে যেন স্মৃতির , অনুভূতির এক অতুলনীয় কোলাজ ।

বিড়বিড় করে লেখা অক্ষরগুলো পড়তে শুরু করলো , ময়ী , সেই কবে তোমাকে কথা দিয়েছিলাম একটা চিঠি লিখবো । অবশেষে কথা রাখতে পারলাম । কিন্তু যখন কথা রাখতে পারছি সেই সময়ে কথা রাখবার আনন্দের চেয়েও বলতে চাওয়া অনেক কথা অব্যক্ত থেকে যাবে এই উপলব্ধিতে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে হচ্ছে । আমার থেকে যোজন যোজন দূরত্বে থেকেও সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ তোমার কানে একদিন পৌঁছাবেই নিশ্চিত জানি । তুমি জানো কি এই নিশ্চয়তার বিষয়টির কারণে তোমাকে চিঠিটি লিখবার প্রবল আকাঙ্খা ছিলো ? শেষ সময় বলে সেই আকাঙ্খায় হালকা অতৃপ্তি এসে জোর করে প্রবেশ করেছে ।

ময়ী , শেষ একটা চেষ্টা করেছিলাম প্রবল বিপদসংকুল পরিবেশের মধ্যেও তোমার কাছাকাছি আসতে । তোমাকে তার অংশ করে নিতে । মনে হয়েছিলো অজস্র দোদুল্যমনতা , দোলাচলের মধ্যে খন্ডিত হয়ে নিজের সাথে সাথে তোমাকেও অনেক বঞ্চিত করেছি । আমি আসলে আমাদের ব্যাপারে দিনের শেষে বড্ড বেশী সাবজেক্টিভই থেকে গিয়েছিলাম । তার জন্য আমি দুঃখ পেয়েছি তা নিয়ে আফসোস নেই ।

আমি তার চেয়ে কনামাত্র ভিন্ন কিছুর প্রাপ্য নই । কিন্তু তুমি হারিয়েছো আমার চেয়েও অনেক বেশী । আমার জন্য আরো অনুশোচনার জায়গা হলো তুমি সবসময়েই সেই ব্যাথাকে নিজের কাছ থেকেও চেপে রাখতে চেয়েছো । আমি যতই তোমার কাছে এসে থাকিনা কেন কেবল নিজের কারণেই তোমার সেই গভীর ক্ষতকে স্পর্শ করতে পারিনি । আসলে আমার সেই ক্ষমতাই ছিলোনা ।

তুমি অন্ধ ছিলে বলেই অনেক বেশী দুঃখ পেয়েছো । আমার হাতে আর বেশী সময় নেই । ইলেভেন্থ আওয়ারে এসে শংকরটাও বিট্রে করে বসলো আমার সাথে । পুলিশকে আমার থাকবার ঠিকানা বলে দিয়ে ঢাকাতে সটকে পড়েছে । এমন কিছু আগেই সন্দেহ করেছিলাম কিন্তু তার জন্য প্রিভেন্টিভ কোন একশন নেইনি ।

সত্যি বলতে মানসিক অবসাদের কারণেই এই ভয়ঙ্কর সময়েও উদাসীন থাকতে পেরেছি । যেদিন তুমি আর আমি মিলে আমাদের সৃষ্ট সেই প্রাণকে পৃথিবীতে নিয়ে আসতে পারবোনা জেনেছিলাম সেদিন থেকেই আমি এই উদাসীনতাকে আমার সহোদর বানিয়ে নিয়েছি । তোমাকে জানাইনি কারণ এই উদাসীনতা তোমাকে কনামাত্র স্পর্শ করুক তা চাইনি । আমি চলে যাচ্ছি কিন্তু তোমাকে থাকতে হবে । মাঠে যোদ্ধাদের কাউকে না কাউকে থাকতেই হয় ।

প্রকৃতির এই ভারসাম্যের খেলা যতদিন অস্তিত্বশীল ততোদিন পৃথিবী মানুষের বসবাসযোগ্য এক অভয়ারণ্য । এই নিয়ে কখনো সন্দেহ করবেনা বলেই আমার বিশ্বাস । স্রেফ কাগুজে দলিলের মধ্যে আজন্ম সীমাবদ্ধ এক সম্পর্কের পঙ্কিলতা তুমি যেভাবে বয়ে বেড়িয়েছো নীরবে দিনের পর দিন তার কথা যতোবারই মনে হতো প্রবলভাবে ক্রোধান্বিত হতাম । শারীরিক জলোচ্ছাসেও এক সময় ক্লান্তি আসে , ঠোঁটজোড়ার দীর্ঘস্থায়ী চুমুও একসময় হৃদস্পন্দনের গতি মেপে দেখতে আর ভালোবাসেনা । কিন্তু দু চোখের বাইরে যে তৃতীয় চোখ থাকে তার প্রতি শর্তহীন ভালোবাসা একে অপরের অন্তঃস্থল যদি আমূল নাড়িয়ে দেয় তবে একে অপরের কাছে টেনে নেয় , যতটা কাছে এলে দুজনের কারো হৃদয়ের শ্বাসরোধ হবেনা ।

আবার একে অপরের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেয় , ঠিক যতোটা দূরত্বে একে অপরকে প্রবলভাবে অনুভব করবার তাড়না বোধ করা যায় । এমন চমৎকার সব অনুভূতি আমরা একে অপরের সাথে ভাগ করে নিয়েছিলাম ভাবতেই আনন্দ-বেদনা মিশ্রিত একরাশ অনুভূতির রংধনু এসে মগজকে রাঙিয়ে দিতো । অথচ দেখো নিজ নিজ সামাজিক , ব্যক্তিগত পরিসরে আমাদের উভয়ের পরিণতিই হলো সহনীয় বেশ্যাবৃত্তির মধ্যে নিজেদের মানানসই করে নেওয়ার নিরন্তর চেষ্টা করে যাওয়া যেখানে যদি প্রাপ্তির কিছু থেকে থাকে তবে তার সবই প্রকৃতিতে জারজ । আমি তাও কিছু একটা আঁকড়ে ধরে বের হবার সুযোগ পেয়েছিলাম কিন্তু তুমি ? কেবল দিয়েই গেলে । যাকে জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করতে তাকেও দিয়ে গেলে ।

যাকে কনামাত্র নিজের বলে ভেবে নিতে পারোনি তাকেও দিয়ে গেলে । কিন্তু তোমার প্রাপ্তির খাতায় শূন্য ছাড়া আর কিছু নেই । তা নিয়ে তোমার অভিযোগও নেই । নাকি তোমার কারো কাছেই অভিযোগ করার আশ্রয় নেই জেনে নির্লিপ্ত হয়ে গিয়েছিলে ? এসবের উত্তর খুঁজতে চাওয়ার প্রবল ইচ্ছা ছিলো একসময় । তবুও প্রতিবারই ভয়ে সরে এসেছি ।

মনে হয়েছে উত্তরগুলো পেলে যদি আমার উপলব্ধি হয় আমার হারানোর খাতায় প্রবলভাবে কাঙ্খিত একটি পাখিও যুক্ত হয়েছে তবে আর বাঁচতে পারবোনা । হা হা হা । ভয়ে সরে আসলাম তবু তো বেঁচে থাকা গেলোনা । কিছুক্ষণ পরেই ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে আমি এমনই এক গন্তব্যে পৌঁছাতে চলেছি যেখান থেকে তোমার সাথে দূরত্ব অনতিক্রম্য । কিছু শুয়োরের বুলেটের গান পাউডার শরীরে প্রবেশ করার আগে আমাদের প্রণয়ের তৃতীয় দিনে কিছু কথা বলেছিলাম সেগুলো দিয়েই শেষ করি “ জীবনে সকালের সুবাতাস গায়ে মেখে , হেমন্তের দুপুরের উজ্জ্বল রোদের স্পর্শ নিয়ে , মনোমুগ্ধকর বিকালের শেষ আলোতে সিক্ত হওয়া থেকে নিজেকে বঞ্চিত না করে , রাতে মগ্ন হওয়া একে অপরের গভীর জীবনবোধের ছায়ায় , এ এক অন্য মাত্রার প্রাপ্তি ।

একে অপরের জীবনে তাদের উপস্থিতি ঠিক তেমনই থাক যেমনটা একটি শিশুর জীবনে থাকে তার মায়ের । যেমনটা শিশিরসিক্ত ঘাসের থাকে শীতের সকালের উপর । আলো টিকে থাকুক , ছায়া খেলা করুক , রোদের কঠোরতা চিনতে শেখাক সেই জীবনকে দিনের শেষে যা সকল বয়ে যাওয়া মুহূর্তকে ছাপিয়ে নিজ নিয়মে ভাস্বর হয়ে উঠে । ঝরঝর করে একে অন্যের ভেতরকার অনুভূতি নিজ গন্ডি ছাপিয়ে অন্যের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে প্রবেশ করুক । একে অপরের স্পর্শে , অনুভূতিতে পরিপূর্ন হয়ে উঠুক সংকল্পে , কল্পনায় , সূক্ষ্ণ জীবনবোধে ।

“ প্রত্যাশা নিয়ে বাঁচতে পারো কিংবা না পারো অন্তত দুর্দমনীয় স্পৃহা নিয়ে বেঁচে থেকো । তুমি সেই অতুলনীয় সংশপ্তক যার কাছে জয়ও প্রায়শই ম্লান হয়ে উঠে । তাই বেঁচে থাকো , অজস্র ঠুনকো জয়কে পরাজিত করে তবেই আমার সাথে শুরু হতে যাওয়ার অনতিক্রম্য দূরত্বকে কমিয়ে আনতে শুরু করো । ইতোমধ্যে বুটের শব্দ শুনতে পাচ্ছি । সূর্যের আলোকে শেষবারের মতো গায়ে মেখে নিচ্ছি ।

চমৎকার সেই ঠিকরে বের হওয়া আলোকে অনুভব করতে করতেই শরীরের অজস্র বুলেট এসে বিঁধবে আমার শরীরে । নিঃশ্বাস ছেড়ে দেওয়ার শেষ মুহূর্তেও মনে হয়না তার যাতনা সম্পর্কে জানতে পারবো । আটপৌরে শাড়ী পরিহিতা নারীটি করবেনা করবেনা মনঃস্থির করেও শেষ পর্যন্ত মৃত শরীরটির উপর থেকে সাদা কাপড়টি সরিয়ে ফেললো । ক্ষতবিক্ষত সেই বুকে অগণিত বুলেটের অজস্র ছাপ । কাছ থেকে একটি গুলি করে এই মৃত্যুঞ্জয়ীকে ধরাশায়ী করা যাবেনা এটা ঘাতকেরাও জানতো ।

চিৎকার করে ডুকরে উঠতে চেয়েছিলো নারীটি । পারলোনা । শাড়ীর কোনাটি আঙ্গুল দিয়ে পেঁচানো বন্ধ করে অবশেষে যখন উঠে দাঁড়ালো তখন দুটি শালিক , তিনটি ঝগড়ারত কুকুর , একজন অভুক্ত মা ও শিশুকে দেখতে পেলো চারপাশে । আচ্ছা এদের কার কথা মনে করে বাকি জীবনটা নিয়ে বেঁচে থাকা যায় ?


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।